post

জোট

মহাজোট : কোন পথে বাংলাদেশের রাজনীতি । মুহাম্মদ আবদুল জব্বার

০৮ অক্টোবর ২০১৮

‘বাংলাদেশ’ তৎকালীন পাকিস্তানের শোষণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক অর্জন। এ দেশের মুক্তিকামী প্রতিটি মানুষ দেশবিভক্তির সুফল প্রাপ্তির পরম আকাক্সক্ষা লালন করেছিল। কিন্তু এখনো সেই প্রত্যাশিত স্বাধিকার অর্জনের ৪৭ বছর পরও প্রত্যাশা-প্রাপ্তির বিস্তর ফারাক বিদ্যমান। ক্ষমতার পালাবদলে শাসকগোষ্ঠীর ভাগ্যের পরিবর্তন হলেও দেশের আমজনতার ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আমরা জাতি হিসেবে খুব ইমোশনাল। অল্পতে নিজেদের সব উজাড় করে দেই, আবার অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে যাই। আমাদের জাতিসত্তার এই সরলতাকে দুর্বলতা হিসেবে নিয়ে শাসকগোষ্ঠী দেশবাসীকে বারবার ঠকিয়েছে, কোন সরকারই প্রকৃতপক্ষে জনগণের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও নিরাপদ জীবনমানের ব্যবস্থা করতে পারেনি। বরং নানা ধরনের শোষণ, বৈষম্য ও জুলুম-নির্যাতন সেই পাকিস্তানি জালিমশাহিকেও হার মানিয়েছে, যা ভাবলে আমরা শিহরিত হই। যাদের শঠতা, নেকামি ও চটকদার বুলি এখনো জনগণকে ঠকিয়েই চলছে। ক্ষমতার ভাগাভাগির রাজনীতিতে কয়েক দশক ধরে জোট-মহাজোটের মাধ্যমে দেশ দু’টি শিবিরে বিভক্ত। আওয়ামী মহাজোট, বিএনপির ২০ দলীয় ঐক্যজোট, হোসাইন মুহম্মদ এরশাদের ৫৫ দলীয় জোট! জোটগঠনে পিছিয়ে নেই সাবেক বিএনপি মন্ত্রী নাজমুল হুদাও। আবার নয়াভাবে ড. কামাল হোসেন ও ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দোজার নেতৃত্বে সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্যের জোটগঠনের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। মূলত বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী নেতৃত্বে বামপন্থী দলসমূহ আর বিএনপির নেতৃত্ব ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী দলসমূহই নির্বাচনের মূল ফ্যাক্টর। নির্বাচন প্রাক্কালে প্রতিবারই এই জোট দু’টির একজোট আরেক জোটের শরিকদের বাগিয়ে দল ভারীর প্রচেষ্টা দৃশ্যমান ও হাস্যকরও বটে! আওয়ামী লীগ ভারতের কৃপা নিয়ে দেশের প্রকৃত বিরোধীদলকে বাদ নিয়ে ১৫৪টি সংসদীয় আসনে বিনাভোটে নির্বাচিত বলে দাবি করে গৃহপালিত বিরোধী দল দিয়ে সরকার দেশ চালাচ্ছে। জনগণের মতামতকে তোয়াক্কা না করে উল্টো স্বৈরাচারী কায়দায় জনগণের ওপর জুলুমবাজি করার ইতিহাস পৃথিবীতে খুব বিরল। রাজনৈতিক সমীকরণে জোট-মহাজোট গঠনপ্রক্রিয়া বেশ কয়দিন আগেই শুরু হয়েছে। ভোট এলেই জোট বাড়ে। গত ১৮ জুলাই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি এবং বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এ দলগুলো মিলে নতুন একটি বাম রাজনৈতিক জোট গঠিত হয়েছে। নতুন জোট গঠনের ওই একই দিনে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় মহাজোটের বাইরে থাকা গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স, সম্মিলিত ইসলামিক জোট, কৃষক শ্রমিক পার্টি, একামত আন্দোলন, জাগো দল, ইসলামিক ফ্রন্ট এবং গণতান্ত্রিক জোটসহ ৯টি দলের নেতাদের সাথে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এরপরের দিন রাতে জরুরি বৈঠকে বসে বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, কৃষক শ্রমিক জনতা পার্টি এবং নাগরিক ঐক্যের সমন্বয়ে গত ডিসেম্বরে (২০১৭) গঠিত যুক্তফ্রন্টের নেতারা। গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে সমদূরত্ব রেখে তারা জাতীয় ঐক্যগঠনের আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল। অন্য দিকে বিএনপি বর্তমান সরকারকে হটাতে বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যগঠনের কথা বলছে। জাতীয় ঐক্য নামে সরকারবিরোধী সম্মিলিত বিরোধী জোট গঠন হলে এ জোট ভোটের মাঠে প্রভাব ফেলবে বলে আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন। জাতীয় ঐক্যের কুশীলবরা জাতীয় অঙ্গনে পরিচিত মুখ হলেও ভোটের মাঠে তাদের অবস্থান ততটা জোরালো নয়। তারপরও সরকারবিরোধী সবাই এক প্লাটফর্মে এলে ক্ষমতাসীনদের জন্য এটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ফলে ‘জাতীয় ঐক্য’ গঠনের ডামাডোলের মধ্যেই জোটের রাজনীতিতে মেরুকরণের চিন্তা করছে আওয়ামী লীগ। ড. কামাল হোসেনের জোটগঠনপ্রক্রিয়াকে রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাব বলে অনেকে মনে করছেন। আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের নেতারা মনে করেন ড. কামালরা পশ্চিমা দেশের সহায়তায় আওয়ামী লীগকে পরাস্ত করার জন্য নতুন কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ড. কামাল হোসেন জামায়াতকে বাদ দিয়ে বিএনপিকে জাতীয় ঐক্য গঠন করার আহবান জানিয়েছেন। এতে তিনি যথেষ্ট সমালোচিতও হয়েছেন। জামায়াতকে ঐক্যপ্রক্রিয়া থেকে বাদ দেয়া প্রসঙ্গে এক টিভি টকশোতে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, ‘একজন জামায়াত নেতার যে ভোট আছে গণফোরামে পুরো মিলে সে ভোট নেই!’ বিএনপির কোন কোন নেতা জামায়াতকে ২০ দলীয় জোট থেকে বাদ দেয়ার পক্ষে মত থাকলেও বাস্তবতার কারণে ভোট রাজনীতির স্বার্থে এই জোটের কোনো বিকল্প নেই বলে তারাও মনে করেন। তবে যে যাই বলুক সচেতনমনারা মনে করেন, আওয়ামী লীগকে রাজনীতির মাঠে টেক্কা দেয়ার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোটের কোনো বিকল্প নেই। আগামী ২২ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দীতে ‘জাতীয় ঐক্য’ নামে সরকারবিরোধী জোটগঠনের পক্ষে সমাবেশ আয়োজনের কথা শুনা যাচ্ছে। এতে সরকারবিরোধী প্রায় সব দল অংশগ্রহণ করবে বলে ঐক্যপ্রক্রিয়ার সাথে জড়িত নেতারা তাদের বক্তব্যে ব্যক্ত করেছেন। এই সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও যোগ দেয়ার কথা শুনা যাচ্ছে। তবে তাদের ঐক্যপ্রক্রিয়া শেষতক কোথায় গিয়ে ঠেকে তার জন্য হয়ত চলতি বছরের অক্টোবর নাগাদ অপেক্ষা করতে হবে। আগামী অক্টোবরে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার হাঁক-ডাক নির্বাচন কমিশনের কর্তা-ব্যক্তিদের মারফতে দেশবাসী অবগত হয়েছে। তবে নির্বাচনকালীন সময় কে বা কারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে বা সে সময়ে ঘোষিত নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে এ ব্যাপারে যথেষ্ট উৎকণ্ঠা জনমনে রয়েই গেছে! কারণ নির্বাচন পরিচালনায় হুদা কমিশন যে পুরোপুরিই ব্যর্থ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আসল ব্যাপার হলো দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের নিমিত্তে নিয়োগকৃত ব্যক্তিদের নিয়ে আর যাই হোক অন্তত নির্বাচন কমিশনের মত একটি পবিত্র ও আমানতদারি প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। হুদা কমিশনের অধীনে পরিচালিত নির্বাচনসমূহে জনগণ সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে না পারায় এই কমিশনের প্রতি অনাস্থা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তাই দেশের সচেতন নাগরিক মাত্রই মনে করে যে, এই কমিশনের অধীনে ভালো কোন নির্বাচন অনুষ্ঠিত সম্ভব নয়। জোট, মহাজোট গঠনের ঠিক এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ নেতারা নানা সভা সমিতিতে দলীয় কর্মীদের আগামী দিনে মহাজোটের ক্ষমতায় পুনরায় অধিষ্ঠিত না হতে পারলে তার কুফল কত ভয়াবহ হতে পারে সেই ব্যাপারে সতর্ক করছেন! কয়দিন আগে আওয়ামী লীগের এক হেভিওয়েট নেতা বলেই ফেললেন, আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতায় আসতে না পারলে প্রথম দিনেই এক শ’ লোক মারা যেতে পারে! কেউ কেউ দলীয় নেত্রী ও সরকারপ্রধানকে একটি বুলেট ধেয়ে বেড়াচ্ছে বলেও আশঙ্কা করছেন। এই অবস্থায় এই দলটি ক্ষমতায় টিকে থাকতে আদাজল খেয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। তারই ধারাবাহিকতায় এরা রাষ্ট্রের প্রায় সবকয়টি প্রতিষ্ঠানকে দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করেছে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ও সম্ভাব্য নির্বাচনী প্রার্থীদের মামলা ও হয়রানির মাধ্যমে মাঠছাড়া করতে পুলিশকে অপব্যবহার করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আগামীতে যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে না পারে, তারা কোনো রাজনৈতিক দলকেও ক্ষমতায় আসতে দিবে না। প্রয়োজনে ভিন্ন কোন পক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে এক্সিট করবে। এতে দেশ আরো মহাসঙ্কটে নিপতিত হবে। সব মিলিয়ে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী হুঙ্কার ও পুলিশের অযাচিত তৎপরতায় অনুমিত হয় যে সামনের দিনগুলো বিরোধীদল ও বিরোধীমতের নাগরিকদের জন্য সুখকর হবে না। সব বিরোধী দলগুলো মিলে ইফেক্টিভ জাতীয় জোট না হলে দেশের গণতন্ত্র, সুশাসন ও বাকস্বাধীনতা আরো মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হবে। তখন দেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকেই ধাবিত হবে

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির