post

আল

মাশুক আহমদ

১৩ জুন ২০২২
মরুভূমিতে পথহারা তৃষ্ণার্ত পথিকের স্বপ্ন যেমন ছায়াময় উপত্যকা, শীতকাতর হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসা পাখির ঠোঁটে যেমন বসন্ত বাতাসের গান, গহিন অন্ধকারে আলো জ্বালাতে জোনাকি পোকার যে অদম্য তৃষ্ণা তার সবটুকু সঞ্চয় দিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা নাজিল করেছেন আল কুরআন। কুরআনের আলোকরশ্মি আলোকিত করতে চায় পৃথিবীকে, যেখানে শোনা যাবে না কোন মায়ের বুকফাটা কান্নার স্বর, ক্ষুধায় কাতর কোনো বনি আদম নির্বাক চেয়ে থাকবে না অপলক, লুণ্ঠিত হবে না মানুষের মৌলিক অধিকার, থাকবে না কোনো বর্ণবৈষম্য ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। সর্বোপরি মহান আল্লাহ তায়ালার বারিধারায় সিক্ত হবে পৃথিবীর জমিন। পৃথিবীতে মহান আল্লাহর সমস্ত নেয়ামতরাজির মধ্যে শ্রেষ্ঠ দু’টি নেয়ামত হলো ১. নবী মুহাম্মদ (সা)-কে প্রেরণ। ২. মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। আসলে ঈমানদারদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন নবী পাঠিয়ে আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। সে তাঁর আয়াত তাদেরকে শোনায়, তাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ ও সুবিন্যস্ত করে এবং তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞান শিক্ষা দেয়। অথচ এর আগে এই লোকেরাই সুস্পষ্ট গোমরাহিতে লিপ্ত ছিল। (সূরা আলে ইমরান : ১৬৪) হযরত উম্মে সালমা (রা) বর্ণিত- জাফর (রা) যখন ১৪ জন সাথী নিয়ে নাজ্জাশির দরবারে হাজির হন তখন আমর ইবনুল আস (ইসলাম গ্রহণের পূর্বে) নাজ্জাশিকে  পরামর্শ দেন যে, এরা (মুসলমানরা) ধর্মত্যাগী ও রাষ্ট্রদ্রোহী। এদেরকে আশ্রয় না দিয়ে আমাদের নবী ঈসা (আ) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। জবাবে হযরত জাফর বিন আবি তালিব (রা) দাঁড়িয়ে বললেন- আমরা জাহিলি যুগের জাতি বিদঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিলাম। চরম অমানিশায় নিমজ্জিত ছিলাম। পিতার মৃত্যুর পর মায়েদের বিবাহ করতেও কুণ্ঠাবোধ করতাম না। এমতাবস্থায় মহান আল্লাহ আমাদের মধ্য থেকে রাসূল প্রেরণ করলেন এবং সাথে স্বীয় পক্ষ থেকে কুরআন নাজিল করে আমাদের আলোর সন্ধান দিলেন। ঈসা (আ) সম্পর্কে বললেন- তিনি আল্লাহর গোলাম, তার রাসূল, আল্লাহর রুহ যাহা হযরত মারইয়ামের প্রতি ফুৎকার করেছিলেন। অতঃপর সূরা মারইয়াম থেকে তেলাওয়াত করে শুনান। জাফর বিন আবি তালিব (রা) এর বক্তব্য শুনে নাজ্জাশির দু’চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে এবং তিনি ঈমান আনয়ন করেন। আল-কুরআনের আকর্ষণ মানুষকে মোমের মতো গলিয়ে  দেয়। যেমন হযরত ওমর (রা) এর ইসলাম গ্রহণ। আমি আপনার প্রতি যে কিতাব (কুরআন) নাজিল করেছি যাতে রয়েছে আলোক মশাল, করুণার আধার ও মুসলিম জাতির জন্য কামিয়াবির সুসংবাদ। (সূরা আন-নাহল : ৮৯) আল-কুরআন একটি বিশ্বজনীন গ্রন্থ: কেননা মানবের এমন কোন প্রয়োজনীয়  দিক নেই যা আল-কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি। শুধু তাই নয়, বিশ্বজনীন ও সার্বজনীন গ্রন্থে যে সকল বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার আল-কুরআন তারই প্রমাণ। মহান আল্লাহ বলেনÑ ‘হে নবী! আমি সত্যসহকারে এই কিতাব তোমার প্রতি নাজিল করেছি, যাতে আল্লাহ তোমাকে  যে সঠিক পথ দেখিয়েছেন সেই অনুযায়ী তুমি লোকদের মধ্যে ফয়সালা করতে পারো। তুমি  খেয়ানতকারী ও বিশ্বাস ভঙ্গকারীদের পক্ষ থেকে বিতর্ককারী হয়ো না। জীবনের নিরাপত্তা বিধানে আল-কুরআন : মানুষের নিকট তার জীবন অত্যন্ত প্রিয় ও মূল্যবান। তাই আল-কুরআন সর্বপ্রকার অত্যাচার, নির্যাতন, উৎপীড়ন, খুন-খারাবি ও ফেতনা-ফ্যাসাদ নিষিদ্ধ করেছে। (সূরা মায়িদা : ৪৫) সম্পদের নিরাপত্তা বিধানে আল-কুরআন : মানুষের  দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয়তা পূরণের ক্ষেত্রে সম্পদের আয়-ব্যয় ও বণ্টনের সুষ্ঠু পদ্ধতি এবং এর ভোগ করার নীতি নির্ধারণ করে সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। সম্ভ্রমের নিরাপত্তায় আল-কুরআন : মানুষের নৈতিক চরিত্র, সম্ভ্রম, ইজ্জত ও আবরুর হেফাজতে নির্ভর করে সমাজ ও জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতি। আল-কুরআন জাতি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সম্ভ্রমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় আল-কুরআনের সূরা নূরই যথেষ্ট। যেমনÑ নবী ! মু’মিন পুরুষদের বলে দাও তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের  হেফাজত করে। এটি তাদের জন্য বেশি পবিত্র পদ্ধতি, যা কিছু তারা করে আল্লাহ তা জানেন।  আর হে নবী! মু’মিন মহিলাদের বলে দাও তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানগুলোর  হেফাজত করে। (সূরা নুর : ৩০-৩১) সমাজে দাস-দাসীর কোন সামাজিক অবস্থান ছিল না। দাস-দাসীদের পশুর মতো থাকতে হতো। পচা-বাসি খাবার খেতে হতো। সেই সমাজের মনিবরা যদি দাসী ব্যবহারের মাধ্যমে একটি সন্তান জন্ম দিতো, তাহলে সন্তান জন্মের কারণে দাসী মুক্ত হয়ে যেত, যা তাকে সারা জীবনের বন্দিজীবন (গোলামি) থেকে মুক্তি দিতো। ইসলাম সেই সকল মানুষকে মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। অর্থনৈতিক সাম্য : মানুষকে অর্থনৈতিক শোষণের জঘন্যতম হাতিয়ার সুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য আল-কুরআন যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলন করেছে ইতিহাসে তা চির অম্লান। আল-কুরআনের বহু সংখ্যক আয়াতের মাধ্যমে সুদকে চিরতরে হারাম করেছেন। শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আল-কুরআন : ইসলামের যতগুলো কল্যাণকর কাজ তন্মধ্যে শ্রমিকের মর্যাদা বা অধিকার চমৎকার একটি ব্যবস্থা। আল-কুরআনের শাশ্বত বাণীকে প্রতিষ্ঠার জন্য রাসূল (সা) বলেন, শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে তার মজুরি দিয়ে দাও। সামাজিক নিরাপত্তায় আল-কুরআন : আল-কুরআন সামাজিক জীবনের শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধানে নৈতিকতা বিরোধী ও সর্বপ্রকার সমাজবিরোধী কর্মকান্ড যেমন মদ-জুয়া, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি নিষিদ্ধ করেছে। এ ছাড়াও আল-কুরআন জাতীয় আয়-ব্যয় ও বিলিবণ্টন বিধানের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়ে রাষ্ট্রের অতীব প্রয়েজনীয় ও কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিশ্চয়তা প্রদান করে। জাতীয় অর্থনীতিকে মজবুত এবং দারিদ্র্য বিমোচনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ইসলামী সমাজব্যবস্থায় মানুষের মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া সম্পত্তির সুষ্ঠু বণ্টনের ব্যবস্থা করেছে আল কুরআন। ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজার মধ্যে আইনের দিক থেকে কোন প্রভেদ আল-কুরআন করেনি। তাই আল-কুরআনের মাধ্যমেই সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আল-কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যা ইহলৌকিক কল্যাণ ও পরলৌকিক মুক্তির নিশ্চয়তা প্রদান করে। আল-কুরআন কর্মের প্রতিও মানুষকে দারুণভাবে উৎসাহিত করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘‘নামাজ শেষ হলে তোমরা জীবিকার সন্ধানে জমিনে ছড়িয়ে পড়।” সুতরাং কুরআনই পারে পৃথিবীর সকল প্রকার দ্বন্দ্ব ও অশান্তি দূর করে চিরশান্তি ও সম্প্রীতির বন্ধন স্থাপন করতে। Encyclopaedia of Britanica-তে বলা হয়েছে- Of all the religious studies, personalities of the world glorious Quran was the most successful book.

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির