post

আমাদের জাতীয়তাবাদ

এবনে গোলাম সামাদ

০৮ এপ্রিল ২০২০
জার্মান দার্শনিক ফিকট (I.G. Fichte, 1772-1814)-এর মতে জাতিসত্তার ভিত্তি হলো ভাষা। এক ভাষায় কথা বলা মানুষ নিজেদের মধ্যে অনুভব করে বিশেষ মানসিক ঐক্য। এই ঐক্যবোধ তাদের অনুপ্রাণিত করে এক জাতি (Nation) ও এক রাষ্ট্র গঠনে। আর একটা জাতীয়তাবাদ পরিগ্রহ করে তার বিশেষ রূপ। জার্মান ভাষাভাষীরা এক সময় বিভিন্ন রাজার অধীনে ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে বাস করতো। জার্মানরা চাচ্ছিল তাদের ভাষাভিত্তিক একটা বড় শক্তিমান রাষ্ট্র গঠন করতে। আর দার্শনিক ফিকট জুগিয়েছিলেন এর পক্ষে যুক্তি। কিন্তু মানুষ কেবল ভাষার ভিত্তিতেই এক জাতি রাষ্ট্র গড়তে পারে, তা নয়। অস্ট্রিয়ানরা (Austrian) জার্মান ভাষায় কথা বলে। কিন্তু তারা জার্মানির সঙ্গে এক হয়ে যেতে চায়নি। এই না যেতে চাইবার একটা কারণ হলো তাদের ধর্ম বিশ্বাস। অস্ট্রিয়ানরা ধর্মে প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ হলো ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। কেবল ধর্মীয় কারণ যে অস্ট্রিয়াকে জার্মানি থেকে পৃথক করে রেখেছে তা নয়। অন্য ঐতিহাসিক কারণও কাজ করেছে এর মধ্যে। এক সময় ইউরোপে অস্ট্রিয়া এবং হাঙ্গেরি মিলে ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরি (Austro-Hungary) সাম্রাজ্য। প্রথম মহাযুদ্ধের পর ১৯১৮ সালে ভেঙে পড়ে এই সাম্রাজ্য। সৃষ্টি হয় দু’টি পৃথক রাষ্ট্র, অস্ট্রিয়া (Austria) এবং হাঙ্গেরি (Hungary)|। জাতিগঠনে ভৌগোলিক নৈকট্য পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। গ্রেট ব্রিটেনে মানুষ ইংরেজি ভাষায় কথা বলে। ইংরেজি ভাষায় কথা বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়েছে একটা পৃথক রাষ্ট্র। যুদ্ধ করে সে হয়েছে গ্রেট ব্রিটেন থেকে স্বাধীন। এটা হবার বড় কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যে আটলান্টিক মহাসাগরের ব্যবধান। অবশ্য গ্রেট ব্রিটেন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথক হয়ে যাবার মূলে সে সময়ে ব্রিটেনের ভুল রাজনীতিও ছিল বিশেষভাবে দায়ী। ভৌগোলিক নৈকট্য, ভাষা, ধর্ম ও ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ এক জাতি এক রাষ্ট্র গড়ে উঠবার মূলে কাজ করেছে। এক একটি জাতি অর্থাৎ এক ভৌগোলিক এলাকায় এক ভাষায় কথা বলা এক মনোভাবাপন্ন মানুষ চেয়েছে অন্য জাতির খবরদারি মুক্ত হিসাবে বাস করতে। জাতি একটি রাজনীতি সচেতন মানবসমষ্টি। যা চায় আপন রাষ্ট্র গড়তে। বাংলা ভাষা ছিল এই উপমহাদেশের সবচেয়ে শক্তিমান ভাষা। এর ছিল উল্লেখযোগ্য লিখিত সাহিত্য। কিন্তু কেবল ভাষা দিয়েই যে আজকের বাংলাদেশের সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করা যায় তা নয়। বাংলা যাদের মাতৃভাষা তাদের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগের বাস আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রে। আর প্রায় শতকরা ৪০ ভাগের বাস ভারতে। সব বাংলাভাষী মানুষ এক রাষ্ট্রের পতাকাতলে আসতে পারেনি। কেবল বাংলাদেশের বাংলা ভাষীরা একটা পৃথক রাষ্ট্র গড়েছে। ভারতের বাংলা ভাষীরা চাচ্ছে ভারতের মহাজাতির অংশ হয়েই থাকতে। ভারতের বাংলা ভাষীরা কোন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেনি। ভারতের রাষ্ট্রভাষা হলো হিন্দি। ভারতের বাংলাভাষীরা শিখছে হিন্দি। একদিন হয়তো হিন্দিই হয়ে উঠবে তাদের ভাষা। যেমন ঘটেছে ভারতের বিহারিদের ক্ষেত্রে। বিহারিদের প্রাচীন ভাষা এখন অবলুপ্ত প্রায়। ভাষা হিসাবে বাংলা ভারতে নয়, টিকে থাকবে বাংলাদেশেই। আর এই ভাষার মাধ্যমেই অভিব্যক্তি পাবে বাংলাদেশের মানুষের জাতিসত্তার; তার আশা-আকাক্সক্ষা, চিন্তা-চেতনা, সুখ-দুঃখের অনুভব। বাংলা ভাষার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখি এই ভাষার বিশেষ বিকাশ ঘটতে পেরেছিল বাংলার পৃথক স্বাধীন সুলতানি আমলে। যা চলেছিল, ১৩৩৮ থেকে প্রায় ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময় বাংলার একাধিক সুলতান ও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী করেছেন বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা। দিয়েছেন তাতে সাহিত্য সৃষ্টির উৎসাহ। ফলে ঘটতে পেরেছে বাংলা ভাষার বিকাশ। (Denesh Chandra Sen; History of the Bengali language and literature; Calcutta University. 1913)। ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাংলা আসে মুঘল অধীনে। বাংলা পরিণত হয় মুঘল সাম্রাজ্যের একটি সুবা বা প্রদেশে। কোন মুঘল সম্রাট বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করেননি। যদিও মুঘল আমলেও চলেছে বাংলা ভাষা সাহিত্যের চর্চা। বাংলায় ইসলাম বিশেষভাবে প্রচলিত হয় সুলতানি আমলে। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে বাংলায় আরম্ভ হয় মধ্য এশিয়া থেকে আগত তুর্কি মুসলিম অভিযান। এর আগে দিল্লিতে সুলতানি প্রতিষ্ঠা করেন কুতুব-উদ-দীন আইবাক (১২০৬-১২১১) কুতুব-উদ-দীন আইবাকের একজন সেনাপতি মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বাংলার একটা অংশ অধিকার করেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে। দিল্লির সুলতানি বা সালতানাত চলেছিল ১২০৬ থেকে ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। কিন্তু বাংলায় ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় একটা পৃথক সুলতানি। ফকর-উদ-দীন মুবারক শাহ যার প্রতিষ্ঠাতা। এই ইলিয়াস শাহির সময়ই পাওয়া যাচ্ছে বাংলা সাহিত্যের প্রথম নমুনা, যা আমরা এখনও পড়লে বিশেষজ্ঞের সাহায্য ছাড়াই বুঝতে পারি। এ পর্যন্ত যেসব বাংলা গ্রন্থ পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হলো শাহ মুহাম্মদ সগীরের রচিত “ইউসুফ জুলেখা”। খুব বেশি সংখ্যক তুর্কি মুসলমান যে মধ্য এশিয়া থেকে বাংলায় এসেছিল তা মনে হয় না। এছাড়া বিশেষত মধ্য এশিয়া থেকে আগত তুর্কি মুসলমানদের মধ্যে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা ছিল কম। এদেশে আগত তুর্কি মুসলমান পুরুষেরা তাই বিবাহ করতে বাধ্য হয় এদেশের কন্যাদের। ফলে এদেশের জনসমষ্টিতে আসতে পারে না কোন বিরাট মানব ধারাগত পরিবর্তন। তুর্কিদের নৃতাত্ত্বিকরা সাধারণত স্থাপন করেন “তুর্কি” মানব ধারায়। তুর্কিদের মাথার আকৃতি যথেষ্ট গোল। মুখের আদল লম্বা ডিম্বাকৃতি। নাক সোজা ও খাড়া। চোখ আয়ত। ঠোঁট পাতলা। দেহের উচ্চতা মাঝারি। গায়ের রং পিতাভ সাদা। এরকমের মানুষ বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান সমাজে কিছু কিছু দেখা যায়। হতে পারে তারা বহন করছে তুর্কি মানব ধারারই প্রভাব। মুঘলরাও ছিল মূলত তুর্কি মানব ধারা ভুক্ত। কিন্তু এদের মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটেছিল মঙ্গোলিয়ার মঙ্গোলীয় মানব ধারা। বাবর, হুমায়ুন, আকবরের যে সব ছবি পাওয়া গিয়েছে তাতে তাদের চোখ আঁকা থাকতে দেখা যায় মঙ্গোলীয় ধাঁচে। বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের মানুষের মধ্যে মঙ্গোলীয় মানব ধারার প্রভাব থাকতে দেখা যায়। বিশেষ করে মুসলিম জনসমষ্টির মধ্যে। কিন্তু এর সঙ্গে মুঘলদের কোন সম্বন্ধ নেই। এই মঙ্গোল প্রভাব এসেছে বাংলার উত্তর পূর্ব দিক থেকে; অনেক অতীতে। প্রধানত তিব্বত ও চীন থেকে। আমরা বলছিলাম বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার হতে পেরেছিল সুলতানি আমলে। এক্ষেত্রে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়াতেও হয়েছে ইসলাম প্রচার। এই ইসলাম প্রচার হতে পেরেছে দক্ষিণ আরব থেকে আগত মুসলিম বণিকদের উদ্যোগে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের সঙ্গে বাংলার মানুষের ছিল বাণিজ্যিক যোগাযোগ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের ইসলাম গ্রহণ, বাংলার মানুষকে তাই জুগিয়ে থাকতে পারে ইসলাম গ্রহণে বিশেষ প্রেরণা। ইসলাম একটি প্রচারশীল ধর্ম। মধ্য এশিয়া থেকে তুর্কি মুসলমানগণ আগমনের আগেই বাংলায় কিছু পরিমাণ ইসলাম প্রচারিত হয়ে থাকতে পারে আরব মুসলিম বণিকদের মাধ্যমে। অনেকে এরকম অনুমান করেন। বাংলাদেশের দুটি প্রাচীন স্থান হলো নওগাঁর পাহাড়পুর এবং কুমিল্লার ময়নামতি। এই উভয় স্থান থেকেই আব্বাসীয় খলিফাদের মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। যা থেকে অনুমান করা চলে মুসলিম আরব বিশ্বের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। পাহাড়পুরে পাওয়া গিয়েছে খলিফা হারুন-অর-রশিদের একটি স্বর্ণ মুদ্রা। মুদ্রাটি ১৭২ হিজরিতে অর্থাৎ ৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে মুদ্রিত। ময়নামতিতে পাওয়া গিয়েছে পরবর্তীকালের আব্বাসীয় খলিফাদের রৌপ্যমুদ্রা। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা হয়নি। তবে এ পর্যন্ত যা জানা গিয়েছে তাতে বলতে হয় সুলতানি আমলেই এই অঞ্চলে হতে পেরেছিল ইসলামের সাধারণ বিস্তার। বাংলাদেশের মুসলমানরা তুর্কিদের মতই সুন্নি এবং হানাফি মাযহাব ভুক্ত। তবে আরব মুসলিম বণিকদের মাধ্যমেও ইসলাম বাংলার কিছু অংশে প্রচারিত হয়ে থাকতেও পারে। এক সময় মনে করা হতো, এদেশের মুসলিম নৃপতিরা জোর করে ইসলাম প্রচার করেছেন। কিন্তু এই জোর করে ইসলাম প্রচারের তত্ত্বকে এখন আর আগের মত সত্য হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। বিশেষ করে বাংলার ক্ষেত্রে। বাংলার লোক গণনা করা আরম্ভ হয় ইংরেজ শাসন আমলে। প্রথম লোক গণনা করা ১৮৭১ সালে। ঐ লোক গণনার হিসাবে দেখা যায় সে সময়ের বাংলায় হিন্দুর সংখ্যা হলো মুসলমানদের চাইতে বেশি। এরপর লোক গণনা করা হয় ১৮৮১ সালে। ঐ লোক গণনার হিসাবে বাংলায় দেখা যায় মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে এবং হিন্দুর সংখ্যা কমতে। এর পর থেকে বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। এই বৃদ্ধির কোন কারণ নির্দেশ করা যায়নি। বাংলায় হিন্দুর তুলনায় মুসলমানদের সংখ্যা বেড়েছে ইংরেজ আমলে। যখন হিন্দুদের জোর করে মুসলমান করবার কোন সুযোগই ছিল না। মুঘলদের পরে বাংলা আসে ইংরেজ অধীনে। এই উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন আরম্ভ হয় বাংলা থেকে। বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যত্র ক্রমশ বিস্তৃত হয় ইংরেজ শাসন। ইংরেজ শাসন আমলেই এই উপমহাদেশে সৃষ্টি হয় হিন্দু মুসলমান বিরোধ। আর এই বিরোধ সৃষ্টিতে ব্রিটিশ রাজের ছিল একটা বিশেষ ভূমিকা। ইংরেজ আমলে এই উপমহাদেশের ইতিহাস পড়ানো আরম্ভ হয় হিন্দু ও মুসলমান যুগে বিভক্ত করে। যাতে করে মনে হয় হিন্দুরা একটি জাতি। আর মুসলমানরা আর একটি জাতি। লক্ষ্য করবার বিষয়, ব্রিটিশ শাসন আমলকে কিন্তু উল্লেখ করা হয় না খ্রিষ্টান যুগ হিসাবে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিলাতে বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ম্যাক্স মুলারকে (১৮২৩-১৯০০) অর্থ প্রদান করা হয় বৈদিক ভাষা থেকে হিন্দু আদি ধর্ম গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত ঋগে¦দকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করবার জন্যে। ম্যাকস মুলার এই অনুবাদ সম্পন্ন করেন। তিনি কেবল যে ঋগে¦দের অনুবাদ করেন তাই নয়। প্রদান করেন “আর্য” জাতির ধারণা। প্রচার করেন অন্য জাতির তুলনায় আর্য জাতির শ্রেষ্ঠত্বের কথা। যার একটা প্রভাব পড়ে ভারতের হিন্দু মনে। সৃষ্টি করে হিন্দুত্বের বিশেষ ধারণা। যে ধারণা এই উপমহাদেশের রাজনীতিকে করেছে প্রভাবিত। আর এখনো করছে। হিন্দুত্বকে নির্ভর করে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের আগেই গঠিত হয় হিন্দু মহাসভা। হিন্দু মহাসভা চায় ইংরেজ শাসন মুক্ত করে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে গড়তে। এক পর্যায়ে হিন্দু মহাসভার বিখ্যাত সভাপতি বিনায়ক দামোদর সাভারকার (১৮৮৩-১৯৬৬) ঘোষণা করেন, এই উপমহাদেশে মুসলমানরা এসেছে বাইরে থেকে। তারাও বিদেশী। তাদেরও বিতাড়িত করতে হবে। এর ফলে এই উপমহাদেশের মুসলিম মানসে উপ্ত হতে পারে এক বিশেষ হিন্দু আধিপত্য ভীতি (Fear Complex)। যা নিয়ন্ত্রিত করতে থাকে এই উপমহাদেশের মুসলিম রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা। ম্যাকস মুলারের দেয়া আর্য জাতির ধারণা যে কেবল হিন্দু মনেই প্রভাব ফেলেছিল তা নয়। ইউরোপের রাজনীতিতে পড়েছিল আর্য জাতির ধারণার বিরাট প্রভাব। ১৯৩০ এর দশকে জার্মানিতে আর্য জাতির ধারণাকে নির্ভর করে সৃষ্টি হয় নাৎসিবাদ। নাৎসিরা জার্মানিতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। নাৎসিরা দাবি করে জার্মানরাই হলো খাঁটি আর্য। আর তারা হলো আর সব জাতির তুলনায় শ্রেষ্ঠ। তারা প্রভুজাতি। অন্য আর সব জাতিকে হতে হবে তাদের আজ্ঞাধীন। নাৎসিরা জার্মানিতে আরম্ভ করেছিল ইহুদি নিধন। হিন্দুত্ব আর আর্য প্রভুজাতির ধারণা এই উপমহাদেশের মুসলিম মনে সৃষ্টি করে খুবই বিরূপ প্রতিক্রিয়া। লক্ষ করবার বিষয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চলাকালীন সময়ে ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগ গ্রহণ করে পাকিস্তান প্রস্তাব। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায় পাকিস্তান। পাকিস্তান আন্দোলনটা ঠিক মুসলিম ধর্মভিত্তিক কোন আন্দোলন ছিল না। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করেননি কোন মুসলিম মাওলানা। এর সব নেতাই ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত। এর গোড়ায় ছিল এই উপমহাদেশের মুসলমানরা একটি পৃথক জাতি, এই ধারণা। যে ধারণার উদ্ভব হতে পেরেছিল ব্রিটিশ ভারতের বিশেষ রাজনৈতিক পরিবেশে। হিন্দু মহাসভার চাইতে ভারতে দল হিসাবে কংগ্রেস ছিল অনেক শক্তিশালী। কিন্তু কংগ্রেসের উপরও পড়েছিল হিন্দুত্বের প্রভাব। মুসলমানরা সাধারণ ভাবে কংগ্রেসে যোগ না দিয়ে যোগ দেয় মুসলিম লীগে। ব্রিটিশরাজ ভারতে দল হিসাবে মুসলিম লীগকেই মেনেছে মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে। ১৯৪৭-এর আগে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা নেয় ভয়াবহ রূপ। কংগ্রেস নেতারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে মেনে নেন, হিন্দু-মুসলিম দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ এড়াবার যুক্তি দেখিয়ে। তাঁদের এই সিদ্ধান্ত কতটা সঙ্গত হয়েছিল সেটা এখনও হয়ে আছে বিতর্কের বিষয়। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে জনাব জিন্নাহ ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশনের গ্রুপিং এর প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন। কংগ্রেস নেতারা গ্রুপিং মানলে এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস অনেক ভিন্ন হতেই পারতো। তবে সেটা হয়নি। পাকিস্তান হয়েছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর সাবেক পাকিস্তানে এই মুসলিম জাতীয়তাবাদ দ্রুত ক্ষয় পেতে থাকে। সাবেক পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ছিল ১৭০০ কিলোমিটারের ভৌগোলিক ব্যবধান। এ ছাড়া এই দুই অংশের মধ্যে ছিল ভাষা ও মানব ধারারও পার্থক্য। সর্বোপরি পাকিস্তানে গণতন্ত্র হয়ে পড়ে অকার্যকর। গণতন্ত্রের পরিবর্তে আসে সেনাশাসন। সেনাবাহিনীতে বাংলাভাষী মুসলমান ছিল না বললেই হয়। পরে সেনাবাহিনীতে তারা কিছু কিছু যোগ দিতে আরম্ভ করে। কিন্তু সেনা শাসন সাবেক পাকিস্তানে সৃষ্টি করে পাঞ্জাবি প্রাধান্য। যা সাবেক পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে জন্ম দেয় গুরুতর রাজনৈতিক বিরোধ। এক পর্যায়ে এই বিরোধ ভেঙে পড়ে সাবেক পাকিস্তান। সৃষ্টি হয় আজকের বাংলাদেশের। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশকে বুঝতে হলে পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাসকে বাদ দেওয়া যায় না। তার কথা বিশেষ ভাবেই মনে রাখতে হয়। বর্তমান বাংলাদেশের সীমানা চিহ্নিত হতে পেরেছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হবারই জন্যে। আর বাংলাদেশের মানুষ এখন এই সীমানাকেই মেনে নিয়েছে নিজেদের দেশের সীমানা হিসাবে। বাংলাদেশের জাতিসত্তা সুগঠিত হতে চাচ্ছে এই ভৌগোলিক সীমানার মধ্যেই। এর বাইরে যেয়ে নয়। জাতীয়তাবাদ শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় একটা মানসিক ঘটনা। এক রকম জাতীয়তাবাদকে বলা যেতে পারে আগ্রাসী (Aggressive)। আর এক প্রকার জাতীয়তাবাদকে বলা যেতে পারে আত্মরক্ষামূলক (Defensive)। আমাদের জাতীয়তাবাদ হলো আত্মরক্ষামূলক। বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এখন হিন্দুত্বকে নির্ভর করে হতে যাচ্ছে প্রচণ্ড আগ্রাসী। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে তাই ভারতের এই আগ্রাসী জাতীয়তাবাদকে নিতে হবে বিশেষ বিবেচনায়। লেখক : বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির