post

আওয়ামী লীগের যুদ্ধাপরাধ বিচার দাবির অন্তরালে

০১ অক্টোবর ২০১২
মুহাম্মদ আবদুল জববার

বাংলাদেশ। আজ থেকে ৪১ বছর আগে যার জন্ম। স্বাধীন মুসলিম আবাস খণ্ডের দাবিতে ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বৃহত্তর ভারতে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র জন্ম লাভ করে।  বৈষম্যের চরম বঞ্চনার শিকার হয়ে পাকিস্তানের ভেতর জন্ম নেয়, পূর্ব পাকিস্তান নামক আজকের বাংলাদেশ। প্রত্যাশা স্বাধীন থাকা, মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা। কিন্তু কই? এখানে সরকার আসে সরকার যায়। সকল সরকারই এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার মসনদে আসে। এখানে মুয়াজ্জিনের আজানে মানুষের ঘুম ভাঙে, মাগরিবের আজানে মেহনতি মানুষ ঘরে ফিরে। এখানে মানুষে মানুষে, ধর্মে ধর্মে নেই ভেদাভেদ কলহ আর বিসম্বাদ। নেই কোন দাঙ্গা-হাঙ্গামা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এখানকার হতদরিদ্র মানুষগুলোর ভাগ্যের পারবর্তন করতে ব্যর্থ হয়েছে সকল শাসকগোষ্ঠী। অথচ ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের অত্যাচার আর নিপীড়নের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে একটি স্বাধীন দেশের প্রত্যাশা। কিন্তু যে কপাল সে মাথা। এখানে কিছু লোক আঙুল ফুলে হয়েছে কলাগাছ, আর কিছু লোক হয়েছে সর্বস্বান্ত আর নিপীড়িত। এরপরও থেমে নেই জীবনের গতি। আমরা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছি। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে দহরম মহরম যেকোনো সময়ের চাইতে বেড়ে যায়। একের পর এক দাসখত চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে  দেশকে তলাবিহীন রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। মহাজোট নেত্রী ক্ষমতায় আসার প্রাক্কালে বাংলাদেশের হতদরিদ্র মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। দশ টাকার চাল আর ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্র“তি ব্যক্ত করেছিলেন। প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়ন তো দূরের কথা চালের দামসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ বেশি, চাকরি দেয়ার পরিবর্তে চাকরিচ্যুত করেছেন হাজার হাজার কর্মচঞ্চল নাগরিককে। চাকরি দেয়ার জন্য অথবা চাকরিতে টিকে থাকার সরকারি দলের টিকিটিই বড় পরিচয়। বিরোধী দলের লাখ লাখ নেতা-কর্মী আর সমর্থকদের মামলা-হামলা, কারা নির্যাতনে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এখানে আইন আদালতের কোনো তোয়াক্কা নেই। অপজিশন দলের লোক এটিই বড় অপরাধ! সরকার গঠনের পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সরব জিগির করেই যাচ্ছেন। এর অন্তরালে এক ভয়াবহ নীলনকশা(!) বিদ্যমান। ক্ষমতার প্রথমার্ধ থেকেই দাদা বাবুদের তিনটি প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়নে আদাজল খেয়ে আওয়ামী লীগ নেমেছিল, যা সে সময় পত্রপত্রিকাতে এসেছিল। প্রথমত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা। দ্বিতীয়ত, ইভিএম পদ্ধতি চালু করা এবং তৃতীয়ত, জামায়াত-শিবিরসহ বিরোধী দলকে দমন করা। সরকারের কাছে দাদাদের নসিহত ছিল বিগত দিনে ফখরুদ্দীন আর মইনুদ্দিনের আমলে ডিজিটাল কায়দায় ভোট পাওয়া গেলেও এবার বিরোধী দল অনেক সচেতন, তাই ভোটকার্যক্রম পুরোদমে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে আসতে হবে। তাই যে কোনো মূল্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা জরুরি। কারণ গত নির্বাচনে এমন ডিজিটাল নির্বাচন হয়েছে যে, অনেক নির্বাচন সেন্টারে ১০০% এর বেশি ভোট পড়েছে। এমনকি রাস্তাঘাটে, নালা-নর্দমায় পর্যন্ত ব্যালট বাক্স পাওয়া গিয়েছিল। অবশ্য এ বিষয়টি সে সময় মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনার ঝড় তুলেছিল। আগের ন্যায় যেহেতু ডিজিটাল কায়দায় সফল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই সেহেতু নয়া কৌশল খুঁজে বের করতে হবে। আওয়ামী লীগ আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে দ্বিধাবিভক্ত রায়কে পুঁজি করে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করতে সক্ষম হয়। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া বিএনপিসহ ১৮ দল জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি না,  বোঝা মুশকিল। সরকারের কাছেও জানা আছে বিএনপিসহ বড় দলগুলো ছাড়া নির্বাচনে গেলে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে এ কথা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগ যদিও নিজেদেরকে সাধু দাবি করে সুষ্ঠু নির্বাচন সংঘঠন হওয়ার দাবি করলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী লীগ ভোটকেন্দ্র থেকে ভোটের বাক্স ছিনতাই ও ব্যালট পুড়িয়ে দেয়ার অসংখ্য দলিল দস্তাবেজ জাতির কাছে সংরক্ষিত আছে। ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ করার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা নিয়ে শোরগোল শুরু করলেও সরকার হালে জোর আনতে পারেনি। কারণ ইতোমধ্যে বিরোধী দল আইটি এক্সপার্ট দিয়ে প্রমাণ করেছেন ইভিএম পদ্ধতি দিয়ে ভোট জালিয়াতি করা যায়। প্রযুক্তির এ যুগেও কারচুপির বাস্তব প্রমাণ ও আশঙ্কা থেকে অনেক দেশে ইতোমধ্যে ইভিএম পদ্ধতি তুলে নেয়া হয়েছে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন আগামী নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ এজেন্ডা হলো জামায়াত-শিবির নিধন। তাদের ভাষ্য মতে ভোটের ক্ষেত্রে মূল নাটের গুরু হচ্ছে জামায়াত-শিবির। যে কারণে নির্বাচনে জামায়াত যে দিকে থাকবে পাওয়ারে তারাই আসবে। যেহেতু জামায়াত ১৮ দলের সাথে সেহেতু আওয়ামী লীগের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিই জোটবদ্ধভাবে আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় যাচ্ছে। তাদের হিসাব মতে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিএনপির ভোট সমানে সমান। অন্তত ১২০ থেকে ১৫০ আসনে জামায়াতের ভোট ২০ থেকে ৫০ হাজারের মধ্যে। আর সেসব আসনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ভোটযুদ্ধ হয় বাঘে- মহিষে। এসব আসনে বিএনপি আওয়ামী লীগের ভোটের ব্যবধান থাকবে ১০ থেকে ১৫ হাজারের  ভেতরে। সুতরাং বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না ভোটের ক্ষেত্রে জামায়াত ইজ ফ্যাক্টর। স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এক বক্তব্যে বলেছেন, বাংলাদেশে জামায়াত-শিবিরের ভোট আছে ২৫%। গেল কয়েক দিন আগে ঘাদানী কমিটির শাহরিয়ার কবির বলেছেন, জামায়াত ছাড়া বিএনপি একটি আসনও পাবে না। তাই বিশেষ করে লক্ষ করা যায় দেশের যে কোনো প্রান্তেই কোনো সমস্যা হলেই সরকারের মন্ত্রী, এমপিরা বলেই চলছেন যে, এসব যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র। আওয়ামী লীগের ২১ শতকের দেশ বিক্রি করার চ্যালেঞ্জের মূল অন্তরায় হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। তাই জামায়াত-শিবিরকে নিঃশেষ করার জন্য চলছে সরকারের শুরু থেকে চিরনি অভিযান। হাজার হাজার জামায়াত ও ছাত্রশিবির কর্মীকে কারারুদ্ধ করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে ডজন ডজন নেতা কর্মীকে। গুম করা হয়েছে দু’জন মেধাবী ছাত্রনেতাকে। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ার আগেই জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বছরের পর বছর জেলে পুরে রাখা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। তথাকথিত ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ২টি বেঞ্চে বিচারের নামে প্রহসন চলছে। বাদী পক্ষের লোকদের আসামি পক্ষ থেকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে বলে ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে হাস্যকর অভিযোগ উঠেছে। আসল ইনফরমেশন হলো আসামি পক্ষের লোকদের বাড়িঘরে পর্যন্ত থাকতে দেয়া হচ্ছে না। সরকারের এখন মূল টাগের্ট হলো জামায়াতের জাতীয় নেতৃবৃন্দের যে কোনো ধরনের শাস্তি চাপিয়ে দিয়ে জামায়াতকে নেতৃত্বশূন্য করা এবং জামায়াতের ইমেজ ক্ষুণœ করে আগামী দিনে জামায়াতকে জোটবদ্ধ নির্বাচন থেকে বিরত রেখে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসা । এখন প্রশ্ন ওঠা অত্যন্ত স্বাভাবিক, যে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে জামায়াতের সাথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করেছিল তখন কি তারা যুদ্ধাপরাধের এই বিষয়টি ভুলে গিয়েছিল? এ কারণে সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে যে হঠাৎ করে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নিয়ে সোচ্চারের কারণ কী? তা-ও বিশেষ করে জামায়াতকে নিয়ে। দেশপ্রেম! অথচ দিন কতক আগেই জামায়াতের সাথে তারা মিটিং সিটিং করেছিল তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে। আর যদি যুদ্ধাপরাধ বিচার করার শুভ বুদ্ধি হঠাৎ জাগরণ(!) তাহলে লিস্টেট যুদ্ধাপরাধীরা বাদ পড়ল কেন? আজকে যারা আওয়ামী লীগ চালায় তারাইতো যুদ্ধের সময় শান্তি কমিটিতে ছিল, সেখানে তো জামায়াতের নাম ছিল না। আওয়ামী নেত্রী সাজেদা চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেনসহ আওয়ামী লীগের অনেকের নাম রাজাকারের নামের তালিকায় আছে। অবশ্য বেয়াইর পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বেয়াই রাজাকার হলেও যুদ্ধাপরাধী নন। যারা সুশীলসমাজ আর মানবাধিকারের ধুয়া তুলে নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করতে চায় তাদের জেনে রাখা উচিত এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে। জালিমের একদিন অবসান ঘটবেই। লেখক : সেক্রেটারি জেনারেল বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির [email protected]

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির