post

জ্ঞানার্জন ও কর্মসংস্থান

মুহাম্মদ আবদুল বাসেত

২১ জুলাই ২০১৬
সদ্য অ্যাকাডেমিক পড়ালেখা সমাপ্তকারী বা দীর্ঘদিন ধরে চাকরিপ্রার্থী এমন অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীর মিলনস্থল শাহবাগ গণগ্রন্থাগার। জ্ঞান সাধনার সুবাদে যতবারই সেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে; শুধুমাত্র বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়েছে। এমন অসংখ্য শিক্ষার্থীর সাথে কথা  বলে জানতে পেরেছি, যেকোনোভাবে একটি কর্মসংস্থানের প্রয়োজন। অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ, বাপ-মা অনেক বুকভরা আশা নিয়ে তাকিয়ে আছেন; সন্তান কী করছে বা কী করবে? দুপুরের ক্যান্টিনে আলুভর্তা ও ডাল দিয়ে মাথা নিচু করে খাবার গ্রহণের অসংখ্য নজির ও বাস্তবতা দেখার সুযোগ হয়েছে। বড় বেশি আফসোস হতো ছাত্রীবোনদের খাবারের কষ্ট দেখে, হয়তোবা মেস বা হোস্টেলের আগের রাতের খাবার বা সকালের নাস্তাকে দ্বিগুণ করে দুপুরের খাবারের টিফিনে করে কোনো উপায়ে ক্ষুধা নিবারণ করা। সকাল আটটা থেকে রাত পৌনে নয়টা পর্যন্ত লাইব্রেরির পড়ার টেবিলে পড়ে থাকতে দেখা গেছে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে। যে পড়ালেখা আসলে কোনো জ্ঞান সাধনার ব্রত হয়ে নয়, বরং শুধুমাত্র ভালো একটি চাকরি পাওয়ার জন্য গলাধঃকরণ। কিন্তু বড় বেশি আফসোস ও দুঃখের বিষয় কোনমতে একটি চাকরির ব্যবস্থা হলেই শিক্ষার্থীরা ভুলে যায় জ্ঞান সাধনা বা পড়ালেখায় ব্যয় করে অতীত সময়ের পরিসংখ্যানটুকু। অথচ শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র চাকরিতে সীমাবদ্ধ নয়, যে শিক্ষার আলোয় এ সমাজ আলোকিত হবে। পথহীন মানব পথের সন্ধান পাবে। যে জ্ঞান প্রদীপে জ্ঞানী নিজেকে যেমনিভাবে পরিচালিত করবে, তেমনি সমাজের অবহেলিত-অত্যাচারিত মানবতাকেও পথের সন্ধান দেবে ও পরিচালিত করবে। জ্ঞান আত্মকেন্দ্রিক নয় এবং যার পরিধিও সঙ্কীর্ণ নয়। জ্ঞানের মর্মোপলব্ধি না করে ও জ্ঞান সাধনায় না ঝুঁকে শিক্ষার্থীরা এমনকি অভিভাবকেরাও ঝুঁকে পড়েছেন বিভিন্ন লোভনীয় চাকরি ও আকর্ষণীয় বেতনের দিকে। কোর্স ও পাঠ্যক্রম তৈরি হচ্ছে চাকরির ওপর ভিত্তি করে। বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনেরা সন্তানাদির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন- তাদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল বা অন্য কিছু বানাবে, যাতে অর্থ-সম্পদশালী হবে। সে জন্য সন্তানাদিও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা উকিইলই হয়, কিন্তু দক্ষ মানবসম্পদ ও ভালো সন্তানে রূপান্তর হয় না। জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রস্থল-বিদ্যালয় যেখান থেকে জ্ঞানী-গুণী বের হয়। সে বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় অপেক্ষাকৃত কম জ্ঞানীরাই ঝুঁকছেন। যদিও বরাবর অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সম্মানজনক ও মহান পেশা হলেও শিক্ষকদের করা হচ্ছে না সঠিক কদর। খতিয়ে দেখার বা তার যথাবিহিত পদক্ষেপ গ্রহণেরও নেই যথাযথ কেউ। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী দেশের কর্মসংস্থানের প্রতি হতাশা; অনেকটা অর্থের লোভে বিদেশে পাড়ি দেয়ার মধ্য দিয়ে যেমনি দেশ হচ্ছে মেধাশূন্য, তেমনি অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়ে ফিরছে দেশে। প্রবাসী অর্থ আমাদের দেশের জন্য অনেক বড় সম্পদ, কিন্তু কেন? বিদেশিরা আমাদের সস্তা শ্রম পুঁজি করে তার থেকেও বেশি লাভবান হচ্ছে। অথবা সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে পরনির্ভরতা কমিয়ে দেশকে আরো উন্নতির দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। আমাদের শিক্ষার আরো বড় আপদ- অ্যাকাডেমিক অর্জিত শিক্ষাসম্পর্কিত কর্মসংস্থানের অভাব। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে এক বিভাগের পড়–য়া শিক্ষার্থী কাজ করছে অন্য বিভাগে। দীর্ঘ পনেরো-ষোলো বছরের পড়ালেখা কী কাজে লাগলো। শিক্ষার্থীদের এমন ভাবনা গজিয়ে দেয়া উচিত, পড়ালেখা শেষ করে চাকরিপ্রার্থী না হয়ে স্বীয় শিক্ষাসম্পর্কিত কর্মসংস্থানের  তৈরি করবে, যা শুধু তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নয়, অন্য বেকারদেরও ঠাঁই হবে। এমনও অনেক উচ্চতর ডিগ্রিধারী পাওয়া যায়- যিনি চাকরিপ্রার্থী হন তাঁর থেকেও কম ডিগ্রিধারী মালিকের প্রতিষ্ঠানে। তবে হ্যাঁ, অভিজ্ঞতা যেহেতু বড় একটি সম্পদ; এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান হবে কর্মসংস্থানের আরো বড় ক্ষেত্র তৈরির প্রয়াস। বর্তমানে আমাদের শিক্ষিত সমাজে সবচেয়ে অভাব-গবেষণাগার ও গবেষকের। গবেষণা ও জ্ঞানার্জনে অধিক সময় ব্যয় করা যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে মুষ্টিমেয় লোকের কাজ। এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপেশার সাথে জড়িত মহামান্যদের মাঝেও এ ক্ষেত্রে উদাসীনতা ব্যাপক হারে লক্ষণীয়। অর্থ ও লোভ-লালসার প্রতি দৌড়ঝাঁপ এবং এটিই যেন জীবনের সব। জ্ঞানার্জনের তৃষ্ণা ও গবেষণার বাস্তব নজির দেখতে আমাদের পূর্বপুরুষদের দিকে যদি একটু তাকিয়ে দেখি- তুর্কির অধ্যাপক ইসমাইল পাশা ‘ইবনোল হাইসামের’ লিখিত একশত সাতচল্লিশটি গ্রন্থের তালিকা প্রকাশ করেছেন। তন্মধ্যে পদার্থ-বিজ্ঞানেই এগারোটি। বিখ্যাত দার্শনিক ‘জাবির ইবনে হাইওয়ানে’র লিখিত ছোট-বড় দুই হাজারেরও বেশি  গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। তন্মধ্যে দর্শনশাস্ত্র, রসায়নশাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র, যুদ্ধবিদ্যা ও ভাগ্যলিপি সম্বন্ধীয় শাস্ত্রের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। যদিও তাঁদের কিছু কিছু প্রবন্ধকে এক একটি গ্রন্থ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। দার্শনিক ‘আল-ফারাবি’ সত্তরটি ভাষা জানতেন। শতাধিক গ্রন্থ তিনি লিখেছেন। ‘আল-কিন্দি’ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর দুইশত পঁয়ষট্টিখানা গ্রন্থ লিখেছেন। ‘আল বেরুনি’ গণিত, জ্যোতিষ, পুরাতত্ত্ব, দর্শন, ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, ভূগোল, রসায়ন ও চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর একশত চুয়াল্লিশটি গ্রন্থ লিখেছেন। ‘ইবনে সিনা’- সাহিত্য, দর্শন, বীজগণিত, জ্যামিতি ও রসায়নে ছোট-বড় মিলে একশত পঁচিশটি গ্রন্থ লিখেছেন। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন হলে আজও স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে তাঁকে। আব্বাসীয় যুগে ‘ইবনে সিনা’র চিকিৎসাশাস্ত্র ‘কানুন ফিত তিব্ব’ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে কিভাবে সম্ভব হলো তাঁদের পক্ষে অসম্ভাবনীয় এসব কর্ম সম্পাদন করার। শুধুমাত্র কর্মসংস্থান বা জীবিকা উপার্জনের জন্য তাঁরা কি কর্ম করেছিলেন? কতটুকু সময় তাঁরা দিয়েছিলেন? যা তাঁদেরকে আজ জগদ্বিখ্যাতদের আসনে সমাসীন করেছে। তাঁদের লিখিত গ্রন্থের ওপর আজ পর্যন্ত অসংখ্য শিক্ষার্থী জ্ঞানান্বেষণ ও গবেষণা করছে। হয়তো তাঁদের সমসাময়িক আরো অনেক জ্ঞানী-পন্ডিতও জীবিত ছিলেন- যা তাঁদেরকে এ আসনে সমাসীন করেনি। যদি তাঁদের শ্রমের সমসাময়িক পারিশ্রমিকের কথা চিন্তা করি, হয়তো তাঁরা পাননি বা সামান্যতম সৌজন্যবোধও না। কিন্তু তাঁদের পরিশ্রমের ফল বয়ে বেড়াচ্ছে যুগ থেকে যুগান্তর। ক্ষুদ্র ও স্বীয় স্বার্থ বিবেচনায় যাঁরা সবসময় ঘুরপাক খাচ্ছে সাময়িক সুবিধাটুকু নিয়ে- মাছের মতো বড়শি খাবার গিলেই তৃপ্তির ঢেঁকুর গিলতে চায় তারা। তবে হ্যাঁ জ্ঞানপিপাসুদের বাস্তব নজির এমনও রয়েছে অর্ধাহারে-অনাহারে যাঁদের জীবনটুকু পর্যন্তও দিয়ে দিতে হয়েছে। সাময়িক লাভ, অনৈতিক ও অর্থ লোভ তাঁদেরকে একবিন্দু পর্যন্তও সাধনা থেকে নড়াতে পারে। জ্ঞানার্জন শুধুমাত্র অ্যাকাডেমিক বই-পুস্তকেই সীমাবদ্ধ নয়। নারীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি লক্ষণীয়। কোনভাবে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারলেই স্বামীর বা বাপের পক্ষ থেকে মানসিকতা যেন এমন হয়ে দাঁড়ায় পড়ালেখার কথা বলাও পাপ। বিয়ের আগে কোন একদিন টেবিলের কোণে বইগুলো যেমনি রেখে এসেছে, এখন আর ধরাছোঁয়ারও কেউ নেই। দুর্ভাগ্যবশত এক সময়ে বাড়ির ময়লা-আবর্জনা ফেলার স্থলেও এদের স্থান হতে দেরি হয় না। সমাজটা নারীজাতিকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, বিয়ে মানেই অন্যের অধীনে চলে যাওয়া, স্বামীর ঘর-সংসারেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকা। সৃজনশীলতা ও নিজের মতো কোনো কর্মসৃষ্টির প্রয়াস ঘটানো বা গবেষণালব্ধ কর্মে নিজেকে সম্পৃক্ত করার ভাবনাটাও যেন বিপদ। যেখানে জনৈক দার্শনিকের উক্তি, “আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো।” যে মায়ের জ্ঞানান্বেষণের শেষ হয়েছে জ্ঞানের মর্ম অনুধাবনের পূর্বেই, যে মা পরের সংসারের জাঁতাকলে অর্জিত জ্ঞানটুকুও হারিয়ে যাওয়ার পথে, সে মা কিভাবে তাঁর সন্তানকে জ্ঞানের মর্মোপলব্ধি করাবেন। অনেক পরিবারেই দেখা যাচ্ছে বাবা-মায়ের শিক্ষার বা জ্ঞানের মর্মোপলব্ধিতার অভাবে ছেলে-সন্তানাদি একটু বড় হলেই পড়ালেখা বন্ধ করে, বিভিন্ন কর্মে লাগিয়ে দেয়ার প্রবণতা,  গ্রাম থেকে এখন শহরাঞ্চলেও লক্ষণীয়। ফলশ্রুতিতে শিশুশ্রমের হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে অত্যধিক হারে। আবার জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র ভালো চাকরি ও কর্মসংস্থান নয়। অনুতাপের বিষয় ইদানীং আমাদের পাঠ্যসূচিও এমনভাবে তৈরি হচ্ছে ভালো চাকরি ও উচ্চতর বেতনের দিকে শিক্ষার্থীদেরকে আকর্ষণীয় করা হচ্ছে। কর্মজীবনে যে যেই কর্মেই থাকুক, প্রত্যেকের জন্য ছোট বড় একটি লাইব্রেরি থাকা প্রয়োজন। যেখান থেকে জ্ঞানের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করবে। মানবতার কল্যাণে কাজ করার যেমনি অনুপ্রেরণা পাবে, তেমনি অর্জিত জ্ঞানানুযায়ী সমাজের অবহেলিত মানুষের জন্য কিছু করার জন্য উৎসাহিত হবে। তাহলেই জ্ঞানার্জনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সার্থক হবে। লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির