post

আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিশ্বায়নের আগ্রাসন

সাকী মাহবুব

১৫ জুন ২০১৮
আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত একটি শোগান হলো বিশ্বায়ন। এ শোগানের প্রধান ধারক ও বাহক কথিত একক সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তার সাথে আছে পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশগুলো। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের পর পুঁজিবাদী বিশ্ব নতুন শোগান নিয়ে মাঠে নামে। এর উদ্দেশ্য তাদের স্বার্থের বৈধতা দান করা, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির অভূতপূূর্ব বিকাশের মাধ্যমে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে প্রচণ্ড গতিদান করা। বিশ্বায়ন পুঁজিবাদী বিশ্বের বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার। তারা চায় তাদের মূল্যবোধ দ্বারাই সবাই পরিচালিত হোক, স্ব স্ব জাতি নিজেদের মূল্যবোধের দ্বারা চলবে এটা তারা মানতে রাজি নয়। তাদের চোখ দিয়ে সবাইকে দেখতে হবে। পুরো দুনিয়া মার্কিন চিন্তায় চলুক এটাই তাদের চেষ্টা। তারা চায় পৃথিবীর সবাই তাদের ভাষায় কথা বলুক এবং তাদের আচরণ গ্রহণ করুক। বিশ্বায়নের আড়ালে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়। বিশ্বায়নের নামে তারা তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্তৃত্বকে নিশ্চিত করতে চায়। বিশ্বায়ন আজ পুঁজিবাদী শোষণের হাতিয়ার। বিভিন্ন জাতির সভ্যতা সংস্কৃতি ও স্বাতন্ত্র্যকে নিশ্চিহ্ন করা বিশ্বায়নের লক্ষ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পাশ্চাত্যের একক আধিপত্য বিস্তার করাই বিশ্বায়নের উদ্দেশ্য। পৃথিবীর ছোট ও দুর্বল দেশগুলো যাতে কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, বিশ্বায়নের নামে সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিশ্বায়নের লক্ষ্য এক সংস্কৃতি এক অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণে বিশ্বকে নিয়ে আসা, আর সে সংস্কৃতি ও অর্থনীতি হচ্ছে মার্কিন সংস্কৃতি ও অর্থনীতি। বিশ্বায়নের নামে আমেরিকা চায় এককেন্দ্রিক বিশ্ব, যার মূলকেন্দ্র হবে আমেরিকা। বিশ্বায়নের অশুভ প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্র আজ শঙ্কিত। বিভিন্ন দেশের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। পৃথিবীর অনেক ক্ষুদ্র জাতি তাদের নিজস্ব ভাষা ও জাতি সত্তা হারিয়ে ফেলেছে। আমাদের নিজেদের ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতির ওপরও বিশ্বায়নের প্রভাব সুস্পষ্ট। তাই বিশ্বের দিকে দিকে আজ বিশ্বায়ন নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমরা ‘আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিশ্বায়নের আগ্রাসন ’ নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআলাহ। বিশ্বায়ন কী? বিশ্বায়নের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Globalizatio যা Globe শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ কোন বিষয়কে ব্যাপক করা এবং তার সীমারেখা বিস্তৃত করা new collegiate Dictionary তে অর্থ এভাবে দেয়া আছে- কোন বিষয়কে আন্তর্জাতিকতার পোশাক পরানো, কোন বস্তুর সীমারেখা আন্তর্জাতিকতা বানানো। সাধারণভাবে বলা যায়, বিশ্বায়ন হলো একটি প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর মাঝে সমন্বয় সাধন হয়ে থাকে অথবা বিশ্বকে একীভূত করা হয়। বিশ্বায়নের যথাযথ সংজ্ঞা দেয়া বেশ মুশকিল। একেক জনের কাছে বিশ্বায়নের একেক অর্থ, ব্যাপক অর্থে বিশ্বায়ন বলতে বিভিন্ন দেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রে একত্রিত হওয়ার তীব্র প্রবণতাকে বোঝায়। অন্য অর্থে বিশ্বায়ন বলা যায়, যার মাধ্যমে পণ্য পরিবহন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোনো সীমারেখা থাকবে না। পুঁজির সরবরাহ ও প্রবাহ অবাধ থাকবে। তবে বিশ্বায়ন ধারণাটি শুধু অর্থনীতি সংশিষ্ট নয়। অনেকে বিশ্বায়নকে অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত করে বিশেষণ করে দেখাতে চেষ্টা করেন। আমাদের কাছে এ বিশেষণকে যথার্থ মনে হয়নি। কারণ বিশ্বায়নের সাথে অর্থনীতি বহির্ভুক্ত অনেক প্রক্রিয়াও জড়িত। বিশ্বায়নের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন’ তথা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বিশ্বায়নের সংজ্ঞা অনেকটা এভাবে করে বিশ্বায়ন বিশ্বের সকল দেশের মাঝে সেই অর্থনৈতিক সহযোগিতার নাম, যা প্রোডাক্ট ও সার্ভিসের বিনিময়ে বৃদ্ধির কারণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং এর ফলে সে সকল দেশের পুঁজিও মূলধনে ও প্রবৃদ্ধি হয়। সেই সাথে বিশ্বের প্রতিটি কোণে অতিদ্রুত টেকনোলজির বিকাশ হয়। এটি এমনই এক আন্দোলন যার উদ্দেশ্য কাস্টম ও ভৌগোলিক সীমারেখা তুলে দিয়ে সমগ্র বিশ্বকে এক ও অভিন্ন বাজারে পরিণত করা। বিশ্ব বাণিজ্য ইনসাইক্লোপিডিয়া বিশ্বায়নের সংজ্ঞায় লিখেছে, ‘বিশ্ব সভ্যতার প্রসার এবং ব্যাপকতা দান করার একটি পথ নির্দেশক বা রোড ম্যাপ। ড: মোস্তফা আন নাশশার বলেন, বিশ্বায়নের উদ্দেশ্য কখনই বিভিন্ন সভ্যতা সংস্কৃতিকে একে অপরের নিকটবর্তী করা নয়, বরং এর উদ্দেশ্য সকল আঞ্চলিক ও জাতীয় তাহজিব তমদ্দুনকে বিলুপ্ত করে তাবৎ দুনিয়াকে আমেরিকার রঙে রঙিন করা। ড. আব্দুল ওয়াহাব আল মুসিরী বলেন, বিশ্বায়ন পাশ্চাত্যের উজ্জ্বল চিন্তাধারার দাওয়াত ও আন্দোলনের নাম, যার উদ্দেশ্য সাংস্কৃতিক ও মানবীয় বৈশিষ্ট্য চির নির্মূল করা। ড: সাদেক জালালুল আযম বিশ্বায়নের সংজ্ঞা এভাবে করেন, বিশ্বায়ন বিশ্বকে একটি কেন্দ্রীয় দেশ তথা আমেরিকার রঙে রঙিন করার নাম। কেউ কেউ মনে করেন, বিশ্বায়ন আমেরিকান সভ্যতা সংস্কৃতি ও সেখানকার জীবনপদ্ধতি গোটা দুনিয়ার ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রয়াসের নাম। এটি এমনই এক মতবাদ যা সমগ্র বিশ্বের ওপর পরোক্ষভাবে ক্ষমতা ও আধিপত্যের অবিকল প্রতিচ্ছবি। কারো কারো মত, বিশ্বায়ন হলো সারা বিশ্বকে এককেন্দ্র থেকে শাসন করার নতুন অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কৌশল। বিশ্বায়নের বর্তমান রূপ বর্তমানে যে বিশ্বায়নের কথা বলা হচ্ছে তা মূলত পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের উপনিবেশবাদী চেহারা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর মাধ্যমে সম্পদশালী দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের ওপর অর্থনৈতিক নয়া উপনিবেশবাদ প্রতিষ্ঠা করে পুঁজিবাদের হাতকে শক্তিশালী করতে চায়। সুতরাং পুঁজিবাদের তথাকথিত বিশ্বায়ন থেকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর চাওয়া পাওয়ার কিছুই নেই। এ কথাটি অর্থনীতির বেলায় যেমন প্রয়োজন, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও ঠিক একই রকম। সংস্কৃতি কী সংস্কৃতি শব্দটি সংস্করণ বা সংস্কার বিশেষ্য পদ থেকে গঠিত। সংস্কার অর্থ শুদ্ধিকরণ। সংস্কৃতি শব্দের অর্থ হচ্ছে শিক্ষা দ্বারা লব্ধ বিদ্যা বুদ্ধি, শিল্পকলা, রুচি তমদ্দুন, মার্জনা, শিষ্টতা, সংস্কার, বিশোধন, শুদ্ধিকরণ। পরিশীলিত, মার্জিত, সজ্জিত, উন্নত, রুচি সমৃদ্ধ জীবনবোধ ও জীবনাচারকে সংস্কৃতি বলা হয়। সংস্কৃতি হল মানুষের জীবন প্রণালী, যা মানুষের আচার আচরণকে পরিশীলিত করে। মানুষের আনন্দকে অবিনাশী করে তোলার সাধনাই হল সংস্কৃতি। প্রখ্যাত সাহিত্যিক মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেন, সংস্কৃতি মানে সুুন্দরভাবে বিচিত্র ভাবে বাঁচা। শওকত ওসমান বলেন, ‘সংস্কৃতি জীবনকে মোকাবিলার চেতনা।’ সুতরাং এককথায় বলা যায়, সংস্কৃতি হলো চলমান জীবনের দর্পণ। অর্থাৎ মানুষের দৈনন্দিন জীবন প্রণালীর গ্রহণযোগ্য চর্চা বা প্রথা যা কোনো সমাজের মানুষের পরিচয় বহন করে। আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিশ্বায়নের আগ্রাসন প্রখ্যাত লেখক ইয়াসির নাদীম তার ‘বিশ্বায়ন : সাম্রাজ্যবাদের নতুন স্ট্র্যাটেজি’ নামক বইয়ের মধ্যে উলেখ করেছেন, বিশ্বায়ন যেমনিভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে নিজেকে বাস্তবায়ন করতে চায় তেমনি ভাবে সভ্যতা সংস্কৃতিকেও স্বীয় ছাঁচে ঢালাই করতে চায়। রাজনীতি ও অর্থনীতির পরে এখন তার উদ্দেশ্য সংস্কৃতিকেও বিশ্বায়ন করা এবং গোটা বিশ্বে একই ধরনের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বায়নের সবচেয়ে ভয়াবহ ও বিপজ্জনক বিভাগই হলো সংস্কৃতি। বিশ্বায়ন আমাদের সাহিত্য সংস্কৃেিতও এমনভাবে আঘাত করেছে যে, এর প্রতিরোধহীন অবিরাম স্রোতে আমাদের দেশীয় সাহিত্য সংস্কৃতির নাভিশ্বাস উঠেছে। পশ্চিমা চটকদার সাহিত্য সংস্কৃতি আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মূলে কুঠারাঘাত করেছে। ফলে আমরা আমাদের স্বকীয়তা হারিয়ে ক্রমেই সাংস্কৃতিক দৈন্যের দিকে দিনে দিনে এগিয়ে যাচ্ছি। ফলে এর প্রভাব পড়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। নিম্নে আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিশ্বায়নের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হলো। সাহিত্যে বিশ্বায়নের প্রভাব আমাদের সাহিত্যে ও বিশ্বায়নের আগ্রাসনের মিসাইল এসে আমাদের সাহিত্যের আদর্শকে চুরমার করে দিচ্ছে। যেমন- প্রয়াত শব্দটি আজকাল যত্রতত্র ব্যবহার হচ্ছে। মৃত ব্যক্তিকে প্রয়াত বলার প্রচলন আছে, কিন্তু কাদের মধ্যে? প্রয়াত মানে প্রস্থান করা বা চলে যাওয়া। সবকিছু শেষ হয়ে যায়, মরণের পর মানুষ চিরতরে চলে যায়- এ কথা মুসলমান বিশ্বাস করে না। মুসলমানরা পরলোকে বিশ্বাস করে। মৃত্যুর পরই অনন্ত জীবনের শুরু। সুতরাং একজন মুসলমান প্রয়াত হয় না, সে ইন্তেকাল করে অর্থাৎ রূপান্তিত হয়। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘স্নাতক’ এবং স্নাতকোত্তর কথা দুটো বহুল প্রচারিত। গ্র্যাজুয়েটদের ‘স্নাতক’ এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েটদের স্নাতকোত্তর বলে আমরা সম্বোধন করছি। স্নাত শব্দের আভিধানিক অর্থ স্নান করিয়াছে এমন। আর্যযুগে ছাত্ররা গুরুর আশ্রমে থেকে লেখাপড়া করত এবং শিক্ষা শেষ হলে গুরু শিষ্যটিকে ব্রহ্মণচর্য্য সমাপ্তি সূচক স্নান করিয়ে গলায় পৈতা পরিয়ে শিক্ষা সমাপনের স্বীকৃতি দিতেন। শিক্ষা শেষে স্নান এবং পৈতা পর্বটি অনুষ্ঠিত হত বলে এর নামকরণ করা হয়েছিল স্নাতকোত্তর। বাংলা ভাষার স্রষ্টা এবং বাংলাসাহিত্যের জনক মুসলমানরা হলেও রাজনৈতিক চক্রান্তের ফলে সে ভাষা মুসলমানদের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। আজ আমরা স্বাধীন হয়েছি, ভাষার জন্য রক্ত ঝরিয়েছি কিন্তু আজও ভাষাকে মুক্ত করতে পারিনি। আজও আমরা কলকাতার দাদা বাবুদের ভাষায় কথা বলছি। আমাদের লেখক সাহিত্যিকরা খাওয়া ভুলে আহার করছেন। পরা ভুলে ‘পরিধান’, করছেন। কলম ভুলে ‘লেখনী’ তুলে নিচ্ছেন। তাদের লেখনীতে আজ তাজ হচ্ছে ‘মুকুট’ ঘোড়সওয়ার হচ্ছে 'অশ্বারোহী, গোশত হচ্ছে মাংস, পানি হচ্ছে জল, খুন হচ্ছে লহু, খানা ভুলে গিয়ে : আহার, গোসল ভুলে গিয়ে ‘স্নানে’ আনন্দ পাচ্ছেন। এ যেন ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।’ অবস্থা আজও আমাদের সাহিত্যে, চিন্তায়, চরিত্রে, উপমায় রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, উপনিষদের সুরই ঝংকৃত হয়। অফুরন্ত জ্ঞান ও শক্তির উৎস মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় আল কুরআন ও হাদিস বা মুসলিম ইতিহাসের প্রেরণা শক্তি, মুসলিম ঐতিহ্যের শব্দ চয়ন আমাদের ভাষা সমৃদ্ধ, সাহিত্যকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করতে পারেনি। বিদ্যাসাগরের উত্তরসূরি আমাদের ভাষাবিদগণ পরিভাষা নির্ণয়ে এখনো সংস্কৃতির অভিধান তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছেন । তাদের গবেষণায় ‘চ্যান্সেলর’ হয়েছেন দেবপূজক পুরোহিতের আধার আচার্য। ম্যানেজার হয়েছেন কর্মাধ্যক্ষ, আইন সভা হয়েছে বিধানসভা। কবি মুকুন্দরাম বা সত্যেনদত্ত রাজাকে রাষ্ট্রপতি বলেছেন। সুতরাং আমরাও প্রেসিডেন্টকে রাজ্যপতি বা রাষ্ট্রপতি বলছি। ভাইস চ্যান্সেলর যখন উপাচার্য হয়েছেন, তখন প্রভোস্ট হয়তো অচিরেই প্রকোষ্ঠ ভট্টাচার্য হবেন এমনটা আশা করা অমূলক নয়। আমাদের তরুণরা মায়ের ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল কিন্তু আমাদের ভাষাবিদরা পশ্চিমবঙ্গের বাংলার অন্ধ অনুকরণে মত্ত হয়ে নিজের মাটির ভাষাকে জলাঞ্জলি দিতে দ্বিধা করছে না। বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে। আজও যদি আমরা ভাষা সাহিত্যের ব্যাপারে সতর্ক না হই, তাহলে আমাদের ব্যক্তিত্ব, স্বকীয়তা ও আত্মা বিজাতীয় ধর্ম-কালচারের হাতে বাঁধা পড়ে জাতীয় স্বকীয়তা খুইয়ে ফেলবে। সুতরাং আজ চাই দৃষ্টির স্বচ্ছতা, চিন্তার সবলতা, স্বাধীন চিত্তবৃত্তির বিকাশ, অতীতের সব ভুল শুধরে এগিয়ে চলার দৃঢ় সংকল্প। চাই স্বাধীন জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার , নতুন পথে পা বাড়াবার সাহস। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল বলছেন- ‘খালেদ! খালেদ! ফজর হয়েছে আযান দিতেছে কওম ঐ শোন, শোন, আসসালাতু খায়রুম মিনান্নাওম।’ সাত সাগরের মাঝি ফররুখও আমাদের স্বপ্ন দেখায়- ‘ভেঙ্গে ফেল আজ খাকের মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙ্গছে বালুর বাঁধ। ছিঁড়ে ফেলো আজ আয়েশি রাতের মখমল অবসাদ নতুন পানিতে হাল খুলে দাও হে মাঝি সিন্দাবাদ। ’ চলচ্চিত্রের ওপর প্রভাব : বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বিনোদন ও প্রচারের জন্য চলচ্চিত্র বা সিনেমা একটি শক্তিশালী মাধ্যম। সকল শ্রেণির মানুষের কাছে বার্তা পাঠানোর জন্য এর চাইতে ভালো কোনো মাধ্যম নেই। মানুষ পড়ে শেখার চাইতে অনেক বেশি শিখতে পারে দেখে আর শুনে। এ বিষয়টা বোঝা যায় চলচ্চিত্রে। সিনেমার একটি মাত্র চরিত্র হয়ে উঠতে পারে একটি বিপব সৃষ্টির আহবান। একটি সিনেমা কোনো জাতিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে পারে বা কোনো মহান উদ্দেশ্য নিয়ে কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানাতে পারে। কিন্তু আমাদের সিনেমা তা কি করতে পারছে? বরং দিনে দিনে বিদেশী সিনেমার প্রভাব পড়ছে আমাদের সিনেমার ওপর। সিনেমায় এখন স্বল্পা বসনা নারীদের পদচারণা খুব বেশি। শিল্পের ছোঁয়া নেই এসব অভিনয়ে। সিনেমায় আজ কে কার চেয়ে বেশি নগ্ন হতে পারে? কে কার চেয়ে বেশি যুবসমাজকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে পারে? তার অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। বিদেশী সিনেমার প্রভাবে মেল গিবস, জন ট্র্যাভোল্টা পিয়ারসন ব্রসনন, দেব, জিৎ প্রসেনজিৎ, ক্যাটোরিনা কাইফ, কাজল, ঐশ্বরিয়া মুসলমান তরুণদের অনুকরণেরর পাত্রে পরিণত হয়েছেন। এদের পোশাক, কথাবার্তা, চলাফেরা নায়কোচিত কাজ করার প্রচেষ্টা এদেশের মুসলমান তরুণদের মাঝে যথেষ্ট পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে আমাদের দেশের অনেক তরুণকে দেখা গেছে বলিউডের নায়ক অমিতাভ বচ্চন, জিৎ, ওদেবের চুলের স্টাইল, পোশাকের স্টাইল, অনুকরণ করতে। জেমস বন্ড সিরিজের ছবিগুলোতে নায়কের ব্যবহৃত বিশেষ ব্র্যান্ডের চশমা, ব্রাসলেট, ঘড়ি স্বাভাবিকভাবেই ক্রেতাদের বেশি উৎসাহিত করছে। বিদেশী ছবিগুলোতে ইসলামের ঐতিহাসিক বীরদেরকে বিশ্বের কাছে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। সম্প্রতি হলিউড থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ছবি ব্যাক হাউক ডাউন যেখানে সোমালিয়ায় মার্কিন বাহিনীর সেনাদের বীররূপে চিত্রিত করা হয়েছে। যে সমস্ত মুসলমান ইতিহাস সচেতন নয় তারা সহজেই এ মগজ ধোলাইয়ের প্রক্রিয়ায় আক্রান্ত। বিদেশী ছবির অনুকরণে কোমলমতি শিশুরা বাবা মাকে বাংলা ভাষায় সম্বোধন না করে বিদেশী ভাষায় পাপা, মাম্মী, মাম ডাকতে আগ্রহী হয় উঠছে। কথায় কথায় তারা বাংলার চেয়ে হিন্দি ডায়ালগ মুখে আওড়াতে বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এভাবে বিশ্বায়নের ছলচাতুরতায় বিদেশী ছবিগুলো আমাদের সোনার পেয়ালায় বিষ পান করাচ্ছে। পোশাক পরিচ্ছদের ওপর প্রভাব : প্রতিটি জাতির নির্ধারিত লেবাস পোশাক তার সভ্যতা সংস্কৃতির দর্পণ। পোশাক দ্বারাই জাতির ইতিহাস উন্মোচিত হয় এবং তার আচার আচরণ সম্পর্কে জানা যায়। এটিই কৃষ্টির প্রাণ ও সংস্কৃতিরর বুনিয়াদ। পোশাক পরিচ্ছদে আমাদের নিজস্ব একটা ঐতিহ্য ছিল। কিন্তু সংস্কৃতির বিশ্বায়নের প্রভাবে আমাদের পোশাকে চাল চলন ভিনদেশী জ্বর পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশ্বায়নের প্রভাবে আমাদের বাজার, দোকান পাট, বিপণিবিতানগুলো এখন ইউরোপীয় পোশাকে সয়লাব হয়ে গেছে। আপনার হাত ঘড়িটার দিকে তাকান সেটি হলো জাপানি সিকো বা ক্যাসিও কোম্পানির। পায়ের জুতাটা আমেরিকান ‘নাইক’ কিংবা ‘বাটার’ বানানো, পরনে জিন্সের ট্রাউজার সেটি ব্রাজিল কিংবা মেক্সিকোর জিন্স দিয়ে তৈরি। গায়ের টি শার্টটি নিদেন পক্ষে থাইল্যান্ডের। যে মোটরসাইকেলে চড়ে আমাদের রোমিওরা সারাদিন বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজ গেটে জুলিয়েটের সন্ধানে দাঁড়িয়ে থাকে তাড়া করে ফেরে তাদের এক ভয়াল বিকৃত পাশবিক উলাসে। সেই মোটরসাইকেলটি জাপান নয়তো নিদেনপক্ষে ভারতীয় কোনো কোম্পানির তৈরি। হাতের মোবাইল ফোনটি জাপান নয়তো সুইডেন কিংবা অন্য কোন দেশের। মাথার ক্যাপটির গায়ে লেখা নিউইর্য়কের নাম। চোখের সান গাসটি সিঙ্গাপুর, নয়তো চীন কিংবা ইংল্যান্ডের। পরনের স্যুটটিও ওই ইংল্যান্ডের নামিদামি কাপড় দিয়ে বানানো। (অন্তর মম বিকশিত কর /জিয়াউল হক) আমরা যে পোশাকগুলো পরছি তার ওপর যৌন সুড়সুড়িমূলক বিভিন্ন ইংরেজি বাক্য লেখা থাকে। উদাহরণস্বরূপ : (kiss me) আমাকে চুমু দাও (take me), আমাকে ধর, (Ism Jewish) আমি ইহুদি, (prostitute) পতিতা নারী, (Adultery) ব্যভিচার এবং (Zion) জায়নবাদী ইত্যাদির মতো অসভ্য, অমার্জিত ও চরিত্র বিধংবসী শব্দ ও বাক্য সে সমস্ত পোশাকের ওপর লিপিবদ্ধ থাকে, যার একমাত্র উদ্দেশ্য পাশ্চাত্য সভ্যতার বিস্তার ঘটানো। যার মূলভিত্তি নগ্নতা, উলঙ্গপনা ও অশান্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিদেশী সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার চর্চা আমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিচ্ছদে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। জিন্স, টি শার্ট, স্কার্ট এখন আমাদের ছেলেমেয়েদের খুবই প্রিয়। শাড়ি, লুঙ্গি, কিংবা পাজামা পাঞ্জাবি এখন আর তাদের তেমন প্রিয় নয়। এমনকি পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের ফলে তারা একদিকে যেমন আধুনিক জীবনের অচিন পাখিকে ধরতে পারে না, তেমনি দেশীয় সংস্কৃতির সাথেও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে তারা একটি দোদুল্যমান অবস্থায় পতিত হয় এবং অবশেষে হয়ে পড়ে লক্ষ্যহীন ও হতাশাপূর্ণ। ফাস্ট ফুড : প্রখ্যাত লেখক ইয়াসির নাদীম তার ‘বিশ্বায়ন : সাম্রাজ্যবাদের নতুন স্ট্র্যাটেজি’ নামক বইয়ে লিখেছেন- আমেরিকা শুধু তার লেবাস পোশাকই পুরো বিশ্বে প্রসার করেনি, বরং তার সাথে সাথে মার্কিন খাদ্য পানীয়কেও গোটা পৃথিবীতে ব্যাপক করেছে। সাংস্কৃতিক সয়লাবের ফলে কিছু অসুস্বাদু খাবার ও ফ্যাশন ও উন্নতির নিদের্শন হয়ে যায়, যেগুলোকে ফাস্ট ফুড নাম দেয়া হয়েছে। হটডগ, হ্যামবার্গার, পিজা, লোকদের প্রিয় খাবারে পরিণত হয়েছে। মার্কিন কালচারের প্রতিনিধিত্বকারী ম্যাকডোনাল্ড, বার্গার কিং ও পিজাহাট নামক রেস্টুরেন্ট প্রতিটি দেশ ও শহরে ছেয়ে গেছে। এ সমস্ত রেস্টুরেন্টে লোকদের উপচে পড়া ভিড় থাকে। খাদ্য ও পানীয় সংস্কৃতিতে পুরো বিশ্বে বিস্তার ঘটানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সচেতনতা কতটুকু তার অনুমান সহজেই করা যেতে পারে। মার্কিন সংস্কৃতির দ্বিতীয় প্রতিনিধিত্বকারী প্রসিদ্ধ পানীয় কোকাকোলা ও পেপসি দেশের আনাচে কানাচে বিক্রি হচ্ছে। মার্কিন সভ্যতা ও সংস্কৃতির এই নিদর্শনকে লোকজন একটি সাধারণ পানীয় মনে করে পান করছে। ধর্মীয় জীবন বোধ ও নৈতিক শিক্ষার ওপর প্রভাব : বিদেশী সংস্কৃতি আমাদের জীবনে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে চরমভাবে আঘাত করেছে, সেটি হলো আমাদের ধর্মীয় জীবনবোধ ও নৈতিক শিক্ষা। পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতির ব্যাপক প্রচারের ফলে আমাদের ধর্মনিষ্ঠা এবং নৈতিকতা বোধ আহত হচ্ছে নিঃসন্দেহে। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, অবাধ যৌনাচার আর অ্যালকোহলিক সংস্কৃতি বিশেষ করে ইসলামী সংস্কৃতির বিরোধী। অথচ সুখী সুুন্দর ও শান্তিময় জীবনের জন্য এসব কিছুর চেয়ে ধর্মীয় জীবনের প্রয়োজনীয় অনুসরণ খুবই জরুরি। বিদেশী সংস্কৃতির প্রাবল্য আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। খাদ্যাভ্যাসের ওপর প্রভাব: বিশ্বায়নের সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। খাবারের পুষ্টিমান বিবেচনা না করে টেলিভিশন চ্যানেলে খাবারের বিজ্ঞাপন প্রচারে আমাদের নতুন প্রজন্ম আগ্রহী হচ্ছে। এমনকি বড়দের ক্ষেত্রেও আত্মীয়স্বজন বেড়াতে এলে রকমারি পিঠা-পায়েস, গুড়-মুড়ির পরিবর্তে নুডুলস, চিপস বা বিজাতীয় সংস্কৃতির কোন খাদ্য উপাদান দিয়ে আপ্যায়ন করা হচ্ছে। উৎসবের উপর প্রভাব: আমাদের সংস্কৃতির উপর আর এক ভয়ঙ্কর থাবা পড়ছে যা গ্রাস করেছে সম্ভাবনাময় তারুণ্যকে। থার্টি ফার্স্ট নাইট, ভ্যালেন্টাইন ডে, এপ্রিল ফুল প্রভৃতি বিজাতীয় সংস্কৃতি তরুণ-তরুণীদের গ্রাস করেছে, তাদের সুকুমার বৃত্তিকে করছে কলুষিত। বাঙালির পয়লা বৈশাখ, পয়লা ফাল্গুন তরুণ তরুণীদের এতটা আলোড়িত করতে পারছে না। ভাষার ওপর প্রভাব : সংস্কৃতির বিশ্বায়ন আমাদের ভাষার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে ভুলতে বসেছি আমরা। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু সবক্ষেত্রে ইংরেজির প্রাধান্য গ্রহণযোগ্য নয়। সংস্কৃতির বিশ্বায়নের ফলে আমাদের মধ্যে ইংরেজির ওপর অতি নির্ভরতা গড়ে উঠেছে। ইন্টারনেটে বাড়ছে অশীলতা: বিশ্বায়নের সবচেয়ে বড় যন্ত্র ইন্টারনেট। ইন্টারনেট অশীলতা, নগ্নতা ও উলঙ্গপনার সবচেয়ে বেশি বিস্তারকারী হাতিয়ার। কম্পিউটারেরর স্ক্রিনের সামনে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক খুলে নিয়ে শুধু একটি ক্লিকে ইন্টারনেট সরবরাহকৃত নগ্ন ও উলঙ্গ কুরুচিপূর্ণ ছবির ফাইল চলে আসে, যা মানুষের লজ্জা শরমকে সম্পূর্ণ নির্মূল করে দেয়। ইন্টারনেটে লাখ লাখ এমন ওয়েব সাইট রয়েছে যার মাধ্যমে উলঙ্গ ছবি, নগ্ন প্রোগ্রাম, নীল ছবি ও অশীলতার পাবন সৃষ্টিকারী ফিল্মসমূহ নির্লজ্জভাবে প্রদর্শন করা হয়। অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ : বিশ্বায়নের ফলে আমাদের সংস্কৃতিতে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। অপসংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অবক্ষয় ঘটছে। পশ্চিমা বিশ্বের সংস্কৃতির এমন কিছু উপাদান আছে যা আমাদের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এতে করে আমাদের সংস্কৃতিতে অশীলতার প্রবেশ করছে। ডিজুস জেনারেশন : চেতনা শক্তির ঘাটতি : সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারেরর লক্ষে যৌন সুড়সুড়ি মার্কা আহবান নিয়ে হিন্দি এসে আমাদের ঘর ও মনে দখলদারিত্ব কায়েম করেছ বিশেষ করে তরুণ তরুণীদের মাঝে। ইন্ডিয়ান টিভি সিরিয়ালগুলো মূলত চারিত্রিক অধঃপতন আর পণ্যের বিজ্ঞাপন ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের সন্তানরা মজে যাচ্ছে ক্লোজআপ ওয়ানে, লাক্স চ্যানেল আই সুন্দরী প্রতিযোগিতায়, কিংবা ডিজুস উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খল উলাসে। এ যুবসমাজ মঞ্চে উঠে গান গায়- ‘সূূর্যোদয়ে তুমি / সূর্যাস্তেও তুমি / ও আমার বাংলাদেশ / প্রিয় জন্মভূমি।’ (কথা: মোহাম্মাদ মনিরুজ্জামান) কিংবা ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে / ভরে আছে সারা মন / শ্যামল কোমল পরশ ছাড়া যে / নেই কিছু প্রয়োজন।’ অথবা উদাস কণ্ঠে সুর তোলে ‘আমি বাংলায় গান গাই’ / আর মোবাইল ফোন বা গচ৩, গচ৪ এ বেজে ওঠে ইন্ডিয়ান হিন্দী গানের মন মাতানো গান ‘আশিক বানায়া অথবা ধুম্মা চলে ধুম্মা চলে ধুম্মা চলেরে।’ আমাদের করণীয় বর্তমানে পৃথিবীর বাসিন্দা হিসেবে বিশ্ব সাম্রাজ্যের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় আমাদের নেই। তাই এর মধ্যে থেকেই নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আর স্বার্থকে বাঁচিয়ে রেখে চলতে হবে আর জটিল এ বিশ্বব্যবস্থায় চলতে হলে আমাদের আরো বেশি কুশলী হতে হবে। সেজন্য- -বিদেশী সংস্কৃতির দরজা বন্ধ করে নিজেদেরকে আরো বেশি প্রতিযোগিতার উপযোগী করে তুলতে হবে। -দেশীয় সংস্কৃতিকে লালন আর বিদেশী সংস্কৃতির মোকাবেলায় টিকে থাকার জন্য দেশীয় সংস্কৃতিকে যুগপোযোগী করে তুলতে হবে। -বিদেশী সংস্কৃতির অনুসরণ ও অনুকরণের ক্ষেত্রে আরো বেশি সজাগ হতে হবে। -আমাদের সংস্কৃতিকে বিশ্বের সমগ্র প্রান্তে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য স্যাটেলাইট চ্যানেলের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ অনুষ্ঠান সম্প্রচারে আরো বৈচিত্র্য আনয়ন করতে হবে। -বিজাতীয় কুরুচিপূর্ণ সংস্কৃতি বন্ধের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। -বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রকাশই আভিজাত্যের পরিচায়ক তরুণদের এ ভ্রান্ত ধারণা ঘোচাতে হবে। -সংস্কৃতি রক্ষার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বৃদ্ধি করতে হবে। আলোচনার বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে একথা উচ্চারণ করতে পারি যে, বিশ্বায়নের এ বিশ্বব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অর্থ হলো নিজেকে সভ্যতা থেকে আলাদা করে রাখা। এটা কোনো জাতির জন্যই সুখকর নয়। এখন প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি নিজস্ব সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করেই বিশ্বব্যবস্থার সাথে তাল মিলাতে হবে? তাই যদি হয়, তাহলে এটাও অস্তিত্বের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি। কেননা, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো অর্থনৈতিক সঙ্কট ও রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার সুযোগ উন্নত দেশগুলো অনেক আগেই গ্রহণ করেছে। এবার তাদের সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পালা। সুতরাং তাদের উপেক্ষা করা অসম্ভব হলেও নিজের অস্তিত্বের খাতিরে, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা বজায় রাখার ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। তথ্যসূত্র : বিশ্বায়ন : সাম্রাজ্যবাদের নতুন স্ট্র্র্যাটেজি : ইয়াসির নাদীম। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও প্রতিরোধ : আরিফুল হক অন্তর মম বিকশিত করো : জিয়াউল হক সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ইসলামী সংস্কৃতি ও অন্যান্য অনুষঙ্গ : ড: শাহ মুহাম্মদ আবদুর রাহীম ও ড: মো: আমির হোসেন সরকার নির্বাচিত গানের সংকলন, সাম্যের গান, সসাস সোনার বাংলাদেশ বগ। বিশ্বায়ন ও অন্যান্য : আবুযর রেজওয়ান। ইন্টারনেটের ধ্বংস লীলা : মাওলানা মাহমুদুল হাসান। লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির