post

ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

০৭ জানুয়ারি ২০১২
শেখ আবুল কাসেম মিঠুন কোন বিষয়কে একটা বিশিষ্টতা দান করে নির্দিষ্ট করে দেয়ার নাম সংজ্ঞা। কিন্তু একটা জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে নির্দিষ্ট করা সম্ভব নয়। কারণ সংস্কৃতি একটি ব্যাপক এবং বিশালতার নাম। তাই সংস্কৃতি যেমন নির্দিষ্ট করা সম্ভব নয় তেমনি তার সঠিক সংজ্ঞা দেয়াও সম্ভব নয়। তবে সংস্কৃতি কাকে বলে এর জবাবে এটুকু বলা যেতে পারে যে, মানুষ যা বিশ্বাস করে, সেই বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশই তার সংস্কৃতি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে একটা জনগোষ্ঠী দূরের কথা একটা পরিবারের ব্যাপারেও আমরা বলতে পারি না যে এই পরিবারটির সংস্কৃতি এই রকম। কারণ একই বিষয়ের ওপর কারো বিশ্বাস সবল আবার কারো বিশ্বাস দুর্বল। তাই তাদের প্রকাশভঙ্গিমারও তারতম্য ঘটে। আর তখন মানুষে মানুষে সাংস্কৃতিক বিভেদ ঘটে। আর সাংস্কৃতিক বিভেদ প্রকট হলে বিশ্বাসে বিভেদ সৃষ্টি হয়। মানুষের বিশ্বাস থেকে সংস্কৃতির উদ্ভব হয় বটে তবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডই আবার মানুষের বিশ্বাসকে পরিচালিত করে, নিয়ন্ত্রণও করে। যেমন মানুষ প্রথমে কোন বিষয়ে অভ্যাস করে, পরবর্তীতে সেই অভ্যাসই তাকে পরিচালিত করে। আর তাইতো সচেতন সমাজ ‘অপসংস্কৃতির’ বিরুদ্ধে এত সোচ্চার, যাতে অপসাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দর্শন করে কিংবা চর্চা করে প্রজন্মের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে না যায়। অতএব ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সুসংস্কৃতির প্রচলন এবং প্রতিষ্ঠা একটি সুসভ্য জনগোষ্ঠী তৈরিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে, এই বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে প্রচুর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা প্রয়োজন। আইনব্যবস্থার উৎস হলো মতবাদ ‘সংস্কৃতি’ বিষয়ে একটি মৌলিক ব্যাপার আমাদের জেনে রাখা দরকার। আর তা হলো, আমরা জানি কোন রাষ্ট্র এক বা একাধিক মতবাদকে ভিত্তি করে নানা ধরনের আইন প্রণয়ন করে। সেই আইন মোতাবেক জীবন-যাপন করতে গিয়ে মানুষের যে মনোবৃত্তি তৈরি হয় তা তার আচার-আচরণ, লেন-দেন বা কর্মানুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশ পায় এবং সেগুলো তার সংস্কৃতি হয়ে ওঠে। অতএব একমাত্র ইসলামের বিশ্বাস ও আইন থেকে উদ্ভূত সাংস্কৃতিক উপাদান উপকরণ ব্যতিরেকে ভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করার অর্থ হচ্ছে ভিন্ন মতবাদকে মানুষের অন্তঃরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বলিষ্ঠ করা। ভিন্ন মতবাদ সম্পর্কে মহান আল্লাহতা’আলা বলেছেন, ‘ওয়ামাই ইয়াবতাগি গাইরাল ইসলামী দ্বীন্নান ফালাই ইয়ুকবালা মিনহু...।’ অর্থ : যে ব্যক্তি ইসলাম ভিন্ন অন্য কোন জীবনব্যবস্থা (আইন-কানুন) অবলম্বন করিতে চাইবে তা তার নিকট থেকে কখনোই গ্রহণ করা হবে না। (সূরা আলে ইমরান : ৮৫) আনাস ইবনে মালেক (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোন লোককে কোন মতবাদের দিকে ডেকেছে, তাকে কিয়ামতের দিন থামানো হবে, সে মাত্র এক ব্যক্তিকে সে দিকে ডেকে থাকলেও। তাকে তার আহবানের পরিণতি ভোগ না করিয়ে রেহাই দেয়া হবে না।’ আর একটি বড় হাদিসের শেষাংশ উল্লেখ করছি, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জাহেলিয়া যুগের রীতিনীতির দিকে আহবান করে সে দোজখীদের দলভুক্ত। জনৈক ব্যক্তি বললো: হে আল্লাহর রাসূল (সা)! সে যদি সালাত আদায় করে, রোজা রাখে তবুও? তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, সে যদি নামাজ-রোজাও করে তবুও। সুতরাং তোমরা সেই আল্লাহর ডাকেই নিজেদের ডাকবে যিনি তোমাদেরকে মুসলিম, মুমিন ও আল্লাহর বান্দা নাম রেখেছেন।’ বর্ণনা : আল-হারিস আল-আশআরী (রা)। হাদিসটিতে বলা হয়েছে, হজরত জাকারিয়া (আ)কেও আল্লাহ এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরকম অনেক আয়াত এবং হাদিস প্রমাণ করে যে, মতবাদ হচ্ছে আইনের ভিত্তি। মতবাদ হচ্ছে বীজ আর আইন হচ্ছে গাছ। আর ফল-ফুল লতা-পাতা হচ্ছে সংস্কৃতি। অতএব ইসলামী সাংস্কৃতিক কর্মীদেরকে খুব ভালোভাবে ইসলামী আইন এবং তার কল্যাণকারিতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা দরকার। অভ্যস্ত হওয়া দরকার এবং জীবনের প্রত্যেকটা কাজে ও চিন্তায় ইসলামী আইনকে সামনে রাখা দরকার। তাহলে ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো প্রকৃত অর্থে ইসলামী হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। আইনব্যবস্থা ইসলামী হলে সংস্কৃতিও ইসলামী হবে প্রসঙ্গক্রমে বলতে চাই যে, কোন রাষ্ট্র যদি ইসলামী আইনের প্রচলন করে তবে এ আইনের বিরুদ্ধবাদীদের সংস্কৃতিও ইসলামী হয়ে উঠবে। মুসলমানদের অতীত ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই বহন করে। যেমন মক্কা, মদীনার পরে যে সমস্ত দেশে মুসলমানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে সমস্ত দেশের ইহুদি, খ্রিষ্টান ও অগ্নিপূজারিরা যারা ইসলাম কবুল করেনি তারা কিন্তু ইসলামী সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি বৃহত্তর ভারত ভূখণ্ডের অমুসলিমরাও ইসলামী সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিল। অথচ তারা পরবর্তীতে ব্রিটিশ-খ্রিষ্টানদের সংস্কৃতি গ্রহণ করেনি। ইউরোপ আফ্রিকার মানুষ ইসলামী সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসে ৭১১-১২ খ্রিষ্টাব্দে স্পেন ও সিসিলি অধিকার করার পর থেকে। মুসলমানদের রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন কৌশল, সামরিক বাহিনীর শ্রেণীবিন্যাসের কলা-কানুন, স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা, সাহিত্য, কাব্য, অভিধান রচনা, গণিত, সঙ্গীত, স্থাপত্য, অনুবাদ সাহিত্য, চিকিৎসাবিজ্ঞান, শল্যবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, কৃষি বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, মোট কথা আবিষ্কার কিভাবে করতে হয়, ইতিহাস লিখনপদ্ধতি, মানচিত্র তৈরি, মুদ্রা তৈরি, পোশাক, কাপড়, কাগজ, বারুদ, ইস্পাত শিল্প, মৃৎশিল্প, বাদ্যযন্ত্র, কাচ, রঙ, ছুরি, কাটা চামচ, চিনি, টেনিস খেলা, বেস বল, তাস, পাশা খেলা ইত্যাদি আধুনিক বিশ্বের সকল প্রকার সভ্যতা-সংস্কৃতির ভিত্তি মুসলমানেরা তৈরি করার সাথে সাথে স্পেন সিসিলি হয়ে তার স্ফুরণ ইউরোপ আফ্রিকাতে পৌঁছে। সেখানকার মহিলাসমাজও ব্যাপকভাবে মুসলিম সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিল। শুধু তাই নয়, ইবনে-যুবাইয়েরের উদ্ধৃতি দিয়ে ফিলিপ কে হিট্টি লিখেছেন, সিসিলির খ্রিষ্টান রাজা প্রথম রজার, দ্বিতীয় রজার, দ্বিতীয় ফ্রেডারিক (১২১৫-৫০, সিসিলি, জার্মানি, জেরুসালেম এবং রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন) দ্বিতীয় উইলিয়াম (১১০১-১১৮৯) এমনভাবে মুসলিম সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে যান যে, সমালোচকরা তাদেরকে বিধর্মী বলতো। ফিলিপ কে হিট্টি আরো লিখেছেন, ‘১৩ শতাব্দীর শেষভাগে আরবি সাহিত্যে ছায়ানাট্যের আবির্ভাব ঘটে। ১২ শতাব্দী নাগাদ পুতুলনাচের প্রচলন শুরু হয়। পশ্চিম এশিয়া এবং মিসর থেকে কনস্ট্যানটিনোপলে এবং পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোতেও এই নাট্যধারা জনপ্রিয় হয়। অনুমান করা হয়, চার্লি চ্যাপলিনের মত আধুনিককালের অভিনেতাদের ওপর তুর্কি কারাগজদের (কালো চক্ষু) প্রভাব রয়েছে।’ নিত্য নতুন আবিষ্কার এবং বস্তুর ব্যবহার, লেনদেন, বণ্টন ও তদ্বসংক্রান্ত আইনব্যবস্থার অধীনে মানুষের কার্যাবলি সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান হয়ে ওঠে। আর উক্ত ঐতিহাসিক বর্ণনা প্রমাণ করে বর্তমান আধুনিক পৃথিবীর সভ্যতা এবং সংস্কৃতির পুরোটাই মুসলমানদের অবদান। কিন্তু বিভিন্ন মতবাদ থেকে উত্থিত আইনব্যবস্থা সেই সভ্যতা-সংস্কৃতির ওপর রঙ চড়িয়ে তাকে বিকলাঙ্গ, অহিতকর এবং অমানবিক করে দিয়েছে। তবে এ কথাও ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, অবক্ষয়ের শুরু হয়েছিল ঐ মুসলিম আমল থেকেই। যার জন্য শুধু শাসনব্যবস্থা নয় সংস্কৃতিরও পতন ঘটেছে। পরিচালক ও শিল্পীদের করণীয় যে ‘রূপে’ বর্তমানে আমরা মঞ্চে বা মিডিয়াতে ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখি সে অনুষ্ঠানের ইতিহাস বেশি দিনের নয়। কিন্তু তাই বলে সে সব অনুষ্ঠানের দুর্বলতাকে উপেক্ষা করা উচিত বলে আমি মনে করি না। কারণ তীব্র গতিশীল এই আধুনিক পৃথিবীতে আরো অধিক গতিশীল হলো বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি। সেসব সংস্কৃতি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানরূপে যখন কোন মাধ্যমে প্রকাশিত হয় তখন তা অতি নিখুঁত, হৃদয়গ্রাহী এবং বাস্তবসম্মত করে তোলার চেষ্টা করা হয়। সেই চেষ্টাটাও সচেতন এবং বোদ্ধা দর্শকের দৃষ্টি এড়াতে পারে না। আর ‘বাস্তবসম্মত’ কথাটার অর্থ হলো বিশ্বাসজাগানিয়া, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘মেক বিলিভ’। অর্থাৎ দর্শকের কাছে বিশ্বাস যোগ্য করে বিষয়গুলো তুলে ধরা। এ ছাড়া মঞ্চে বা পর্দায় একটা স্বপ্নময় আবহ তৈরি করতে পারলেই দর্শক বাহ্যিক জগতের চিন্তামুক্ত হয়ে শিল্পীর তৈরি স্বপ্ন জগতে হারিয়ে যায়। যখন একজন সঙ্গীতশিল্পী কাগজ দেখে গান পরিবেশন করেন তখন দর্শকের ঐ স্বপ্নজগৎটা ভেঙে যায়। তার গানটা সার্বজনীন ইমেজ তৈরি করতে পারে না, দর্শক স্বপ্নজগতের বদলে বাস্তব জগতেই থেকে যায়। শিল্পীকে একজন সাধারণ গায়ক মনে হয়। কিন্তু যখন তিনি মুখস্থ এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে গান পরিবেশন করেন তখন দর্শক তাকে স্রেফ একজন গায়ক মনে করেন না, মনে করেন তিনি যেন স্বপ্নজগতের মানুষ এবং অন্য একটা প্রতিভার অধিকারী। দর্শকের এই ভাবনাই শিল্পীকে সার্বজনীন করে তোলে। শিল্পীর পরিবেশনা এক দর্শক থেকে বহু দর্শকের মধ্যে প্রভাবিত হয়। অর্থাৎ গায়কের মনোযোগ কাগজের দিকে, তিনি সাবলীল নন, তার এই আচরণ তার পরিবেশনাকে সার্বজনীন হতে দেয় না। আমাদের দেশেরই বিখ্যাত শিল্পীরা কিন্তু সঙ্গীত পরিবেশনের সময় স্বপ্নময় একটা আবহ তৈরি করেন। তা ছাড়া মঞ্চে সঙ্গীত বা নাটক পরিবেশনের সময় উপস্থিত পারফরমাররা ছাড়া কোন দ্বিতীয় ব্যক্তি প্রবেশ করলে ঐ স্বপ্নজগৎটা গুঁড়িয়ে যায়। অনেক সময় পরিচালক এসে শিল্পীর কানে কানে কিছু বলেন, অথবা কেউ এসে মাইক্রোফোন ঠিক করেন, এসব একেবারে অনুচিত। এসব বিষয়গুলো দৃষ্টিকটুও বটে। শিল্পীরা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আবেগের সৃষ্টি করে, যা ধীরে ধীরে দর্শককে আবেগের গভীরে স্বপ্নজগতে নিয়ে যায়। কোন তৃতীয় ব্যক্তি বা বিষয়ের উপস্থিতি তা বাধাগ্রস্ত করে বলেই সে অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তা পায় না আর তাই তা জন-সংস্কৃতিতে পরিণত হয় না। এজন্য মাধ্যমে (মঞ্চ, পর্দা, রেডিও, ভিসিডি ইত্যাদি) প্রকাশ করার আগে লেখক-পরিচালককে ব্যাপকভাবে গবেষণা যেমন করতে হয় তেমনি শিল্পীদেরকে প্রচুর পরিশ্রমে রিহার্শাল করানো হয়। সংলাপ বা সঙ্গীত ভালো করে মুখস্থ করানো হয়। এমনকি মাইক্রোফোনের ব্যবহার, লাইট কিভাবে নিতে হয় বা ভয়েস ডেলিভারি কিভাবে করতে হয় এসব আগেই রিহার্শালের মাধ্যমে অনুশীলন করতে হয়। অনুষ্ঠানের সার্বজনীনতা ত্র“টিপূর্ণ অনুষ্ঠানকে গোষ্ঠী বা দলভুক্ত দর্শকবৃন্দ ক্ষমার চোখে দেখে থাকে অথবা ত্র“টিগুলো তাদের চোখেই পড়ে না। কারণ এসব ক্ষেত্রে দর্শক মনস্তাত্ত্বিকভাবে শিল্পীদের ওপর দুর্বল থাকে। দর্শক ভাবে ওসব শিল্পীরা তো আমার গোষ্ঠী বা দলভুক্ত অথবা ওরাতো আমার গোষ্ঠী বা দলের সমর্থনে গান গাইছে বা নাটকের সংলাপ বলছে। অর্থাৎ দলীয় আনুগত্যের কারণে দর্শক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতীয় মান এবং গুণ সম্পর্কে বিচারবোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন কোনরূপ সমালোচনা গ্রহণ করে গঠনমূলক বিশ্লেষণপূর্বক অনুষ্ঠানের মানোন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করার মানসিকতা না থাকে সমর্থকদের, না থাকে শিল্পীগোষ্ঠীগুলোর। তখন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো তার গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে, যার জন্য তা জনসংস্কৃতির রূপ পরিগ্রহ করতে ব্যর্থ হয় এবং সার্বজনীনতার বদলে এককেন্দ্রিক অনুষ্ঠানে পর্যবসিত হয়ে যায়। জনসংস্কৃতির রূপ পরিগ্রহ করার অর্থ কিন্তু এই নয় যে, বৈধ-অবৈধ সকল প্রকার উপাদান উপকরণ নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সাজানো হবে বা পরিবেশন করা হবে। আদর্শবহির্ভূত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দর্শকের পছন্দের উপকরণ ও উপাদান দিয়ে সাজানো হয়। তাতে বৈধ-অবৈধের কোন বালাই থাকে না। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমার বাড়িতে মেহমান এসেছে সে যা পছন্দ করে তাকে তাই খাওয়াবো। অন্য দিকে আমি যা পছন্দ করি তা অতি সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে মেহমানকে খাওয়াবো, যাতে সে তার নিজের বাড়িতে গিয়ে আমার পছন্দকেই প্রতিষ্ঠা করে। অর্থাৎ নিজস্ব আদর্শিক সংস্কৃতিকে ঘষে মেজে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে জনগণের মন-পছন্দ করে তোলা উচিত। যাতে সে নিজে তা চর্চা করে। অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য আমাদের প্রথমে জানা দরকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য কী! সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দর্শককে কী দেয়। দর্শকই বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কী উদ্দেশ্যে আসে। এ সম্পর্কে স্থুলভাবে বলা যেতে পারে যে, আদর্শবর্জিত বা পার্থিব স্বার্থসংশ্লিষ্ট তথাকথিত বিনোদন সংবলিত যেকোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দর্শককে তিনটি জিনিস দেয়, এক. জানান দেয়, দুই. শিক্ষা দেয়, তিন. আনন্দ দেয়। কিন্তু এসব গ্রহণের ইন্দ্রিয় ক্ষমতা মানুষের সীমাবদ্ধ। তাই সব চেয়ে সহজ ও সস্তা হালকা রস গ্রহণ করে দর্শক আবেগগ্রস্ত হয় এবং সন্তুষ্ট থাকে। তখন তার অন্তর্লোক থেকে উদ্ভাসিত মানবীয় গুণগুলোকে তার ইন্দ্রিয়জনিত দোষগুলো ঢেকে ফেলায় ব্যস্ত থাকে। কারণ পার্থিব স্বার্থ এবং মহৎ গুণ এ দু’টি একে অপর থেকে ভিন্ন মেরুতে অবস্থিত। [১৯৭৩ থেকে ১৯৭৯, সাতটি বছর রেডিও টেলিভিশনের নাট্যকার এবং তালিকাভুক্ত গীতিকার, অভিনয় শিল্পী ছাড়াও নাট্য পরিচালনার সুবাদে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় নানাপ্রকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার সুযোগ আমার হয়েছে। আমি দেখেছি কিভাবে দর্শক অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পরপরই ইন্দ্রিয় উত্তেজনায় নাচতে শুরু করে। পরবর্তীতে ১৯৭৭ থেকে ২০০২-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত চলচ্চিত্র জগতে নায়ক, লেখক, পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবে কাজ করাকালীন আমার উপরোক্ত বক্তব্য এবং বিশ্লেষণের সমর্থন পেয়েছি। পক্ষান্তরে ২০০২-এর পর থেকে অদ্যাবধি দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে এবং হচ্ছে, আমি দেখেছি সাধারণ দর্শকদের প্রতিক্রিয়া, তারই আলোকে আমার এই বিশ্লেষণ] অন্য দিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যখন কোন আদর্শকেন্দ্রিক অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক (বিশেষ করে ইসলামভিত্তিক) হয়, তখন দর্শক পঞ্চ-ইন্দ্রিয়শক্তির ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে আত্মিক শক্তির আশ্রয়ে ঠাঁই নেয়। আর এ কথা সত্য যে ইন্দ্রিয় যখন অকার্যকর থাকে তখন আত্মা তার জ্ঞানের দরজা খুলে দেয়। মানুষের অন্তর্লোকের মানবীয় গুণগুলোর উদ্দেশ্য  যেহেতু পার্থিব স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয় সেহেতু সেসব গুণগুলো মানুষের ইন্দ্রিয়জনিত দোষগুলোকে ঢেকে রাখায় ব্যস্ত থাকে অথবা সেগুলোকে দুর্বল করে দেয়। সে তখন অতিন্দ্রীয় জ্ঞানের এক অদৃশ্য সমুদ্রে অবগাহন করায় ব্যস্ত থাকে। তাই দর্শক নাচানাচি করে না এবং অস্থির হয়ে ওঠে না। আমি দেখেছি বিকেল ৪টা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও নারী-পুরুষ দর্শকবৃন্দ ঠায় বসে অনুষ্ঠান দেখছে। আর রাতে তাদের ভালো ঘুম হয়েছে। ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সার্থকতা এখানেই। অন্য দিকে অনৈসলামিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দর্শকদের রাতে ভালো ঘুম হয় না, একটা অস্থিরতা তাদের চিন্তাজগতে ভর করে থাকে, পরদিন তারা অনেক ক্লান্তি নিয়ে কাজ করে। ঘুমের জন্য অনেকে ট্যাবলেট খায় এবং পরবর্তীতে অনেকে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। উপরের বিশ্লেষণটুকু আরো স্পষ্ট করার জন্য আমি বলতে চাই, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কোনো মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে না, মানুষের প্রবৃত্তির পরিবর্তন করে না এবং মানুষের ধ্যান-ধারণাকে বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। তা সত্ত্বেও জনমনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের এত বিপুল ক্ষমতা কেন এ প্রশ্ন আসতে পারে। আসলে যে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মূল কর্মটি হচ্ছে অন্তর্লোকের চেতনা এবং চিন্তনকে উসকে দেয়া, তাপিত করা অথবা তাতে প্রাণ সঞ্চার করা এবং অন্তর্লোকে অন্তর্নিহিত ভাবনাকে বলিষ্ঠ করা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অন্যতম কাজ। কিন্তু বেশির ভাগ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দর্শকের অন্তর্লোকে প্রবেশ করতে পারে না, বরং আদিরস সঞ্চার করে তাদের ভোগী মনোবৃত্তিকে উসকে দেয়। যুগ যুগ ধরে অসংখ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে, নাটক-সিনেমা হচ্ছে, সঙ্গীত হচ্ছে, স্থাপত্য, ক্রীড়া কত কী! কত শত রকম আদর্শের প্রচার হচ্ছে সেইসব অনুষ্ঠানে, কিন্তু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিপুল ক্ষমতা হিসেবে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তা হলো বিভিন্ন রকম পোশাক এবং চুলের ফ্যাশন, ঘরবাড়ি সাজানো, যুবক-যুবতীর অবৈধ প্রেমের ব্যাপারে কথা বলার স্টাইল, বাক্যবিন্যাস ও ক্ষেপণ, প্রসাধনীর স্টাইল, চৌষট্টি কলার চর্চা, পরকীয়া প্রেম, কুটবুদ্ধি, অপরাধ করার বিভিন্ন কায়দা-কানুন, মারামারি করার বিভিন্ন রকম কৌশল ইত্যাদি এসব পার্থিব ও ইন্দ্রিয়জনিত দোষ স্বল্প ও হালকা জ্ঞানবোধ সম্পন্ন এবং যারা জীবন ও মৃত্যুর ব্যবস্থাপনা জানে না, অপরাধ করলেও বিনা তওবা অথবা শাস্তি ব্যতিরেকে ছাড়া পাবে বলে মনে করে বা রাষ্ট্র তাদের মনে সেই বিশ্বাসের জন্ম দেয় শুধু সেসব ভোগীদের ওপরই ঐসব অপরাধ ও দোষ আছর করে বা প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু ঐ সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ক্ষমতা জ্ঞান-বোধ সম্পন্ন সচেতন মানুষের চেতনা-চিন্তনের গায়ে এতটুকু আঁচড় ফেলতে পারেনি। তবে হ্যাঁ, খুব সামান্য হলেও যতটুকু সত্য এবং মহত্ত্বর বিষয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দর্শকদের আত্মাকে শক্তি জুগিয়েছে সে শক্তির স্ফুরণই পৃথিবীতে সত্য এবং মহৎকে উৎসাহিত করে যাচ্ছে। কারণ সব মানুষের অন্তস্থলে সত্য বিরাজিত, সেই সত্যটি কোন না কোনভাবে নড়ে চড়ে ওঠে। কিন্তু বিভিন্ন অসংস্কৃতিক তাণ্ডবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষের মনের মধ্যেই সে সত্য আবার ঢেকে যায়। বিশ্বনবী (সা) বলেছেন, ‘আদম সন্তান তার স্বভাব ধর্মের ওপর জন্মগ্রহণ করে।’ অর্থাৎ একটা বিশেষ বয়স পর্যন্ত ইন্দ্রিয়শক্তি তার ওপর প্রবল না থাকার কারণে তার অন্তর্লোক থাকে পবিত্র মানবীয় গুণে সমৃদ্ধ। এই গুণ পরবর্তীতে তার পিতা-মাতা, সমাজ, পরিবেশ ও অনৈসলামিক শিক্ষা ঢেকে ফেলে। তাকে সাহায্য করে তার ইন্দ্রিয়শক্তি। কিন্তু এগুলোর ধ্বংস বা মৃত্যু হয় না। ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সফলতা তখনই যখন সেই অনুষ্ঠান অন্তর্লোকে ঘুমিয়ে থাকা সেই চিরন্তন সত্য এবং চির উন্নত মহৎ গুণকে উসকে দিতে পারে, তাপিত, পুষ্ট, বলিষ্ঠ এবং জাগ্রত করতে পারে। ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য সে পথ অবারিত। আর ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মীদের জন্য এটা সর্ববৃহৎ সুযোগ। এই সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর জন্য প্রথমেই আমাদের ইসলামী সংস্কৃতির আসল স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা দরকার। আর তারপর তা পরিবেশন সম্পর্কিত জ্ঞান লাভ করা প্রয়োজন। ইসলামী সংস্কৃতির স্বরূপ ইসলামী সংস্কৃতির স্বরূপ অল্প কথায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এটা ব্যাপক একটা বিষয়। একটা উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টিকে বোধগম্য করে তুলে ধরার চেষ্টা করা যেতে পারে। আমরা স্কুলে একটা রচনা পড়েছি, ‘জীবনের লক্ষ্য’ বা ‘এইম ইন লাইফ’। শিক্ষার্থীরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক, অর্থনীতিবিদ এমন নানা উদ্দেশ্যের কথা লেখে। বিষয়টি ইসলামী সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত। আর এটি মানুষের চিন্তাধারাকে অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ করে দেয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে এ ধরনের সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে দেখতে চান। তাই আল্লাহ নিজেই মানুষকে শিখিয়ে দিয়েছেন, ‘কুল ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন’। বলো আমি আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি এবং আল্লাহর কাছে ফিরে যাব। এই আয়াতটি সকল প্রকার চিন্তার সঙ্কীর্ণতাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় আমাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহ রাব্বুল  আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জন করে তার কাছে ফিরে যাওয়া। এখানে দেখা যাচ্ছে মানুষের উদ্দেশ্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া নয়। তাহলে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে চাওয়ার একটা পরিভাষা দরকার। সেটা হতে পারে ‘বাহন’ অথবা ‘মাধ্যম’। অথবা হতে পারে ‘আমি কী হতে চাই বা কী করতে চাই।’ যদি ভাবধারাটা এমন হয় যে, একদিন আমি আল্লাহর কাছে ফিরে যাব এবং আমার মাধ্যম হচ্ছে ‘ডাক্তারি’। তাহলে ডাক্তারি পেশাটা আমার কাছে অত্যন্ত সততাপূর্ণ এবং পূর্ণাঙ্গ সেবামূলক একটা পেশা হয়ে ওঠে। এই পেশার সততাই আমাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে তার কাছে নিয়ে যাবে। আমি যদি বৈজ্ঞানিক হই তবে আমি আ্যটম বোমা বানাবো মানুষ হত্যার জন্য নয়, কারণ তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টির বদলে প্রচণ্ড ক্রোধ আছে। অতএব আমাকে অ্যাটম বোমা বানাতে হবে মানুষের কল্যাণের জন্য, তা হলে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবো, না পারলে বানাবোই না। এটাই ইসলামী সংস্কৃতি শুধু নয় ইসলামেরও মৌল ভিত্তি এবং সমস্ত সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে। কাজ হচ্ছে বাহন, কাজ কখনো উদ্দেশ্য নয়। কাজগুলোকে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক সম্পন্ন করলেই আল্লাহ সšু—ষ্ট হন। আর আল্লাহর সন্তুষ্টিই হচ্ছে বুদ্ধিমান মানুষের একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। আরো ভালোভাবে ইসলামী সংস্কৃতির স্বরূপ বোঝার জন্য আমি পাঠককে অনুরোধ করবো ‘ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা’- মাওলানা মওদূদী (রহ)-এর লেখা এই বইটি পড়ার জন্য। এই বইয়ের মূল বক্তব্য যা, আধুনিক সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞরা তাদের লিখিত পুস্তকে তাদের ভাষায় ঐ একই বক্তব্য লিখে গেছেন। যেমন গাস্ত রোবের্জ, ড. সাধন কুমার ভট্টাচার্য, সোমেন ঘোষ, ধীমান দাশগুপ্ত প্রমুখ সাংস্কৃতিক গবেষক। অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট এখন আমাদের সামনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উপাদান ও উপকরণ কেমন হতে পারে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। আমাদের মনে রাখা দরকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানে বিচিত্রা অনুষ্ঠান। বিচিত্রমুখী উপাদান ও উপকরণে সাজিয়ে অনুষ্ঠান পরিবেশনার মাধ্যমে আবেগাপ্লুত করে দর্শকের অন্তর্লোকের সত্যকে উসকে দেয়া, শক্তিশালী করা বা জাগিয়ে তোলা। হতে পারে তা আনন্দের মাধ্যমে, হতে পারে তা ট্র্যাজেডির মাধ্যমে। আনন্দ বা ট্র্যাজেডি যাই হোক তা হতে হবে অন্তর্লোককে জাগ্রত এবং পুষ্ট করার নিয়তে, তা যেন কোন ক্রমেই ইন্দ্রিয়ের রসাস্বাধনের খোরাক না হয়। যদি তা হয় তবে তা হবে, ‘ওয়াল আর্স, ইন্নাল ইনসানা লাফি খুসর..’ পবিত্র কুরআনের এই আয়াতের পরিণাম। আনন্দ এত বেশি হবে না যাতে দর্শক আত্মহারা হয়ে যায়। আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আনন্দে আত্মহারা লোকদের ভালোবাসেন না।’ (সূরা আল কাসাস :৭৬) তাই জ্ঞান ও শিক্ষার জন্য যতটুকু প্রভাব বিস্তার করা দরকার ততটুকু আনন্দ বিতরণ করা যেতে পারে। স্মরণ রাখা দরকার, কিয়ামতের দিনে নিয়তের ওপরই বিচারকার্য অনুষ্ঠিত হবে। অন্তর্লোককে জাগ্রত এবং পুষ্ট করার অর্থ নিয়তকে সঠিক পথে চালিত করা। ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে কোনক্রমেই অনৈসলামিক সংস্কৃতির ভেজাল মেশানো উচিত নয়। তাতে দুর্বল ঈমানদারেরা তৃপ্ত হলেও সত্যিকার ঈমানদার ব্যক্তির অন্তর্জ¡ালা হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঈমানদারদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন, বেহেশতে কোনরূপ বাজে কথা তারা শুনবে না। বেহেশতবাসীর জন্য অফুরন্ত নেয়ামতের মধ্যে এটাও একটা নেয়ামত। আল্লাহ জানেন পৃথিবীর নানা ধরনের বাজে কথায় ঈমানদারদের কষ্ট হয়। আর বাজে কথা তাই যা আল্লাহর স্মরণকে ভুলিয়ে দেয়। অনৈসলামিক সংস্কৃতির সব কথাই বাজে কথা। কারণ তা আল্লাহ এবং পরকালের কথা ভুলিয়ে দেয়তো বটেই ইন্দ্রিয়গুলোকেও অসৎ পথে ধাবিত করায়। অনুষ্ঠান পরিবেশনাকারীদের প্রথমেই জেনে নেয়া দরকার কোন কোন শ্রেণীর দর্শক সেখানে উপস্থিত। দর্শকদের মনস্তাত্ত্বিকতা বুঝে, অনুষ্ঠান পরিবেশনের জন্য একটি বিশুদ্ধ স্ক্রিপ্ট তৈরি করে রীতিমাফিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করলে সেই ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি জন-সাংস্কৃতিতে রূপ নেবে। আর তখনই হবে ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সফলতা। ইংরেজিতে একটি খেলার নাম ‘পিংপং’। ছোট বলটি একবার ওদিকে একবার এদিকে মারা হয়। ফিল্মে একটি শট আছে, যার নাম পিংপং শট। অর্থাৎ দু’টি বিষয়ের একটিকে কাট করে অন্যটিকে দেখানো এবং এটা কয়েকবার অথবা বারবার করা। দর্শককে উত্তেজিত বা অস্থির করে তোলা এবং সংক্ষিপ্ত সময়ে ব্যাপক কিছু বুঝানো অথবা টেনশন ক্রিয়েট করা। মঞ্চে যেমন একটি গান করেই একটি ছোট নাটিকা, আবার একটি গান আবার একটি নাটিকা এইভাবে অনুষ্ঠান এগিয়ে নেয়া। ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে এই পদ্ধতি বেমানান। কারণ মনে রাখা দরকার ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দর্শকেরা উত্তেজিত বা অস্থির হতে পছন্দ করেন না। তারা ইন্দ্রিয়ের খোরাক চান না, তারা চান আত্মার খোরাক। তাই স্ক্রিপ্টটা এমনভাবে সাজানো উচিত যাতে দর্শকেরা ধীরে ধীরে আবেগগ্রস্ত হয়ে অন্তর্লোকের দ্বার খুলে দেবে এবং তারপর পরিবেশনকারীরা তাদের পরিবেশনা দিয়ে সেই আসল সত্যকে জাগিয়ে তুলবে, নিদেন পক্ষে তাকে একটু নাড়া দেবে, খোঁচাবে অথবা উসকে দেবে। আপাতত মঞ্চে অথবা স্ক্রিনে ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট হওয়া উচিত বর্ণনাধর্মী (ন্যারেটিভ ফর্ম) অথবা ব্যক্তিকেন্দ্রিক (পারসন ব্যাসিস), কোনোক্রমেই মন্তাজধর্মী নয়। বর্ণনার ধারাবাহিকতা দর্শককের উপলব্ধি এবং অনুভূতিকে বক্তব্যের গভীরে নিয়ে যায়। আর পারসন ব্যাসিসের সমস্যা হলো মঞ্চ বা স্ক্রিন পারসন (পারসোনা ল্যাটিন শব্দ, অর্থ : অভিনেতা) ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য আজও তৈরি হয়নি। মন্তাজ এবং ডাইরেকটোরিয়াল ফর্মের স্ক্রিপ্ট তৈরির জন্য যে উচ্চাঙ্গের টেকনিকাল চিন্তাবিদ প্রয়োজন তা তৈরি হবার কোন পরিবেশ বা পরিস্থিতি এদেশে এখনো সৃষ্টি হয়নি। দর্শকের পছন্দ মানুষের অন্তর্নিহিত বিশ্বাস থেকে তার পছন্দের উৎপত্তি হয়। তাই মুমিন এবং অমুমিনের পছন্দ এক নয়। পৃথিবীর সকল প্রকার কল্যাণকর ঘটনা বা বিষয় মুমিনের পছন্দ। কিন্তু এই ‘কল্যাণকর’ বুঝার ব্যাপারটি মুমিনের অভিজ্ঞতালব্ধ নয়, তার অন্তর্লোকের সত্য বিশ্বাস এবং কুরআন ও হাদিসের জ্ঞানই এর ভিত্তি। পক্ষান্তরে অমুমিনের অভিজ্ঞতা এবং পঞ্চইন্দ্রিয়ের খাদ্যালোভই তার জ্ঞানের ভিত্তি। অতএব তার পছন্দ অবশ্যই ভিন্ন। তারপরও তার অন্তর্লোকে সেই সত্য থেকে যায় যা আবৃত হয়ে আছে। তাই সে বাস্তবেও সত্যকে ঢেকে রাখতে চেষ্টা করে, যাকে আরবিতে কুফর বলা হয়। ইসলামী অনুষ্ঠানের উপাদান উপকরণগুলো এমন যে সকল বয়সের দর্শক এমনকি পিতা-মাতা সন্তান এবং শিশু-কিশোররাও একসাথে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারে। সেখানে যেমন থাকে শিশুর সারল্য তেমনি থাকে সব বয়সের জ্ঞান আহরণের বিষয়। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব এবং সাদা কালো রঙের সব মানুষের অন্তর্লোকের সত্যের রূপ একই, তাই লেখক বা পরিচালককে অনৈসলামিক লেখক পরিচালকদের মত বিভিন্ন ক্যাটাগরির দর্শকের জন্য নানা ধরনের জটিল চিন্তার শিকার হতে হয় না। অনৈসলামিক লেখক পরিচালকরা দর্শককে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে বিভিন্ন আদিরস সঞ্চার করেন। যেমন অ্যাডাল্টস্, ইউনিভার্সাল, কিডস্, ফ্যামিলি ইত্যাদি। অবশ্য মানুষের মধ্যে এই ভেদরেখা প্রথম তৈরি করেছিল ফেরাউন। সূরা আল-কাসাসের চার নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘প্রকৃত ঘটনা এই যে, ফেরাউন পৃথিবীতে সীমালংঘন ও বিদ্রোহ করিয়াছিল এবং উহার অধিবাসী জনসাধারণকে দলে উপদলে বিভক্ত করিয়া দিয়াছিল।’’ ইসলাম যেমন সকল মানুষের জন্য তেমনি ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও সকল মানুষকে প্রদর্শন করার যোগ্য হতে হবে। স্টার প্রথা আর একটা গুরত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে ‘স্টার প্রথা’। অনৈসলামিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের স্টারের অর্থ হচ্ছে, রোমান্টিকতা, ট্র্যাজেডি, ড্রামা, সঙ্গীত-নৃত্য, অ্যাকশন, কমেডি ইত্যাদি বিষয়ে নতুন ঢঙ তৈরি করে তা দর্শককে পছন্দ করানো। এ বিষয়গুলোতে যিনি যত দক্ষতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক ছাপ রাখতে পারেন তিনি ততবড় স্টার। কিন্তু ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের স্টারের ঐসব গুণ অবশ্যই থাকবে, অথচ তা স্টারের মর্যাদা বা জনপ্রিয়তা পাবে না যদি অনুষ্ঠানের উপাদান উপকরণগুলো ইসলামী থাকে। যদি তা ইন্দ্রিয়ের খোরাক না হয়ে অন্তর্লোকের খোরাক হয়। কারণ কুরআন এবং হাদিসের মর্মকথা এবং তা থেকে সৃষ্ট জ্ঞানই স্বয়ং স্টার। এর ওপরে যারা নিজকে স্টার করতে চায়, তারা আত্মসমালোচনা করলে স্পষ্ট দেখতে পাবে কুরআনি কল্যাণ নয় বরং নিজেদেরকেই তারা জনপ্রিয় করতে চেয়েছে। তবে পারফর্ম করে সুনাম ও প্রশংসা কুড়ানো ভিন্ন বিষয়। নামীদামি শিল্পীর পারফর্ম দেখতে সবাই চায়। কিন্তু তা যেন নিজের ইমেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য না হয়। বরং জনপ্রিয়তা যত বাড়বে তাকে পুঁজি করে সে তত বেশি বেশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আরো ব্যাপকভাবে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করবে। আরো বেশি করে আল্লাহর কাছে নিজেকে সোপর্দ করবে। যারা স্টার হতে চায় বা স্টারত্বের দাবি করে তাদের একটা কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, স্টারত্ব দাবি করেছিল ইবলিস, তাকে স্টারত্ব অর্থাৎ শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে। মুমিন স্টারত্ব দাবি করে না, সে সকল অহঙ্কার ত্যাগ করে আল্লাহর কাছে নত হয়, আল্লাহর দাস হয়ে যায় তাই খুশি হয়ে আল্লাহ তাকে স্টারত্ব দান করেন। অর্থাৎ ইবলিস শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে আর মুমিনকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়। উপাদান-উপকরণ কোন বিষয়ের ভাবনা যখন চিন্তারাজ্যে স্পষ্ট এবং নিখুঁত হয়ে ওঠে তখনই কেবল সে বিষয়ের ওপর ভাষা, শব্দ এবং অলঙ্কার সাংস্কৃতিক কর্মীর লেখায় আপনা আপনি ব্যাপকভাবে বেরিয়ে আসে। আর তাই-ই হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উপাদান উপকরণ। যেহেতু আইনব্যবস্থা সংস্কৃতির উদ্ভব, বিকাশ ও বিস্তার ঘটায়, তা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে সেহেতু ইসলামী সংস্কৃতি কর্মীদেরকে ইসলামী আইনই শুধু নয়, ইসলামী নীতি-নিয়ম, রসম-রেওয়াজ এবং ইসলামের মৌলিক চাহিদা সম্পর্কে স্পষ্ট, নির্ভুল ও নিখুঁত জ্ঞান অর্জন করা দরকার। তবেই অনুষ্ঠান উপস্থাপনের জন্য হরেক রকম অতুলনীয় সব উপাদান উপকরণের জোয়ার এসে হাজির হবে। বন্ধুর বেশে যেসব প্রবাদ, রসকথা, বাক্য এবং শব্দালঙ্কার মুসলমানদের নিত্যজীবনে ঢুকেছে তা বাছাই করার যোগ্যতা অর্জন করা প্রয়োজন। মনে হয় কোন ধরনের মানসিকতা নিয়ে কী ধরনের অনুষ্ঠান করা দরকার তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গেল। তবুও বলতে চাই, কোনক্রমেই ইসলামী অনুষ্ঠানের মানদণ্ড অনৈসলামিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতে পারে না। কারণ ইসলাম স্বয়ং সম্পূর্ণ। যুগ যুগ ধরে সত্য ও সুন্দরের ওপর ময়লা পড়তে পড়তে তা শক্ত পাথরে পরিণত হয়েছে, অনেক যতœ করে শিশুর ঘায়ের ঢালা তোলার মত করে সে ময়লা তুলতে হবে, এক সময় সেই সত্য ও সুন্দর আল্লাহই বের করে দেবেন। আল্লাহ মহান। ইমেইল : [email protected]

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির