post

জীবন্ত শহীদ আমিনুর রহমান আমান

০৭ অক্টোবর ২০১৪

ডা: মুহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক

Chhatrasangbad২৮ অক্টোবরের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতেতে বাঁক পরিবর্তনের ইতিহাস, ফলে বাংলাদেশের স্থিতির সাথে সাথে ২৮ অক্টোবরের স্মৃতি অটুট থাকবে । ঐদিন সময় আনুমানিক ১১.০০ পল্টন মোড় কস্তুরী হোটেল এলাকায় শৃঙ্খলা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন নওশাদ আলম ভাই (তৎকালীন মহনগরী সেক্রেটারি ও তার সহকারী আমিনুর রহমান আমান ভাই (তৎকালীন মহানগরী প্রশিক্ষণ সম্পাদক)। নওশাদ ভাই, মোস্তফা আল মাহমুদ ইমরোজকে (তৎকালীন মহানগরী সংস্কৃতি সম্পাদক ) মূল দায়িত্বশীল করে কাফরুল থানার সকল জনশক্তিকে বায়তুল মোকাররম মার্কেট ও জিপিওর মাঝখানের রাস্তায় শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব প্রদান করে চলে গেলেন । এর প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট পরেই শুরু হল নব্য হিন্দা বাহিনীর লগি বৈঠার তাণ্ডব, ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া, ইটের খোয়ার ঢিলাঢেলিতে এলাকাটি মুহূর্তের মধ্যে রণক্ষেত্রে পরিনত হল। হঠাৎ কিছু বুঝে উঠার আগেই ডান হাত অবশ হল, কান ফেটে রক্ত বের হল, কিছুক্ষণ পর মাথায় আঘাত লাগার কারনে হাসপাতালে ভর্তি হলাম। কুরআন হাদিসে অসংখ্যবার বদর, ওহুদ, খন্দক যুদ্ধের কাহিনী পড়েছি। কিন্তু বাস্তবে দেখা উপলব্ধির সুযোগ কমই পেয়েছি। বিশেষ করে কাফরুল থানার কলেজগামী কর্মী তাহসীন, জিয়া, মিথুন ও কামরূলের সেদিনের ভুমিকা আমাদের মায়াজ-মুয়াজের কথা মনে করিয়ে দেয়। কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ ভাই যখন সামনে আসতেন সাথীরা সাথে সাথে মাসুদ ভাইয়ের চারদিকে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করত। আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে রক্ষার জন্য বিষয়টি ওহুদ যুদ্ধের ঘটনার বাস্তব প্রতিচ্ছবি বলে মনে হল। হাসপাতালে আসার পর প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়ার সময় তৎকালীন কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক রেজাউল করিম ভাইকে হুইল চেয়ারে করে নিয়ে আসতে দেখলাম। একে একে অসংখ্য চেনা অ-চেনা ভাইয়ের রক্তাক্ত অবস্থা অবলোকন করলাম। একটু পর বাকীদের খোঁজ খবর নেয়া শুরু করলাম। প্রথমে আমান ভাইকে রিং দিয়ে সেটটি বন্ধ পেলাম। তখন মহানগরী সভাপতিকে ফোন দিলে তিনি বললেন আমান ভাই আহত হয়েছে রক্ত লাগবে ! কথাটা শুনা মাত্রই হৃদয়ের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠল। একটু নীরবে চিন্তা করলাম, পরক্ষণেই কেন যেন মনে হল আমান ভাইয়ের কিছু হতে পারে না। এক অজানা আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হলাম এবং সাথে সাথে আমি দু’জন সাথীকে ফোন করে ঢাকা মেডিক্যালে পাঠিয়ে দিলাম। ঘটনাকালীন সময়ে আমি কাফরূল থানার সভাপতি ছিলাম এবং আমান ভাই আমার ঠিক আগে এই থানার সভাপতি থাকার কারণে ময়দানের সর্বস্তরের জনশক্তি আমান বাইয়ের খোঁজ জানারজন্য আমাকে একের পর এক ফোন দেওয়া শুরু করল। আমি তখন দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে বললাম আমান ভাই একটু আহত হয়েছে আপনারা দোয়া করুন। এরই মধ্যে খবর এলো মহানগরী পশ্চিমের মুজাহিদুল ইসলাম শহীদ হয়েছে। একটু পরেই মুজাহিদের পাগল প্রায় পিতা হাসপাতালের রুমে রুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করছেন তোমরা কি আমার মুজাহিদ দেখেছ? অনেকেই তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল সে আছে আপনি ধৈর্য ধরুন। এক বিভীষিকাময় পরিবেশে রাতে বাসায় ফেরার পর থেকে শুধু আমান ভাইয়ের খোঁজে ফোন আসল। সবাইকে দোয়া করতে বলি কিন্তু এতে কোন তৃপ্তি পাই না। পরের দিন কোন খবর না জানার কারণে অফিস সম্পাদককে রিং দিয়ে বললাম আমাকে আমান ভাইকে দেখতে দিতে হবে। তিনি আমাকে একা ধানমন্ডি রেনেসাঁ হাসপাতালে আসতে বললেন। আমি থানা সেক্রেটারি তৌহিদ ভাইকে নিয়ে বিকাল ৩ টায় রেনেসাঁ হাসপাতালে উপস্থিত হই। অফিস সম্পাদক আহমাদুল্লাহ ভাই বললেন আমান ভাই আইসিইউ তে আছে, কোন কথা বলা যাবে না, একজন একজন করে দেখে আসতে হবে। দুরু দুরু মন নিয়ে আমান ভাইয়ের কছে গিয়ে যা দেখলাম তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। কারণ আমান ভাই আহত কিন্তু তাঁর আঘাতের পরিমাণ যে এত বেশি তা ভাবনার ও অতীত ছিল। দেখলাম ডান কান দিযে রক্ত পড়ছে। শুধু অস্বভাবিক ফুলে উঠা মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছে, সারা মুখ ও মাথা, গলা, বুকের পাঁজর এবং দু’হাতে অসংখ্য আঘাতে ক্ষত বিক্ষত নিথর দেহ পড়ে আছে। মন চাইল স্পর্শ করি, আমান ভাই বলে ডাকি, হয়তো ডাকও দিয়েছিলাম কিন্তু আমান ভাই কোন উত্তর দেয়নি। এক নজর দেখে মনে হল অসংখ্য কষ্টের যাতনা ভাষায় না বলে নীরবে প্রতিবাদ করছেন। পরক্ষণেই মনের পর্দায় ভেসে উঠল আমান ভাইয়ের সাথে অসংখ্য অন্তরঙ্গ মুহূর্তে ছবি, বিশেষ করে আমান ভাই কোন অসাংগঠনিক কথা কাজ দেখলে শাসন করতেন । তখন মনে হল কে আর আমাকে শাসন করবে। পিতা মাতার একমাত্র ছেলে হওয়ার কারণে তাঁর পিতা মাতার কষ্ট হৃদয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করলাম। ইতোমধ্যে ডাক্তারের তাগাদায় স্থান ত্যাগ করলাম। তৌহিদ ভাই একটু দেখে সহ্য করতে না পেরে বাইরে গিয়ে কাঁদতে শুরু করল। আমি বাইরে দায়িত্বরত চিকিৎসককে প্রশ্ন করলাম। রপঁ-তে বেঁচে ওঠার হার কত? তিনি বললেন ৫০%। তখন একটু সাহস পেলাম। যদি একজনও বাঁচে তাহলে আমান ভাই বাঁচবেন। ইনশাআল্লাহ। তখন আমান ভাইয়ের মৎধফব পড়সসধ ংঃধমব লেভেল ছিল ৩, যা আশঙ্কাজনক। পরের দিন এটা উন্নীত হয়ে ৫ হল, তখন আরো আশাবাদী হলাম। কেউ ফোন করলে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বসের সাথে বলতাম আমান ভাই উন্নতির দিকে, আপনারা দোয়া করবেন। মহানগরী সভাপতি মান্নান ভাইয়ের মান্নত উপলক্ষে আমান ভাইয়ের জানের সদকা হিসেবে একটি খাসি কোরবানি দিলাম। প্রতি ওয়াক্ত নামাজে সর্বস্তরের জনশক্তিরা কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কছে দোয়া করছে। আল্লাহ তুমি প্রয়োজনে আমাদেরকে নিয়ে যাও তবুও আমান ভাইকে ফিরিয়ে দাও। কিন্তু হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল। মহানগরী সভাপতি মান্নান ভাই ফোন করে আমান ভাইয়ের ঢাকা ও গ্রামের বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করতে বললেন। তখন আমার মনে হল আমান ভাইয়ের অবস্থা তা হলে ভাল না। ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়েছেন ও কফিন তৈরি করতে বলেছে। আমি ঠিকানা সংগ্রহ করে মানান্নœ ভাইকে দিলাম। আমান ভাইয়ের চাচা বললেন ঠিকানা দিয়ে কী করবে? বললাম আহত ভাইদের তালিকা হচ্ছে এ জন্য দরকার। এদিকে নাছোড়বান্দা কাফরুল থানার প্রথম সভাপতি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ডা: মুনতাকিমুজ্জামান ভাই আমান ভাইয়ের খবর শুনার পর থেকেই এ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার পাশাপাশি হোমিও চিকিৎসার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করলেন। এমতাবস্থায় মুজাহিদ ভাই ও মান্নান ভাইয়ের অনুমতিক্রমে খালাম্মার মাধ্যমে চিকিৎসা প্রদান শুরু করলেন। পরের দিন আবার হাসপাতালে গেলাম। শুনলাম আমান ভাই মা বলে ডাক দিয়েছেন। আশ্বস্ত হলাম। ধীরে ধীরে জিসিএস লেভেল ৮ হল। আলহামদুলিল্লাহ। দীর্ঘ ৯ দিন আইসিইউ তে থাকার পর অবচেতন স্তর থেকে চেতন স্তরে ফিরে আসায়। ৬ নভেম্বর আমান ভাইকে ইবনে সিনার ৬০৫ কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। বিকেলে আমি আর তৌহিদ ভাই মহানগরীতে বৈঠক শেষে দেখতে গেলাম। আমান ভাই তৌহিদ ভাইকে দেখে চিনে ফেলেন। বলে উঠলেন ‘মা দেখ শরৎ এসেছে, এতদিন কোথায় ছিলে?’ কিন্তু আমাকে চিনতে একটু সময় নিয়ে বলল, ‘মা দেখ কাফরুল থানার আমীর এসেছেন। ঈদের দিনের পায়জামা পাঞ্জাবি পরে।’ এতকিছুর মাঝে একজন মানুষের ধৈর্য ও নিষ্ঠা এবং আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস, আমার মনে হয় কোন মানুষের দৃষ্টি এড়ায়নি, তিনি হলেন আমান ভাইয়ের আম্মা। আমি জানতাম খালাম্মা প্রচণ্ড অসুস্থ। বিশেষ করে ডায়াবেটিস ও পা ভাঙার কারণে সবকিছু স্বাচ্ছন্দ্যে করতে পারতেন না। কিন্তু এরপরও তিনি আমান ভাইয়ের জন্য নিয়মিত রোজা রাখতেন। এদিকে মান্নান ভাই আমান ভাইয়ের খোঁজ খবরের ব্যাপারে খুব সচেতন ছিলেন। এ জন্য আমিও কিছুটা তটস্থ থাকতাম। কখন কোন ভুল করে ফেলি, কারণ আমান ভাইকে দেখাশুনার দায়িত্ব আমার ওপর ছিল। আমি পর্যায়ক্রমে ফিরোজ, রেজা, গোলাম রব্বানীকে আমান ভাইয়ের কাছে রাখতাম। এত কিছুর মাঝে আমান ভাই কাউকে দেখলেই সাংগঠনিক প্রশ্ন করতেন। বলতেন ফিরোজ তুমি সদস্য হয়েছো? আমান ভাই সুস্থ হওয়ার সাথে সাথে মুহতারাম আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদসহ সর্বস্তরের দায়িত্বশীলগণ আমান ভাইকে নিয়মিত দেখতে যেতেন ও খোঁজ খবর রাখতেন। ১৬ দিন পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে ১৩ নভেম্বর আমান ভাইকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আসা হয়। তখন পর্যন্ত আমান ভাই ঐ দিনের কোন ঘটনা স্মরণ করতে পারছিলেন না। আমরাও দায়িত্বশীলদের নিষেধ থাকায় বলতাম না। কোন শহীদ ভাইয়ের সংবাদ দিতাম না কিন্তু আমরা বলাবলি করলে আমান ভাই বোঝার চেষ্টা করতেন। আমান ভাই ২২ নভেম্বর পর্যন্ত জানতেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষে তার এ অবস্থা। এরই এক পর্যায়ে তার বড় বোন সাথী আপার সাথে কথা বলতে বলতে এবং বাসার সামনের দেয়ালে ২৮ অক্টোবরের ৫ শহীদের পোস্টার দেখে ২৮ অক্টোবরের ঘটনা স্মরণ হলো। তখন আপা তাকে সব ভাল করে স্মরণ করিয়ে দেয়, জবিতে নয়াপল্টনে তার এ অবস্থা হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ এক হৃদয় ফাটা আনন্দে বুকটা ভরে গেল, আমান ভাই ২৫ দিন পর স্মৃতি ফিরে ফেলেন। সবাই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। এখন ধীরে ধীরে মুজাহিদকে (২৮ অক্টোবরের শহীদ) চিনার চেষ্টা করলেন। তার সাথে অরো যারা দায়িত্ব পালন করছিল। বিশেষ করে ফখরুদ্দিন মানিক ভাইয়ের কথা, যিনি আহত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর সাথে ছিলেন। কিন্তু আঘাত পাওয়ার পর কী হয়েছে বলতে পারেননি। ক্রমান্বয়ে আমান ভাই সুস্থ হয়ে ওঠার সাথে সাথে রাতে ভয়ে ঘুমাতে পারতেন না। বিশেষ করে ঈদের পরের দিন বাস দুর্ঘটনায় নিহত কাফরুল থানার কর্মী মোস্তাফিজুর রহমান রাসেলের বীভৎস চেহারা ভেসে উঠলে বলত আপনার কর্মী আমাকে ঘুমাতে দেয় না। আপনি ওকে আসতে নিষেধ করেন। আমি হেসে বলতাম ঠিক আছে না করে দেবো। বর্তমানে আমান ভাই হেফাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত। আহত হওয়ার দিন আন্দোলনের ভাইয়েরা ঢাকা মেডিক্যালে পৌঁছার পূর্বে মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ যে ব্লাড দিয়েছিল তাতে সম্ভবত সি ভাইরাসের জীবাণু ছিল। এখনো উনাকে ইনজেকশন নিতে হচ্ছে। ২৪টা নিতে হবে। এ বছর ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত এ সংখ্যা ১৯টি পৌঁছবে। ১২টা নেয়ার পর ডাক্তার বলেছেন, অবস্থা উন্নতির দিকে। আমান ভাই এখনও অসুস্থতা নিয়ে আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন শুধু মনের জোরে-যেন সৃষ্টিকর্তা এ জন্যই তাকে সৃষ্টি করেছেন। মহান রাব্বুল আলামিন তার দ্বীনের পথে আমান ভাইকে, তাঁর আব্বা-আম্মাকে ও তার পরিবারকে এবং আমাদের সকলকে কবুল করুন। আমিন। অনুলিখন : ওয়েছ খান নূর সোহেল

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির