post

অগ্নিগর্ভ সিরিয়ার শান্তি কোন পথে

হারুন ইবনে শাহাদাত

০৩ এপ্রিল ২০১৮
গণতন্ত্রহীনতা একটি সমৃদ্ধ দেশ ও জাতিকে কিভাবে ধ্বংস করে দেয় তার জ্বলন্ত উদাহরণ সিরিয়া। দেশটিতে সংসদ আছে, আছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী। রাজনৈতিক দলও আছে। বাশার আল আসাদ সরকারের দাবি ‘নির্বাচনও আছে’। তারপরও কেন জ্বলছে সিরিয়া? নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পরও কেন বাশার আল আসাদকে স্বৈরাচার বলা হয়? এই সব প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সিরিয়া সঙ্কটের মূল কারণ। ২০০০ সালে বাশার আল আসাদের বাবা হাফেজ আল আসাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার তিন দশকের শাসন অবসানের পর পুত্র বাশার আল আসাদের শাসন শুরু হয়। ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক বা ইউএআর’র পতনকালে অনুষ্ঠিত অভ্যুত্থানের পর ১৯৬৬ বাথ পার্টির নেতৃত্বে সিরিয়াতে আরেকটি পাল্টা অভ্যুত্থান হয়। ইউনাইডেট আরব রিপাবলিক বা ইউএআর? ইউএআর হলো মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের গঠিত মিসর, সিরিয়াসহ কয়েকটি আবর দেশ নিয়ে সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র প্রজাতন্ত্র। তিনি ছিলেন এ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত ইউএআর টিকে ছিল। সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র প্রজাতন্ত্রের পতনের পর বাথ পার্টি সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করে। ১৯৬৬ সালে পার্টির ভেতর আরেকটি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাথ পার্টির হাফেজ আল আসাদের পক্ষ ক্ষমতা দখল করে। বাশার আল আসাদের বাবা তৎকালীন বিমান বাহিনী প্রধান হাফেজ আল-আসাদ নবগঠিত বাথ সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান অর্জনের ফলে হাফেজ আল আসাদ সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের একজন হয়ে ওঠেন। সশস্ত্রবাহিনী ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হওয়ায় ১৯৭০ সালে সিরিয়ার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আল-আতাসি হাউেৎ প্রতিরক্ষামন্ত্রী হাফেজ আল আসাদ ও যুদ্ধে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা মুস্তাফা ত’লাসকে ডেকে সকল সরকারি ও সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দানের নির্দেশ দেন। সরে দাঁড়াবার নির্দেশ পাবার পরপর হাফেজ আল-আসাদ ও মুস্তাফা ত’লাস বাথ পার্টির অভ্যন্তরে একটি অভ্যুত্থান ঘটান। তিনি রাষ্ট্রপতি আল-আতাসি, বাথ মহাসচিব সালাহ জাদিদকে তাদের প্রভাবশালী সমর্থকদেরসহ কারাগারে পাঠান। হাফেজ আল আসাদ সমর্থকরা জনগণের মধ্যে প্রচারণা চালান রাষ্ট্রপতির সহযোগিতা না করায় তারা ইসরাইল বিরোধী যুদ্ধে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তার এই অবৈধ ক্ষমতা দখলকে সাধারণ সিরীয়রা স্বাগত জানিয়েছিল যা সিরিয়ার সংশোধনী বিপ্লব (কারেক্টিভ রেভুলিউশন) হিসেবে পরিচিত। বাশার আল আসাদ যুগের শুরু বাশার আল-আসাদ সিরীয় আরব প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি, বাথ পার্টির আঞ্চলিক সচিব এবং সাবেক সিরীয় রাষ্ট্রপতি হাফেজ আল-আসাদের পুত্র ও রাজনৈতিক উত্তরসূরি। বাশার আল-আসাদের নেতৃত্বাধীন বাথ পার্টি বর্তমানে সাংবিধানিকভাবে সিরিয়ার সরকারি দল। ২০০০ সালে রাষ্ট্রপতিত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত বাশার সিরিয়ার রাজনীতিতে তেমনভাবে জড়িত হননি। রাজনৈতিক কার্যক্রম বলতে তিনি এর আগে সিরিয়ার কম্পিউটার সমিতির প্রধান ছিলেন। উল্লেখ্য এই কম্পিউটার সমিতির অবদানেই ২০০১ সালে সিরিয়ায় ইন্টারনেটের বিস্তার ঘটে। তার বাবার ৩০ বছরের স্বৈরশাসনের অবসানের পর ইতিবাচক ইমেজ নিয়ে বাশার আল-আসাদ ২০০১ সালে একটি গণভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার পরবর্তী আচরণ বিশ্লেষণ করে এই গণভোট কতটা নিরপেক্ষ হয়েছিল তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মনে যথেষ্ট সন্দেহ দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা আশা করেছিলেন যে বাশার দায়িত্ব নেয়ার পর সিরীয় প্রশাসন হাফেজ আল-আসাদের রক্ষণশীল নীতি থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসবে। দায়িত্ব নেয়ার পর বাশার আল-আসাদ এক সাক্ষাৎকারে অন্যান্য স্বৈরশাসকদের মতোই বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্রই হতে পারে সিরিয়ার দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণের চাবিকাঠি। গণতন্ত্রের ইতিবাচক প্রভাব একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং তাড়াহুড়ো করে এর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।’ (সূত্র : আল জাজিরা.নেট) রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাশার খুব সতর্কতার সাথে একটি সংস্কার প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন শুরু করেন যা সিরিয়ার তথাকথিত ডেমাস্কাস স্প্রিং বিতর্কের মধ্য দিয়ে চালিত হয়েছিল। বাশারের পিতা ও রাজনৈতিক পূর্বসূরি হাফেজ আল-আসাদ প্রায় ৩০ বছর যাবৎ সিরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন এবং ২০০০ সালে তার জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে হাফেজ যুগের অবসান ঘটে। এক্ষেত্রে হাফেজ আল-আসাদের তুলনামূলক রক্ষণশীল রাজনৈতিক নীতিমালা থেকে বেরিয়ে এসে নব্য রাষ্ট্রপ্রধান কী কী উপায়ে সিরিয়ার প্রশাসনকে আরও উদারপন্থী করে ক্রমশ গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, এই বিষয়ে ২০০০ সাল থেকে প্রায় এক বছর যাবৎ একটি রাজনৈতিক বিতর্ক চলছিল যা ডেমাস্কাস স্প্রিং নামে খ্যাতি লাভ করে। উল্লেখ্য যে ডেমাস্কাস স্প্রিং বাশারের পিতার রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতির সমালোচনা করলেও তিনি এই বিতর্ক হতে উত্থাপিত বেশ কিছু প্রস্তাবনা গ্রহণ করেছিলেন ও বাস্তবায়িত করেছেন। যেমন মেজে নামক একটি কারাগার যেখানে রাজনৈতিক বন্দীদের আটক রাখা হতো, বাশার এই কারাগারের সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা করেন ও কারাগারটি বন্ধ ঘোষণা করেন। বাশার তার পিতার তুলনায় কিছুটা উদারপন্থী রাষ্ট্রনায়ক হলেও তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতার তেমন উন্নয়ন সাধন করেননি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি একনিষ্ঠভাবে পিতার নীতিমালা অবলম্বন করলেও সেগুলোর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমালোচনা এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে চতুর স্বৈরশাসকদের মতোই গুরুত্ব দিয়েছেন ও লক্ষ্য রেখেছেন যে তার কার্যক্রম যেন কোন অসন্তোষের কারণ না হয়। মার্কিন এবিসি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাশার বলেন, “আমাদের কারাগারে কোন ব্যক্তিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় আটক রাখা হয়নি।” সঙ্কটের শুরু যেভাবে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে যখন আরব বসন্তের আগমনে সারা আরব জাহান টালমাটাল, সিরিয়া তখন মোটামুটি শান্ত। অনেক গবেষক মনে করেছিলেন, সিরিয়াতে আরব বসন্তের প্রভাব পড়বে না, কারণ সিরিয়ার শাসন ব্যবস্থায় গত ৪০ বছর ধরে শক্ত কন্ট্রোল বজায় রেখেছে বাশার আল আল আসাদ এর নেতৃত্বে বাথ পার্টি। ছোট একটা বিষয়কে বেশি কঠোর হাতে দমন করতে গিয়েই আজকে সিরিয়া অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। ২০১১ সালের মার্চের মাঝামাঝি সময়। ১০-১২ জন ছেলে দেয়ালে সরকারবিরোধী ওয়াল রাইটিং (চিকা মারার) করার সময় ঘটনার পর সরকারি বাহিনী তাদের গ্রেফতার করে টর্চার করে। তার প্রতিবাদে যে বিক্ষোভ হয় সেই বিক্ষোভে সরকারি বাহিনী ব্যাপকভাবে গুলিবর্ষণ করে। হতাহত হয় অনেক। কয়েকজন বিক্ষোভকারী মারা যায়। সেই সূত্র ধরেই বিক্ষোভ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পরে। বিক্ষোভ দমন করতে বাশার আল আসাদের সরকারি বাহিনী ব্যাপক আগ্রাসী ভূমিকা নেয়। ফলে বিক্ষোভ আরও ছড়িয়ে পড়ে এবং এপ্রিল মাসে আসাদ সারা দেশের শহরগুলোতে আর্মি এবং তার অনুগত সিক্রেট সার্ভিসকে মাঠে নামায়। যারা ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি এবং হেলিকপ্টার গান-শিপ সহকারে দেশব্যাপী অপারেশন চালায়। মাত্র তিন মাসে ২০১১ সালের জুলাই নাগাদ প্রায় ১৬০০০ বিক্ষোভকারী নিহত হয় আসাদ বাহিনীর হাতে। এরপর ঘটনাপ্রবাহ এত জটিল হয়েছে যে তার সঠিক হিসেব রাখা মুশকিল। আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ, শহর দখল, দখল থেকে মুক্ত হওয়াসহ অনেক ঘটনার পালাক্রমে সাত বছরে প্রায় পাঁচ লক্ষ গেরিলা, নিরীহ জনগণ, সরকারি সেনা এবং সরকারি সমর্থক নিহত হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা প্রথমে অগোছালো থাকলেও ধীরে ধীরে তারা আন্তর্জাতিক সাহায্য পেয়ে সংগঠিত হয় এবং সরকারি সেনাদের বিরুদ্ধে নিজেদের সংগঠিত করে। বিরোধীদের মধ্যে প্রায় ১২০ গ্রুপ এবং উপগ্রুপ তাদের নিজেদের মধ্যে অনেক দ্বন্দ্ব থাকলেও আপাতত তারা একত্রিত হয়ে একটি অর্গানাইজড ফোর্স গঠন করেছে যার নাম দেয়া হয়েছে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। ফ্রি সিরিয়ান আর্মিতে সিরিয়ান সরকার এর অনেক সৈন্য পক্ষ ত্যাগ করে যোগদান করে। গণভোট নাটক এবং হিলারি ক্লিনটনের আশঙ্কা সরকারবিরোধীরা চলমান সহিংসতা এবং আসাদের জুলুম নির্যাতন থেকে জনগণকে বাঁচাতে সংবিধান সংশোধনের পর একটি নিরপেক্ষ গণভোট আয়োজনের আহবান জানিয়ে আসছিল। কিন্তু আসাদ তাদের দাবিকে অগ্রাহ্য করে ২০১২ সালে একটি গণভোট নাটকের আয়োজন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এই গণভোট নাটক দেখে বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘দেশটিতে পুরোপুরি গৃহযুদ্ধ বেধে যাওয়ার শঙ্কায় আমি উদ্বিগ্ন। বাইরে থেকে কোন হস্তক্ষেপ হলেও তা ঠেকানো যাবে না বরং তা আরো ছড়িয়ে পড়বে।’ সেই গণভোট নিয়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২ বিবিসিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল: ‘সিরিয়ায় চলমান বিক্ষোভ, সহিংসতা আর বিরোধী দলগুলোর বয়কটের মধ্যেই সরকার আজ তাদের প্রস্তাবিত নতুন এক সংবিধানের ওপর গণভোট করছে। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ভোটদানের খবর ও ছবি দেখানো হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন শহর থেকে বিক্ষোভ ও গোলাগুলির খবরও পাওয়া যাচ্ছে। বিবিসির সংবাদদাতারা বলছেন যে ভোটগ্রহণ কেমন হচ্ছে তা নিয়ে নানা রকম খবর পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু সেগুলোর নির্ভুলতা যাচাই করা কঠিন। বৈরুত থেকে বিবিসির সংবাদদাতা জিম মিউয়ার বলছেন, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে লোকজন ভোট দিচ্ছে এমন এমন চিত্র দেখানো হচ্ছে কিন্তু এরই পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় গোলাগুলি চলছে বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে। দক্ষিণের দারা শহর, ইরাকের সীমান্তবর্তী দেরিজর, উত্তরের তুরস্ক সীমান্তবর্তী ইদলিব এবং মধ্যাঞ্চলের হমস আর হামা শহর থেকে সহিংসতার খবর পাচ্ছি। সেখানে এর মধ্যে কী করে ভোট হতে পারে আমার পক্ষে কল্পনা করা কঠিন। তবে দামেস্ক এবং আলেপ্পার মতো দু’টি বড় শহরে- যেখানে অপেক্ষাকৃত কম গোলযোগ হয়েছে- সেখানে ভোট হচ্ছে। টিভি চিত্র থেকে অবশ্য এটা বোঝা কঠিন যে কি পরিমাণ লোক এতে অংশ নিচ্ছে। সারা সিরিয়াজুড়ে সরকারি হিসাব মতে ১৩ হাজার ভোটকেন্দ্র খোলা হয়েছে যাতে প্রায় এক কোটি ৪৬ লাখ ভোটার ভোট দিতে পারবেন। যে নতুন সংবিধানের ওপর এই গণভোটে মানুষের মতামত চাওয়া হচ্ছে তা দেশটিতে এক বছর আগে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদই প্রস্তাব করেছিলেন। এতে আগামী তিন মাসের মধ্যে বহুদলীয় পার্লামেন্টারি নির্বাচনের কথা রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো যে দেশে গণবিক্ষোভে গত এক বছরে ৭০০০ এরও বেশি লোক নিহত হয়েছে সেখানে এই নির্বাচন কতটা বিশ্বাসযোগ্য বলে বিবেচিত হবে? বিরোধী গ্রুপগুলো ইতোমধ্যেই এই নির্বাচনকে একটা প্রহসন বলে আখ্যায়িত করে একে প্রত্যাখ্যান করেছে, এবং তা বয়কটের ডাক দিয়েছে। তারা বলছেন এই সংবিধান একটা জালিয়াতি। এখন ঘর থেকে বের হওয়াটাই নিরাপদ নয়, ভোট দিতে যাওয়া তো দূরের কথা। সিরিয়ার একজন বিরোধীদলীয় কর্মী রানিয়া কিসার বলছেন, এখন ঘর থেকে বের হওয়াটাই নিরাপদ নয়, ভোট দিতে যাওয়া তো দূরের কথা। এটা একটা লজ্জার ব্যাপার যে সিরিয়ার জনগণকে নির্বোধ বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। আমরা এই অবৈধ রাষ্ট্রের তৈরি একটি অবৈধ সংবিধানের ওপর ভোট দিতে চাই না। বিরোধীরা আরো বলছেন, বাশার আসাদ সরকার নতুন সংবিধান তো দূরের কথা- পুরনো সংবিধানকেও কখনো সম্মান করেনি। যাতে বাকস্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা ছিল, যাতে নির্যাতনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কাজেই নতুন সংবিধান বা এর ওপর গণভোটের কথাকে তারা আদৌ আমল দিচ্ছেন না। পুরোপুরি গৃহযুদ্ধের শঙ্কায় আমি উদ্বিগ্ন, বাইরে থেকে কোন হস্তক্ষেপ হলেও তা ঠেকানো যাবে না বরং তা আরো ছড়িয়ে পড়বে। কারণ একদিকে যখন গণভোটের খবর সরকারি সংবাদমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি সহিংসতায় নতুন মৃত্যুর খবরও আসছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীরা বলছেন, রোববারেই অন্তত ১৩ জন লোক নিহত হয়েছে। যার মধ্যে এগারোজনই নিহত হয়েছেন হমস শহরে। শনিবার সারা দেশজুড়ে নিহত হয়েছে ৮০ জনেরও বেশি। যদিও এসব সংখ্যা যাচাই করার কোনো উপায় নেই। বিবিসির সংবাদদাতারা বলেছেন, এই গণভোটকে সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করছে, তা যদি এক বছর আগে হতো তাহলে হয়তো ব্যাপারটা অন্যরকম হতো। কিন্তু এখন একটি পুরোমাত্রার গৃহযুদ্ধের এই আশঙ্কার মধ্যে এই যে গণভোট, তা কি সিরিয়ার ভবিষ্যৎ ঘটনাপ্রবাহের ওপর কোন ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে কিনা সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যার উত্তর অনেকেরই অজানা।’ ৭ বছরের ব্যবধানে তার অনেক কিছুই আর জানা নেই। বরং সমস্যার সূচনাকালে পর্যবেক্ষকরা যা আশঙ্কা করেছিলেন সময়ের ব্যবধান তাই সত্যে পরিণত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষের রক্ত ঝরছে একজন স্বৈরশাসকের ক্ষমতার সাধ পূরণ করতে। এখন লাখ লাখ শিশুর রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে সিরিয়ার মাটি। ধ্বংস হচ্ছে একটি সমৃদ্ধ দেশ। সিরিয়ায় কে লড়ছে কার বিরুদ্ধে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধকে কেন্দ্র করে গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে তার ভয়াবহতা এতটাই ব্যাপক যে তা কল্পনারও বাইরে। মুসলিম বিশ্বের এক সময়ের সমৃদ্ধ এই দেশটি একজন স্বৈরাচারী শাসকের কারণে পৃথিবীর নরকে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে মুসলমানরা নিজেরাই নিজেদের নিঃশেষ করছে। কে কার বিরুদ্ধে লড়ছে নিউ ইয়র্ক টাইমস ও জার্মান বার্তা সংস্থা ডয়চে ভেলে অবলম্বনে তা তুলে ধরা হলো: ‘সিরিয়ার আসাদের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া অভ্যুত্থান থেকে যে সংঘর্ষ শুরু, তা এখন বহুধা বিভক্ত। পরস্পরের স্বার্থবিরোধী বহু পক্ষের উপস্থিতির কারণে সহজে এ সংঘর্ষের কোন শান্তিপূর্ণ ইতি টানার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, তুরস্ক, ইরান ও ইসরাইলের মতো বিদেশি শক্তিগুলো যুদ্ধরত ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। তাদের দেয়া অস্ত্রের সরবরাহের কারণে যুদ্ধ আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। আসাদকে উৎখাতে যুদ্ধ করা গোষ্ঠীগুলোকে গত বছরের জুন থেকে সামরিক সহায়তা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু কুর্দি ও আরবদের নিয়ে গঠিত ‘সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এসডিএফ)- কে ’ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে তারা। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে এসডিএফর সঙ্গে উপস্থিত আছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষায়িত বাহিনীর (স্পেশাল ফোর্স) বিপুল পরিমাণ সদস্য। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সাল থেকে ৬০টি দেশের জোটকে নেতৃত্ব দিচ্ছে আইএসবিরোধী যুদ্ধে। এতদিন আসাদের বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু না করলেও সম্প্রতি ব্যত্যয় ঘটেছে। সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে আসাদ বাহিনীর একটি বিমানঘাঁটি আক্রমণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেছিলেন, আইএস ধ্বংস করা ছাড়া আর বিশেষ কিছু করার নেই ইরাক ও সিরিয়ায়। কিন্তু গত বছরের জুলাইতেই সিরিয়ার সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতির চুক্তি করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ঠিক কী চায় সিরিয়া সংকট সমাধানের জন্য সে বিষয়ও পরিষ্কার নয়। আসাদকে ক্ষমতায় রেখে কোন সমাধান প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র মানবে কি না তা বোঝা যাচ্ছে না। অন্যদিকে রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে সমর্থন করছে আসাদ সরকারকে। নিজের সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে অস্ত্র পর্যন্ত সবই রাশিয়া দিয়েছে আসাদের সমর্থনে। এমন কী জাতিসংঘে কূটনৈতিক সমর্থনও নিশ্চিত করেছে সিরিয়ার জন্য। ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে রাশিয়া দেশটিতে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। সাবেক সমাজতান্ত্রিক একনায়ক শাসিত রাশিয়া সিরিয়ার গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিকে ‘সন্ত্রাসীদের’ আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালাচ্ছে। তাদের ভাষায় এইসব সন্ত্রাসীরা আইএসের সদস্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বারবার অভিযোগ করেছে, রাশিয়া আইএস দমনের অজুহাতে তাদের সমর্থিত আসাদ বিরোধী সাধারণ মানুষের ওপর বিমান হামলা করছে। অন্য দিকে রাশিয়াও অভিযোগ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে এমনভাবে ব্যবহার করছে যেন রাশিয়া ও সিরীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। রাশিয়ার ইচ্ছা আসাদকে ক্ষমতায় রাখা। কারণ আসাদ মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। সিরিয়ায় রাশিয়ার একটি বিমানঘাঁটি ও একটি নৌঘাঁটি রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে নিজের সামরিক শক্তি অটুট রাখতে রাখতে রাশিয়া তাই আসাদকেই চায়। শান্তি আলোচনায় রাশিয়া হয়তো সিরিয়ার অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর জন্য সীমিত মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন অনুমোদন করতে পারে, তবে সেটা আসাদকে ক্ষমতায় রেখেই হতে হবে। রাশিয়ার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানও সমর্থন করে আসাদকে। ২০১২ সাল থেকে তেহরান আসাদ সরকারকে বিশাল পরিমাণে সামরিক সাহায্য ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে আসছে। ইরান সিরিয়াতে তার সেনাবাহিনীর পাশাপাশি শিয়া মিলিশিয়াদেরও মোতায়েন করেছে। তা ছাড়া ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহও আসাদ সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক। ইরান আসাদবিরোধীদের পাশাপাশি আইএসের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করছে। ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে সিরিয়া সবসময় ইরানের পাশে থেকেছে। তা ছাড়া লেবাননে হিজবুল্লাহকে অস্ত্র পাঠাতে সিরিয়া দিয়ে যেতে হয় ইরানকে। তাই আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে চায় ইরান। লেবাননের হিজবুল্লাহও ইরানের মতো ইসরাইলবিরোধী। সিরিয়ার প্রতি ইরান ও হিজবুল্লাহর সমর্থনই ইসরাইলকে এই সংঘাতে সিরিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে তারা বিমান থেকে সিরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আক্রমণ করছে। সিরিয়া যুদ্ধের শুরু থেকেই তুরস্ক আসাদবিরোধীদের সমর্থন করছে। কুর্দি ব্যতীত অন্যান্য সরকারবিরোধী শক্তি যেমন ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মির’ সঙ্গে তারা আসাদবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ জোটের অংশ তুরস্ক আইএসের অবস্থানের ওপর যেমন হামলা করেছে তেমনি একতরফাভাবে কুর্দিদের অবস্থানের ওপরও হামলা করেছে। অপারেশন ‘ইউফ্রেটাস শিল্ডের’ নামে চলা অভিযানে তারা পদাতিক সেনাও পাঠিয়েছিল সিরিয়ায়। রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে ‘সংঘাতমুক্ত এলাকার’ চুক্তি করায় তুরস্ক ও তাদের সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো ওই এলাকা ছেড়ে ইদলিব প্রদেশে ঘাঁটি গেড়েছে। সিরিয়া যুদ্ধে তুরস্কের মূল লক্ষ্য কুর্দিদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা। তুরস্ক চায় না কুর্দিরা নতুন এলাকার নিয়ন্ত্রণ পাক। তা ছাড়া যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তারা যেন কোন রকম স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ না পায় সেদিকেও নজর রয়েছে তুরস্কের। তাদের দাবি, সিরিয়ার কুর্দিরা পিকেকের কুর্দিদের সঙ্গে যুক্ত। পিকেকে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে স্বাধীনতার জন্য তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করছে। দেশটিতে পিকেকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা যুক্তি থাকে। অভ্যুত্থান থেকে শুরু হয়ে যে সংগ্রাম যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল তা আপাতত শেষ পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। আসাদবিরোধীদের কোন একক নেতা নেই। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিদেশি যেসব শক্তি তাদের সহায়তা দিচ্ছিল, তারাও তা বন্ধ করে দিচ্ছে। তাদের অবস্থানও সীমিত হয়ে পড়েছে কিছু নির্দিষ্ট স্থানে। আসাদ সরকারের বিদেশি সাহায্যকারীরা সহায়তা সরবরাহ বাড়িয়ে দিলেও, আসাদের পক্ষে যুদ্ধ করার মতো লোকবলের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তা রক্ষা করার মতো লোকবল নেই আসাদ সরকারের। যেসব আধাসামরিক বাহিনীর লোকেরা তার পক্ষে বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করছে, তারা যুদ্ধ করতে পারলেও, শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার মতো প্রশাসনিক সক্ষমতা নেই। এমন অনেক স্থান আছে যেখানে আসাদের নিয়ন্ত্রণ নিছক কাগুজে বিষয়। সেসব এলাকায় আসাদের চেয়ে বেশি প্রভাবশালী রাশিয়া ও ইরানের মতো বিদেশি শক্তিগুলো। আইএস জঙ্গিরা তাদের দখল করা প্রায় পুরো এলাকারই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে যেখানে তারা তথাকথিত খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় কুর্দি যোদ্ধারা আইএসের রাজধানী হিসেবে পরিচিত রাকা থেকে তাদের বিতাড়িত করেছে। আইএসের অবশিষ্ট যোদ্ধাদের কোণঠাসা করে সিরিয়ার পূর্ব সীমান্তের ছোট এলাকায় সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। যদিও এর ভেতরেও আইএসের যোদ্ধারা মরুভূমিতে তাদের গোপন আশ্রয়স্থল থেকে বের হয়ে এসে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর আচমকা হামলা চালাচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবার আইএসের যোদ্ধারা যুদ্ধের বদলে নাশকতা করা শুরু করবে। কারণ তাদের আর যুদ্ধ করার মতো সক্ষমতা নেই। কুর্দিরা আইএসকে বিতাড়িত করলেও, বেশির ভাগ আরব অঞ্চলের শাসনক্ষমতা তাদের হাতে যাবে না। এতে এই অঞ্চলগুলোতে নেতৃত্বের সংকট দেখা দেবে যা ভবিষ্যতে নতুন সংঘাতের উপলক্ষ হয়ে উঠবে। কারণ সিরিয়া যুদ্ধের ভেতরেই কুর্দিরা তুরস্ক সীমান্তে একটি নতুন ‘দেশ’ প্রতিষ্ঠা করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় কুর্দি অধ্যুষিত ছিটমহল আফরিনে আক্রমণ করেছে তুরস্ক। তুর্কিদের দাবি, তারা সন্ত্রাসীদের মূলোৎপাটন করতে আফরিন আক্রমণ করেছে। উত্তর সিরিয়ার এলাকাগুলোতে কুর্দি নিয়ন্ত্রণ থাকায় সমাধানের আশা খুব কম। কারণ আসাদ দীর্ঘমেয়াদে কুর্দিদের প্রভাব বরদাশত করবেন না। অন্যদিকে তুরস্ককে যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করছে আইএস দমনের জন্য। কিন্তু তুরস্ক ভাবছে সেই সমর্থনকে ব্যবহার করে এবার তারা কুর্দিদের পর্যদুস্ত করবে। সমস্যা হচ্ছে, কুদির্রাও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত। ফলে এখন যারা মিত্র ভবিষ্যতে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারে।’ লাখ লাখ শরণার্থীর বিভিন্ন দেশে আশ্রয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চাইতেও বেশি সময় ধরে চলছে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। দীর্ঘ সময়ের কারণে মানুষ সিরিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের হিসাবে, জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) সিরিয়ায় ৫.৫ মিলিয়নেরও বেশি শরণার্থীকে নিবন্ধিত করেছে। আনুমানিক ৬.৫ মিলিয়ন অভ্যন্তরীণভাবে শরণার্থী হয়েছে। লেবানন, জার্মানি, ইরান এবং তুরস্ক সিরিয়ান শরনার্থীদের আশ্রয় দেয়। তাদের অনেকে ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে আরো ভালো সুবিধা পাওয়ার জন্য। ২০১৭ সালে ৬৬ হাজার শরণার্থী সিরিয়াতে ফিরে আসে। সর্বশেষ গৌতায় যা ঘটছে যা সহ্য করা কোন মানবিকবোধ সম্পন্ন মানুষের জন্য সম্ভব নয়। তারপরও গোটা বিশ্ব দেখছে সেই ধ্বংস আর মরণ খেলা। দেশটিতে যে সংঘর্ষময় পরিস্থিতি এখন চলছে তার কারণ কেবল রাজনৈতিক নয় বরং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সঙ্গে এর একটি সম্পর্ক আছে। এ বিষয়ে করা সর্বশেষ এক গবেষণা থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। খবর টেলিগ্রাফ অনলাইনের। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি সিরিয়ার সংঘাতকে আরও তীব্রতর করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি এবং সান্টা বারবারার অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকরা বলেছেন সিরিয়র বর্তমান সংঘাতের সঙ্গে মানব সৃষ্ট কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে। তারা দেখিয়েছেন দেশটি গত কয়েক দশকে দফায় দফায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত খরার কবলে পড়েছে। এর ফলে কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল ১৫ লাখ মানুষ পল্লী এলাকা ছেড়ে শহর এলাকায় চলে এসেছে। শহরাঞ্চলের ওপর এই বাড়তি চাপ সংঘর্ষমুখর পরিস্থিতি তৈরি করতে ইন্ধন জুগিয়েছে। সিরিয়ায় ২০০৭ সালে খরা শুরু হয়েছিল, এটি ১০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। সম্ভবত এর চেয়েও বেশি সময় এটি অব্যাহত ছিল। ২০১১ সালে শাসক বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন শুরুর পর আবহাওয়ার উপাত্ত সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। কলাম্বিয়ার জলবায়ু বিজ্ঞানী রিচার্ড সিগার বলছেন, সিরিয়ায় সঙ্কট তৈরির নেপথ্যে অনেক কারণ রয়েছে তবে দেশের ভেতরেই ১৫ লাখ মানুষের অভিবাসী হওয়ার বিষয়টি একটি বড় ঘটনা। প্রসেডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমিতে যে রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছে তার অন্যতম লেখক সিগার। তিনি বলছেন, কেবল রাজনৈতিক নয় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত খরাসহ সবকিছু মিলিয়েই সিরিয়ায় পরিস্থিতি এমন সংঘাতমুখর হয়ে উঠেছে। রিপোর্টটির প্রধান লেখক ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার কলিন কেলি বলছেন, সিরিয়া যুদ্ধের বিষয়টি ব্যাখ্যা করা সহজ নয়। আসাদের নিপীড়নমূলক শাসন একটি কারণ মাত্র। তবে এর সঙ্গে অভ্যন্তরীণভাবে ১৫ লাখ মানুষ অভিবাসী হওয়া, ইরাক যুদ্ধের ফলে সেদেশে ১০ লাখের বেশি শরণার্থীর অনুপ্রবেশ, খরা, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আরব বসন্তের হাওয়া সব মিলিয়ে এই সঙ্কট তৈরি হয়েছে। কেলি বলছেন, এর মধ্যে কোন একটি কারণকে এককভাবে সবচেয়ে বড় কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা খুব কঠিন। তবে এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিষয়টিকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন, সিগার। কেলি ও সিগার দু’জনই তাদের গবেষণায় পরিসংখ্যান এবং কম্পিউটার সিমুলেশন ব্যবহার করেছেন। শেষ হবে কবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ সপ্তম বছরে পড়েছে। ইতোমধ্যেই পাঁচ লাখ লোক নিহত হয়েছে, আরো অন্তত পাঁচ লাখ আহত হয়েছে, দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে দেশটির যুদ্ধপূর্ব প্রায় অর্ধেক। অন্তহীন যুদ্ধে যখন সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছিল, তখনই একটা সমাধান হাতের কাছে বলে মনে হচ্ছিল। রাশিয়া, চীনসহ কয়েকটি দেশের এগিয়ে আশায় এই আশার সৃষ্টি হয়েছিল; কিন্তু তখনই আবার তীব্র হয়ে ওঠে সিরিয়া যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, তুরস্ক, ইরান এখন আসাদ সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তবে নতুন মাত্রা হলো প্রকাশ্যে ইসরাইলের আগমন। আসাদ বাহিনীর বিপক্ষেই তাকে দেখা গেছে। বিমান হামলা পর্যন্ত করেছে। সিরিয়া আবার ইসরাইলি সামরিক ড্রোন ভূপাতিত করার কথা প্রথমে অস্বীকার করলেও এখন স্বীকার করে নিচ্ছে। একের পর এক সিরিয়ান শহর নগর গ্রাম জনপথ ধ্বংস হচ্ছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, সিরিয়ার আসাদ সরকারের পক্ষে মুসলমানদের সমর্থন বাড়িয়ে এবং এই স্বৈরশাসকে টিকিয়ে রাখতেই ইসরাইল এই অপকৌশল গ্রহণ করেছে। তাদের উদ্দেশ্য বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করা। সমাধান কোন পথে সমস্যার সমাধান নেই এমন কথা শুধু তারাই বলতে পারেন যারা সমস্যা জিইয়ে রেখে ফায়দা লুটে। সিরিয়াকে নিয়ে বিশ্বনেতাদের ফায়দা লুটার খেলাটাই চলছে। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, সিরিয়ার সমস্যার সমাধানে সবার আগে স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদকে পদত্যাগ করতে হবে। তারপর জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বিবদমান গ্রুপগুলোকে অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য করতে প্রত্যেক গ্রুপের নেতাদের নিয়ে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে গণভোটের আয়োজন করতে হবে। সেই গণভোটে সিরিয়ার জনগণ যাকে নির্বাচিত করবে তার হাতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা করতে হবে। সাথে সাথে কমপক্ষে ৫ বছর শান্তিসংঘের শান্তিরক্ষীদের সিরিয়ায় রাখতে হবে শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির