post

“ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন!”

মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন

২৩ আগস্ট ২০১৫
মানবতার ধর্ম ইসলামের এক মহান বৈশিষ্ট্য কোরবানি মানবসভ্যতার ইতিহাস যতটা প্রাচীন ততটা প্রাচীন এ  কোরবানির ইতিহাস। মানুষ বিভিন্ন যুগে সম্মান, শ্রদ্ধা, জীবনদান, আত্মসমর্পণ, প্রেম ভালোবাসা বিনয়, ন¤্রতা, ত্যাগ  কোরবানি ও আনুগত্যের বিভিন্ন পন্থা-পদ্ধতি অবলম্বন করে আসছে। আল্লাহ পাকের শরিয়তের মধ্যেও মানুষের মানুষ্যত্ব এবং আবেগ অনুভূতির প্রতি লক্ষ্য রেখে সেসব পন্থা-পদ্ধতি সংশোধন করে। মানুষ তাদের কল্পিত দেব-দেবীর সামনে জীবন দান করেছে আর এটা হচ্ছে কোরবানির উচ্চতম বহিঃপ্রকাশ। এ জীবন দানকে আল্লাহ তায়ালা তার নিজের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ ধরনের জীবন উৎসর্গ তিনি ব্যতীত অন্যের জন্য হারাম ঘোষণা করে দিয়েছেন। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ)-এর যুগ থেকে সুদীর্ঘ পাঁচ হাজার বছর ধরে চলে আসছে এ কোরবানি। মহান আল কুরআনুল কারিম সাক্ষ্য দেয় যে পৃথিবীর সব জাতির মধ্যে প্রচলিত আছে এ কোরবানি। তবে অন্যান্য জাতি ও আমাদের কোরবানির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এর মাধ্যমেই মানুষের অন্তরের পরিশুদ্ধতা যাচাই করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, কোরবানির পশুর রক্ত, মাংস আল্লাহ তায়ালার কাছে কিছুই পৌঁছায় না বরং তার কাছে কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া বা খোদাভীতি। কোরবানি শব্দের পরিচয় কোরবানি শব্দটি আরবি কুরবান শব্দ থেকে গঠিত। যা কুরবাতুন থেকে এসেছে। মূলত আরবি কোরবানি শব্দটি ফারসিতে কোরবানি রূপে পরিচিত। যার অর্থ নৈকট্য লাভ করা যায়। (ইমাম রাগিব আল ইস্পাহানী আল মুফরাদাত ৩/২৮৭, আল্লামা জামাখশারী তাফসিরে কাশশাফ ১/৩৩৩ পৃ.) প্রচলিত অর্থে ঈদুল আজহার দিন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য যে পশু জবেহ করা হয় তাকে কোরবানি বলা হয়। কোরবানির ইতিহাস হযরত আদম (আ)-এর দুই পুত্র কাবিল ও হাবিলের কোরবানির দৃষ্টান্ত থেকেই মূলত কোরবানির উৎপত্তি। যেমন আল্লাহ বলেন, (হে নবী)! তুমি তাদেরকে (আহলে কিতাবদেরকে) আদমের পুত্রদ্বয়ের (কাবিল ও হাবিলের)-কাহিনী সঠিকভাবে পাঠ করে শুনিয়ে দাও, যখন তারা উভয়ে এক একটি কোরবানি উপস্থিত করলো। তন্মধ্যে একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অপর জনের কোরবানি কবুল হলো না। তাই অপরজন বললো, আমি তোমাকে নিশ্চয়ই হত্যা করবো, প্রথমজন বললো, ‘আল্লাহ মুত্তাকিদের কোরবানিই কবুল করে থাকেন। তুমি যদি আমাকে হত্যা করার জন্য হস্ত প্রসারিত কর, তথাপি আমি তোমাকে হত্যা করার জন্য তোমার দিকে কখনও হাত বাড়াবো না। আমি তো বিশ্বপ্রভু আল্লাহকে ভয় করি। (সূরা আল মায়েদা : ২৪-২৮) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা হাফিজ ইমাদুদ্দিন ইবনে কাসির (রহ) তার স্বীয় তাফসিরের মধ্যে লিখেছেন : বড় ভাই কাবিল কৃষিকাজ করতো এবং ছোট ভাই হাবিল ছাগলের মালিক ছিল। হাবিলের বোনের তুলনায় কাবিলের বোনটি ছিল অপেক্ষাকৃত সুন্দরী। নিয়ম অনুযায়ী কাবিলের বোনকে বিয়ে করার জন্য যখন হাবিল প্রস্তাব দেয় তখন কাবিল তা প্রত্যাখ্যান করে এবং সে নিজেই তাকে বিয়ে করতে চায় বলে জানায়। এতে হযরত আদম (আ) তাকে বাধা প্রদান করেন তখন উভয়েই আল্লাহর নামে কোরবানি পেশ করলো যে, যার কোরবানি কবুল হবে সে-ই তাকে বিয়ে করবে। হাবিল একটি মোটাতাজা মেষ আল্লাহর নামে জবেহ করলেন এবং বড় ভাই কাবিল স্বীয় ভূমির শস্যের একটা অংশ আল্লাহর নামে বের করলো। আগুন এসে হাবিলের নজর জ্বালিয়ে ফেললেন যা ছিল সেই যুগের কোরবানি গৃহীত হওয়ার নিদর্শন, কাবিলের নজর গৃহীত হলো না। তৎকালীন সময়ে কোরবানি গৃহীত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল যে আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে কোরবানিকে জ্বালিয়ে দিয়ে আবার অন্তর্হিত হয়ে যেত। যে কোরবানিকে অগ্নি এসে ভস্মীভূত করতো না তার কোরবানি কবুল হয়নি মনে করা হতো। কোরবানির প্রচলন আদম (আ) থেকে শুরু হলেও মুসলিম জাতির কোরবানি মূলত ইবরাহিম খলিলুল্লাহ (আ) এবং তার পুত্র ইসমাইল জবিহুল্লাহ (আ)-এর কোরবানির স্মৃতি রোমন্থন অনুসরণে চালু হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ইবরাহিম (আ) যখন আমার কাছে দোয়া করলো হে আমার প্রতিপালক তুমি আমাকে সৎকর্মশীল পুত্র সন্তান দান করো। অতঃপর আমি তোমাকে ধৈর্যশীল এক পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। সে যখন তার পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল তখন হযরত ইবরাহিম (আ) বললো, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে আমি তোমাকে জবেহ করছি, এখন বলো তোমার অভিমত কী? সে বললো, হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তা করুন। আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। (সূরা আস সাফফাত : ৩৭) আরব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কোরবানি আরব দেশে প্রাচীনকালে আতিয়া ও ফারা নামক দুই ধরনের বলিদান অনুষ্ঠান বা এক বিশেষ ধরনের কোরবানি প্রথা চালুছিল। রজব মাসে অনুষ্ঠিত হতো বলে এ কোরবানিকে রাজাবিয়াহও বলা হতো। যে দেবতার নামে এই বলিদান অনুষ্ঠিত হতো বলিদানের পর নিহত পশুর রক্ত তার ওপর নিক্ষেপ বা লেপন করা হতো। রাসূলুল্লাহ (সা) এসব অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করেন। (বুখারি ও মুসলিম) জাহেলি যুগে আরববাসীগণ লাত, উজ্জা, হুবল এবং বিভিন্ন গোত্রের সাথে সম্পৃক্ত এমনি ধরনের অর্জন বুত-প্রতিমা তথা গায়রুল্লাহর উদ্দেশে কোরবানি করত। স্বীয় পুত্রের প্রাণ বলি দিয়ে প্রতিমার উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করত। অনেকেই মূর্তির নামে নিজ নিজ সন্তানদের গলা কেটে বা সমুদ্রে ডুবিয়ে অথবা আগুন জ্বালিয়ে হত্যা করাকে পরম পুণ্যের কাজ বলে বিশ্বাস করত। এমনিভাবে তারা পশু জবেহ করে মূর্তির ওপর চড়িয়ে দিত। কখনও বা এরূপ করত যে, মৃত ব্যক্তির কবরের ওপর কোন জানোয়ার বেঁধে রেখে আসত এবং তাকে ঘাস-পানি অথবা  কোন প্রকার খাদ্যদ্রব্য না দিয়ে এমনিই ফেলে রাখত। অবশেষে ক্ষুধা ও পিপাসায় যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে জানোয়ারটি সেখানেই মরে যেত। এহেন নিষ্ঠুর মানবতাহীন কাজটিকে তারা কোরবানি ও পুণ্যের কাজ বলে মনে করত। কোরবানির বিধান হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) বলেন, রাসূল (সা) মদিনায় হিজরত করার পর দশ বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি ঐ দশ বছর কোরবানি করেছেন। (তিরমিজি) হাফেজ ইবনুল কাইয়ুম বলেন, রাসূল (সা) কখনো কোরবানি বিরতি দেননি। (জাদুল মাআদ) এ ছাড়া রাসূল (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোরবানি করার সামর্থ্য রাখে অথচ কোরবানি করে না তাহলে সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে। (ইবনে মাজাহ) কোরবানির ফজিলত কোরবানির ফজিলত সম্পর্কে অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যেমন হযরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেন, কোরবানির দিনে বান্দার কোরবানির পশুর রক্ত ঝরানোর চেয়ে মহান আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় কোন আমল  নেই। সে কেয়ামতের দিবসে উক্ত পশুর শিং, খুর, লোম প্রভৃতি নিয়ে উপস্থিত হবে। এবং তার রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহর নির্ধারিত মর্যাদার স্থানে পতিত হয়। অতএব তোমরা প্রফুল্লচিত্তে কোরবানি করো। (তিরমিজি, হাকিম ) হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন- হে আল্লাহর রাসূল (সা)! কোরবানির তৎপর্য কী? তিনি জবাবে বললেন, এটা তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ)-এর সুন্নত। এতে আমাদের কী সওয়াব আছে? তিনি বললেন, প্রতি পশমের বিপরীতে একটি করে সওয়াব আছে। তারা আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ছোট ছোট লোমও তো রয়েছে সেগুলোর কী হবে। সেগুলোর বিপরীতে একটি করে নেকি রয়েছে। (ইবনে মাজাহ) হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা) হযরত ফাতেমা (রা)কে বললেন, তুমি  কোরবানির পশুর নিকটে জবেহকালীন সময়ে দাঁড়াও এবং উপস্থিত থাক। কারণ তার পশুর প্রথম ফোঁটা রক্ত জমিনে পড়ার সাথে সাথে তোমার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। হযরত ফাতেমা (রা) বলেন, আল্লাহর রাসূল এটা কি নবী পরিবারের জন্য খাস নাকি সাধারণভাবে আমাদের সকল মুসলিমের জন্য? তিনি বললেন, আমাদের জন্য এবং সকল মুসলিমের জন্য। (হাকিম) হযরত আলী (রা) হতে বর্ণিত, তিনি নবী করীম (সা) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, হে জনগণ তোমরা কোরবানি করো এবং তার রক্তকে সওয়াব লাভের মাধ্যম মনে করো। নিশ্চয়ই এর রক্ত জমিনে পতিত হলে তা আল্লাহর হেফাজতে চলে যায়। (আবু দাউদ) হযরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হে লোক সকল! আপনারা কোরবানি করুন এবং তা খুশি মনে করুন। কারণ আমি নবী করীম (সা)কে বলতে শুনেছি, যদি কোন ব্যক্তি তার কোরবানির পশুসহ কেবলামুখী হয় এবং জবেহ করে তাহলে তার রক্ত, শিং এবং লোম  নেকিতে পরিণত করা হবে, যা কেয়ামত দিবসে তার দাঁড়ি পাল্লায় উপস্থিত হবে। কোরবানির পশুর খুন যদিও মাটিতে পড়ে কিন্তু প্রকৃত অর্থে আল্লাহর হেফাজতে পড়ে। তিনি এর প্রতিদান কিয়ামত দিবসে প্রদান করবেন। আল্লাহ তায়ালা ইবরাহিম (আ)-এর প্রতি সদয় হলেন। ইসমাইলের রক্তের পরিবর্তে তিনি পশুর রক্ত কবুল করলেন। আর ইবরাহিম (আ)-এর পরবর্তী সন্তানদের জন্য কোরবানির সুন্নতকে জারি রাখলেন। কোরবানির শিক্ষা মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহিম (আ) তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ)কে আল্লাহর রাহে কোরবানি দেয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যেভাবে ঈমানী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মানবজাতিকে ত্যাগের শিক্ষা দিয়ে গেছেন, সে আদর্শ ও প্রেরণায় আমরা আমাদের জীবনকে ঈমানী আলোয় উজ্জীবিত করব-এটাই কোরবানির মৌলিক শিক্ষা। ত্যাগ ছাড়া কখনোই কল্যাণকর কিছুই অর্জন করা যায় না। পশু কোরবানি মূলত নিজের নফস তথা কুপ্রবৃত্তিকে কোরবানি করার প্রতীক। কোরবানি আমাদেরকে সকল প্রকার লোভ-লালসা, পার্থিব স্বার্থপরতা ও ইন্দ্রিয় কামনা-বাসনার জৈবিক আবিলতা হতে মুক্ত এবং সত্য ও হকের পক্ষে আত্মোৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত করে। কোরবানির সার্থকতা এখানেই। তাই পশুর গলায় ছুরি চালানোর সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা, কুফর, শিরক, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ, রিয়া, পরচর্চা-পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, আত্মগর্ব, আত্ম অহঙ্কার, কৃপণতা, ধনলিপ্সা, দুনিয়ার মায়া-মহব্বত কলুষতার মতো যেসব জঘন্য পশুসুলভ আচরণ সহযত্নে লালিত হচ্ছে তারও কেন্দ্রমূলে ছুরি চালানো হলো কোরবানির মূল শিক্ষা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিটি মুহূর্তে প্রভুর আনুগত্য, অজ্ঞাপালন ও তাক্কওয়ার দ্বিধাহীন শপথ গ্রহণ করতে হবে। (আত-তাহরিক) পরিশেষে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথার মাধ্যমে নিবন্ধটি শেষ করতে চাই- ‘‘ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন!” লেখক : পরিকল্পনা ও উন্নয়ন সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির