সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য, সালাম ও দুরূদ সম্মানিত রাসূল (সা)-এর প্রতি। আশা করি সবাই ভালো আছেন এবং সুস্থতার সাথে আল্লাহর ইবাদত পালন করে যাচ্ছেন। আমি আজ ইসলাম ও ইকামাতে দ্বীনের সাথে সম্পর্ক নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করবো, তার সাথে তাওহিদ এবং ইসলামের কিছু মৌলিক বিষয়ে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ। দ্বীনের বিষয়ে আলোচনা করতে হলে শুরুতেই ইসলামের কিছু মৌলিক বিষয়ে আলোচনা করা জরুরি। ইসলামে ঈমানের মূল ভিত্তি ছয়টি। যথা- (১) আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস (২) ফিরিশতাগণের প্রতি বিশ্বাস (৩) কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস (৪) রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস (৫) শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস (৬) তাকদিরের ভালো-মন্দের প্রতি বিশ্বাস। আবার কালেমা হলো ইসলামের মূল ভিত্তি। কালেমার অর্থ- ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার প্রেরিত রাসূল।’ ঈমানের মূল ছয়টি ভিত্তির প্রথম ভিত্তি এবং কালেমার প্রথম অংশ হচ্ছে তাওহিদ। তাহলে বোঝা যায় ইসলামে তাওহিদের গুরুত্ব কতটুকু। এক কথায় বলা যায় তাওহিদ ছাড়া ইসলাম কল্পনাই করা যায় না। তাওহিদ ইসলাম ধর্মে এক ঈশ্বরের ধারণাকে বোঝায়। তাওহিদ শব্দের অর্থ একত্ববাদ? ইসলামী পরিভাষায় এবং কালেমার মধ্যে যে ‘ইলাহ’ শব্দটি রয়েছে, এর অর্থ হচ্ছে মালিক, সৃষ্টিকর্তা, মানুষের জন্য বিধান রচনাকারী, মানুষের দোয়া যিনি শোনেন এবং গ্রহণ করেন- তিনিই উপাসনা পাওয়ার একমাত্র উপযুক্ত। আমার ও আপনার প্রত্যেকটি জিনিস এবং দুনিয়ার প্রত্যেকটি বস্তুই তাঁর। তিনি সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, ভাগ্যের ভালো-মন্দের মালিক, বিপদে উদ্ধার করার মালিক, পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণকারী, জীবন ও মৃত্যু তাঁরই হুকুম মতো হয়ে থাকে। সুখ ও বিপদ এবং অসুস্থতা ও শিফা তাঁরই তরফ হতে আসে। মানুষ যা কিছু পায়, তাঁরই কাছ হতে পায়- সকল কিছুর দাতা প্রকৃতপক্ষে তিনি। শুধু তাঁকেই ভয় করা উচিত। তাঁরই সামনে মাথা নত করা উচিত। আর মানুষ যা হারায়, তা প্রকৃতপক্ষে তিনিই কেড়ে নেন। কেবলমাত্র তারই ইবাদত ও বন্দেগি করা কর্তব্য। তিনি ছাড়া আমাদের মনিব, মালিক ও আইন রচনাকারী আর কেউই নেই। একমাত্র তাঁরই হুকুম মেনে চলা এবং কেবল তাঁরই আইন অনুসারে কাজ করা আমাদের আসল ও একমাত্র কর্তব্য। নিজের আকিদাহ-বিশ্বাসে, কথা-বার্তায় ও কাজে-কর্মে আল্লাহর একত্ববাদ প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত করা। যেমন- আল্লাহ তাআ’আলার একটা সিফাত হচ্ছে তিনি ‘আলিমুল গায়িব।’ সুতরাং অন্য কেউ গায়েব জানে, এই আকিদা না রাখা। আমি এখানে তাওহিদের অর্থ এবং গুরুত্ব উল্লেখ করেছি। কিন্তু কেউ যদি তাওহিদে বিশ্বাস করে অন্য যেকোনো একটা বিষয়ে (ফেরেশতাকুল, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ ইত্যাদি) অস্বীকার করে তাহলে তাকে মুসলিম বলা যাবে না। তাহলে আমরা বলতে পারি যে তাওহিদ ইসলামের একটা অংশ এবং গুরুত্বের দিক দিয়ে সবার উপরে। দ্বীন সম্পর্কে আলোচনার শুরুতেই কুরআন পাকের আলোকে ‘দ্বীন’ শব্দের সঠিক ব্যাখ্যা প্রয়োজন। কুরআন মজিদের বিভিন্ন জায়গায় দ্বীন শব্দটির বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। কোন জায়গায় কী অর্থে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা পূর্ণ বাক্য থেকেই বোঝা যায়। দ্বীন শব্দের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের ব্যাপকতা এত অধিক যে মুসলিমের বিশ্বাস ও আকিদা, নীতি ও কর্মপন্থায় এটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মূলত দ্বীন হলো একজন মুসলিমের তাওহিদ, ঈমান, আকিদা, আমল, আনুগত্য, আইন ও নীতির সামগ্রিক দিক যা ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে পরিপূর্ণভাবে সকল ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে। কুরআনুল কারিমে উল্লেখ আছে “তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্যদ্বীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি সকল দ্বীনের ওপর তা বিজয়ী করে দেন। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।” (সূরা আস-সফ: ৯) কুরআনের অনেক জায়গায় (প্রায় ৮০ জায়গায়) দ্বীন শব্দটি উল্লেখ আছে, এখন আমি কুরআন ও হাদিসের আলোকে দ্বীনের বিভিন্ন অর্থের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। দ্বীন বলতে তাওহিদ বুঝায়। কুরআনুল কারিমে উল্লেখ আছে, ‘তুমি নিজেকে দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখ একনিষ্ঠভাবে এবং কখনো মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।” (সূরা ইউনুস: ১০৫) ঈমান শব্দের অর্থ বিশ্বাস করা, কিন্তু ইসলামের পরিভাষায় আল্লাহ, রাসূল, কিতাব, আখিরাত ইত্যাদি মৌলিক বিষয়ের প্রতি দৃঢ়বিশ্বাস স্থাপন, মুখে স্বীকার এবং তা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টার নামই ঈমান। ঈমানের প্রতি দৃঢ়তা, আন্তরিকতা, সম্পৃক্ততা যে এর জন্য জীবনের সর্বোচ্চ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ত্যাগ স্বীকার করার নামই আকিদা। কুরআন ও হাদিসে সর্বদা ‘ঈমান’ শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে ‘আকিদা’ ব্যবহৃত হয়নি। দ্বীন বলতে ঈমান বোঝায়, কুরআনুল কারিমে উল্লেখ আছে “যখন মুনাফিকরা ও যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তারা বলছিল, ‘এদের দ্বীন এদের প্রতারিত করেছে। যারা আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে তবে তো আল্লাহ নিশ্চয় পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান।” (সূরা আল-আনফাল: ৪৯) দ্বীন মানে আনুগত্য। কুরআনুল কারিমে উল্লেখ আছে “আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদত করে তাঁরই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয়; আর এটিই হলো সঠিক দ্বীন।” (সূরা আল-বাইয়েনাহ: ৫) মদিনায় হিজরতের পর মুসলমানরা ক্ষুদ্রাকৃতির হলেও একটি স্বাধীন রাষ্ট্র লাভ করলো। এখন এই নতুন ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য আইন-কানুন ও নিয়ম-বিধির প্রয়োজনে এ সময়ে বেশ কিছু সূরা অবতীর্ণ হয়, তার মধ্যে সূরা নিসা, সূরা মায়েদা এবং সূরা নূর উল্লেখযোগ্য। দ্বীন বলতে আইন বা রাষ্ট্রব্যবস্থা বা সমাজব্যবস্থা যে আইনে চলে তা বোঝায়। কুরআনুল কারিমে উল্লেখ আছে “ফিরাউন বললো, আমাকে ছাড়, আমি মূসাকে হত্যা করবো। সে তার রবকে ডেকে দেখুক। আমি আশঙ্কা করি যে, সে তোমাদের আইন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা (দ্বীন) বদলিয়ে দেবে অথবা (অন্ততপক্ষে) দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে।” (সূরা মুমিন: ২৬ ) অন্য এক জায়গায় উল্লেখ আছে, “যদি তোমরা মুমিন হও তাহলে (জেনার শাস্তি দেয়ার সময়) আল্লাহর আইনের (দ্বীনের) ব্যাপারে তোমাদের মনে তাদের প্রতি যেন দয়া না জাগে।” (সূরা আন নূর-২) মূলত দ্বীন বলতে ইসলাম তথা একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা বোঝায়। মহান আল্লাহ বলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে।” (সূরা মায়িদা: ৩) দ্বীন শব্দের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উপরোক্ত আয়াতসমূহ থেকে পরিষ্কার হয়েছে যে, দুনিয়ার জীবনে মানুষের মূল কাজই হলো একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য করা। আর জীবনে একমাত্র আল্লাহর আনুগত্যের বিধান যাতে পালন করা যায় এবং কোন ক্ষেত্রেই অন্য বিধান থেকে কিছু নিতে না হয় সে জন্য আমাদের জীবনবিধান পূর্ণ করে দিয়েছেন। পরিশেষে আমরা বলতে পারি ইসলাম শুধু কতিপয় আকিদা-বিশ্বাসেরই সমষ্টি নয়, যাকে প্রচলিত ভাষায় ‘ধর্ম’ বলা যায় এবং যার সম্পর্ক কেবল মানুষের মন-মগজের সঙ্গে। বরং ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনপদ্ধতি, যার সম্পর্ক মানুষের মন-মগজ ছাড়াও তার পূর্ণ জীবনের সঙ্গে; পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, যুদ্ধ, সন্ধি সব কিছুই তার অন্তর্ভুক্ত। সবশেষে ইকামাতে দ্বীনের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ। ইতোমধ্যে আমাদের দ্বীনের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা হয়েছে, এক কথায় দ্বীন বলতে আমরা বুঝি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে রাসূলের মাধ্যমে প্রেরিত জীবনবিধান। ইকামত কী? ইকামাত শব্দের সহজবোধ্য অর্থ হলো কায়েম করা, চালু করা, খাড়া করা, অস্তিত্বে আনা, প্রতিষ্ঠিত করা ইত্যাদি। তা হলে ইকামাতে দ্বীন বলতে আমরা বুঝি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে রাসূলের মাধ্যমে প্রেরিত জীবনবিধান প্রতিষ্ঠিত করা বা কায়েম করা। দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করা মানে তাওহিদ, আনুগত্য, ঈমান, (পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র) আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করা এক কথায় ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ পাক দ্বীনকে কায়েম করার দায়িত্ব দিয়েই রাসূল (সা)কে পাঠিয়েছেন। যেমন- কুরআনুল কারিমে তিনটি সূরায় এ বিষয়ে পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে- “তিনিই সে সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে হেদায়াত ও একমাত্র হক দ্বীন দিয়ে পাঠিয়েছেন যেন (সে দ্বীনকে) আর সব দ্বীনের ওপর বিজয়ী করেন।” (সূরা আত তাওবা: ৩৩, সূরা ফাতহ: ২৮ ও সূরা আস সফ: ৯) পরিশেষে একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের নিজস্ব সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করার উদাত্ত আহ্বান জানাই।
লেখক : সচৌ বিশ্ববিদ্যালয় (Soochow University, China)
আপনার মন্তব্য লিখুন