post

চীন

০৪ অক্টোবর ২০২০

এশিয়ার অন্যতম বড় দেশ ভারত অর্থনীতি, সমৃদ্ধি ও সভ্যতার বিচারে পিছিয়ে থাকলেও দাদাগিরিতে অনেক এগিয়ে। সবচেয়ে খারাপ প্রতিবেশী দেশ হিসেবে দুনিয়ার মানুষ দেশটিকে চিনে। ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের ওপর রাজনৈতিক আগ্রাসন এবং সরকার পরিবর্তনে গুপ্তহত্যা চলানোর অভিযাগও আছে দেশটির বিরুদ্ধে। বর্ণ হিন্দুদের দ্বারা শাসিত ভারতের রাজনৈতিক আগ্রাসনের শিকার বাংলাদেশ আজ এক যুগ ধরে গণতন্ত্রহীন। কথায় আছে, অন্যের জন্য কূপ খনন করলে সেই কূপে নিজেকেই পড়তে হয়। ভারতের অবস্থা আজ এমন পর্যায়েই পৌঁছেছে। বড় প্রতিবেশী চীন ভারতের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে ভারসাম্য আনতে তৎপর হয়ে উঠেছে। চীনের ভূমিকার কারণে ক্ষুদ্র প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপও ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে। ১৯৪৭ ঈসায়ীতে ভারত ও পাকিস্তান ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই দু’দেশের মধ্যে দা-কুমড়ো সম্পর্ক। সব মিলিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো প্রতিবেশী দেশের সাথে ভারতের সুসম্পর্ক নেই। ভারত দিন দিন এক ঘরে হয়ে পড়ছে। কট্টর হিন্দুবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষতার লেবাসধারী দেশটির শাসন ক্ষমতায়। তাদের দুঃশাসনে এক সময়ের স্বায়ত্তশাসিত কাশ্মির এখন নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের সেভেন সিস্টার খ্যাত রাজ্যগুলোও কেন্দ্রের শোষণের প্রতিবাদে স্বাধীনতা দাবিতে আন্দোলন করছে। কাশ্মিরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতের ভিত্তিতে স্বাধীনতার প্রশ্ন মীমাংসা হওয়ার জাতিসংঘের প্রস্তাবটি হিমাগারে ফেলে রেখেছে। সেখানে কেন্দ্রের শাসন জারি করে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। এই অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সৌদি আবরের সমর্থন আশা করেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। কিন্তু স্বঘোষিত মুসলিম দেশগুলোর অভিভাবক সৌদি আরব তাদের কথিত মিত্রদের খুশি রাখতে ভারতের পক্ষ নিয়ে পাকিস্তানকে বেকায়দায় ফেলেছে। উল্লিখিত ঘটনাপ্রবাহের ফলে এশিয়ার রাজনীতিতে লু-হাওয়ার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। এই লু হাওয়া শেষ পর্যন্ত গাজওয়ায়ে হিন্দ নাকি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত গড়াবে, সেই বিশ্লেষণে ব্যস্ত আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা। ফলাফল কী হবে তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, চীন ভারত পাকিস্তান সৌদি আরব দ্বন্দ্ব এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। সৌদি আরব-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে চীন মুসলিম বিশ্বের গর্ব হিসেবে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পৃথিবীর মানচিত্রে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে ছিল। ইসলামী আদর্শের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রত্যয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণেই দেশটির সাংবিধানিক নাম ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান। ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় গোটা দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্যে একটি আত্মবিশ্বাস জাগ্রত হয়েছিল। সাথে সাথে ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠীও আদাজল খেয়ে লেগেছিল দেশটির অগ্রযাত্রাকে অঙ্কুরেই শেষ করে দিতে। এখনো সেই অপচেষ্টা অব্যাহত আছে। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও পরিবর্তন এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যের শাসকদের মধ্যেও তথাকথিত প্রগতি আর সমৃদ্ধির নামে ইসলামবিরোধী মুসলিম নামধারী একটি গোষ্ঠী বেশ পাকা অবস্থান করে নিয়েছে। স্বর্ণকেশী ইহুদি নারী গোয়েন্দা আর ভারতের মুম্বাইয়ের সুন্দরী নায়িকাদের প্রেমের সাগরে হাবুডাবু খেতে খেতে শুধু তাদের ধর্ম আর চরিত্রই শেষ হয়ে যায়নি, উম্মাহর প্রতি ভালোবাসাও এখন শূন্যের কোটায়। এরই প্রতিফলন ঘটছে সর্বত্র। সৌদি আরবের সাথে পাকিস্তানের বর্তমান সম্পর্ক নিয়ে বিবিসি তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘কাশ্মির একমাত্র কারণ নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এখানে গুরুত্ব পাচ্ছে।’ বর্তমানের এই সম্পর্কের ফাটলের সাথে গত বছরের সুসম্পর্কের তুলনা করে প্রতিবেদনটিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ‘গত বছর ক্ষমতাধর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যখন ইসলামাবাদ সফর করেন, তখন পাকিস্তানে তিনি এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে ইমরান খান মজা করে বলেছিলেন, পাকিস্তানে নির্বাচন করলে যুবরাজ বিন সালমান নির্ঘাত জিতবেন। পাকিস্তানের আতিথেয়তায় দারুণ মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন পাকিস্তানিরা তাকে সৌদি আরবে তাদেরই একজন দূত হিসাবে দেখতে পারে। শত শত কোটি ডলারের বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ চুক্তি হয় ওই সফরে। পর্যবেক্ষকরা এক বাক্যে লিখেছিলেন, পাকিস্তান-সৌদি আরবের ঐতিহাসিক সম্পর্ক নতুন এক মাত্রা পেল। কিন্তু মাত্র ১৮ মাস পর সৌদি-পাকিস্তান সম্পর্ক মুখ থুবড়ে পড়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি যে ভাষায় প্রকাশ্যে সৌদি আরবের সমালোচনা করেছেন, তাতে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। গত ৫ই আগস্ট ভারত-শাসিত কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা খারিজের প্রথম বর্ষপূর্তিতে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে কাশ্মির ইস্যুতে সৌদি আরবের অবস্থান নিয়ে চরম হতাশা এবং ক্ষোভ উগরে দেন তিনি। মি. কোরেশি বলেন, ‘সৌদি আরবের সাথে আমাদের সম্পর্ক খুবই ভালো। মক্কা ও মদিনার মর্যাদা রক্ষায় পাকিস্তানিরা জীবন দিতেও প্রস্তুত, কিন্তু আমাদের বন্ধু-প্রতিম দেশকে আজ বলছি তারা যেন কাশ্মির ইস্যুতে ভূমিকা রাখে। মুসলিম উম্মাহর যে প্রত্যাশা, তারা যেন তা পূরণ করে।’ পাকিস্তান বিশেষভাবে চেয়েছিল কাশিীর ইস্যুতে সৌদি আরব তাদের সমর্থন করুক এবং ভারতের ওপর চাপ তৈরি করুক। কিন্তু পরিবর্তে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলকে সৌদি আরব ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসাবে দেখেছে। এমনকি সৌদি আরবের অনিচ্ছাতেই ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) কাশ্মিরের ওপর একটি জরুরি বৈঠক ডাকা নিয়ে পাকিস্তানের প্রস্তাবে কান দেয়নি। সে কারণে ওআইসি জোটকেও একহাত নেন মি. কোরেশি। “আমি ওআইসিকে বিনীত অনুরোধ করছি, আপনারা যদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাউন্সিল না ডাকতে পারেন, আমি প্রধানমন্ত্রীকে (ইমরান খান) বলবো তিনি যেন এমন মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ে একটি সম্মেলন আয়োজন করেন, যেসব দেশ কাশ্মিরে ইস্যুতে পাকিস্তানের সাথে রয়েছে।’ স্পষ্টতই মি. কোরেশি মালয়েশিয়া এবং তুরস্কের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। সৌদি আরবের বিষয়ে সিনিয়র কোনো মন্ত্রীর এমন নজিরবিহীন মন্তব্যে একাধারে বিস্ময় এবং অস্বস্তি তৈরি হয়েছে পাকিস্তানে। মুখে কিছু না বললেও, প্রায় সাথে সাথেই সৌদি আরব জানিয়ে দেয় যে তারা চরম নাখোশ এবং যেখানে চাপ দিলে পাকিস্তানের গায়ে সবচেয়ে বেশি লাগবে, ঠিক সেখানেই হাত দিয়েছে সৌদি সরকার। দেশটি ২০১৮ সালে যে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার জরুরি ঋণ পাকিস্তানকে দিয়েছিল, তার মধ্যে ১০০ কোটি ডলার দ্রুত ফেরত চায় তারা। চীনের কাছ থেকে ধার করে সেই টাকা পাকিস্তান দিতে পারলেও জানা গেছে আরও একশো কোটি ডলার ফেরত চেয়েছে সৌদি আরব। পাশাপাশি, ধারে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ৩২০ কোটি ডলারের যে ক্রেডিট লাইন সৌদি আরব পাকিস্তানের জন্য অনুমোদন করেছিল, তার মেয়াদ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হিমঘরে ঢুকে গেছে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার বাহ্যিক একটা চেষ্টা দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানে। বলার চেষ্টা করা হচ্ছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি একান্তই তার নিজের, পাকিস্তান সরকারের নয়। কোন কোন মহল থেকে তাকে সরিয়ে দেয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মন্ত্রী মেহমুদ কোরেশির বক্তব্যকে অনেকে দায়িত্বজ্ঞানহীন বাগাড়ম্বর বলে আখ্যা দেয়ার চেষ্টা করা হলেও তিনি কি সত্যিই রাগের মাথায় না ভেবেই সৌদি আরবের ওপর ঝাল ঝেড়েছেন? নাকি বুঝে শুনেই কথা বলেছেন? পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রিজওয়ান নাসির ইসলামাবাদে বিবিসি উর্দু বিভাগের সুমাইলা জাফরিকে বলেন, "শাহ মেহমুদ কোরেশি একজন ঝানু রাজনীতিক। তার বিবৃতি, তার শব্দের বাছাই, বলার ভঙ্গি এবং বিবৃতির সময়- কোনটাই অপরিকল্পিত বিষয় হতে পারে না।" পাকিস্তানের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্কে এখন যে টানাপড়েন, অবশ্যই তার অন্যতম কারণ কাশ্মির ইস্যুতে মাথা গলাতে সৌদি আরবের অনিচ্ছা। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, শুধু কাশ্মিরই একমাত্র এবং প্রধান ইস্যু নয়। এর সাথে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক নতুন যে মেরুকরণ শুরু হয়েছে, তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। দিল্লির জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদোয়াজ বিবিসিকে বলেন, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের সম্পর্কের টানাপড়েনকে বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে। ইরানের চাবাহার বন্দর। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরে (সিপেক) ইরানের অন্তর্ভুক্তি এবং তাতে পাকিস্তানের সায় দেয়াটাকে সৌদি আরব একেবারেই পছন্দ করছে না। তার মতে, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বৈরিতাকে কেন্দ্র করে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কে যে অদলবদল চলছে, মূলত তার কারণেই পাকিস্তান-সৌদি সম্পর্কে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। অধ্যাপক ভরদোয়াজ বলেন, “সৌদি আরব আগাগোড়া যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র এবং বহুদিন ধরেই তারা ইসলামী দুনিয়ার নেতৃত্বে। কিন্তু নতুন শীতল যুদ্ধ সেই প্রচলিত ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনছে। চীন চাইছে, ইসলামী দুনিয়ায় সৌদি আরবের প্রাধান্য খাটো হোক। ফলে তারা ইরান, তুরস্ক, মালয়েশিয়ার ঘনিষ্ঠ হচ্ছে।” চীন এবং পাকিস্তানের ইকোনমিক করিডোর (সিপেক)-এর ভেতর ইরানের অন্তর্ভুক্তি এবং তাতে পাকিস্তানের সায় দেয়াটাকে সৌদি আরব একেবারেই পছন্দ করছে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের নীতি-নির্ধারকদের অনেকেই মনে করতে শুরু করেছেন যে দেশের নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ তার নিজের অঞ্চলেই নিহিত, মধ্যপ্রাচ্যে নয়। ড. রিজওয়ান নাজির বলেন, “পাকিস্তান যদি চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের মধ্যে ইরানকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয় এবং ইরানের চাবাহার বন্দর যদি এই করিডোরের অংশ হয়, তাহলে সৌদি আরব বদলা নেবে।” কারণ তার মতে, “ইরান ও সৌদি আরবের আদর্শিক দ্বন্দ্ব ব্যাপক। এখনও এই দুই দেশে ইয়েমেন, লেবানন বা সিরিয়ায় পরোক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত।” পাকিস্তান-সৌদি সম্পর্ক ঐতিহাসিক- ধর্ম ছাড়াও দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা এবং কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা বহুদিনের। কিন্তু বাণিজ্যিক সম্পর্কে ভারত অনেক এগিয়ে গেছে, এবং সৌদি আরবের বর্তমান সরকারের কাছে বাণিজ্য স্বার্থ প্রধান একটি অগ্রাধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত-সৌদি বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে এখন প্রায় ২,৭০০ কোটি ডলার, যা পাকিস্তান-সৌদি বাণিজ্যের ১০ গুণ। ভারত সৌদি তেলের অন্যতম শীর্ষ আমদানিকারক। ভারতে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে সৌদি আরব। ফলে এখন কাশ্মিরে ইস্যুতে নাক গলিয়ে দিল্লিকে চটানোর কোনো ঝুঁকি সৌদি আরব নিতে চাইছে না। পাকিস্তান এই বাস্তবতা বুঝতে পারছে যে চিরশত্রু ভারতের গুরুত্ব এখন সৌদি আরবের কাছে দিন দিন বাড়ছে, এবং তারা কিছু চাইলেই রিয়াদ তাতে সবসময় কান দেবে না। ফলে বিকল্প ভাবতে শুরু করেছে পাকিস্তান। তার কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছেন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী শিবলি ফারাজ। মি. ফারাজ সম্প্রতি বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “যদি কোনো বিদেশ নীতিতে কোন দেশের উদ্দেশ্য হাসিল না হয়, তাহলে নীতি-কৌশল তো বদলাতেই হবে।” “কাশ্মির ইস্যুতে অনেক দেশের জাতীয় স্বার্থের সাথে আমাদের জাতীয় স্বার্থ মিলছে না। সে ক্ষেত্রে যার সাথে আমাদের জাতীয় স্বার্থ মিলবে, তাদের কাছেই তো যেতে হবে।” পাকিস্তানি মন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের সাথে সৌদি আরবের বিশেষ করে যুবরাজ বিন সালমানের ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি পরিষ্কার, এবং “তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।” “এটা এমন একটি বিশ্ব, যেখানে বিভিন্ন দেশ তাদের জাতীয় স্বার্থে নতুন নতুন বন্ধু তৈরি করছে, জোটবদ্ধ হচ্ছে।” চীনের সাথে অর্থনৈতিক করিডোর তৈরির পাশাপাশি সৌদি বলয়ের বাইরে তুরস্ক. মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরান এবং কাতার মিলে যে একটি বিকল্প ইসলামী প্লাটফর্ম তৈরির চেষ্টা চলছে, তার দিকে গভীরভাবে নজর রাখছে পাকিস্তান। গত বছর ডিসেম্বরে মালয়েশিয়ায় প্রধানত ওই দেশগুলোর অংশগ্রহণে একটি সম্মেলনে আমন্ত্রিত হন ইমরান খান। আমন্ত্রণ গ্রহণও করেন তিনি, কিন্তু সৌদি আরবের চাপে শেষ মুহূর্তে তিনি যাননি। তা নিয়ে খেদ প্রকাশ করতেও পিছপা হননি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কুয়ালালামপুরে ইমরান খানের যাত্রা বাতিলের পর মি. কোরেশি বলেছিলেন, “সৌদি আরব চেয়েছে আমরা যেন না যাই। আমরা মালয়েশিয়ার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছি। মাহাথির মোহাম্মদ (মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী) আমাদের বাস্তবতা এবং দায়বদ্ধতা যে বুঝতে পেরেছেন, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।” ইসলামী বিশ্বে সৌদি আরবের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তুরস্কের সাথে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা যে বাড়ছে, তা স্পষ্ট। ওয়াশিংটনে গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সাময়িকীতে গবেষক মাধিয়া আফজাল লিখেছেন, সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের মধ্যে সর্বসাম্প্রতিক টানাপড়েন আবারো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে তার স্বার্থের জন্য পাকিস্তানের এখন প্রধান ভরসা চীন।” তবে পাকিস্তানের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক সহসা একবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকবে, তা মনে করেন না মিজ আফজাল। কারণ এখনও অর্থনৈতিকভাবে সৌদি আরবের ওপর পাকিস্তানের যে নির্ভরতা, তা থেকে সহসা দেশটি বেরুতে পারবে না। বিশ লক্ষ পাকিস্তানি সৌদি আরবে কাজ করেন। সরকার ছাড়াও পাকিস্তান সেনাবাহিনী অনেক সৌদি সাহায্য পায়। ১৯৬০-এর দশক থেকে পাকিস্তান সৌদি আরবের এবং সৌদি রাজপরিবারের নিরাপত্তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। সেই সাথে জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তান সৌদি আরবের ওপর নির্ভরশীল। ফলে, তার মতে, অদূর ভবিষ্যতে যে পাকিস্তান সৌদি প্রভাব বলয় থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে যাবে বা পাকিস্তানের ওপর সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা এবং রাজনৈতিক নির্ভরতা শূন্য হয়ে যাবে, তা বলার সময় এখনও আসেনি।” শুধু বাণিজ্যিক স্বার্থ নয় চলছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলা বিবিসির প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মুসলিম দুনিয়ার নেতা হিসেবে সৌদি আবরের একক গুরুত্ব আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। এখন আর শুধু শিয়াপন্থী ইরান নয়, সুন্নি তুরস্ক, মালেশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এক জোট হওয়ায় আস্তে আস্তে তুরস্কের প্রভাব বাড়ছে। এক সময় গোটা মুসলিম দুনিয়া তুর্কি খেলাফতের অধীনে ছিল। তখন সৌদি আরবও সেই খেলাফতের বাইরে ছিল না। সেই ইতিহাস সৌদি আরবের আতঙ্কের অন্যতম কারণ। তা ছাড়া সৌদি আরবের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইরানও তুরস্কের এই জোটের সাথে আছে। তুরস্ক চাচ্ছে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে একটি শক্তিশালী ইসলামী জোট গঠন করতে। কিন্তু আমেরিকা ও পাশ্চাত্য দুনিয়া এবং ইসরাইল ও ভারত তা চায় না। তাই সৌদি রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি আরামকোকে ভারতের রিল্যায়ান্স ইন্ডাস্ট্রির ১৫ শতাংশ শেয়ার কেনার ফাঁদসহ আন্তর্জাতিক রাজনীতির নতুন নতুন প্রলোভন দেখাচ্ছে মূলত শক্তিশালী মুসলিম জোট থেকে দূরে রাখতে। কারণ তারা জানেন, সৌদি আরব এই জোটে যোগ নিলে মুসলমানদের যে শক্তিশালী প্লাটফরম তৈরি হবে, তার মোকাবেলা করা এশিয়ার শক্তিশালী দেশ ইসরাইল, ভারত চীন শুধু নয় ইউরোপ আমেরিকার জন্য কঠিন হবে। তাই ইরানফোবিয়া ও তুর্কি প্রভাবের ভীতিকে কাজে লাগিয়ে সৌদি আরবসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে এই জোট থেকে দূরে রাখার রাজনৈতিক খেলা খেলেছে আন্তর্জাতিক দুনিয়া। চীন-ভারত সংঘাতের কারণ কী চীন ভারতের এই দ্বন্দ্ব আজকের নয়। ১৯৫১ ও ১৯৬২ সালে দুই দেশ যুদ্ধের জড়িয়ে পড়েছিল। তারপর প্রথাগত যুদ্ধ বা সীমান্ত সংঘর্ষ বন্ধ থাকলেও উত্তেজনা অব্যাহত ছিল। বেশ কয়েক বছর ধরেই ভারত অভিযোগ করছে, লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পার হয়ে ভারতীয় এলাকায় ঢুকে পড়ছে চীন। কখনও পাথরের ওপর চীনা ভাষায় লিখে যাচ্ছে। কখনও ভারতের এলাকায় চীনের সেনা বেশ কিছুদিন থেকে যাচ্ছে। তারপর প্রতিবাদ, আলোচনার পর তারা আবার ফিরে যায়। ভারত, চীন ও ভুটান সীমান্তে ডোকলামে রাস্তা বানানো নিয়ে ৭৩ দিন ধরে সংঘাত ও উত্তেজনা ছিল। কিন্তু এই বার লাদাখে যা হয়েছে, তার কারণটা ভিন্ন বলে বিশেষজ্ঞদের মত। এবারের সংঘাতের কারণ হিসাবে বেশ কয়কটি বিষয় উঠে আসছে। তার মধ্যে অন্যতম বলা হচ্ছে, কাশ্মির নিয়ে ভারতের সিদ্ধান্ত। কিছুদিন আগে জম্মু ও কাশ্মিরকে দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মির এবং লাদাখ। সেটা নিয়ে সংসদে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, আকসাই চীনও ভারতের অভিন্ন অঙ্গ। এটা নতুন কথা নয়। ভারতের বরাবরের অবস্থান। কিন্তু লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, চীনের দাবি, লাদাখের বেশ কিছু এলাকা বিতর্কিত ও তারা সেই এলাকা নিজেদের বলে দাবি করে আসছে। সেই সঙ্গে আকসাই চীন নিয়ে ভারতের দাবিকেও তারা হালকাভাবে নিচ্ছে না। প্রবীণ সাংবাদিক জয়ন্ত রায় চৌধুরী জার্মান বার্তা সংস্থা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘চীন আমাদের কাছ থেকে সবচেয়ে বড় সম্পদ যেটা নিয়ে নিয়েছে তা হলো আকসাই চীন। সেখান দিয়েই তিব্বত থেকে পাকিস্তানের মধ্যে রাস্তা যাচ্ছে। এরপর লাদাখ নিয়ে সিদ্ধান্তে চীন উদ্বিগ্ন।” বিরোধের আরেকটি বড় কারণ, লে থেকে দারবুক, শাইয়োক হয়ে দৌলত বেগ ওল্ডি বায়ুসেনা ঘাঁটি পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করছে ভারত। দৌলত বেগ ওল্ডিতে ১৬,৬১৪ ফুট উচ্চতায় বিশ্বের সর্বোচ্চ এয়ারস্ট্রিপ নির্মাণ করেছে ভারত। এই রাস্তা কারাকোরাম পাসের কাছে সিয়াচেন হিমবাহ পর্যন্ত গিয়েছে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা লাগোয়া এই রাস্তাই হলো বিরোধের অন্যতম কারণ। ভারত আবার এই রাস্তাকে আরও বিস্তার করতে চাইছে। অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল সুব্রত সাহা জার্মান বার্তা সংস্থা ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘চীনের মনে হয়েছে এই রাস্তা তাঁদের কাছে বিপদের কারণ। আমি এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। এই জায়গায় রাস্তা বানানো যে কী অসুবিধেজনক তা আমি জানি। অনেক চেষ্টা করে আমরা সফল হয়েছি। এর ফলে দৌলত বেগ ওল্ডি পর্যন্ত আমরা সহজে সেনা নিয়ে যেতে পারব। এর পূর্ব দিকেই আকসাই চীন এবং ওদের হাইওয়ে। উত্তর দিকে সাকসাম উপত্যকা যেটা পাকিস্তান বে আইনিভাবে চীনকে দিয়ে দিয়েছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সে জন্যই চীন রাস্তাটা নিয়ে এতটা চিন্তিত।” প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, “চীন নানাভাবে ভারতকে বিব্রত করতে চাইছে। বিশেষ করে ভারত যখন লাদাখ সীমান্তে কয়েকটি রাস্তা নির্মাণ করেছে, তাতে চীনের ঘোরতর আপত্তি আছে। একইভাবে নেপালের পাশ দিয়ে রাস্তা তৈরি নিয়েও তারা ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছে। সংঘাতের অনেকগুলো কারণ আছে। তার মধ্যে রাস্তা তৈরি একটি কারণ।” চীন তিব্বতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলো ১৯৫১ সালে। তার আট বছর পরে চতুর্দশ দলই লামা পালিয়ে ভারতে আসেন। ভারত তাঁকে আশ্রয় দেয়। চীন তার বিরোধিতা করে। তারপর শুরু হয় সীমান্তে দুই সেনার সংঘর্ষ। সিবিএসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুমিত দত্ত মজুমদার সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন আর্টিকেল ৩৭০ নিয়ে। তখন তিনি কাশ্মির, আকসাই চীন, পাক অধিকৃত কাশ্মির নিয়ে প্রচুর পড়াশুনো করেছেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ‘যদি ইতিহাস দেখা যায়, তা হলে দেখা যাবে অনেক যুদ্ধই হয়েছে ওয়ার্ম ওয়াটার নিয়ে। শীতপ্রধান দেশে অনেক সমুদ্র শীতে নাব্য থাকে না। চীনেরও একই সমস্যা আছে। সাউথ চায়না সমুদ্র নিয়ে কয়েক বছর ধরে প্রবল বিতর্ক চলছে। পাকিস্তানের দাক্ষিণ্যে পাক অধিকৃত কাশ্মিরের ভিতর দিয়ে চীন গুঞ্জেরা পাস হয়ে, স্কার্ডু হয়ে, ইসলামাবাদ গাদার পোর্ট পর্যন্ত রাস্তা বানায়। সেই বন্দর চীন ব্যবহার করে। ওরা খুব ভালো রাস্তা বানিয়েছে। কিন্তু শীত ও বর্ষায় রাস্তাটা বারবার বন্ধ হয়ে যায়।” সুমিতবাবুর মতে, ‘আমার মনে হয়েছে, ওরা বিকল্প রাস্তা বানাতে চাইছে। সেই রাস্তা তিব্বত থেকে সোজা স্কার্ডু পর্যন্ত যাবে। কিন্তু এই রাস্তাটা গালওয়ান হয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে নিয়ে দিয়ে যাবে। তখন এলএসি বদলাতে হবে। সেই প্রয়াসটাই চীন শুরু করেছে। চীনের মধ্যে বরাবর একটা আগ্রাসী মনোভাব আছে। তারই ঝলক দেখা যাচ্ছে লাদাখে।’ অমলবাবুর মতে, চীনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা আছে। তিব্বত দখলের পর থেকে তা বেড়েছে। তার ওপর অ্যামেরিকা এখন ভারতের কাছাকাছি এসেছে, তাই চীন বড় চিন্তিত। চীন এখন ভারতকে নানাভাবে বিব্রত করতে চাইছে। নেপালকে দিয়েও তারা ভারতকে বিব্রত করার চেষ্টা করছে। চীনের প্রবণতা হলো, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে আসা। চীন ভারত দ্বন্দ্ব কার পাল্লা ভারী ভারত যতই বিশ্ব পরাশক্তি হওয়ার ভাব নিক না কেন, বাস্তবতা হলো দেশটির অধিকাংশ মানুষ এখনো, অন্ন, বস্ত্র, খাদ্যের মতো মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত। টয়লেট ব্যবহার করতেও শিখেনি ভারতের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ। বিশুদ্ধ পানির অভাবে প্রতি বছর লাখ লাখ লোক মারা যায়। নরবলির মতো মানবতাবিরোধী কুপ্রথা চলে ধর্মের নামে। নেংটি পরা সাধুরা তাদের পবিত্র ধর্মগুরু। তাদের অথচ মুম্বাই, চেনাইয়ের ঝলকানি দিয়ে তারা বিশ্বকে দেখায় ভারত সভ্য দুনিয়ার নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা রাখে। তাদের এই দাদাগিরির খোলস কতটা ভঙ্গুর ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের সময় তা প্রমাণ হয়েছে। এবারও কয়েক হাজার মাইল এলাকা চীনাসৈনরা দখল করার পর সামনে আগানোর সাহস পাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক সামরিক বিশ্লেষকরা অবশ্য মনে করেন, ভারত এই কয়েক দশকে তার নাগরিকদের জীবন-মানের উন্নয়ন ততটা না করলেও বিশাল সামরিক ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যগুলোর বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, চীন এবং ভারতের মধ্যে বড় ধরনের কনভেনশনাল বা প্রথাগত সম্মুখ লড়াই হয়েছিল একবারই, ১৯৬২ সালে। কিন্তু ঐ যুদ্ধের পর বিগত দশকগুলোতে এশিয়ার এই দু’টি দেশ বিপুল সমরাস্ত্র সম্ভার গড়ে তুলেছে, পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে বৈরিতাও বেড়ে চলেছে। এই দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা কতটা? বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এবং পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? ভারত বা চীন- কেউই কি আসলে এরকম একটা যুদ্ধ চায়? আর এরকম সংঘাতে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলো কেন উভয় সঙ্কটে পড়বে? প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলির বিবিসিকে চীন-ভারত সম্ভাব্য সামরিক সংঘাতে গুরুত্বপূর্ণ নয়টি প্রশ্ন নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন: ১. চীন-ভারত সংঘাত কতটা উদ্বেগজনক? গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সীমান্তের তিনটি এলাকাতে চীনা এবং ভারতীয় সৈন্যরা নিজেদের শক্তি জোরদার করেছে। ভারত এবং চীনের মধ্যে যদিও সীমান্ত চিহ্নিতকরণ হয়নি, দু’পক্ষের মধ্যে কয়েকবার আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা হয়েছিল যে বর্তমানে যে পরিস্থিতি, সেটা লংঘন করা হবে না। কেউই বিদ্যমান পরিস্থিতি পাল্টানোর চেষ্টা করবেন না। এখন সোমবার রাতে যে ঘটনা ঘটেছে সে সম্পর্কে চীনা এবং ভারতীয়, দু’পক্ষের বক্তব্য একেবারে পরস্পরবিরোধী। দু’পক্ষই বলছেন যে অন্য পক্ষের সেনাবাহিনী তাদের আগের অবস্থান থেকে সামনে এগিয়ে এসে ভূমি দখল করেছেন এবং এবং সে কারণেই হাতাহাতি-মারামারি হয়েছে। কাজেই পরিস্থিতি একটু ঘোলাটে। দু’পক্ষই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রাখছে। কারা যে কোন এলাকায় ঢুকেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে দু’পক্ষই তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা ছেড়ে দিতে একেবারেই রাজি নয় এবং প্রয়োজনবোধে তারা হাতাহাতি করবেন। এবং সেটা তারা করেছেন। তবে গোলাগুলি হয়েছে এমনটা শোনা যায়নি। ২. এটা কি শুধুই সীমান্ত বিরোধ, নাকি এর পেছনে আরো বড় কিছু আছে? সেনাবাহিনী বা সশস্ত্রবাহিনী যা কিছু করে, তার পেছনে একটা রাজনৈতিক-কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট থাকে। বর্তমানে ভারত এবং চীনের মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে, সেটা বিশ্বজনীন প্রেক্ষাপটে সেটা বেশ বৈরি। বিশ্ব রাজনীতিতে এই দ্ইু দেশের অবস্থান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরে। আন্তর্জাতিকভাবে চীনের সেই অর্থে কোন মিত্র নেই। তাদের একটি মিত্রদেশ হচ্ছে পাকিস্তান। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র ২০ বছর ধরে বলা যায় ভারতের মিত্র রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৯-২০০০ সাল হতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের সম্পর্ক ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এর মধ্যে সামরিক সহযোগিতার ব্যাপারটিও রয়েছে। এই সহযোগিতা গত দুই দশকে অনেক দৃঢ় হয়েছে। ভারত বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কয়েকটি সামরিক জোটের অংশগ্রহণ করেছে। অন্যদিকে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক গত কয়েক বছরে বেশ বৈরি হয়ে গেছে, ভারত-মার্কিন সামরিক সহযোগিতাকে তাই তারা মোটেই পছন্দ করছে না। চীন এবং ভারতের মধ্যে বৈরিতার এরকম একটা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে। এই প্রেক্ষাপটে চীন-ভারত সম্পর্ক ক্রমশ শত্রুভাবাপন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই আলোকে দেখতে গেলে এই সীমান্ত বিরোধ তাদের মধ্যকার শত্রুতার একটি প্রকাশ মাত্র। ৩. চীন-ভারতের এই উত্তেজনা কি বৃহত্তর সামরিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে? চীন এবং ভারত, দুটি দেশই গত বছর দশেক ধরে তাদের সীমান্ত এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে। চীন এটা করেছে তিব্বতে। আর ভারত করেছে দক্ষিণের অরুণাচল প্রদেশে এবং লাদাখ অঞ্চলে। দুটি দেশই এসব জায়গায় রাস্তাঘাট করেছে, বিমান ঘাঁটি বানিয়েছে। রাডার স্টেশন বসিয়েছে। সৈন্য সমাবেশ বৃদ্ধি করেছে। দু’পক্ষই বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে। সেখানে সামরিক মহড়াও দিয়েছে দুই দেশ। কাজেই একটা যুদ্ধংদেহী মনোভাব সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেখা যাচ্ছে। এর পাশাপাশি চীন এবং ভারত, দুই দেশেই জাতীয়তাবাদী একটি মনোভাব জোরালো হয়ে উঠেছে। দুটি দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো দেখলে, বিশেষ করে ভারতে, এটা বেশ চোখে পড়বে। সেখানে চীনকে একটি বৈরি দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে অনেক কথা বলা হচ্ছে। চীনের সংবাদমাধ্যমগুলোতে অবশ্য ভারত অতটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। কিন্তু তারপরও যখনই ভারত সম্পর্কে কথা উঠছে, সেখানে জাতীয়তাবাদী একটা মনোভাব বেশ স্পষ্ট। সুতরাং এটা বলা যায়, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিকভাবে যে বৈশ্বিক মেরুকরণ, সেখানে ভারত এবং চীনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। দ্বিতীয়ত: দুই দেশেই একটা জাতীয়তাবাদী আকাক্সক্ষা বা চিন্তাধারা বেশ জোরদার হয়ে উঠেছে। তৃতীয়ত: যেসব সীমান্ত এলাকায় দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনী সামনা সামনি মোতায়েন আছে, সেখানে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। কাজেই সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ জটিল। ৪. ভারত কেন ‘৬২-র যুদ্ধে চীনের কাছে হেরে গিয়েছিল? ১৯৬২ সালের যুদ্ধের সময়ের প্রেক্ষাপট ছিল একেবারেই অন্যরকম। ১৯৪৭ সালে ভারত সরকার মার্কিন বিমানবাহিনীকে ৬টি বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করতে দিয়েছিল। এই ঘাঁটিগুলো থেকে মার্কিন বাহিনী চীনের ভেতর কমিউনিস্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এর পাশাপাশি ১৯৫০ সালে যখন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি বা গণপ্রজাতন্ত্রী চীন তিব্বত পুনর্দখল করে, তখন সেখানে একটি গেরিলা গোষ্ঠী চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালায়। এই গেরিলা গোষ্ঠীকে গোপনে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র মদদ জুগিয়েছিল। সেই সংঘাতের প্রেক্ষাপটেই কিন্তু ১৯৬২ সালের যুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো দুটি দেশের কোনটিই সীমান্তরেখা মেনে নেয়নি। চীনের হিসাব অনুযায়ী অষ্টাদশ শতাব্দীতে যে সীমান্তরেখা ছিল, তাতে অরুণাচল প্রদেশ এবং লাদাখের কিছু অংশ তৎকালীন চীন সা¤্রাজ্যের অংশ ছিল। ব্রিটিশরা যখন ১৯১৩ সালে সিমলা চুক্তি করে একটি সীমান্তরেখা এঁকেছিল, ম্যাকমোহন লাইন এবং অন্যান্য লাইন, সেটা চীন কখনো মানেনি। কিন্তু ব্রিটিশদের চিহ্নিত সেই সীমারেখাই ভারত বরাবার দাবি করেছে। কাজেই দু’পক্ষের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে ব্যাপক মতবিরোধ রয়েছে। কিন্তু মতবিরোধ মানেই যে যুদ্ধ, তা নয়। যুদ্ধ তখনই হয়, যখন দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের নেতারা সিদ্ধান্ত নেন যে তাদের পক্ষে অন্য পক্ষের অবস্থান আর মেনে নেয়া সম্ভব নয়। তখন যুদ্ধ বাধে। ৫. তার মানে কী দুই দেশ সম্মুখ যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে? দুটি দেশেরই স্বার্থ হচ্ছে যুদ্ধে না জড়ানো। কারণ যুদ্ধ হলে ক্ষয়ক্ষতি বেশ ব্যাপক হবে। দুটি দেশেরই ক্ষতি হবে। কাজেই দুই দেশই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাইছে। চীন এবং ভারত উভয়েরই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। দুই দেশের সংঘাতে যদি ক্রমবর্ধমান হারে ভয়ঙ্কর সমরাস্ত্রের ব্যবহার হতে থাকে, দুই দেশই আসলে পরস্পরকে ধ্বংস করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। কাজেই আমার ধারণা কোন দেশই সে রকম ব্যাপকতর কোন সংঘাতে জড়াতে চায় না। কারণ শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধের ফল কী দাঁড়াবে সেটা কেউই এখন পর্যন্ত বলতে পারে না। দ্বিতীয়ত ভারত এবং চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক এখন ব্যাপক আকার নিয়েছে। বিশ্বব্যাপী একটা অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে কোন দেশই এরকম একটা সম্পর্ক ক্ষুন্ন করতে চাইবে না। তৃতীয়ত, যুদ্ধ যদি খুব বেশি ছড়িয়ে পড়ে, সেটা যে ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনতে পারে সেটা দু’পক্ষই বোঝে। কারণ দুটি দেশই পারমাণবিক শক্তিধর। কাজেই তাদের চেষ্টা থাকবে উত্তেজনা কমিয়ে আনার। ৬. কিন্তু দুই দেশ যদি সত্যিই যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তখন সামরিক শক্তির দিক থেকে কে বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে? দু’টি দেশেরই বিপুল অস্ত্রসম্ভার রয়েছে এবং এসব অস্ত্রশস্ত্র বেশ আধুনিক। গত ২০ বছর ধরে দুটি দেশ শুধু নিজেরাই সমরাস্ত্র তৈরি করেনি, একই সঙ্গে অস্ত্র আমদানিও করেছে। বিশেষ করে ভারত পরপর পাঁচ বছর বিশ্বের সবচাইতে বেশি অস্ত্র আমদানিকারক দেশের স্থান দখল করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ইসরাইল থেকে তারা অনেক অত্যাধুনিক অস্ত্র এনেছে। তারা নিজেরাও বিদেশি প্রযুক্তি এনে নিজেরা অস্ত্র তৈরি করেছে। একইভাবে চীন রাশিয়া থেকে কিছু অস্ত্র কিনেছে, কিন্তু বেশির ভাগ অস্ত্র তারা এখন নিজেরা উৎপাদন করে । কাজেই অত্যাধুনিক অস্ত্র দু’পক্ষেরই আছে। কিন্তু সমস্যাটা হলো গিরিসংকুল পার্বত্য এলাকায় তারা সেইসব অস্ত্র কতটা ব্যবহার করতে পারবে। বিমান বহর এবং ক্ষেপণাস্ত্র হয়তো তারা ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু যাকে আমরা সেনাবাহিনী বলি, যারা মাটিতে যুদ্ধ করে, তারা তাদের গোলন্দাজ, সাঁজোয়া বা ট্যাংক বহর খুব একটা ব্যবহার করতে পারবে বলে মনে হয় না। গত কদিন ধরে গণমাধ্যমে, বিশেষ করে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে দুই দেশের সামরিক শক্তির অনেক তুলনামূলক হিসাব দেয়া হচ্ছে। তিব্বত আর শিনজিয়াং অঞ্চলে চীনের কত যুদ্ধবিমান, কত সৈন্য আর ট্যাংক আছে, তার পাশাপাশি ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় যে কমান্ডগুলো রয়েছে, সেখানে কত সৈনিক আর সরঞ্জাম আছে। কিন্তু এ ধরনের অঙ্কের হিসাব আসলে একেবারেই সঠিক নয়। কেননা যার যত সৈন্যই থাকুক, নানা কারণে সব সৈন্য কোন দেশই মোতায়েন করতে পারে না। কারণ যেখানে এই যুদ্ধ হবে, সেখানকার ভূপ্রকৃতি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাকেও বিবেচনায় নিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, যে জায়গা নিয়ে বিরোধ, সেটা কোন দেশের কাছে কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটির জন্য তারা কতটুকু পর্যন্ত বলপ্রয়োগ করতে প্রস্তুত, সেটাই আসল প্রশ্ন। কাজেই কোন সামরিক সংঘাতে এই প্রশ্নটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে সামরিক শক্তির চেয়ে। ৭. যদি দুদেশের মধ্যে যুদ্ধ বেধেই যায়, তখন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া বা অন্য ক্ষমতাধর দেশগুলো কে কী ভূমিকা নেবে? সাম্প্রতিক কালে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র দেশগুলোর বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যেমন জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইসরাইল এবং ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে। ভারতের এসব দেশের সামরিক সহযোগিতা বেশ ঘনিষ্ঠ। কাজেই এসব দেশ হয়তো রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিকভাবে ভারতকে সমর্থন দেবে। অন্যদিকে চীনের সে রকম আন্তর্জাতিক মিত্র নেই। রাশিয়া চীনের বন্ধুরাষ্ট্র, কিন্তু মনে রাখতে হবে অতীতে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতেরও ঘনিষ্ঠ মৈত্রী ছিল। ১৯৬২ সালে রাশিয়া কিন্তু চীনের বদলে ভারতকেই সমর্থন করেছিল। কাজেই প্রত্যেকটি দেশ হয়তো এখানে তার নিজের স্বার্থটাকে আগে দেখবে। ৮. দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মতো দেশের সঙ্গে চীন এবং ভারত, উভয় দেশেরই সুসম্পর্ক আছে। দুই দেশের মধ্যে যদি যুদ্ধ হয়, তখন সরাসরি কোনো পক্ষ নেওয়ার জন্য কি চাপ বাড়বে বাংলাদেশের উপর? এ ধরনের একটা চাপ গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের ওপর আছে। যেমন ২০১০ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছিলেন যে চীনের সাহায্যে তারা চট্টগ্রামের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করবেন। কিন্তু এই প্রস্তাব যখন বাংলাদেশ চীনের কাছে দেয়, তখন চীন সেটি গ্রহণ করেছিল। এই বন্দর নির্মাণে বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং জাপানের চাপের মুখে বাংলাদেশকে সেই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিতে হয়। পরে বাংলাদেশ জাপানের সাহায্য নিয়ে চট্টগ্রামে সামুদ্রিক বন্দর নির্মাণ করছে। এ ধরনের চাপ কিন্তু বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরেই অনুভব করছে। এটার মোকাবেলায় বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে তাদের সাধ্যমত কাজ করে চলেছে। তবে যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি যে বেশ জটিল হয়ে পড়বে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের অনেক সমরাস্ত্র চীন থেকে এসেছে। বাংলাদেশি সেনা অফিসাররা চীন থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। ভারতের সঙ্গেও বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, কিন্তু সেটা রাজনৈতিক সম্পর্ক, সামরিক নয়। এখনো পর্যন্ত ভারত থেকে বাংলাদেশ সে পরিমাণ সমরাস্ত্র কেনেনি। কাজেই এটা একটা জটিল সম্পর্ক। অর্থনীতি, রাজনীতি, কূটনীতি- সব দিক দিয়ে। কাজেই বাংলাদেশের মতো দেশগুলো, চীন এবং ভারত- দুই দেশের সঙ্গেই যাদের এরকম সম্পর্ক, তাদের জন্য বেশ জটিল একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে সন্দেহ নেই। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যুদ্ধ এড়ানোর জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। যেমন হটলাইনে দুই দেশের নেতারা তাৎক্ষণিকভাবে সরাসরি কথা বলে উত্তেজনা প্রশমনের ব্যবস্থা রেখেছিলেন। ৯. চীন এবং ভারতের বেলায় কি সেরকম কোন মেকানিজম আছে? এরকম ব্যবস্থা দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে আঞ্চলিক অধিনায়ক পর্যায়ে আছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের লেফটেন্যান্ট জেনারেল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে এরকম যোগাযোগ হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিকভাবে যারা আসলে সিদ্ধান্তগুলো নেবেন, তাদের মধ্যে যোগাযোগের কোন ব্যবস্থা এখনো আছে বলে মনে হয় না। চীনের নেতা শি জিনপিং যখন সম্প্রতি ভারত সফরে যান, তখন এরকম একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব উঠেছিল। তবে সেটি বাস্তবায়িত হয়েছিল কি না জানা যায়নি।’ যুদ্ধ কাম্য নয় আন্তর্জাতিক সমরবিশ্লেষকরা মনে করেন, সামরিক শক্তির র‌্যাঙ্কিংয়ে ভারতের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে আছে চীন। দেশটির অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার ঠিক পরে, অর্থাৎ তিন নম্বরে আছে চীন আর ভারত আছে চার নাম্বারে। দুই দেশেই পারমাণিক শক্তিধর। তাই যুদ্ধ হলে গোটা এশিয়ায় এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। কেউ কেউ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাও করেছেন। তাই শান্তিপূর্ণ সমাধানই কাম্য।

অবশ্য তার জন্য ভারতকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ করতে হবে। নিজের প্রভাব বাড়াতে অন্য দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। তা না হলে প্রকৃতির প্রতিশোধ থেকে তারা বাঁচতে পারবে না। লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সিনিয়র সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির