post

এমপি লিটন হত্যা রাজনীতির ভিতর বাহির

ইয়াসিন মাহমুদ

০২ এপ্রিল ২০১৭
২০১৭ সালের প্রথম দিন। নতুন দিনটি স্বাভাবিকভাবে ভালো লাগার কথা। অন্যের সুখ ম্লান করে দেয়ার এই সংবাদ তো আমরা শুনতে চাইনি। আমরা চেয়েছিলাম সকল গুমোট কেটে গিয়ে ভালোবাসায় ভরে উঠবে সবার জীবন। কিন্তু আমাদের সে প্রত্যাশা ব্যর্থ হলো। প্রথম প্রভাতে দুঃসংবাদের প্রতিধ্বনি। গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সাংসদ মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন দুর্বৃত্তদের ছোড়া গুলিতে নিহত হন। আমাদের জাতীয় জীবন আজ শুধু হতাশার কালো চাদরে আবৃত। সুসংবাদ যেন আমাদের শুনতে নেই! তেমনি একটি দুঃসংবাদ এমপি লিটনের হত্যাকান্ড। একটি কালো রাত পার হতে না হতেই আরো একটি সন্ধ্যার অবতারণা। আমরা এমন পরিস্থিতির জন্য একদম প্রস্তুত ছিলাম না। ঘরে ঢুকে সাংসদকে গুলি করে হত্যা (দৈনিক প্রথম আলো, ১ জানুয়ারি, ২০১৭) এমপি লিটনকে বাসায় ঢুকে গুলি করে হত্যা (দৈনিক সমকাল, ১ জানুয়ারি, ২০১৭) গুলিতে এমপি লিটন নিহত, নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের হামলা (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১ জানুয়ারি, ২০১৭) এমপি লিটন হত্যার পর স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভেতরে তীব্র ক্ষোভ লক্ষ করা যায়। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও এ ঘটনার নিন্দা জানান। এমপি লিটনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে (দৈনিক ইনকিলাব, ৩ জানুয়ারি, ২০১৭) ২ জানুয়ারি ২০১৭, সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলেন, গাইবান্ধা-১ আসনের এমপি লিটনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, চক্রান্তকারীরা আগে লিটনের মর্যাদাকে নষ্ট করেছে, পরে তাকে হত্যা করেছে। ছেলেটি ভালো ছিলো, বিদেশে পড়াশোনা করেছে। জামায়াত অধ্যুষিত এলাকায় সে আওয়ামী লীগের পতাকা উড্ডীন রেখেছে। গাইবান্ধা-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়া লিটনের জানাজার নামাজ শেষে বলেন, অপরিণত বয়সে লিটনের মৃত্যু হয়েছে। এটি জামায়াত-শিবিরের চক্রান্ত। লিটন ছিলেন স্পষ্টভাষী। এ কারণে গাইবান্ধায় তিনি ছিলেন জামায়াত-শিবিরের আতঙ্ক। এক সময় তারা চেষ্টা করেছিলো তাদের নেতা গোলাম আযমকে সুন্দরগঞ্জে এনে জনসভা করার। কিন্তু এমপি লিটন সুন্দরগঞ্জের মাটিতে গোলাম আযমকে পা রাখতে দেননি। এটিই ছিল তার দোষ। আর অতীতের এই আক্রোশের কারণে জামায়াত- শিবির লিটনকে হত্যা করেছে। (দৈনিক সমকাল, ২ জানুয়ারি ’১৭) গাইবান্ধায় সাংসদ মঞ্জুরুল হত্যা- সন্দেহে জামায়াত, অন্ধকারে পুলিশ (দৈনিক প্রথম আলো, ২ জানুয়ারি ’১৭) রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, সাংসদ মঞ্জুরুল ইসলামকে (লিটন) কারা, কেন হত্যা করেছে, এ বিষয়ে এখনো অন্ধকারে পুলিশ। তবে ঘটনার পর থেকেই জেলা আওয়ামী লীগ এ ঘটনায় জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করছে। পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে ১৮ জনকে আটক করেছে, তারাও জামায়াত- শিবিরের স্থানীয় নেতাকর্মী বা সমর্থক বলে জানা গেছে। জেলা পুলিশ সুপার মো: আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সন্দেহভাজন হিসেবে ১৮ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য মেলেনি। পুলিশ সুপার আরো বলেন, এই ১৮ জনের বেশির ভাগই জামায়াতের। এদিকে এমপি লিটনের বোনদের মুখে ভিন্ন ভিন্ন কথা শোনা যায়। মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের স্ত্রীসহ দলের নেতারা হত্যাকান্ডের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে সন্দেহ করলেও এই সংসদ সদস্যের বোনেরা তদন্তে সব বিষয়কেই মাথায় রাখতে বলেন। লিটনের বোন তৌহিদা বুলবুল ও ফাহমিদা বুলবুল কাকলী বলেন, কোনো কিছু স্পষ্ট না করেই শুধু জামায়াতকে ঘিরে যেন হত্যা মামলার তদন্ত আটকে না থাকে। তার আগে লিটনের স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতি সাংবাদিকদের বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে জামায়াতই তার স্বামীকে হত্যা করেছে বলে তার ধারণা। তৌহিদা বুলবুল বলেন, শুধু জামায়াত জামায়াত করলে তো হবে না। যদি জামায়াত হয় জামায়াত। যদি আওয়ামী লীগ হয়, আওয়ামী লীগ। আমি হই, আমি। এনি বডি। আমরা তার পানিশমেন্ট চাই। আমাদের আর কিছু চাওয়ার নেই। এমপি লিটনের বন্ধু ও তার পরিবারের নিকটজন হিসেবে পরিচিত মুকুট বলেন, জামায়াত হতে পারে। কিন্তু ডাইরেক্ট জামায়াত করছে- একথা কখনও বলা হয়নি। মামলার বাদি ফাহমিদা কাকলী বলেন, আমার ভাইয়ের হত্যাকারী কে, কারা করল- সেটা আমি জানতে চাই এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। এদিকে জামায়াতের নায়েবে আমির  অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ১ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে বলেন, প্রকৃত খুনিদের আড়াল করতে পরিকল্পিতভাবে জামায়াত-শিবিরের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে। এ ঘটনায় গাইবান্ধা, নীলফামারী, রংপুর ও লালমনিরহাটে জামায়াতের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি এর তীব্র নিন্দা জানান। এমপি লিটন হত্যার পর মিডিয়াকর্মীদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মীদের অবস্থাও নাজেহাল ছিলো। সবাই আস্থা নিয়ে সন্দেহের তীর ছুঁড়ে দেয় জামায়াতের দিকে। এ অভিযোগে দলটির অনেক নেতাকর্মীকে আটক করা হয়। তবে কয়দিন পরের ঘটনা একটু ভিন্ন। বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। খোঁজ মেলে এমপি লিটন হত্যার প্রকৃত রহস্য। অভিযুক্ত জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ আবদুল কাদের খানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এবার আমরা এমপি লিটন হত্যার বিষয়ে আবদুল কাদেরের মুখ থেকে শুনবো ভেতরের কথা। কাদের খান দোষ স্বীকার করলেন (দৈনিক প্রথম আলো, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭) এই রিপোর্টটিতে জানা যায়, ২৫ ফেব্রুয়ারিতে কাদের খানের দেয়া জবানবন্দি শেষে পুলিশের রংপুর রেঞ্জের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক আহমেদ বশির সাংবাদিকদের বলেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে কাদের খান সম্পূর্ণ ঘটনা স্বীকার করেছেন। তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি এ ঘটনার পরিকল্পনা ও অর্থায়নের সঙ্গে সরাসরি জড়িত, সে বিষয়ে অকপটে স্বীকার করেছেন। কাদের খান কেন এই হত্যায় জড়িত হলেন, এ প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক বলেন, প্রতিহিংসাটা হচ্ছে ক্ষমতার লোভ, সাংসদ হতে না পারা। উল্লেখ্য, এমপি লিটনকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় ছয় মাস আগে। গত অক্টোবরে একবার চেষ্টা করা হয়েছিলো। তবে আবদুল কাদের খান কেন এই জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়লেন সেদিকেও একটু খেয়াল করা প্রয়োজন। কাদের খান একজন চিকিৎসক, সাবেক সেনাকর্মকর্তা ও সাবেক সংসদ সদস্য। ক্ষমতাসীন মহাজোটের অংশীদার জাতীয় পার্টির নেতা। গাইবান্ধা-১ আসন থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে তিনি কিভাবে সাংসদ হয়েছিলেন সেটাও কিন্তু ভুলে যাননি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সারা দেশের মতো গাইবান্ধা-১ আসনে মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে কাদের খানও কিন্তু অংশগ্রহণ করে। কাদের খানের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ততার কোনো রেকর্ড ছিলো না। বগুড়ায় বসবাসকারী একজন ডাক্তার হিসেবে পরিচিত। অন্য দিকে এমপি লিটনের বিরুদ্ধে আগে থেকেই সন্ত্রাস ও অসামাজিক কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিলো। স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে হঠাৎ তার উত্থান ঘটে। সংসদ সদস্য হওয়ার পরও অপরাধকর্ম কমেনি। এর মধ্যে মাতাল অবস্থায় এক শিশুকে গুলি করার ঘটনা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। মূলত তার ক্যাডার বাহিনীর হাতে শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী নয়, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরাও নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন এমন অভিযোগও ছিলো। কাদের খান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের সংসদ সদস্য হিসেবে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বহাল ছিলেন। কিন্তু কাদের খানের গ্রেফতারের পর দলটির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বক্তব্যটি বেশ আশ্চর্যজনক। তারা বলেন, কাদের খানের সাথে দলের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে কাদের খান যদি জাতীয় পার্টির নেতা না হবে তবে কিভাবে তিনি জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেটিও প্রশ্ন থেকে যায়। অপর দিকে কাদের খান সর্বশেষ কেন এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে হত্যার মতো একটি নিকৃষ্ট পথ বেছে নিলেন সেটাও চিন্তার বিষয়। আসলে কি কাদের খান সুষ্ঠু ভোটপদ্ধতির আশঙ্কায় নিজের আগামীর পথ পরিষ্কার করতে এমন হীন সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন? তবে দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সঠিক চর্চা না থাকার দরুন এমন অনাকাক্সিক্ষত, অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম নিচ্ছে বলে বিশিষ্টজনেরা মন্তব্য করেছেন। কাদের খান যদি এমপি লিটন হত্যার প্রকৃত খুনি হন তাহলে আইন অনুযায়ী তার বিচার হওয়া উচিত। আর কাদের খান কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার কিনা সেটিও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে পথ এগোতে হবে প্রশাসনকে। আর কোনো ঘটনা ঘটার সাথে সাথে কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়া এখানে জামায়াত- শিবির কিংবা বিএনপির হাত রয়েছে, তারাই মূল ইন্ধনদাতা এমন বালখিল্য বক্তব্য চরম হাস্যকর এবং একটি রাষ্ট্রের জন্যও অপমানজনক। দেশে কোনো একটি ঘটনা ঘটলে মিডিয়ার একপেশে সংবাদ পরিবেশনও আমাদের গণমাধ্যমের প্রতি সর্বসাধারণের আস্থার সঙ্কট তৈরি করেছে। ঢাকার রাজপথে পুলিশের সামনে ছাত্রলীগের হাতে তরুণ দর্জি বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ড, চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে বৌদ্ধ পল্লীতে অগ্নিকান্ড, রংপুর ও ঢাকাতে দুই বিদেশী হত্যাকান্ড, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগরে হিন্দু গ্রামে অগ্নিসংযোগ, গাইবান্ধার সাঁওতাল পল্লীতে অগ্নিকান্ড, কয়েকটি ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা এবং ইমাম-মুয়াজ্জিন-পুরহিত হত্যাকান্ডসহ অসংখ্য ঘটনা এখন সময়ের সাক্ষী। প্রতিটি ঘটনার পর রাজনীতিতে শুরু হয় দোষারোপের খেলা। ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়াই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল ও দুর্বল করে সাময়িক ফায়দা হাসিলের নেশায় মত্ত হয়ে অগ্রিম দোষারূপে মেতে ওঠার সংস্কৃতি শান্তিপ্রিয় দেশবাসী লক্ষ্য করে আসছে। ফলে অধিকাংশ ঘটনার তদন্ত রিপোর্টের খবর মানুষ জানতে পারে না। পরিতাপের বিষয়, এমপি লিটন হত্যার পর হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার সন্দেহে জামায়াত-শিবিরের যেসব নেতাকর্মীদের আটক করা হয়েছে তাদের প্রতি প্রশাসনের এই অমানবিক আচরণ কি মানবাধিকারের লঙ্ঘন নয়? এমন অসংখ্য ঘটনায় বিনা অপরাধে দীর্ঘ দিন কারাভোগ করতে হয় নিরপরাধ অনেক দেশপ্রেমিক জনতাকে। তাই দোষারোপের অসুস্থ রাজনীতি নিপাত যাক। সংবিধান ও গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে ফিরে আসুক একটি সোনালি সকাল। লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির