post

চরিত্রের আয়নায় বিম্বিত ব্যক্তিত্ব

এইচ এম জোবায়ের

২৬ জুন ২০১৮
বিশ্বমানবতার জন্য রাসূলে আকরাম (সা.) যে সর্বোত্তম ব্যবহারিক জীবন শিক্ষা দিয়ে গেছেন কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জন্য তা অতুলনীয় আদর্শ। তিনি মহান আল্লাহ পাকের ‘যিকর’র সার্বক্ষণিক তাগিদ করে গেছেন এবং কতিপয় মাসনুন দোয়া শিখিয়ে গেছেন। যে দোয়াগুলো মানুষ তার প্রতিটি কাজের শুরুতে ও শেষে পড়ার মাধ্যমে বাহ্যত ও কর্মে আল্লাহর বিধানের আওতাধীনে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে। তেমনি- আয়নায় মুখ দেখার সময় আমরা যে দোয়াটি পড়ি তা হচ্ছে- অর্থাৎ- হে আল্লাহ! যেমনিভাবে আপনি আমাকে সুন্দর আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন, তেমনি আমার চরিত্রকে সুন্দর করে দিন। এই দোয়া ও হাদীসটি অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। এতে সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে- মানুষের চেহারা এবং চরিত্র দুটোই অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি বাদ দিয়ে অন্যটি অর্থহীন। রাসূলুল্লাহ (সা.) সৎ চরিত্রকে আমলের পাল্লায় সবচেয়ে ওজনদার জিনিস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, ‘(কিয়ামাতের দিন) মুমিনের পাল্লায় সচ্চরিত্রের চাইতে বেশি ভারী কোন জিনিস হইবে না। (আবু দাউদ)। অর্থাৎ চরিত্র ভালো হলে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নাজাত এবং চরিত্র খারাপ হলে ব্যর্থতা ও শাস্তি অবধারিত। মানব জীবনের মূল্যবান আকর ‘চরিত্র’ নিয়েই আজকের আলোচনা। সৃষ্টিজগতে মানুষ অনন্য পবিত্র কুরআনের সূরা আত্তীন এর চার নং আয়াতে আল্লাহ মানুষকে সর্বোত্তম গঠনাকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। সূরা রূমে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশম-লী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা আর রূম : ২২) সর্বোত্তম কাঠামোতে মানুষ সৃষ্টির একটি অর্থ হচ্ছে তাকে এমন উন্নত পর্যায়ের সুষম দেহ সৌষ্ঠব ও সৌন্দর্য দান করা হয়েছে যা অন্য কোন প্রাণীকে দেয়া হয়নি। পাশাপাশি এর অন্য অর্থটি হচ্ছে-তাকে এমন উন্নত পর্যায়ের চিন্তা, উপলব্ধি জ্ঞান ও বুদ্ধি দান করা হয়েছে, যা অন্য কোন সৃষ্টিকে দেয়া হয়নি। আত্ তীনের আয়াত থেকে এই দু’টি অর্থই প্রকাশ পায়। সুতরাং সৃষ্টি জগতের সেরা হিসেবে শুধু বাহ্যিক চেহারা সুন্দর হওয়াই শর্ত নয় বরং সুন্দর চেহারার পাশাপাশি সুন্দর বুদ্ধি-বিবেচনা প্রসূত কাজ অর্থাৎ চরিত্রকে সুন্দর করা একান্ত আবশ্যক। অন্যথায় সেরা মানুষ সেরা শয়তানে পরিণত হতে বেশি সময় ও সাধনার প্রয়োজন হবে না। মানুষের বাহিরের চাকচিক্য ও অবয়বের চেয়ে তার ভেতরের কোমলতা, ভদ্রতা, সততা ইত্যাদি আল্লাহর কাছে বেশি মূল্যবান। সৃষ্টির সেরা হিসেবে মানুষ হালালকে হালাল, গুনাহকে গুনাহ মনে করবে। সৎ কাজের অদম্য স্পৃহা তাকে সর্বদা স্বচালিত রাখবে এটাই স্বাভাবিক। এ সম্পর্কে মাওলানা মওদূদী (রহ:) বলেন- ‘তার এ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কেবল সাধারণ অবস্থায় হওয়া উচিত নয় বরং তার চারিত্রিক শক্তি এতই উন্নত পর্যায়ের হতে হবে যে, অস্বাভাবিক বিকৃত পরিবেশে তাকে সকল প্রকার ভয়-ভীতি ও লোভ-লালসার মোকাবেলা করে এবং সবরকম বিরোধিতা ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেও সত্য পথে অবিচল থাকতে হবে। যার মধ্যে এ গুণ নেই সে সমাজ সংস্কার ও পরিগঠনের কাজে সাহায্যকারী হতে পারে কিন্তু সে প্রকৃত কর্মী হতে পারে না।’ চরিত্রের আয়নায় বিম্বিত ব্যক্তিত্ব লংম্যান ডিকশনারি অব ইংলিশ কনটেমপোরারির মতে, ‘ব্যক্তিত্ব হলো- একজন ব্যক্তির সামগ্রিক প্রকৃতি অথবা চরিত্র।’ মানুষের ব্যক্তিত্ব এবং স্বতন্ত্রতা প্রকাশ পায় তার চরিত্রের মাধ্যমে। চরিত্র হচ্ছে আচার-ব্যবহার, চাল-চলন, কথা-বার্তা, আকার-ইঙ্গিত, উঠা-বসা, আসা-যাওয়া, হাসা-কাঁদা ইত্যাদির সমষ্টি। একজন মানুষ সকাল থেকে সন্ধ্যা এবং সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত যত কাজ করে সেগুলোর মধ্য দিয়েই তার চরিত্রের স্ফুরণ ঘটে। বিশ্বাসের আলোকেই গড়ে ওঠে নির্মল-নিষ্কলুষ চরিত্র। চরিত্রের মাধ্যমেই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। একজন উন্নত ব্যক্তিত্বের অধিকারী ব্যক্তি কখনো হালকা কথা-বার্তা, অতিরিক্ত হাস্য-তামাশা ও বেহুদা আলাপে মত্ত হতে পারে না। কেননা সে রাসূলের (সা.) অমিয় বাণী- ‘হয়তো ভালো কথা বল নয়তো চুপ থাকো’ সম্পর্কে সম্যক অবগত। তার কাজ-কর্মে পরোপকার, খোদাভীরুতা, নিরহঙ্কার প্রকাশ পায়। হিংসা-বিদ্বেষ, চিন্তা ও কাজের বক্রতা, প্রদর্শনী কিংবা বাহবা পাওয়ার ন্যূনতম আকাক্সক্ষা তার চরিত্রে স্থান পায় না। একমাত্র বিশ^নবীর আদর্শের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের মাধ্যমেই এ ধরনের পঙ্কিলতামুক্ত পূত-পবিত্র চরিত্রের অধিকারী হওয়া সম্ভব। কেননা চরিত্রের ব্যাপারে রাসূল (সা.)-এর সার্টিফিকেটদাতা স্বয়ং আল্লাহপাক। (হে রাসূল!) নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী। (সূরা ক্বালাম, আয়াত নং ৪)। সুন্দর চেহারা এবং সুন্দর চরিত্র একটি সুদর্শন-সুন্দর চেহারার জন্য কে না লালায়িত। চেহারাকে আকর্ষণীয়-মসৃণ করার জন্য মানুষের পেরেশানি ও পদক্ষেপের অন্ত নেই। কিন্তু দুনিয়া-আখেরাতের সবচেয়ে মূল্যবান বিষয় ‘উন্নত নৈতিক চরিত্র’ এ ব্যাপারে আমাদের নিরন্তর কোন প্রচেষ্টা নেই বললেই চলে। রাসূল (সা.) তাই আয়নায় চেহারা দেখার সাথে ভেতরের সংশোধন অর্থাৎ চরিত্র সুন্দর করার তাগিদ দিয়েছেন। মানুষ যতবার নিজের চেহারা আয়নায় দেখবে ততবারই যেন নিজের চরিত্র সংশোধনের তীব্র অনুভূতি তার মাঝে জাগ্রত হয়। কেননা চরিত্র অতি মূল্যবান সম্পদ। যখন কারো অর্থ নষ্ট হয় তখন মনে করা হয় যে কিছুই নষ্ট হয়নি। যখন কারো স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় মনে করা হয় যে, তার অতি সামান্য কিছু ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু যখন কারো চরিত্র ধ্বংস হয়ে যায় তখন তার সবকিছুই নষ্ট হয়ে গেছে বলে ধরে নেয় হয়। আমাদের সমাজে লাখো মানুষ উৎকৃষ্ট চেহারার অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি নিকৃষ্টতম চরিত্রের ধারক-বাহক হয়ে আছেন। যাদের বাহ্যিক গঠনাকৃতি নজরকারীর নজর কেড়ে নেয় কিন্তু তাদের আচার-আচরণ-তৎপরতা প্রতিনিয়ত অগণিত মানুষের কষ্টের কারণ হয়ে থাকে। প্রতিটি বাড়িতে যে পরিমাণ প্রসাধনী সামগ্রীর সমাহার থাকে তার দশ ভাগের এক ভাগও থাকে না চরিত্র ভালো করার সামগ্রী। এমন অসংখ্য মুসলমান পরিবার পাওয়া যাবে যাদের ঘরে অনুবাদসহ এক খ- কুরআন এবং একখানা হাদীসের গ্রন্থ পাওয়া যাবে কি-না সন্দেহ! মুসলমান যুবক-যুবতীদের পড়ার টেবিলে, বিছানায় যে পরিমাণ বাজে উপন্যাস ও অর্থহীন গল্পের বই পাওয়া যাবে তার কিয়দংশও পাওয়া যাবে না নবী-রাসূল (আ) ও সাহাবায়ে আজমাঈন এর জীবনী এবং ইসলামী সাহিত্যের গ্রন্থ। তাহলে কী করে ভালো হবে আমাদের মুসলমান যুবক-যুবতীদের চরিত্র? মুসলমানদেরকে কুরআন এবং নবী মুহাম্মদ (সা.) কে পড়ার দিকে মনোযোগী হতে হবে। রাসূলের (সা) চরিত্রই প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত সর্বোত্তম চরিত্র। তিনি আদর্শ চরিত্রের রোল মডেল। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে যতসব মানবীয় উত্তম চরিত্রের-গুণাবলির বর্ণনা এসেছে তার সবকটি’র বাস্তব রূপদান লক্ষ্য করা যায় রাসূল (সা.) এর জীবনে। হযরত আয়িশা (রা.) কে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন- ‘রাসূলুল্লাহর (সা.) চরিত্র হলো কুরআন।’ সাহাবাদের (রা.) চারিত্রিক নিষ্কলুষতা বিশ্বনবী (সা.) অল্প সময়ের ব্যবধানে এমন একদল সোনার মানুষ তৈরি করেছিলেন যারা চরিত্র মাধুর্যে কালোত্তীর্ণ-জগতশ্রেষ্ঠ। রাসূল (সা.) নামের পরশ পাথরের সংস্পর্শ লাভে ধন্য হয়ে তারা তাদের আমল-আখলাককে এমন উচ্চ মার্গে নিয়ে গিয়েছিলেন যাকে টপকে যাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। জ্ঞান ও আমল এর পরিপূর্ণ সমন্বয়ে তারা ঈর্ষণীয় স্থান দখল করে নিয়েছেন। যাদেরকে অর্থ-সম্পদ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রলোভন, নারী এবং সামাজিক নেতৃত্বের লোভ দেখিয়ে কেনা যায়নি। আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল (সা.) ও তাঁর আদর্শের কাছে তারা সবিনয় মাথা নোয়ে দিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে বাতিল, বক্রতা, লালসা, পাপাচার, অনাচার তাদের ধারে-কাছে ঘেঁষতে পারেনি। অপরের হক আদায়ে তাদের থেকে অগ্রগামী কিয়ামত পর্যন্ত কাউকে পাওয়া যাবে না। ওয়াদা পালন ও আমানত রক্ষায় তাদের দৃষ্টান্ত ইসলামের ইতিহাসের পাতায় পাতায় মণি-মুক্তার হরফে লেখা আছে। সুন্দর ব্যবহার দিয়ে তারা তাদের চির শত্রুদের মন জয় করে নিয়েছিলেন। পরোপকার, ক্ষমা, কোমলতা, উদারতা, সাম্য, কল্যাণচিন্তা ও সততায় তারা বয়স ও সময়কে ছাড়িয়ে গেছেন। সামান্যতম দায়িত্বও যার ওপর বর্তেছে তিনি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বোঝা বহনকারী মনে করে অতি সতর্কতার সাথে পথ চলতেন। ফলশ্রুতিতে এই মুষ্টিমেয় মরুচারী আসহাব’দের কল্যাণে দুনিয়াবাসী ন্যায়-ইনসাফে ভরপুর এমন এক কল্যাণ রাষ্ট্রের সন্ধান পেয়েছে যা যেকোনো সময়ের ও দেশের মানুষের জন্য আদর্শ রাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ মডেল। যিনি সামনে থেকে লোক তৈরি ও আদর্শ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি হচ্ছেন শিক্ষক ও রাসূল মুহাম্মদ (সা.)। তিনি তার সাহাবাদের চরিত্রগঠনে ছিলেন সদা তৎপর। হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে পাঠানোর সময় অসিয়ত করতে করতে শেষ অসিয়ত হিসেবে বলেন, তুমি অবশ্যই তোমার চরিত্রকে সুন্দর করবে। কারণ মানুষের মধ্যে যার চরিত্র বেশি সুন্দর সে দ্বীনদারির দিক থেকে তাদের মধ্যে উত্তম। (মুসনাদে আহমাদ: ২১৯৮৯) চরিত্রগঠনের বাস্তব দিক ইসলাম মানুষের জন্য কিছু আমল আবশ্যক করে দিয়েছে। এগুলো মৌলিক বিধি-বিধান। এসব মেনে চলার মধ্য দিয়েই একজন মুসলমানকে তার মুসলমানিত্বের পরিচয় দিতে হয়। যা মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করে দেয়। দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতাও নিশ্চিত করে সে গুণগুলো। উত্তম চরিত্রগঠনের ক্ষেত্রে সর্বোৎকৃষ্ট উপায়সমূহ নিম্নে সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা করা হলো। ন্যায়পরায়ণতা: ন্যায়পরায়ণতা উন্নত চরিত্রের অন্যতম দিক। আল্লাহ্তা’য়ালা বলেন, ‘ইনসাফ করো, এটা তাক্বওয়ার অতীব নিকটবর্তী।’ (সূরা মায়িদা: ৮) সত্যবাদিতা: সদা সত্য বলা ও সত্যের উপর অটল থাকা মামুলি কোনো বিষয় নয়। কঠিন সাধনা ও আল্লাহর যথাযথ ভয়ই এ গুণটি নিশ্চিত করতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সহযোগী হও। (সূরা আত তাওবাহ: ১১৯) রাসূল (সা.) বলেছেন- ‘তোমরা সততা অবলম্বন কর। কেননা সত্যবাদিতা পুণ্যের পথ দেখায়। আর পুণ্য জান্নাতের পথ দেখায়। আমানতরক্ষা: লোভী ও স্বার্থপর মানুষের পক্ষে আমানত রক্ষা করা সম্ভব নয়। অল্পেতুষ্ট হলেই আমানত রক্ষা করা সম্ভব। আল্লাহ বলেন, হে মুসলিমগণ! আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় আমানত তার হকদারদের হাতে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। (সূরা আন নিসা: ৫৮) বিনয়-নম্রতা: রহমানের বান্দারা দুনিয়াতে নম্রভাবে চলাফেরা করে। পক্ষান্তরে শয়তানের বান্দারা ঔদ্যত্ত ও অহংকারবশে, দম্ভভরে চলাফেরা করে। কুরআনের ঘোষণা হচ্ছে- ‘এবং মুমিনদের মধ্য থেকে যারা তোমার অনুসরণ করে তাদের সাথে বিনম্র ব্যবহার করো।’ (সূরা শু’আরা : ২১৫) পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার : স্বচ্চরিত্রের মানুষের পক্ষে পিতা-মাতার প্রতি অসদাচরণ করা কখনোই সম্ভব নয়। কেননা তারা জানেন আল্লাহর ঘোষণা- ‘আর তোমরা সবাই আল্লাহর বন্দেগি করো। তাঁর সাথে কাউকে শরিক করো না। পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার করো। (সূরা আন-নিসা : ৩৬) আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা: এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন- ‘যদি তোমরা ক্ষমতা পাও, তাহলে কি তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে? তারা তো ওই সব লোক, যাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা অভিশাপ করেছেন। তিনি তাদেরকে বধির করে দিয়েছেন এবং তাদের দৃষ্টি অন্ধ করে দিয়েছেন।’ (সূরা মুহাম্মদ : ২২-২৩) রাসূল (সা.) সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না বলে ঘোষণা করেছেন। (বুখারি ও মুসলিম) অঙ্গীকারপূর্ণ করা: সূরা বনি ইসরাইলে আল্লাহ বলেন- ‘প্রতিশ্রুতি পালন করো, অবশ্যই প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে। (আয়াত: ৩৪) হাদিসে ওয়াদা ভঙ্গ করাকে মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার: প্রতিবেশীর সাথে উত্তম আচরণ করা মহৎ চরিত্রের অন্যতম দিক। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘আর মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর, নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকিন, নিকটতম প্রতিবেশী ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর প্রতিও।’ (সূরা আন নিসা: ৩৬) রাসূল (সা.) বলেন, ‘জিবরাইল আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে অসিয়ত করছিল, এমনকি আমি ধারণা করে নিলাম যে, প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকার বানিয়ে দেয়া হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম) ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা: ধৈর্য আদর্শ চরিত্রের অন্যতম দিক। আল্লাহ বলেন, ‘তবে যে ধৈর্যের সাথে কাজ করে এবং ক্ষমা প্রদর্শন করে তার সে কাজ মহত্তর সংকল্পদীপ্ত কাজের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা আশ শুরা : ৪৩) লজ্জাশীলতা: উন্নত ব্যক্তিত্বের অধিকারী লজ্জাশীল হয়ে থাকেন। লজ্জা চরিত্রের ভূষণ। লজ্জাশীলতাকে রাসূল ঈমানের অঙ্গ বলেছেন। তিনি আরো বলেন, ‘লজ্জা কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসে না।’ (মুত্তাফাকুন আলাইহি) দয়া ও করুণা: দয়া এবং করুণা চরিত্রে দুটি উন্নত ও মহৎ গুণ। দীনের দায়ীদের জন্য এ গুণ দু’টি অর্জন করা একান্ত জরুরি। এ বিষয়ে রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, ‘মুমিনদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য, করুণা, অনুকম্পার উপমা হচ্ছে একটি শরীরের মতো। যখন তার একটি অঙ্গ অসুস্থ হয় তখন গোটা শরীর নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।’ এছাড়া আতিথেয়তা, দান ও বদান্যতা, সমঝোতা-সংশোধন, সামাজিকতা, নিরহংকার ইত্যাদি গুণাবলি ছিল তাদের চরিত্রের অন্যতম দিক। আমরা যদি আজকের সমাজের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই সমাজ যেন পরিণত হয়েছে এক কর্পোরেট সভ্যতার লালনকেন্দ্রে। স্বার্থের হানাহানিতে লিপ্ত মানুষগুলোর মন থেকে ভালোবাসা ও নিঃস্বার্থ পরোপকারের আন্তরিক ইচ্ছা উঠে গিয়েছে বলা যায়। আজকের ‘সালাম’ সেও কোন ভিন্ন অর্থ বহন করছে! আইফোন-স্মার্টফোন সভ্যতা মেজাজকে খিটখিটে করে আত্মকেন্দ্রিক করে দিচ্ছে আমাদের। আমার ‘আমি’কে নিয়েই আমি সারাক্ষণ ব্যতি-ব্যস্ত। অশুভ ও ভারসাম্যহীন স্বার্থের প্রতিযোগিতা আমাদের চরিত্রের নিত্য সঙ্গীতে পরিণত হয়েছে। এমতাবস্থায় মনে হচ্ছে যেন আমরা ধ্বংস ও অবক্ষয়ের শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছি। সময় এসেছে রাসূলে আকরাম (সা.) এর প্রকৃত অনুসরণের দিকে ফিরে আসার। তাঁর যে সুমহান আলোকবর্তিকার কারণে মরুর রাখালদের মাঝে ফিরে এসেছিলো স্থিরতা, নমনীয়তা, অল্পে তুষ্টি সেই আলোর কিছুটা আমরা নিজেদের গায়ে মেখে নিয়ে হয়ে উঠতে পারি সোনার মানুষ। হয়তোবা পেয়ে যেতে পারি নাজাতের প্রত্যাশিত ফয়সালা। লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির