post

আধ্যাত্মিক বিপ্লব কী ও কেন? । ফিরোজ মাহবুব কামাল

০৫ আগস্ট ২০১৯

আধ্যাত্মিক বিপ্লব কী ও কেন? । ফিরোজ মাহবুব কামাল‘আধ্যান’ শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ হলো স্মরণ বা চিন্তন। ‘আধ্যাত্মিক’ শব্দটির মাঝে আত্মার সাথে মিশ্রণ ঘটেছে আধ্যান শব্দের। ব্যক্তির মনে মহান আল্লাহ তায়ালার স্মরণে লাগাতার ধ্যানমগ্নতাই হলো আধ্যাত্মিকতা। আরবি ভাষায় মনের এরূপ অবস্থাকে বলা হয় জিকর। জিকরের মাঝেই আত্মার পুষ্টি। পশুর জীবনে সে জিকর থাকে না বলেই সে পশু। মানুষ পশু বা তার চেয়েও নিচু পর্যায়ে পৌঁছে যদি সে জিকর ও ফিকর না থাকে। এখানে ফিকরের অর্থ হলো গভীর চিন্তাশীলতা। আরবিতে এরূপ চিন্তাশীলতা বলা হয় তাফাক্কু, তায়াক্কুল ও তাদাব্বুর। নবীজি (সা) চিন্তাশীলতাকে উচ্চমানের ইবাদত বলেছেন। পবিত্র কোরআনে আফালা তাফাক্কারুন, আফালা তাদাব্বারুন, আফালা তা’কিলুন বলে সে চিন্তাশীলতায় বার বার তাগিদ দেয়া হয়েছে। আধ্যাত্মিক বিপ্লবের অর্থ মানব মনে মহান আল্লাহ তায়ালার জিকর ও ফিকরে বিশাল প্লাবন আনা। সে জিকর ও ফিকর তখন ব্যক্তির মনে সীমিত থাকে না, বরং কূল উপচানো জোয়ারের ন্যায় তা নেমে আসে ব্যক্তির কথা, কর্ম, লিখনি, আচরণ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও যুদ্ধবিগ্রহে। ব্যক্তির চেতনারাজ্যের এ বিশাল বিপ্লব তখন মহাবিপ্লব আনে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে। তখন পাল্টে যায় দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি ও মূল্যবোধ। তখন নির্মিত হয় উচ্চতর সভ্যতা। নবীজি (সা) ও সাহাবায়ে কেরামের আমলে তো সেটিই হয়েছিল। মানব ইতিহাসে এটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লব। এ বিপ্লবটি ছিল বস্তুত মানব শিশুকে মানবতাসম্পন্ন প্রকৃত মানবরূপে গড়ে তোলার। ফলে এ বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার বিপদটি বিশাল। তখন মানব শিশুর পক্ষে মানব রূপে বেড়ে উঠা ব্যাহত হয়। তখন সভ্যতার বদলে বাড়ে অসভ্যতা। শান্তির বদলে বাড়ে অশান্তি। মহান আল্লাহতায়ালা চান, তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ এ মানব সৃষ্টি জৈবিক বা দৈহিক পরিচয়ের বাইরেও প্রবল এক নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বল নিয়ে বেড়ে উঠুক। দৈহিক বলে মানব থেকে বাঘ-ভালুক-হাতি-সিংহ বহুগুণ শক্তিশালী। কচ্ছপও মানুষের চেয়ে বেশি দিন বাঁচে। মানুষের প্রকৃত গৌরব ও চ্যালেঞ্জটি বাঘ-ভালুকের ন্যায় শক্তি নিয়ে বাঁচা নয়, কচ্ছপের ন্যায় দীর্ঘকাল বাঁচাও নয়। বরং নৈতিক গুণ নিয়ে বাঁচায়। মানবের শ্রেষ্ঠত্ব উচ্চতর সভ্যতা নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে বাঁচায়। মু’মিনের জীবনে সেটাই মূল মিশন। সে মিশন ভুলে মানব যখনই নিছক পানাহার ও আনন্দ-উল্লাস নিয়ে বাঁচায় ব্যস্ত হয়েছে তখনই পশু থেকে মানুষের পার্থক্যটিও বিলুপ্ত হয়েছে। এরূপ পশুবৎ মানুষটি মর্যাদা হারায় মহান আল্লাহর কাছেও। সমাজে এরূপ মানুষের সংখ্যা বাড়লে আল্লাহর রহমত না এসে তখন আজাব আসে। তাই আধ্যাত্মিক বিপ্লব অপরিহার্য শুধু ওলি-আউলিয়া, পীর-দরবেশদের জন্য নয়, এটি অপরিহার্য হলো প্রতিটি নারী-পুরুষ, বালক-বৃদ্ধেরও। কারণ, মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে আত্মিক বন্ধনটি অর্জিত না হলে বান্দার মুসলিম বা ঈমানদার হওয়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়। শুধু মু’মিন হওয়ার জন্য নয়, মানব শিশুকে মানবরূপে বেড়ে ওঠার জন্যও সেটি অপরিহার্য। ব্যক্তির জীবনে এ বিপ্লবটি না এলে শুরু হয় আগাতার নিচে নামা। নিচে নামা মানুষটি তখন বর্বরতা ও হিংস্রতায় হিংস্র পশুকেও হার মানায়। আজ অবধি দেশে দেশে রাজনৈতিক ও সামরিক বিপ্লব কম হয়নি। সে সব বিপ্লবে মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ানটি অতি বিশাল। কিন্তু তাতে শান্তি বাড়েনি, প্রতিষ্ঠা পায়নি মানবতাও। মানব জাতির ব্যর্থতা এক্ষেত্রে অতি বেদনাদায়ক। পৃথিবী পৃষ্ঠে সবচেয়ে বড় বড় হিংস্র তা-বগুলো কোন বন্য পশুদের দ্বারা ঘটেনি। প্লাবন, ঘূর্ণিঝড়, সুনামি, মহামারী বা ভূমিকম্পেও হয়নি। ভয়াবহ যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ, গণহত্যা, এথনিক ক্লিনিজং, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ন্যায় বীভৎস কা-গুলো ঘটেছে মানবতাশূন্য বা আধ্যাত্মিকতাশূন্য মানব-পশুদের হাতে। কম্যুনিস্টদের বিপ্লবে বহু লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে রাশিয়া ও চীনে। এবং ২০ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে ক্যাম্পুচিয়ায়। সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে মাত্র দুটি বিশ্বযুদ্ধে। অথচ ইতিহাস জুড়ে এরূপ ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের সংখ্যা দুয়েক শত নয়, বরং কয়েক হাজার। তাছাড়া এরূপ মানব পশুদের পাপাচারের কারণে পৃথিবীপৃষ্ঠে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ভয়ানক আজাব নেমে আসার বিপদটিও বিশাল।

ইতিহাসের অনন্য বিপ্লব প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের সফলতার মূল কারণটি কৃষি, শিল্প বা কারিগরি বিপ্লব নয়। বরং বিশাল মাপের আধ্যাত্মিক বিপ্লব। সে বিপ্লবের ফলে মানুষ বেড়ে উঠেছিল মহামানব রূপে। বলা হয়, অধিকতর ক্ষমতা মানুষকে অধিক অত্যাচারী, দুর্নীতিপরায়ণ ও আরামপ্রিয় করে। ফিরাউন-নমরুদের ন্যায় স্বৈরাচারী শাসকগণ তার উদাহরণ। কিন্তু আধ্যাত্মিক বিপ্লব ক্ষমতাধর মানুষেকেও অতিশয় বিনয়ী ও মাটির মানুষে পরিণত করে। মানুষের চিন্তা, চেতনা, চরিত্র ও কর্ম যে তখন কতটা পাল্টে যায় তার একটি উদাহরণ দেয়া যাক। খলিফা হযরত উমরা (রা) ছিলেন তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রটির প্রধান। তাঁর আমলে মুসলিমগণ তৎকালীন দুটি বিশ্বশক্তি রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে প্রধান বিশ্বশক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। তার আমলের একটি মাত্র প্রদেশ বালাদে শাম (সিরিয়া) ভেঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে আজ কের ৫টি রাষ্ট্র সিরিয়া, লেবানন, জর্দান, ইসরাইল ও ফিলিস্তিন। থানার দারগো বা গ্রামের মাতবরও রাস্তায় সচরাচর একাকী হাঁটে না, সেটিকে তারা হীনতা বা অপমান ভাবে। অথচ সে বিশাল রাষ্ট্রটির শাসক মদিনা থেকে জেরুজালেমের দীর্ঘ ৬ শত মাইল পথ সফর করেছেন মাত্র একজন খাদেম ও একটি মাত্র উট নিয়ে। পালাক্রমে খাদেমকে উটের ওপর বসিয়ে তিনি নিজ হাতে উটের রশি টেনেছেন। যখন তাদের যাত্রা জেরুজালেমের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে তখন ছিল হযরত উমর (রা)-এর রশি ধরে উটের সামনে চলার পালা। প্রজাদের কল্যাণে তিনি এতটাই বিভোর থাকতেন যে মাঝ রাতে কাঁধে আটার বস্তা বহন করে ক্ষুধার্ত মানুষের ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। সাবেক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস হযরত বিলাল (রা)কে তিনি শ্রদ্ধাভরে সম্বোধন করতেন ‘সাইয়্যেদুনা বিলাল’ অর্থাৎ ‘আমাদের নেতা বেলাল’ রূপে। কারণ সত্যদ্বীনকে চেনার ব্যাপারে হযরত বেলাল (রা) হযরত উমর (রা)-এর চেয়ে অগ্রণী ছিলেন এবং অকথ্য নির্যাতনও তাকে ইসলাম থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। অথচ সম্ভ্রান্ত আরব সর্দারের পিঠে চাবুক মেরে শাস্তি দিতে তিনি ইতস্তত করেননি। এই ছিল হযরত উমরের আধ্যাত্মিকতা। মহান আল্লাহ তায়ালার ভয় হৃদয়ে স্থান পেলে অন্য সবকিছুর ভয় তখন বিদায় নেয়। কাকে অধিক সম্মান দিতে হবে সেটি তিনি শিখেছিলেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষণা থেকে। পবিত্র কোরআনের ঘোষণা- “ইন্না আকরামাকুম ইন্দাল্লাহি আতকাকুম” (সূরা হুজুরাত: আয়াত নং ১৩) অর্থ- “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক তাকওয়া সম্পন্ন।” তাকওয়ার গুণে সে সমাজে তাই বেলালের মতো সমাজের দরিদ্র ও দুর্বলেরা সেদিন অতি সম্মানিত হয়েছেন। সমগ্র ইতিহাসে কোন অমুসলিম রাজা বা শাসক কি একটি দিন, একটি ঘণ্টা বা একটি মিনিটের জন্যও এরূপ নজির সৃষ্টি করতে পেরেছে? অথচ এই হযরত উমর (রা)ই নবীজি (সা)-এর হত্যায় অস্ত্র হাতে রাস্তায় নেমেছিলেন। ইসলাম কবুলের ফলে তিনি এক ভিন্ন মানুষে পরিণত হয়েছিলেন।

কিরূপে আধ্যাত্মিক বিপ্লব? সমাজ বিপ্লবে ইসলামের অবদান শুধু বিশালই নয়, অতুলনীয়ও। কোন ভূখ-ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা পেলে পরিবার ও রাষ্ট্র তখন মহামানব গড়ার ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়। অথচ শয়তানি শক্তির হাতে রাষ্ট্র অধিকৃত হলে পরিণতিটি হয় সম্পূর্ণ বিপরীত। তখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয় মানুষরূপী হিং¯্রজীবের উৎপাদন কেন্দ্রে। ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, ইরাকে যারা লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করলো বা অতীতে যারা রক্তক্ষয়ী ক্রসেড ও বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল তারা জঙ্গলে বেড়ে ওঠেনি, বেড়ে উঠেছিল এরূপ রাষ্ট্রীয় ইন্ডাস্ট্রি থেকেই। অথচ রাষ্ট্র সম্পূর্ণ ভিন্নতর ও কল্যাণকর পরিচয় পেয়েছিল নবীজি (সা) ও খোলাফায় রাশেদার আমলে। সে রাষ্ট্রে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য উমর। ফলে সম্ভব হয়েছিল ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মাণ। তখন রাষ্ট্র পরিণত হয়েছিল আধ্যাত্মিক বিপ্লবের হাতিয়ারে। কত সাধু-সন্ন্যাসীই তো আধ্যাত্মিকতার নামে জঙ্গলে গিয়ে বসবাস করে। হাজার হাজার সুফি-দরবেশ হুজরা, খানকা বা দরগায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। কিন্তু তাদের হাতে বিশ্বের কোথাও কি আধ্যাত্মিক বিপ্লব এসেছে? সে সন্ন্যাসব্রতে নির্মিত হয়েছে কি উচ্চতর কোনো সভ্যতা? যে ভারতে বহু লক্ষ সাধু-সন্ন্যাসীর বাস সে দেশটিতে বহুকোটি দরিদ্র ও অনগ্রসর মানুষ তো অচ্ছুতই রয়ে গেছে। অচ্ছুৎদের ঘৃণা করা সন্ন্যাসব্রতে অপরাধ গণ্য হয় না বরং ধর্মীয় কর্ম রূপে বৈধতা পায়। তাই সংসারত্যাগী সাধু-সন্ন্যাসী প্রতিপালন বা আধ্যাত্মিকতার নামে খানকা, হুজরা বা দরগাহ গড়া মহান আল্লাহতায়ালার রীতি নয়, নবীজি (সা)-এরও সুন্নত নয়। ইসলামের গৌরব যুগে এসব ছিল না। মুসলিম উম্মাহর জীবনে ঈমানের স্রোত যখন গতি হারায় তখন আধ্যাত্মিকতার নামে এসব আবর্জনা জমতে শুরু করে। মহান আল্লাহতায়ালার সাথে নিজ আত্মার বন্ধনটি গভীরতর করার মাঝেই আধ্যাত্মিক বিপ্লব। সে বিপ্লবে গুরুত্ব পায় পার্থিব স্বার্থের বদলে আখেরাতের স্বার্থ। গুরুত্ব পায়, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যা চান বা পছন্দ করেন সেটিকেই নিজ জীবনে প্রায়োরিটি দেয়া। মনের সে বিপ্লবটি অন্ধকার বনে-জঙ্গলে হয় না, জ্ঞানচর্চাহীন সুফিখানকা, পীরের মাজার বা হুজরাতেও হয় না। সে জন্য চাই ওহির জ্ঞানে আলোকিত মন। সে আলোকিত মনের সৃষ্টিতে ইসলামের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানটি হলো মসজিদ ওহির জ্ঞান বিতরণে পৃথিবীপৃষ্ঠে মহান আল্লাহ তায়ালার এটিই একমাত্র আলোকিত ঘর বা ইনস্টিটিউশন। মহান আল্লাহ তায়ালার সৈনিকদের জন্য প্রতি জনপদে এটিই মূল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। মুসলিমগণ যখন বড় বড় যুদ্ধজয় করেছে এবং জ্ঞানচর্চায় বিপ্লব এনেছে তখন মসজিদ ছাড়া তাদের কোনো সেনানিবাস ছিল না। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল না। মসজিদের জায়নামাজেই ঘটে মু’মিনের জীবনে সবচেয়ে বড় আত্মবিপ্লব। সে বিপ্লবটি ঘটে কোরআনি জ্ঞানে আত্মস্থ হওয়ায় এবং ইবাদতের মাঝে ধ্যানমগ্ন হওয়ায়।

মূল অস্ত্রটি কোরআন আধ্যাত্মিকতার পথে ঈমানদারের মূল যুদ্ধটি হয় তার নিজ নফস ও খায়েশাতের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধে তরবারি বা গোলাবারুদের ব্যবহার চলে না। অস্ত্রটি এখানে আল কোরআন। পবিত্র কোরআনই হলো মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে বান্দাহর একমাত্র যোগসূত্র। কোরআনের মাধ্যমেই মহান আল্লাহ তায়ালা বান্দাহর সাথে কথা বলেন এবং তাঁর অন্তরে ওহির ইলম (জ্ঞান) ও হিকমা (প্রজ্ঞা) ঢেলে দেন। নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এটিই মুমিনের মূল হাতিয়ার। নামাজের শ্রেষ্ঠ অংশটি তাই রুকু-সিজদা নয়, বরং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ কোরআন পাঠ। বার বার কোরআন পাঠের মাধ্যমে সে তার বিদ্রোহী নফসে হত্যা করে। নবুয়তের প্রথম সাড়ে এগারো বছর ৫ ওয়াক্ত নামাজ ও সে নামাজে আজকের ন্যায় রুকু-সিজদা ছিল না, ছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ রাতব্যাপী কোরআন তেলাওয়াত। তারাবির নামাযে নফসের বিরুদ্ধে সে অস্ত্রটির প্রয়োগ আরো দীর্ঘকালীন হয়। মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ- ‘জাহিদুহুম বিহি জিহাদান কবিরা’ অর্থ “এ দিয়ে (অর্থাৎ কোরআন দিয়ে) বড় জিহাদের যুদ্ধটি চালিয়ে যাও।” (সূরা ফুরকান: আয়াত ৫২) রোযা মু’মিনের মনে মহান আল্লাহ তায়ালার জিকর বা স্মরণকে পুরা দিবাভাগে জারি রাখে, রাতে সে সংযোগটি আরো গভীরতর হয়। এবং সেটি তারাবিতে কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে। কিন্তু যে ব্যক্তিটি কোরআনের কথাগুলোই বুঝলো না, বা বুঝলেও তাতে ধ্যানমগ্ন হলো না তার মনে আধ্যাত্মিকতা বাড়বে কেমনে? ঈমানদারের আধ্যাত্মিকতার মূল কেন্দ্রবিন্দুটি হলো কোরআন। মহান রাসূলে পাক (সা)-এর ভাষাই পবিত্র কোরআনই হলো যিকরুল্লাহিল হাকিম (প্রজ্ঞাপূর্ণ আল্লাহর জিকর), হাবলুল্লাহিল মাতিন (আল্লাহর মজবুত রশি)ও সিরাতুল মুস্তাকিম (জান্নাতের পথে সরল রাস্তা)। তাই কোরআন থেকে দূর থাকার অর্থ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জিকর, তাঁর মজবুত রশি ও তাঁর প্রদর্শিত জান্নাতের পথ থেকে দূরে থাকা। এমন দূরে থাকায় আধ্যাত্মিকতা হাওয়ায় হারিয়ে যায়। মু’মিনের আলোকিত মনে যে চেতনাটি সর্বক্ষণ কাজ করে সেটি মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে জবাবদিহিতার দায়ভার। সে চেতনাটিই তাকে প্রতি পদে পথ দেখায়। জাহেলদের অন্ধকার মনে সে জবাবদিহিতার ভাবনা থাকে না, ফলে সিরাতুল মুস্তাকিমে চলায় যেমন আগ্রহ থাকে না, তেমনি সে পথটি পাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না। জাহেলদের থাকে পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির প্রবল তাড়না। ফলে থাকে প্রচ- পথভ্রষ্টতা। অপর দিকে মু’মিনের জীবনে প্রতিক্ষণের মূল ভাবনাটি জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার। এটিই মু’মিনের তাকওয়া। এখানে ধ্যানমগ্নতাটি প্রতিদিন ও প্রতিক্ষণ মহান আল্লাহ তায়ালার একান্ত আজ্ঞাবহ গোলাম রূপে বাঁচার; এবং সে সাথে সাথে তাঁরই রাস্তায় প্রাণ বিলিয়ে দেয়ার আকুতি। ‘ইসলাম’-এর আভিধানিক অর্থ আত্মসমর্পণ। আত্মসমর্পণটি এখানে মহান আল্লাহ তায়ালার সব হুকুমের প্রতি। এমন আত্মসমর্পিত ব্যক্তিকেই বলা হয় মুসলমান। পবিত্র কোরআনে ‘উদখুলু ফিস সিলমে কা-াফ্ফা’ অর্থ ‘ইসলামে পরিপূর্ণ রূপে দাখিল হয়ে যাও’ বলে মহান আল্লাহতায়ালা মূলত সে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণই চেয়েছেন। ফলে ঈমানদারের বুদ্ধিবৃত্তি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য তথা প্রতিটি কর্ম, চিন্তা ও আচরণের মাঝেই আসে ইসলাম তথা আত্মসমর্পণ। এবং সেটি না আসাটিই বেঈমানি। এরূপ আত্মসমর্পণের মাঝেই মু’মিনের আধ্যাত্মিকতা। দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও প্রশাসনের অঙ্গনকে ইসলামচ্যুত সেক্যুলারিস্টদের হাতে সমর্পিত করে খানাকা, হুজরা বা দরগায় আশ্রয় নেয়াটি ঈমানদারি নয়, বরং গাদ্দারি। আল্লাহর দ্বীনের কোন আধ্যাত্মিক সৈনিক রাষ্ট্রের কোন একটি অঙ্গনেও আল্লাহর দ্বীনের পরাজয় মেনে নেয় না। প্রকৃত ঈমানদার ঝান্ডা উড়ানোর জন্য দেশ স্বাধীন করে না। ভাষা বা জাতির গর্ব বাড়াতেও যুদ্ধ করে না। অর্থ ও রক্ত ব্যয় করে এবং দেশ স্বাধীন করে স্রেফ আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তি বিধান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এপথেই মেলে জান্নাত। এখানেই মু’মিনের আল্লাহপ্রেম ও ঈমানদারি। তাদের বন্ধনটি ভাষা, বর্ণ, ভূগোল বা জাতিগত পরিচয় নিয়ে নয়। বরং সেটি রাব্বুল আলামিনের সাথে। সালাহউদ্দীন আইয়ুবী তাই কুর্দি হয়েও স্বাধীন কুর্দিস্থান প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেননি। বরং আরব, তুর্ক, কুর্দ সবাইকে সাথে নিয়ে তিনি যুদ্ধ করেছেন মুসলিম উম্মাহর স্বাধীনতা ও সংহতি বাঁচাতে। তাঁর মনে কাজ করেছে আল্লাহপ্রেম ও আধ্যাত্মিকতা। সে আল্লাহপ্রেম ও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে মু’মিনগণ জন্মভূমি থেকে হাজার মাইল দূরে গিয়ে জিহাদ করে এবং শহীদ হয়। আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় শহীদ হওয়ার মাঝেই তাঁরা জীবনের সর্বোচ্চ সফলতা দেখে। ইসলাম বহু হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশে পৌঁছেছে তো এমন চেতনাধারীদের ত্যাগের বিনিময়েই। এমন এক আধ্যাত্মিক বিপ্লবের কারণে যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুমুখী আহত ও পিপাসার্ত সৈনিকটি মুখের কাছে পানি পেয়েও পাশের অপর আহত সৈনিককে তা দিতে অনুরোধ করে। আত্মপ্রেমের স্থলে আল্লাহপ্রেম প্রবলতর হলে আচরণ এভাবেই পাল্টে যায়। কিন্তু মুসলমানদের মাঝে সে চেতনার আজ মৃত্যু ঘটেছে। ফলে থেমে গেছে ইসলামের প্রসার; এবং সে সাথে বিলুপ্ত হয়েছে মুসলমানদের শক্তি ও ইজ্জত। তারা ইতিহাস গড়ছে বরং দুর্বৃত্তি ও বিভক্তিতে। নবীজি (সা)-এর সাহাবাদের হাতে পিরামিড বা তাজমহল নির্মিত হয়নি। চাঁদের বুকে পা রাখার স্বপ্নও তাঁরা দেখেননি। তাদের জীবনে মূল সাধনাটি ছিল আল্লাহপ্রেমী হওয়ার। মনে ব্যাকুলতা ছিল মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে কোন কর্মটি অতি পছন্দের সেটি জানার এবং প্রচণ্ড তাড়না ছিল সে কর্মে প্রাণ বিলিয়ে দেয়ার। ফলে তাদের আগ্রহ বেড়েছিল জিহাদে ও শহীদ হওয়াতে। এর চেয়ে বড় আধ্যাত্মিকতা আর কী হতে পারে? আধ্যাত্মিকতার সে বিপ্লব এসেছিল সাহাবায়ে কেরামদের জীবনে। মহান আল্লাহ তায়ালার গর্ব তো এমন মানুষদের নিয়ে। ফেরেশতাদের দরবারে তিনি তাদের প্রশংসা করেন। এরূপ আধ্যাত্মিক ব্যক্তিগণই শয়তান ও তার অনুচরদের মূল শত্রু। ফলে শয়তানি শক্তি চায় না, পৃথিবীর কোন প্রান্তে এমন আধ্যাত্মিক মানব নির্মাণের ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠুক এবং মুসলিমগণ বেড়ে উঠুক জিহাদের সংস্কৃতি নিয়ে। এ জন্যই ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের বিরুদ্ধে তাদের এতো ক্রোধ এবং বিশ্বজুড়ে গড়েছে বিশাল কোয়ালিশন। পৃথিবীর যেখানেই ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের প্রচেষ্টা সেখানেই শুরু হয় এ শয়তানি কোয়ালিশনের বিমান হামলা। তাদের বোমা বর্ষণে নিহত হয়েছে সিরিয়া ও ইরাকের হাজার হাজার নিরপরাধ নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। বিধ্বস্ত হয়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি। তারা চায়, ১৩০ কোটির বেশি মুসলমান বাস করুক ইসলামী রাষ্ট্র ও শরিয়তের প্রতিষ্ঠা ছাড়াই। অথচ মুসলমানদের জনসংখ্যা যখন বাংলাদেশের একটি জেলার সমানও ছিল না তখনও কি ইসলামী রাষ্ট্র, খেলাফত ও শরিয়ত ছাড়া তাদের একটি দিন বা একটি ঘণ্টাও অতিক্রান্ত হয়েছে?

আধ্যাত্মিকতার পরিচয় কিরূপে? দেশে আধ্যাত্মিকতা কতটা বাড়লো সেটি সুফি-দরবেশ, সুফি খানকাহ, মাজার ও পীর-মুরিদের সংখ্যা দিয়ে নির্ণীত হয় না। সুফি খানকাগুলোর জিকর, ওজিফা পাঠ ও দরবেশী গানেও সেটি ধরা পড়ে না। বরং সঠিকভাবে ধরা পড়ে মহান আল্লাহ তায়ালার হুকুমের প্রতি আত্মসমর্পণ কিরূপ, কতটা প্রতিষ্ঠা পেল শরিয়তি বিধান, কতটা সংঘটিত হলো জিহাদ, কতজন শহীদ হলো সে জিহাদে এবং কতটা নির্মূল হলো শয়তানি শক্তির বিদ্রোহ তা দিয়ে। যে দেশের রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, আইন-আদালত জুড়ে মহান আল্লাহ তায়ালার দ্বীনের পরাজয় এবং বিজয় ইসলামের শত্রুপক্ষের সে দেশের মানুষের আবার কিসের আধ্যাত্মিকতা? তাদের ঈমানদারিই বা কোথায়? বিদ্রোহ বা অবাধ্যতার মাঝে কি আধ্যাত্মিকতা বাঁচে? আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ও শহীদ হওয়ার মাঝেই আধ্যাত্মিকতা তথা মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে বন্ধনের পরমতম প্রকাশ। জিহাদে তো তারাই যায় যাদের অন্তরের গভীরে মহান প্রভুর সাথে বন্ধনের টানটি প্রবল। শহীদ তো তারাই হয় যারা তাঁর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়তি বিধানের বিজয় আনতে শুধু শ্রম, মেধা, অর্থ ও সময়ই বিনিয়োগ করে না, নিজের প্রাণও বিলিয়ে দেয়। শুধু চেতনা-রাজ্যে নয়, তাদের কর্মজীবনের সবটুকু জুড়ে থাকে মহান আল্লাহ তায়ালার স্মরণ। সে প্রতি মুহূর্ত বাঁচে মহান আল্লাহ তায়ালার খলিফা রূপে নিজ দায়বদ্ধতা নিয়ে। যার মধ্যে এ দায়বদ্ধতা নেই সে ব্যক্তি যত বড় সুফি বা সাধক রূপেই পরিচিত পাক না কেন, আদৌ কি তাকে আধ্যাত্মিক বলা যায়? মু’মিনের জিকর কি ¯্রফে মহান আল্লাহ তায়ালার নামের জিকর? সেটি তো তাঁর প্রতি দায়বদ্ধতার স্মরণ। মু’মিনের জীবনে এ যিকর প্রায় প্রতি মুহূর্তের। এদের নিয়েই মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “(এরা হলো তারা) যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে, এবং চিন্তা করে আসমান-জমিনের সৃষ্টি নিয়ে...।” (সূরা আলে ইমরান : আয়াত ১৯১)। জিকর ও আধ্যাত্মিকতার এটিই তো প্রকৃত রূপ। আল্লাহ তায়ালার প্রতি এরূপ গভীর প্রেম নিয়ে কোন ব্যক্তি কী মহান আল্লাহ তায়ালার দ্বীনের অপমান বা পরাজয় সইতে পারে? তাই যে দেশে জনগণের মাঝে আধ্যাত্মিকতা প্রকট, শয়তানি শক্তির দখলদারির বিরুদ্ধে জিহাদও সে দেশে প্রবলতর। তাই নবীজি (সা)-এর এমন কোন সাহাবা ছিলেন না যিনি জিহাদে যোগ দেননি। অর্ধেকের বেশি সাহাবী শহীদও হয়েছেন। বিশ্বে আজ মুসলিমদের সংখ্যা বেড়েছে। বিপুল ভাবে বেড়েছে নামাযী ও মসজিদের সংখ্যাও। বেড়েছে সুফি-দরবেশ ও তাদের মুরিদদের সংখ্যাও। এবং আধ্যাত্মিকতার নামে বেড়েছে সুফি তরিকা, খানকাহ, ওরস এবং ওজিফা পাঠের বিশাল বিশাল আয়োজনও। বেড়েছে ভক্তিগান, গজল, কাউয়ালি ও মারেফতি গান। কিন্তু এতো আয়োজনের মাঝে কতটুকু বেড়েছে আধ্যত্মিকতা বা আল্লাহপ্রেম? কতটুকু বেড়েছে জিহাদে সুফিদের সংশ্লিষ্টতা? কতটুকু প্রতিষ্ঠা পেয়েছে শরিয়ত? বরং মুসলিম বিশ্বজুড়ে যা বেড়েছে তা হলো আল্লাহর দ্বীনের পরাজয়। মুসলিম দেশগুলি আজ দেশী ও বিদেশী শত্রুদের হাতে অধিকৃত; এবং প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কুফরি আইন-আদালত। চোখের সামনে মহান আল্লাহ তায়ার দ্বীন ও তাঁর শরিয়তি বিধানের এরূপ পরাজয় দেখেও যে ব্যক্তিটি রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমায় এবং সে পরাজয় রুখতে জিহাদে নামে না বা জিহাদের প্রস্তুতিও নেয় না এবং জনগণের সামনে জিহাদের গুরুত্বও তুলে ধরে না সে ব্যক্তি যতবড় সুফি, পীর, দরবেশ,পীরে কামেল বা আল্লামা বলে খ্যাতি পাক না কেন, তার মধ্যে যে বিন্দুমাত্র আল্লাহপ্রেম বা আধ্যাত্মিকতা নাই -তা নিয়ে কি সন্দেহ চলে? আধ্যাত্মিকতার দাবিতে এরূপ জিহাদবিমুখ ব্যক্তিগণ যে ভণ্ড সে সাক্ষ্যটি এসেছে খোদ নবীজি (সা) থেকে। নবীজি (সা)-এর প্রসিদ্ধ হাদীস: যে ব্যক্তিটি জিহাদে যোগ দিল না এবং জীবনে কোন দিন জিহাদের নিয়তও করলো না -সে ব্যক্তিটির মৃত্যু ঘটে মুনাফিক রূপে। এ ভণ্ডামি দাড়ি-টুপি ও দরবেশী লেবাস দিয়ে কি লুকানো যায়?

আধ্যাত্মিক বিপ্লবে ব্যর্থতা ঈমানদারের জীবনে নামায, রোযা, হজ, যাকাত ও কোরআন পাঠের ন্যায় যত ইবাদতÑ তার মূল লক্ষ্যটি ইবাদতকারীর জীবনে আধ্যাত্মিক বিপ্লব। ইবাদত যত গভীরতর হয় এ বিপ্লবও ততই প্রবলতর হয়। আধ্যাত্মিক বিপ্লব এলে চারিত্রিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে, আগুন জ্বললে যেমন উত্তাপ অনিবার্য। ইবাদত কতটা সফল তা পরিমাপের মূল মাপকাঠিটি হলো ব্যক্তির জীবনে এই আধ্যাত্মিক বিপ্লব। নামায- রোযা-হজ-যাকাত পালন ও কোরআন পাঠে যদি সে বিপ্লবই না আসে তবে বুঝতে হবে সেগুলি প্রকৃত ইবাদত নয়, নিছক রসম-রেওয়াজ। ইবাদতের অর্থ তো মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুমের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ। প্রতিদিন ৫ বার মসজিদে ডেকে নামায তো সে আত্মসমর্পণের প্রশিক্ষণই দেয়। যে ইবাদতে কোরআনি আনুগত্য বা আত্মসমর্পণ সৃষ্টি হয় না -তা কি আদৌ ইবাদত? যে ব্যক্তির আত্মসমর্পণ এমন আইনের প্রতি যে আইনে সুদ, ঘুষ ও পতিতাবৃত্তির ন্যায় যিনাও সিদ্ধ; সে ব্যক্তির ইবাদতকে কী ঈমানদারি বলা যাবে? নামায- রোযা তো নবীজি (সা)-এর আমলে মুনাফিকগণও পালন করেছে, এমনকি নবীজি (সা)-এর পেছনে তারা নামাযও আদায় করেছে। কিন্তু সে ইবাদতে মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে তাদের আত্মিক সম্পর্কটি বাড়েনি। ফলে বাড়েনি আধ্যাত্মিকতাও। বরং যা বেড়েছে তা হলো রাব্বুল আলামিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও গাদ্দারি। পশু বাঁচে তার জৈবিক সত্তা নিয়ে, সে বাঁচায় আধ্যাত্মিকতা নেই। সত্যকে চেনা বা বুঝার ব্যাপারে পশুর কান, চোখ ও কালব কোন সাহায্যই করে না। ব্যক্তির জীবনেও একই রূপ অবস্থা সৃষ্টি হয় ঈমানশূন্যতা ও তাকওয়া শূন্যতার কারণে। তবে পার্থক্য হলো, পশুর জীবনে অজ্ঞতা থাকলেও আল্লাহ তায়ালার দ্বীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা অবাধ্যতা নেই। কিন্তু সে বিদ্রোহ ও অবাধ্যতা আছে মানব পশুদের মাঝে। এমন মানব পশুদের নিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার ভাষ্য, “তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দিয়ে অনুভব করে না, তাদের চোখ কাছে কিন্তু তা দিয়ে দেখে না, তাদের কান আছে কিন্তু তা দ্বারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ পশুর মত, বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। এরাই হলো গাফেল।” (সূরা আরাফ : আয়াত ১৭৯) প্রশ্ন হলো: মহান আল্লাহ তায়ালা কি তাঁর পবিত্র জান্নাত এমন চেতনাশূন্য পশুদের দিয়ে ভরবেন? দেহ নিয়ে বেঁচে থাকাকে নিশ্চিত করতে মহান আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীপৃষ্ঠে নানারূপ পানাহারের ব্যবস্থা করেছেন। আর আত্মার খাদ্য জোগাতে একাধিক কিতাব নাযিল করেছেন। এবং সে সাথে লক্ষাধিক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন, এবং তাদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ওহির জ্ঞান দিয়েছেন। মানব রূপে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এ হলো অতি অপরিহার্য প্রয়োজন। সে প্রয়োজন পূরণে পবিত্র কোরআন হলো সর্বশেষ কিতাব। সে অর্পিত মিশন পালনে পবিত্র কোরআনের সামর্থ্যটিও গোপন বিষয় নয়। বস্তুত সমগ্র মানব ইতিহাসে পরিশুদ্ধ আত্মার সবচেয়ে অধিক ও সবচেয়ে সবল মানুষ গড়ে উঠেছে পবিত্র কোরআনের বদৌলতে। মানব জাতির কল্যাণে এটিই হলো মহান আল্লাহ তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান। এ দান না পেলে মানুষের পক্ষে মানবিক পরিচয় নিয়ে বেড়ে ওঠা কোনো কালেই সম্ভব হতো না, তখন মানুষ বাঁচতো নিছক পশু রূপে। মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ দানের মাসটি হলো রামাদান। এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সে দানটি হলো আল কোরআন। সে দানকে সম্মানিত করতেই তিনি রামাদানে মাসব্যাপী রোজা ফরজ করেছেন। এবং দান করেছেন লায়লাতুল কদর যা হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর। বহু গুণ বাড়িয়েছেন এ মাসে সম্পাদিত প্রতিটি নেক কর্মের সওয়াব। এভাবে বুঝিয়েছেন, মানব জাতির জন্য কত বড় গুরুত্বপূর্ণ দান হলো আল কোরআন। প্রশ্ন হলো, পবিত্র কোরআন নাজিল হওয়ার মাস হওয়ার কারণে যে মাসকে মহান আল্লাহ তায়ালা এভাবে সম্মানিত করলেন, মুসলিমগণ নিজেরা সে কোরআনকে কতটা সম্মানিত করছে? সেটি কি অর্থ না বুঝে বার বার খতমে তেলাওয়াতের মাধ্যমে? কোরআন হিদায়েতের গ্রন্থ। না বুঝে পড়ায় কি হিদায়েত জুটে? কোরআন নাযিল হয়েছিল সিরাতুল মুস্তাকিম দেখাতে। কিন্তু সে সিরাতুল মুস্তাকিমের অনুসরণই বা কতটুকু? অনুসরণের জন্য তো সে পথের জ্ঞানটি জরুরি। সিরাতুল মুস্তাকিমের অনুসরণ হলে তো মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা পেত। গড়ে উঠতো ইসলামী খেলাফত।

লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির