post

জামায়াতকেই মুক্তির দিশারি রূপে গ্রহণ করবে জনগণ

০৬ মে ২০১৫

মতিউর রহমান আকন্দ#

Kamaruzzamanবাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের নন্দিত নেতা, বরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ, দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল জনাব মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ১১ এপ্রিল শনিবার রাত ১০টার পর সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। সারা জীবন গঠনমূলক রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে সকল মহলে যিনি সমাদৃত, দেশের শিক্ষিত-সচেতন মহলে যিনি একজন বুদ্ধিজীবী, লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে পরিচিত এবং সাধারণ জনতার নিকট যিনি একজন পরোপকারী ব্যক্তি হিসেবে নন্দিত, সরকার তাকে হত্যা করার মাধ্যমে মূলত একটি প্রতিভাকে হত্যা করেছে। কামারুজ্জামানকে হত্যা করার মাধ্যমে বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক, গঠনমূলক রাজনীতি চর্চার কবর রচনা করা হলো। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি সত্যের পথে আপসহীন ভূমিকা পালন করে গেছেন। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার অপরাধে মিথ্যা, ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছে এবং সরকার তাকে নির্দয়, নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। বাংলাদেশের জমিনে দ্বীন কায়েমের জন্য তার এ রক্ত এ দেশের জমিনকে দ্বীন কায়েমের পথে আরো উর্বরতা দান করবে। মহান রাব্বুল আলামিন তার শাহাদাত মঞ্জুর করুন। তার প্রতি ফোঁটা রক্তের বিনিময়ে এ জমিনকে মহান রাব্বুল আলামিন ইসলামের জন্য কবুল করুন। আমিন। শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান নিজের জীবন দেয়ার মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন তিনি। পৃথিবীতে এমন মৃত্যু ক’জনার হয়, যাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের অসংখ্য, অগণিত মানুষ বুকফাটা আর্তনাদ ও হাহাকার নিয়ে কান্না করতে থাকে! অভিশাপ দিতে থাকে তার হত্যাকারীদের! এ মৃত্যু গৌরবের, এ মৃত্যু সম্মানের। শহীদ কামারুজ্জামানকে নিয়ে রচিত হবে মহাসত্যের ইতিহাস। ষড়যন্ত্র ও কাপুরুষোচিত রাজনীতির মুখোশ উন্মোচিত হবে। সত্যানুসন্ধিৎসু জনতা তার বিরুদ্ধে অবিচারের নির্মমতা উপলব্ধি করবে। বিবেকের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে শহীদ কামারুজ্জামানের ওপর জুলুমের প্রচন্ডতা ও সত্যের প্রতি তার জীবন কোরবানের উদ্দীপনাময় ভূমিকা দেখে মানুষ কামারুজ্জামানের প্রতি আরো সহানুভূতিশীল হবে। দ্বীন প্রতিষ্ঠার চেতনায় উদ্বেলিত হবে। শহীদ কামারুজ্জামানের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে বাংলার সবুজ জমিনে। ইনশাআল্লাহ্। এটা অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয় যে, আইন পেশায় সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে কারাগারের লৌহ পিঞ্জিরে আবদ্ধ সরকারের কড়া বেষ্টনীর মধ্যে একান্ত নিরিবিলি পরিবেশে তার সাথে বহুবার কথা বলার, হাত ও বুক মিলানোর সুযোগ পেয়েছি। দু-একটি সাক্ষাৎকারের বিষয় সম্পর্কে গণমাধ্যমে লেখারও চেষ্টা করেছি। তার সাথে সাক্ষাৎ ও সান্নিধ্যে কাটানোর প্রতিটি মুহূর্ত ও তার মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দই শিক্ষণীয় ও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। মহান আল্লাহ তায়ালা সুযোগ দিলে এসব বিষয় সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে লেখার ইচ্ছা রইলো। ফাঁসি কার্যকরের পূর্বমুহূর্তে সর্বশেষ সাক্ষাতে তিনি যেসব কথা বলেছেন তার সামান্য অংশ এখানে তুলে ধরা হলো। যে সময়ের যে অভিযোগে তাকে হত্যা করা হলো সে সময়ে তিনি উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীর একজন ছাত্র ছিলেন। শেরপুরের নিভৃত পল্লীর একজন তরুণ এই বয়সে কিভাবে সরকারের এই অভিযোগের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে তা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ অবশ্যই মূল্যায়ন করবেন। নিছক রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য সরকার তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। তিনি রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের শিকার। জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়ে শাহাদাতের পূর্বমুহূর্তে তিনি ইসলামী আন্দোলনের কর্মী ও তার প্রিয় দেশবাসীর উদ্দেশে যে বক্তব্য রেখে গেছেন তা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। মৃত্যুদন্ড কার্যকরের প্রস্তুতি চলাকালে তিনি বলেছেন : আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ, আমাকে অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। যে সোহাগপুর পল্লীর ঘটনার সাথে আমাকে জড়ানো হয়েছে তার সাথে আমার দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। আমি জুলুমের শিকার। আল্লাহ তায়ালা যেন আমার শাহাদাতকে কবুল করেন। আমি দেশবাসীর নিকট এই দোয়াই কামনা করি। আমার ওপর যে অবিচার করা হয়েছে তার বিচারের ভার আমি সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক মহান রাব্বুল আলামিনের নিকট অর্পণ করলাম। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন আদালতে আখিরাতে ন্যায়বিচার করবেন এবং আমাকে হত্যা করার প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককে উপযুক্ত শাস্তি দেবেন। আমি আমার শাহাদাতের আগে আন্দোলনের কর্মীদের উদ্দেশে বলতে চাই, এ আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে কুরআনের চর্চা ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। বিশেষ করে তাফহিমুল কুরআন গভীর মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করতে হবে। কুরআন আমাদেরকে আলোর পথ দেখাবে। কারাগারের বন্দিশালায় আটক জীবনযাপনের সময় আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি, কুরআনের জ্ঞানের চাইতে শক্তিশালী সম্পদ আর কিছু হতে পারে না। আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে এই জ্ঞানের ভান্ডার যত সমৃদ্ধ হবে আন্দোলন তত সমৃদ্ধ হবে। কর্মীদের নৈতিক মান মজবুত হবে। ঈমানের দৃঢ়তা বৃদ্ধি পাবে। সর্বোপরি আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার চেতনা বেগবান হবে। আমি প্রতিটি কর্মী ভাইকে কুরআনকে তাদের নিত্যসঙ্গী বানানোর জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে শুধুমাত্র আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যই নিরলস প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বাতিলের সাথে ইসলামী আন্দোলনের কোন আপস হতে পারে না। সত্যের নিকট মিথ্যার পতন অবশ্যম্ভাবী। মিথ্যা সবসময়ই পরাভূত এবং পরাজিত। মিথ্যার দানবীয় শক্তির নিকট ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা কোন দিনও আপস করতে পারে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের নিকট থেকে ঈমানের পরীক্ষা গ্রহণের কথা বলেছেন। এ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয় মহান রাব্বুল আলামিন তাদের হাতেই দ্বীনের ঝান্ডা তুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আমি আন্দোলনের কর্মীদেরকে আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা দিয়েছেন, আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে পছন্দ করেন তাদেরকেই শহীদ হিসেবে কবুল করেন। বিনিময়ে শহীদের রক্তঝরা ময়দানে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করেন। আমি দেশবাসীর নিকট দোয়া চাই, আমি যেন আল্লাহর পছন্দনীয় বান্দা হিসেবে তার নিকট গৃহীত হই। আল্লাহর পছন্দের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চাইতে মুমিনের জীবনে উত্তম প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মী ভাইদের উদ্দেশে বলতে চাই, আপসহীন ভূমিকা পালন করে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এ দেশের মানুষ অত্যাচারীর হাত থেকে উদ্ধারের জন্য জামায়াতকে তাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে গ্রহণ করবে ইনশাআল্লাহ্। আমি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী ভাইদের উদ্দেশে বলতে চাই, তরুণ বয়সে নিজেদের লেখাপড়া ও সকল কিছু উৎসর্গ করে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য তারা যে ত্যাগ স্বীকার করেছে এ দৃষ্টান্ত বিরল। তাদের ত্যাগ কিছুতেই বৃথা যাবে না। আল্লাহ তায়ালা তরুণদের রক্তের ওপরে তার দ্বীনকে বিজয়ী করবেন ইনশাআল্লাহ্। আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও দেশ এবং জাতি জুলুমের হাত থেকে মুক্তি পাক। আল্লাহ্ আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিকে সকল ষড়যন্ত্রের হাত থেকে উদ্ধার করুন। ইসলামী আন্দোলনের অপরাধে যারা আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদেরকে হত্যা করার চক্রান্ত করছে শেষ পর্যন্ত ওরা রেহাই পাবে না। নতুন প্রজন্ম ও বিশ্ববাসী শিগগিরই তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে পারবে ও তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। ষড়যন্ত্রকারীদের করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে। সত্যের কাছে অসত্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। মহান রাব্বুল আলামিন সূরা আলে ইমরান, সূরা নিসা ও সূরা আম্বিয়াসহ কুরআনের বহু স্থানে ঘোষণা দিয়েছেন সত্যের কাছে অসত্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। অসত্যের দ্বারা সত্যকে কখনো ঢেকে রাখা যায় না। ফাঁসির মঞ্চে যাবার আগে ১১ এপ্রিল শনিবার শহীদ কামারুজ্জামানের পরিবারকে কারাকর্তৃপক্ষ তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য চিঠি দেয়। পরিবারের সদস্যগণ নির্দিষ্ট সময়ে কারাগারে উপস্থিত হন। নির্ভীক অবিচল কামারুজ্জামান পরিবারের সদস্যদেরকে ধৈর্য ও শান্ত থাকার আহ্বান জানান। তিনি পরিবারের সদস্যদেরকে নসিহত করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দেন, রাষ্ট্রপতি প্রাণের মালিক নন যে তাঁর কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে হবে। পরিবারের সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ শেষে জনাব মুহাম্মদ কামারুজ্জামান তাঁর প্রভুর নিকট উপস্থিত হবার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। অজু, গোসল করে নামাজ ও কুরআন তিলাওয়াত করতে থাকেন। নির্দিষ্ট সময়ে যখন তাঁকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তিনি উচ্চস্বরে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। সেই সাথে কালেমা তাইয়্যেবা ও কালেমা শাহাদাত উচ্চারণ করতে করতে তিনি ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে যান। সামান্য সময়ের জন্যও তিনি বিচলিত হননি। অত্যন্ত দৃঢ় পদক্ষেপে ফাঁসির মঞ্চে এগিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। তিনি দুনিয়ার সকল মায়া এবং মোহ ত্যাগ করে মহান আল্লাহ তায়ালার দিদার লাভের উদ্দেশে উচ্চস্বরে কালেমা তাইয়্যেবা উচ্চারণ করেন। এ অবস্থায় তাঁর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। শাহাদাতের পর শহীদ কামারুজ্জামানকে হত্যা করার পর এ জালেম সরকার তাঁর নামাজে জানাজা সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে দেয়নি। এমনকি তাঁর পরিবারের সকল সদস্যকেও তাঁর শহীদি মুখ দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করেছে। ১২ এপ্রিল ভোরে তাঁর লাশ দাফনের সময় তাঁর কবরস্থলের চতুর্দিকে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত থেকে চিৎকার করতে থাকলেও শহীদ কামারুজ্জামানের লাশ সামনে নিয়ে নামাজে জানাজা পড়তে দেয়া হয়নি। ওরা ভেবেছিল এভাবেই কামারুজ্জামানকে মানুষের হৃদয় থেকে মুছে ফেলা যাবে। কিন্তু তাদের এ চিন্তা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ঐ দিন সকাল ৯টা পর্যন্ত শহীদ কামারুজ্জামানের কবরের কাছাকাছি অসংখ্য নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অসংখ্য মানুষ মাটির সাথে গড়াগড়ি করে হৃদয় ফাটানো কান্নায় ভেঙে পড়েছে। দুই হাত তুলে মহান রবের দরবারে কামারুজ্জামানের শাহাদাত কবুলের জন্য দোয়া করেছে। প্রতিদিন সেখানে অসংখ্য মানুষের আগমন ঘটছে। জীবিত কামারুজ্জামানের চাইতে শহীদ কামারুজ্জামান ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছেন। ১৮ এপ্রিল শনিবার আমরা গিয়েছিলাম শহীদ কামারুজ্জামানের কবর জিয়ারত করতে। কোন ঘোষণা ছাড়াই আমরা কয়েক জন সেখানে উপস্থিত হয়েছিলাম। তা সত্ত্বেও আমাদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে চতুর্দিক থেকে শতশত মানুষ কামারুজ্জামানের কবরস্থানে এসে উপস্থিত হন। তাদের কান্না ও আর্তনাদ এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা করে। এ দৃশ্য চলতে থাকবে অনাদি-অনন্ত কাল পর্যন্ত। কামারুজ্জামানের প্রতি মানুষ আরও সহানুভূতিশীল হবে। যারা তাকে হত্যা করেছে তাদেরকে জনগণ ধিক্কার জানাতে থাকবে। জনাব মুহাম্মদ কামারুজ্জামান পরিবারের সাথে শেষ সাক্ষাতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মহান আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে দোয়া করেছেন, আল্লাহ তায়ালা যেন তার শাহাদাতকে কবুল করেন। আমরা রাব্বুল ইজ্জতের দরবারে হৃদয় উজাড় করা আবেগ দিয়ে দোয়া করছি, হে আল্লাহ্, তুমি আমাদের প্রিয় নেতা ও ভাই শহীদ কামারুজ্জামানের শাহাদাতকে কবুল কর। আমিন। স্বপ্নে শহীদ কামারুজ্জামান ০৩ নভেম্বর ২০১৪, মহামান্য আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে জনাব মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে প্রদত্ত মৃত্যুদন্ডের রায়ের আপিল খারিজ করে দেন ও মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন। এর পরপরই তাকে কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। সরকারের আইনমন্ত্রী কারাকর্তৃপক্ষকে ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। এমনি পরিস্থিতিতে তার সাথে সাক্ষাতের জন্য আমরা পাঁচজন আইনজীবী কারাকর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করি। ৫ নভেম্বর ২০১৪, সন্ধ্যায়ই জানা গেলো পরদিন ৬ নভেম্বর সকাল ১০টায় আমাদের সাক্ষাৎকার। মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম। এই সঙ্কট সন্ধিক্ষণে অনেক স্মৃতি অনেক ঘটনাই মনে পড়লো। মনের মাঝে তখন এক তুফান বয়ে চলছে। ছাত্রজীবনের আন্দোলনের কঠিন মুহূর্তে তাকে পেয়েছিলাম অভিভাবক হিসেবে, আবার বড় ভাই হিসেবে। তার সাথে সম্পৃক্ত অনেক স্মৃতির কথা স্মরণ করতে করতে চোখে ঘুম এসে গেলো। ঘুমে এক উদ্দীপনাময় স্বপ্ন দেখলাম। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আমার ভায়রা ভাইয়ের ছেলে শহীদ সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুম ও অপর আত্মীয় হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপন শাহাদাত বরণ করে। দীর্ঘ আট বছর পর আজ রাতে স্বপ্নে তাদের সাথে সাক্ষাৎ। স্বপ্নে দেখছি হঠাৎ মাসুম আমার সামনে হাজির। তার মুখমন্ডল থেকে সূর্যের আলোকরশ্মির মতো জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। এর পরই দেখলাম একই রূপে আমার দিকে এগিয়ে আসছে শিপন। স্বপ্নেই তাদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা কেমন আছ?’ তারা জবাব দিলো, ‘খালু আমরা খুব ভালো আছি। আমরা যে হোস্টেলে আছি সেখানে উন্নতমানের খাবার দেয়া হয়। খুবই উন্নতমানের ঘরে আমরা ঘুমাই, প্রতিনিয়ত আমাদের নামে উপহার আসে। আমাদের কোনো জিনিসের অভাব নেই। আপনি কি আমাদের হোস্টেলে যাবেন? আসুন আমরা আপনাকে সেখানে নিয়ে যাই।’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই যাবো। তোমাদের থাকার জায়গাটা আমি দেখতে চাই।’ তারা আমাকে হাত ধরে সামনে এগোতে লাগলো। কিছুদূর এগোতেই দেখলাম বিশাল এক প্রাচীর আমাদের সামনে। তারা কিছুদূর অগ্রসর হতেই প্রাচীরটা বিভক্ত হয়ে গেলো। তারা দু’জন ভেতরে প্রবেশ করলো। কিন্তু আমি প্রাচীরের সামনে যেতেই প্রাচীরটা আবার জোড়া লেগে গেলো। আমি হাত দিয়ে প্রাচীরের বিভক্তি স্থান শনাক্ত করার চেষ্টা করছিলাম। প্রাচীরটি অনেক মোটা মনে হলো। কয়েকবার চেষ্টা করেও পারলাম না প্রাচীরের বিভক্তি স্থান শনাক্ত করতে। এমন সময় পেছন থেকে একটি ডাক শুনতে পেলাম, ‘আকন্দ থামো।’ মনে হলো কণ্ঠটি অনেক পরিচিত। পেছনে তাকানোর চেষ্টা করলাম। মনে হলো দূর থেকে কেউ ডাকছে। হঠাৎ সামনে দেখলাম কামারুজ্জামান ভাই এগিয়ে আসছেন। লক্ষ্য করলাম তিনি এগিয়ে আসতেই প্রাচীরটি আগের মতো খুলে গেলো। আর কামারুজ্জামান ভাই বললেন, ‘তুমি একটু অপেক্ষা কর।’ আমি লক্ষ্য করলাম উনি ঢোকার সাথে সাথে তা আবার বন্ধ হয়ে গেলো। প্রাচীরের অংশবিশেষ খুলে যাবার সাথে সাথে একপলকের দৃষ্টিতে ভেতরের দৃশ্যটি আমার চোখের পর্দায় আটকে গেলো। আমি দেখতে পেলাম, বিরাট প্রশস্ত এক উদ্যান। সারি সারি গাছ, ফুলের বাগান, দুই দিক দিয়ে বিস্তৃত কার্পেট বিছানো রাস্তা। এমন বাগান আমি কখনো দেখিনি। দেখলাম বাগানের ঠিক মধ্যখানে একটি পানির নহর। তার রঙ নীলাভ। নহরের মাঝখানে দেখলাম পানির সুউচ্চ ফোয়ারা। সেখানে সাদা, লাল ও বেগুনি রঙের পানি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সূর্যের কিরণে তা ঝলমল করছে। রাস্তার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত অনেক তরুণ সারিবদ্ধভাবে নানা ধরনের ফুলের সমাহারে সজ্জিত তোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছে। এর মাঝেই কামারুজ্জামান ভাই ভেতরে প্রবেশ করলেন। সমস্বরে একটি ধ্বনি শুনতে পেলাম। ‘আহ্লান, সাহ্লান, কামারুজ্জামান।’ আমি ‘মাসুম মাসুম, শিপন শিপন, কামরুজ্জামান ভাই...’ বলে চিৎকার করে উঠলাম। মাসুম বললো, ‘খালু আমি হোস্টেল সুপারের অনুমতি নিয়ে আপনাকে নিয়ে আসবো, একটু দাঁড়ান।’ হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। আট বছর আগে যে শিপন, মাসুম শহীদ হয়েছে স্বপ্নে তাদের সাথে সাক্ষাৎ, তাদের সাথে এগিয়ে যাওয়া, প্রাচীর খুলে যাওয়া, প্রাচীরের ভেতরের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য আমার মাঝে এক উদ্দীপনার সৃষ্টি করলো। কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের আগে এ স্বপ্ন আমার মাঝে এক ভাবান্তর সৃষ্টি করলো। বারবার মনে উদয় হচ্ছিল প্রাচীরটা কিসের? কেনই বা এ প্রাচীর? শহীদ মাসুম, শহীদ শিপনের জন্য খুলে গেলো, আবার আমি এগিয়ে আসতেই কেন তা বন্ধ হয়ে গেলো? মাসুমই বা হোস্টেল সুপারের অনুমতির কথা বলে কী বোঝাতে চাইলো? বিশাল বিস্তীর্ণ উদ্যানই বা কিসের? এ স্বপ্নের তাৎপর্য কী? এসব ভাবতে ভাবতেই সকাল হয়ে এলো। ফজরের নামাজ আদায়, কুরআন অধ্যয়ন, গোসল ও নাশতা সেরে ছুটে চললাম কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্দেশে। সেখানে কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাক্ষাতের জন্য কারাফটকের ভেতরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম। সামান্য পরই তাকে আমাদের সামনে নিয়ে আসা হলো। রাতের স্বপ্নে যে পোশাকে তাকে দেখেছিলাম সে পোশাকেই যেন তিনি আমাদের সামনে হাজির হলেন। এর পর পেরিয়ে গেছে পাঁচটি মাস। এই পাঁচ মাসে চারবার তার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। প্রত্যেকবারই স্বপ্নের সেই পোশাকে সজ্জিত অবস্থায় তাকে আমাদের সামনে আসতে দেখেছি। ১১ এপ্রিল শনিবার রাতে তাকে হত্যা করার পর বারবার সেই স্বপ্নের কথা মনে হচ্ছিল। এ স্বপ্ন আমার অন্তরে চির দীপ্যমান থাকবে। প্রাচীরের ভেতরের সেই নয়নাভিরাম সৌন্দর্য বারবার আমার দৃষ্টিশক্তিতে ভেসে উঠছে। এক অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে উঠছে হৃদয়, মন। হৃদয়ের সীমাহীন হাহাকার আর স্বপ্নের সেই অপরূপ দৃশ্য মনোজগতে এক বিভীষিকাময় দৃশ্যের অবতারণা করছে। অন্তর ফাটানো আবেগ দিয়ে দোয়া করি, হে আল্লাহ্! তুমি আমাদের প্রিয় নেতা কামারুজ্জামান ভাইয়ের শাহাদাতকে কবুল কর। আমিন। লেখক : শহীদ কামারুজ্জামানের আইনজীবী

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির