post

ছাত্ররাজনীতি লেজুড়বৃত্তিতে বাড়ছে অবক্ষয়

০৩ ডিসেম্বর ২০১৪

 মনির আহমেদ #

H-T-Emamবাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে অবক্ষয় বাড়ছেই। কোনভাবেই যেন লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না ছাত্র নেতাদের। ক’দিন আগেও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সুমন চন্দ্র নিহত হয়েছেন। একই ভাবে দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজে কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। ‘প্রথম আলো’র প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ছয় বছরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ছাত্রলীগের ৩৯ নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। যেখানে ছাত্রসমাজ চলমান রাজনীতির কলুষমুক্ত থেকে দেশীয় রাজনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার কথা, সেখানে আমরা উল্টো চিত্র দেখছি। এর একটি অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় ছাত্রসংগঠনগুলোর লেজুড়বৃত্তি। স্বকীয়তা হারিয়ে ছাত্রসংগঠনগুলো আজ অবক্ষয়ে পেয়ে বসা রাজনৈতিক নেতাদের ইশারা-ইঙ্গিতে পরিচালিত হচ্ছে। এই লেখায় এ বিষয়েই বিশ্লেষণের প্রয়াস পাচ্ছি। বলে রাখি- লেজুড়বৃত্তির বাইরে থেকে মেধাবী ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত ছাত্রসংগঠন যে দেশে নেই, তা বলা যাবে না। স্বকীয় অবস্থান ধরে রেখে নিজস্ব সংবিধানের আলোকে পরিচালিত সংগঠন এখনো রয়েছে। কিন্তু যেখানে বেশির ভাগ ছাত্রসংগঠনের একই অবস্থা, সেখানে এ ধরনের সংগঠনকে ব্যতিক্রম হিসেবে চিহ্নিত করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। প্রশ্ন হলো, কেন ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত তরুণরা লেজুড়বৃত্তিতে মেতে থাকছে? কেনইবা যোগ্যতা অর্জনের চিন্তা থেকে সরে এসে নেতাকে খুশি করার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে? যেখানে শিক্ষকদের পিতার সমতুল্য শ্রদ্ধ করার কথা, সেখানে একজন ছাত্র হয়েও অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছে! ছাত্রছাত্রীদের সাথে যেখানে সুসম্পর্ক রেখে তাদের কল্যাণে ভূমিকা রাখার কথা, সেখানে কেনইবা কিছু সংখ্যক ছাত্রকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে দলে আনার চেষ্টা করছে? সোজা কথায় বললে, নানাভাবে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা মাথায় চেপে বসেছে ছাত্ররাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টদের। ক’দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর মাননীয় উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের বক্তব্য আমরা শুনেছি। তিনি যেভাবে ও যে ভাষায় কথা বলেছেন, তাতে বোঝা যায় যে ছাত্রদের হালুয়া-রুটি ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে, যেন তারা মুরুব্বিদের কথা মেনে কাজ করে। এইচ টি ইমাম ছাত্রলীগ নেতাদের বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় শুধু পাস করার জন্য বলেছেন। আর পাস করতে পারলে মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করে দেয়ার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছেন। মাননীয় উপদেষ্টাসহ সরকারি দলের অনেক নেতাই এ ধরনের বক্তব্য অতীতে রেখেছেন। তাদের কথার যথার্থ নমুনা  দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে। এলাকার এক ছোট ভাইয়ের কথা বলতে পারি। এসএসসি পাস করার পর সে ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছিল। পড়াশোনায় কখনও সে খুব ভালো ছিল না। একদিন দেখা হতেই জিজ্ঞেস করলাম- কেমন আছো, কী করছ এখন? বললো, ভাই ভালোই আছি। অনেক কষ্ট করে এমপি সাহেবকে বলে ব্যাংকে একটা জব নিয়েছি। সেখানে এখন ভালোভাবেই আছি। আমি হাসতে হাসতে প্রশ্ন করলাম, এই কারণেই কি বাড়িতে এলে বেশ রাজনীতি চর্চা করছো? তার সহজ উত্তর, ভাই কী করব! না করে তো পারি না। এখন তো অনেকটা বাধ্য। এই ছোট ভাইটিই বছরখানেক আগে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে হামলা করে আহত করেছিল তার এলাকারই প্রতিপক্ষের কয়েকজন ছাত্রকে। ছাত্র নেতাদের অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তারা যে এই নেতাদের দিয়ে অনেক কিছু করিয়ে নিচ্ছেন, তা সহজেই বোঝা যায়। অনেক ছাত্র নেতাদের দ্বারা খুন, গুমসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এসবের পেছনে ইশারা রয়েছে, গ্রিন সিগন্যাল রয়েছে। আর এইচ টি ইমামের মত নেতারাই যে এসব ইশারা করেন, তা জনগণের বুঝতে বাকি নেই। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ছাত্ররাজনীতি করা মানে কিছু সুযোগ-সুবিধা আদায়। ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা তাই সেই পথেই ঝুঁকছে। এইচ টি ইমাম তার বক্তব্যে একটি বড় সত্য প্রকাশ করেছেন। দলীয় ক্যাডারদের প্রশাসনে নিয়োগ দেয়ার ফলে তারা যে গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসাতে যা সম্ভব তা-ই করেছেন, তা এই আওয়ামী নেতার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে। কাজেই এ কথা স্পষ্ট করেই বলা যায়, আজ যারা ছাত্রলীগ করছেন, তারা মুখে বড় কথা বললেও কোন আদর্শকে ধারণ করে মোটেও রাজনীতি করেন না। তাদের রাজনীতি মানে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা। নেতাদের পিছু পিছু ঘুরে নিজেদের আখের গোছানো। এ ধরনের রাজনীতিতে যে মেধার চর্চা নেই, মেধাবীর মূল্যায়ন নেই; তা দলের নেতাকর্মীদের কর্মকান্ডেই দৃশ্যমান। সিলেটে সুমন চন্দ্র নিহত হলেন আর ঢাকায় বসে ছাত্রলীগের সভাপতি বললেন, সুমন চন্দ্র ছাত্রলীগের কেউ নয়। এর জন্য তার সংগঠনের কোন দায় নেই। দায়হীন থাকার যে সংস্কৃতি আমরা জাতীয় রাজনীতিতে দেখছি, এটা কি তার অন্ধ অনুকরণ নয়? গত উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে সারাদেশে যে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে, তা দিবালোকের মত স্পষ্ট। আর এই কারচুপির জন্য সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সদলবলে গিয়ে ভোটকেন্দ্র দখল, ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা, জোরপূর্বক বের করে দেয়াসহ নানান অপকর্মের সাথে তারা জড়িত ছিল। নেতার হয়ে যেকোনো অপকর্ম করতে তাদের কোনভাবেই বাধে বলে মনে হয় না। জনগণের প্রাণের দাবি, ছাত্ররাজনীতি ছাত্রদের দ্বারাই পরিচালিত হবে। ওপর থেকে কেউ ছড়ি ঘোরাবে না। ছাত্ররারাজনীতি করার মাধ্যমে মানুষ হিসেবে নিজেদের উৎকর্ষ সাধনের সুযোগ পাবে। নিজেদের যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলে পরবর্তীতে দেশ ও সমাজের নেতৃত্বদানে সক্ষম হিসেবে প্রমাণিত করবে। কিন্তু জনগণের দাবির প্রতিফলন ছাত্ররাজনীতিতে নেই। যার ফলে ছাত্ররাজনীতি দিনে দিনে আরো কলুষিত হচ্ছে, আর তার সাথে দেশের ভবিষ্যতও হচ্ছে অন্ধকারাচ্ছন্ন। একজন সচেতন মানুষ কখনোই একটি টেপ রেকর্ডারের মতো নয়। একটি টেপ রেকর্ডার যে কোন কিছু ধারণ করে হুবহু তা তুলে ধরে। সচেতন যে কোন মন কোনকিছু শোনার পর তা যাচাই করে নেয়। নিজের বিবেচনা বোধকে কাজে লাগিয়ে কোন কাজে যুক্ত হয়। কিন্তু ছাত্ররাজনীতির সাথে আজ যারা যুক্ত, তাদের মাঝে এ বিবেচনা বোধ আছে কি? লেখক : প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির