post

নবীজি সা.

০৫ জুন ২০২১

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্ববাসীর জন্য এসেছিলেন শান্তি ও করুণার আধার রূপে। এসেছিলেন একটি বর্বরজাতি ও অসভ্য সমাজকে সভ্য সমাজ ও আদর্শ মানবরূপে গড়তে। মহান আল্লাহর লা-শরিক সত্তার একত্ববাদের বাণী শুনাতে এবং অনাবিল শান্তির এক অপূর্ব জগতের সন্ধান দিতে। মানব সভ্যতাকে বিশ্বের মানচিত্রে আদর্শের মানদণ্ডে দাঁড় করাতে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তিনি ইসলামের সুমহান দাওয়াত দিতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন পদে পদে। ইসলামবিদ্বেষীরা তাকে একটি রাতও শান্তিতে ঘুমাতে দেয়নি। শুধু নির্যাতন আর নির্যাতন এবং ষড়যন্ত্রের বিশাল পাহাড়ের মুখোমুখি হয়েছেন ক্ষণে ক্ষণে। তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। মানবতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবন ওয়াক্ফ করেছেন। তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে বারবার। এরপরও থমকে দাঁড়ায়নি তাঁর মহান দাওয়াতের মিশন।

ইসলামের দাওয়াতের সূচনালগ্ন থেকেই মক্কার কাফিরগণ রাসূল সা.-এর বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে। ইসলামের প্রচার-প্রসারে গতি যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে, খোদাদ্রোহী শক্তির প্রতিরোধ ততই বাড়তে থাকে। যে সময় মক্কার কাফের মুশরিকগণ ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ইসলামকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায় ও গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এমনকি আরব পৌত্তলিকরা ‘দারুন্ নাদওয়া’তে রাসূলে করীম সা.-কে হত্যা করার সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গ্রহণ করে। এর অংশবিশেষ ওকবা বিন আবু মুয়িত রাসূল সা.-এর গলায় চাদর পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল। আবু জাহল একটি ভারী পাথর দিয়ে তার মস্তক চূর্ণ করতে চেয়েছিল। ইসলাম গ্রহণ করার আগে খাত্তাবের ছেলে ওমর নগ্ন তলোয়ার হাতে নিয়ে তাঁকে হত্যা করতে গিয়েছিল। তারা রাসূল সা. এবং মুসলমানের উপর অমানুষিক জুলুম, নির্যাতন, মহানবী সা.-এর উপর সামাজিক বয়কট ও অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দিলো। এতে বানু হাশেম ও বানু মুত্তালিবের সকল মুসলিম-অমুসলিম, নারী-পুরুষ ও শিশুসহ আল্লাহর রাসূল সা. আবু তালেবের ঘাঁটিতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। এই বয়কটে পরিস্থিতি এতো মারাত্মক ও গুরুতর হয়েছিল যে, খাদ্যসামগ্রীর সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেল। মক্কার পণ্যসামগ্রী যা কিছু আসতো আরব পৌত্তলিকগণ তা তাড়াতাড়ি ক্রয় করে নিতো। যাতে মুসলমানরা ক্রয় করতে না পারেন। তারা গাছের পাতা, ছাল ও পশুর চামড়া খেয়ে জীবন ধারণ করতেন। ক্ষুধার যন্ত্রণা এত তীব্র ছিল যে, ক্ষুধার্ত নারী-শিশুদের কান্নার আওয়াজ শিয়াবে আবু তালেবের বাইরে শোনা যেত। তাদের আহাজারিতে আল্লাহর আরশ প্রকম্পিত হয়ে উঠতো। নবুওয়তের সপ্তম বছর থেকে দশম বর্ষ পর্যন্ত পুরো তিন বছর বয়কট চলতে থাকে। “তাদের একমাত্র অপরাধ সপ্রশংসিত মহা পরাক্রমশালী আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা।” (সূরা বুরুজ : ৮) তিনটি বছর আরব পৌত্তলিকদের সর্বাত্মক সামাজিক বয়কট, অর্থনৈতিক অবরোধ, রাসূল সা.-এর পরম শুভাকাক্সক্ষী ও হিতাকাক্সক্ষী আবু তালেবের মৃত্যু, ইসলামী আন্দোলনের জন্য সর্বস্ব উৎসর্গকারিণী নিবেদিতাপ্রাণ হজরত খাদিজা রা.-এর ইন্তেকাল ও তায়েফের ময়দানে অমানুষিক নির্যাতন মহানবী সা. মানসিকভাবে জর্জরিত ও ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন। ঠিক এমনি এক কঠিন মুহূর্তে তিনি তার স্বীয় মাতৃভূমি মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হন। নবুয়তের দশম বর্ষে পরপর দুটো বিয়োগান্ত ঘটনা এবং তায়েফের ময়দানে রক্তাক্ত হওয়া ইত্যাদির কারণে সাহাবায়ে কেরাম সেই বছরকে “আমুল হুযন” অর্থাৎ দুঃখ-বেদনার বছর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

মহানবী সা. শান্তিপূর্ণভাবে তাঁর দাওয়াতি মিশন পরিচালনা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা সত্ত্বেও তিনি অনেক যুদ্ধবিগ্রহের সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি নিজের পক্ষ থেকে কোনো অভিযান পরিচালনা করেননি বরং তিনি শুধু আত্মরক্ষা করেছেন। তার অভিযান কখনো আক্রমণাত্মক (অমমৎবংংরাব) ছিল না বরং ছিল আত্মরক্ষামূলক (উবভবহংরাব)। এতদসত্ত্বেও অনেক যুদ্ধ অভিযান মুসলমান ও ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে। মুহাদ্দিস আবু এয়ালা হযরত জাবের রা. থেকে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল সা. ২১টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। মুহাদ্দিস আব্দুর রাজ্জাক হযরত সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সা. ২৪টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। ইবনে সা’য়াদ তাঁর তাবাকাতে উল্লেখ করেছেন যে, রাসূল করীম সা. ১৭টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। রাসূল সা. যেসব অভিযানে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন, এদের মধ্যে বদর, উহুদ, খন্দক, বানু কুরাইজা, বানু মুস্তালিক, খাইবার, হুনাইন, তায়েফ, মক্কা বিজয় ও তাবুকের যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মহানবী সা. ৬২২ ঈসায়ী সালের ১১ সেপ্টেম্বর ২৭ সফর দিবাগত রজনীতে তাঁর অত্যন্ত বিশ্বস্ত সহচর হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা.কে সাথে নিয়ে হিজরতের উদ্দেশ্যে মদীনায় রওয়ানা হন। মদীনার হিজরত করার পর প্রথম ছয় মাস মহানবী সা. নির্বিঘেœ শান্তিতে সময় কাটান এবং একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ছয় মাস পর হতেই মদীনার সোনালি আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা যায়। রাসূল সা.-এর প্রভাব প্রতিপত্তি ও নব-উত্থিত ইসলামী শক্তির আধিপত্য বিস্তারে ঈর্ষান্বিত হয়ে আরব পৌত্তলিক কুরাইশরা ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। মদীনার খাজরাজ গোত্রের প্রভাবশালী নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই নিজেকে মদীনার ভাবী রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনে করত। কিন্তু মহানবী সা. মদীনায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলে তার পরিকল্পনা চিরপরিকল্পনায় থেকে যায়। ফল সেও হিংসা-বিদ্বেষের অনলে জ্বলে-পুড়ে দগ্ধ হতে লাগলো। আর মনের অনল নিবারণের জন্য কুরাইশদের সাথে হাত মিলিয়ে মুসলমানদের সমূলে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

অপর দিকে মদীনার বিশ্বাসঘাতক ইহুদিরা ও মদীনা সনদের সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে কুরাইশদেরকে মদীনা আক্রমণে প্ররোচিত করে। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বাণিজ্যের অজুহাতে অস্ত্র সংগ্রহ করার জন্য সিরিয়া গমন করে। সে কাফেলায় অনেক সম্পদ ছিল। ১০০০ উটের পিঠে ৫০ হাজার দিনারের বিভিন্ন ব্যবসায়িক পণ্যসামগ্রী ছিল। ৫০,০০০ দিনার হচ্ছে ২৬২ কিলোগ্রাম সোনার সমান। এ-বাণিজ্য সফরের লক্ষ্যই ছিল অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি সঞ্চয় করা। বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়া থেকে মক্কা যাওয়ার পথে মুসলমান কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছে মর্মে মক্কায় গুজব ছড়িয়ে পড়লে এর কোনো সত্যতা যাচাই না করে কুরাইশগণ আবু জাহেলের নেতৃত্বে তেরোশত সৈন্য নিয়ে মদীনা আক্রমণের জন্য বদর অভিমুখে রওয়ানা হয়। আখনাস বিন সুরাইক একজন বিশিষ্ট আরব নেতা ছিলেন। তিনি সহ-সাধারণ সৈন্যরা আবু জাহেলকে এই মর্মে অনুরোধ জানালেন যে, আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে বাণিজ্য কাফেলা নিরাপদে মক্কায় পৌঁছে গিয়েছে বিধায় আমরা মক্কায় ফিরে যাই। কিন্তু বাদ সাধল আবু জাহল। সে অহঙ্কারের সাথে হুঙ্কার দিয়ে বলল, ‘আল্লাহর কসম আমরা বদর প্রান্তর এগিয়ে তিন দিন অবস্থান না করা পর্যন্ত মক্কায় ফিরে যাব না। এ সময় আমরা সেখানে উট জবাই করবো, আনন্দ-ফুর্তি করবো, মদের আসর জমাবো, দাসীরা আমাদের মনোরঞ্জনের জন্য গান গাইবে। ফলে সমগ্র আরবে আমাদের গৌরবগাথা ছড়িয়ে পড়বে এবং চিরকালের জন্য আমাদের এই ঐতিহাসিক সফর চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। অবশ্যই আখনাস বিন সুরাইক তার কথায় কর্ণপাত না করে তিনশত সৈন্য নিয়ে বদর প্রান্তর ত্যাগ করে। ফলে কুরাইশদের সাথে মুসলমানদের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠলো।

বদর যুদ্ধ ছিল মূলত একটি অসম যুদ্ধ। মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৩১৩ কারো মতে ৩১৪ এবং কারও মতে ৩১৭ জন। ইমাম বুখারী (রহ.) সহিহ বুখারীতে বদরী সাহাবীদের একটি আংশিক তালিকা পেশ করেছেন এদের মধ্যে ৮২/ ৮৩/ ৮৬ জন মুহাজির সাহাবী বাকি সকলেই ছিলেন আনসার সাহাবী। আনসারদের মধ্যে ৬১ জন ছিলেন আউস গোত্রের আর ৭০ জন ছিলেন খাজরাজ গোত্রের। এ ৩১৩ জন বলতে গেলে নিরস্ত্র ছিলেন। সমস্ত সেনাদলে ঘোড়া ছিল মাত্র দুটো। একটি হযরত জুবায়ের ইবনুল আাওয়াম রা.-এর আর অপরটি মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ রা.-এর; উট ছিল ৭০টি। দু-তিনজন পালাক্রমে একটি উটের উপর আরোহণ করছিলেন অপরদিকে শত্রু বাহিনীর সৈন্য ১০০০ জন। ঘোড়া ছিল একশত, বর্ম ছিল ছয়শত, উটের সংখ্যা ছিল অনেক। একদিনে নয়টি অপর দিনে দশটি উট জবাই করা হতো। গায়িকা বাঁদীদল বাদ্যযন্ত্রসহ তাদের সাথে ছিল। সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ছিল আবু জাহল ইবনে হিশাম।

৬২৪ ঈসায়ী সালের ১৭ মার্চ হিজরি দ্বিতীয় সনের ১৭ রমাদান মদীনা হতে ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বদর প্রান্তরে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে ১৪ জন সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। এর মধ্যে ছয়জন মুহাজির ও আটজন আনসার সাহাবী। ২০০৩ সালে আমি বদর প্রান্তর সফর করেছি। ১৪ জন শহীদের নাম মার্বেল পাথরে খোদাই করা একটি তালিকায় লিপিবদ্ধ করা আছে, যা দেখলে শরীর রোমাঞ্চিত ও নয়নযুগল সিক্ত হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে শত্রুপক্ষের ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন বন্দী হয়। বন্দীদের সাথে রাসূল সা.-এর পিতৃব্য হযরত আব্বাস রা. এবং আবু তালিবের দুই পুত্র তালেব এবং আকিলও ছিলেন। তাদেরকে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধ্য করা হয়েছিল। শত্রু বাহিনীর অধিনায়ক আবু জাহল ইবনে হিশাম, উমাইয়া বিন খালফ, উতবা বিন রবিয়া, সাইবা বিন রাবিয়া, ওলিদ বিন উতবাসহ চব্বিশ জন কুরাইশ নেতা নিহত হয়। হযরত আবু তালহা রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, মহানবী সা.-এর নির্দেশে বদরের দিন কুরাইশদের চব্বিশ জন বড় বড় নেতার লাশ বদরের একটি নোংরা কূপে নিক্ষেপ করা হয়। নিক্ষেপের পর হঠাৎ কূপের তীরে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। নিহত কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে সম্বোধন করে বলেন, হে অমুকের পুত্র অমুক, তোমরা যদি মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতে তাহলে সেটা কি তোমাদের জন্য মঙ্গল হতো না? আর মহান আল্লাহ আমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছেন আমরা তার সত্যতার যথার্থ প্রমাণ পেয়েছি। তোমরা কি তোমাদের প্রভুর কৃত ওয়াদা সত্যতার প্রমাণ পেয়েছ? হযরত ওমর রা. আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এসব মৃতদেহের সাথে কি কথা বলছেন? রাসূল সা. জবাবে বললেন সেই মহান সত্তার শপথ করে বলছি যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, আমি যা কিছু বলেছি তোমরা ওদের চেয়ে বেশি শুনতে পাওনি। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে তোমরা ওদের চেয়ে বেশি শ্রবণকারী নও। কিন্তু তারা জবাব দিতে পারে না। (বুখারী ও মুসলিম)

বদর যুদ্ধের ফেরেশতাদের অংশগ্রহণ বদর যুদ্ধে সরাসরি ফেরেশতারা অংশগ্রহণ করেছিলেন। এদের নেতৃত্বে ছিলেন হযরত জিবরাইল (আ) ও মিকাইল (আ)। তাদের দায়িত্ব ছিল মূলত দুটো। প্রথমত, মুসলমানদের সাহস বৃদ্ধি করা এবং তাদের মনোবল অটুট রাখা। দ্বিতীয়ত, বিজয়ের সংবাদ শুনানো। প্রথমত, আল্লাহ তায়ালা এক হাজার মুরদেফিন তথা ধারাবাহিকভাবে আগত ফেরেশতাদের দিয়ে সাহায্যের ওয়াদা দেন। যেমন মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যখন তোমরা তোমাদের রবের নিকট ফরিয়াদ ও প্রার্থনা করেছিলে তিনি তোমাদের প্রার্থনা এই বলে মঞ্জুর করলেন যে, আমি তোমাদের এক হাজার ধারাবাহিকভাবে আগত ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করবো।” (সূরা আনফাল: ৯) পরবর্তীতে তিন হাজার তথা আকাশ থেকে অবতীর্ণ হবে এমন রিজার্ভ বাহিনী দিয়ে সাহায্য করবেন। যেমন: সূরা আলে-ইমরানের ১২৪ নং আয়াতে রয়েছে, “আপনি যখন মুমিনদেরকে এ কথা বলতে লাগলেন যে- তোমাদের জন্য কি যথেষ্ট নয় তিনি তোমাদের সাহায্যার্থে তিন হাজার আকাশ থেকে অবতরণকারী ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করবেন? পরবর্তীতে পাঁচ হাজার বিশেষ ব্যাজধারী ফেরেশতা দ্বারা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। যেমন: সূরা আলে-ইমরানের ১২৫ নং আয়াতে আছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, বদর যুদ্ধে মহানবী সা. বললেন, এইতো জিবরাইল এসে গিয়েছেন। তিনি ঘোড়ার মাথা চেপে ধরে আছেন এবং তার সাথে রয়েছে যুদ্ধাস্ত্র। (বুখারী)

হযরত ইকরামা রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, বদর যুদ্ধের দিন মানুষের মাথা কর্তিত হয়ে পড়েছিল। অথচ বুঝা যাচ্ছিল না যে, কে তাকে মেরেছে। মানুষের কর্তিত হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যেতো, অথচ কে কেটেছে তাও বুঝা যেতো না। (ইবনু সা’দ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, একজন আনসারী সাহাবী বদর রণাঙ্গনে একজন মুশরিককে ধাওয়া করেছিলেন। হঠাৎ সে মুশরিকের উপর চাবুকের আঘাতের শব্দ শুনা যাচ্ছিল আর কে যেন বলছিল যাও সামনে এগিয়ে যাও। সাহাবী লক্ষ্য করলেন যে, মুশরিক ব্যক্তি চিৎ হয়ে পড়ে আছে। তার নাকে চোখে আঘাতের চিহ্ন, রক্তাক্ত চেহারা দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল যে, তাকে চাবুক দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। অথচ আঘাতকারীকে দেখা যাচ্ছিল না, সেই আনসার সাহাবী রাসূল সা.-কে এই ঘটনার বর্ণনা দিলে, মহানবী সা. বললেন তুমি সত্য বলেছ, এটি ছিল তৃতীয় আসমানের সাহায্য। (মুসলিম ২য় খণ্ড)

বদর যুদ্ধে একজন আনসার সাহাবী হযরত আব্বাস রা.-কে গ্রেফতার করে নিয়ে এলেন, হযরত আব্বাস রা. তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি বলেন, আমাকে তো এই লোকটি বন্দি করে নিয়ে আসেননি, আমাকে মুণ্ডিত মস্তকের একজন লোক গ্রেফতার করে নিয়ে এসেছে। সুদর্শন এই লোকটি একটি চিত্রল ঘোড়ার পিঠে আসীন ছিল। এখনতো তাকে দেখা যাচ্ছে না। আনসারী সাহাবী বললেন, ওহে আল্লাহর রাসূল সা. আমিই তো তাকে বন্দি করে নিয়ে এসেছি। রাসূল সা. বললেন; চুপ কর, মহান আল্লাহ একজন সম্মানিত ফেরেশতা দিয়ে তোমাকে সাহায্য করেছেন। (আর রাহীকুল মাখতুম, ২৫৫ পৃ:) বদরী সাহাবীদের মর্যাদা এতো বেশি যে, মহান আল্লাহ তাদের শানে বলেছেন; তোমাদের যা ইচ্ছা তা আমল কর, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি। অনুরূপ বদরী ফেরেশতাদেরও মর্যাদা রয়েছে। হযরত মুয়াস ইবনে রেফায়া রা. তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেছেন, অবশ্য তার পিতা বদরী সাহাবী ছিলেন। তিনি বলেন, হযরত জিবরাইল (আ) নবী করিম সা.-কে প্রশ্ন করলেন যে, বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ব্যাপারে আপনি কী অভিমত পোষণ করেন? জবাবে তিনি বললেন, আমি বদরী সাহাবীদেরকে মুসলমানদের মধ্যে সর্বোত্তম মনে করি। জিবরাইল (আ) বললেল, ফেরেশতাদের মধ্যে যারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তারাও অনুরূপ মর্যাদার অধিকারী। (বুখারী)

বদর যুদ্ধে ইবলিসের অংশগ্রহণ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত আছে যে, আবু জাহলের নেতৃত্বে কুরাইশ বাহিনী রওয়ানা হলে তাদের মনে পড়লো যে, বানু বকর গোত্রের সাথে তাদের শত্রুতা ও যুদ্ধ চলছিলো। ফলে তাদের মধ্যে এই আশঙ্কা চেপে বসল যে, ওরা পিছন দিক থেকে আক্রমণ করতে পারে কিংবা মক্কায় তাদের বাড়িঘর ও নারী-শিশুদের উপর হামলা চালাতে পারে। এ প্রসঙ্গে অনেক আলোচনা পর্যালোচনার পর কুরাইশদের সামরিক অভিযান স্থগিত হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। ঠিক এমনি মুহূর্তে অভিশপ্ত শয়তান বানু বকর ও কেনানা গোত্রের সরদার সুরাকা ইবনে মালেকের চেহারা ধারণ করে আবির্ভূত হয়ে কুরাইশ নেতাদের বললো, আমি তো তোমাদের পরম বন্ধু। বানু কেননা তোমাদের অনুপস্থিতিতে আপত্তিকর কোনো কাজই করবে না। আমি তোমাদের এই নিশ্চয়তা দিচ্ছি। সেই সৈন্যদের সামনে এগিয়ে গিয়ে কুরাইশ যুবকদের উদ্দেশ্যে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিল এভাবে ভাইয়েরা আমার! আজকের দিনে এমন কেউ নেই যারা তোমাদের উপর জয় লাভ করতে পারে। আমি তোমাদের শক্তি সামর্থ্য ও সংখ্যাধিক্য তো স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। তোমরা এগিয়ে যাও। বিজয় তোমাদের জন্য সুনিশ্চিত। আর বানু বকর গোত্রের ব্যাপারে অহেতুক মাথা ঘামানোর কোনো কারণ নেই। এর দায়-দায়িত্ব আমি নিলাম। কেননা আমি তোমাদের পরম হিতাকাক্সক্ষী, পরম বন্ধু ইত্যাদি। শয়তানের এই বক্তব্যটি মহান আল্লাহ নিজের ভাষায় কোড করছেন এভাবে, “স্মরণ করো, যখন শয়তান তাদের কর্মকাণ্ডকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে উপস্থাপন করলো এবং বললো যে, আজকের দিনে কোনো মানুষই তোমাদের উপর বিজয়ী হতে পারবে না। আর আমি তোমাদের প্রতিবেশী ও সহায়ক।” (সূরা আনফাল : ৪৮)

রণক্ষেত্র থেকে ইবলিসের পলায়ন অভিশপ্ত শয়তান সুরাকা ইবনে মালেকের আকৃতি ধারণ করে বদর প্রান্তে এসেছিল। সে যখন দেখতে পেল হযরত জিবরাইল (আ)-এর নেতৃত্বে ফেরেশতাগণ প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করল তখন শয়তান ছুটে পালাতে লাগলো। কিন্তু হারেস বিন হিশাম রা. তাকে সুরাকা ইবনে মালেক মনে করে ধরে ফেললেন। কিন্তু ইবলিস হযরত হারেসের বুকে প্রচণ্ড ঘুষি মেরে মাটিতে ফেলে দিলো। ইতোমধ্যেই ইবলিস পালিয়ে গেল। মুশরিকগণ বলতে লাগলো সুরাকা তুমি কোথায় যাচ্ছ? তুমি কি বলো নাই যে, আমাদের সাহায্য করবে? আমাদেরকে ছেড়ে পালাবে না? সুরাকা ছদ্মরূপী শয়তান বললো- আমি এমন কিছু দেখতে পাচ্ছি, যা তোমরা দেখতে পাচ্ছো না। আমি আল্লাহ্কে ভয় করছি। তিনি কঠোর শাস্তিদাতা। (সূরা আনফাল : ৪৮) বদরের যুদ্ধে রাসূল সা. অত্যন্ত কাতর কণ্ঠে দোয়া করেছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত আছে যে, বদর যুদ্ধে রাসূল সা. এ কথা বলে দোয়া করছিলেন যে, হে আল্লাহ! তুমি তোমার প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করো, হে মহান আল্লাহ তুমি কি এটা চাও আজকের পরে কখনো তোমার এবাদত করা না হোক। একপর্যায়ে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. তার হাত ধরে বললেন হে আল্লাহর রাসূল সা. এতটুকুন দোয়াই তো আপনার জন্য যথেষ্ট। তারপর তিনি কুঠির হতে বের হলেন এবং বলতে লাগলেন এই দলতো শিগগিরই পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালিয়ে যাবে। (বুখারী) হাফেজ আবু ইয়ালা বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আলী রা. বলেন বদর যুদ্ধের এ রাতে ঘুমায়নি এমন কেউ ছিলেন না। শুধু হযরত রাসূলে কারীম সা. সারারাত জেগে থেকে ভোর পর্যন্ত তাহাজ্জুদ নামাযে নিয়োজিত থাকেন। ইবনু কাসীর বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী সা. যখন স্বীয় আরিশ তথা শামিয়ানার নিচে তাহাজ্জুদ নামাজে রত ছিলেন তখন তার চোখেও সামান্য তন্দ্রা এসে গিয়েছিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জাগ্রত হয়ে হাসতে হাসতে বললেন, হে আবু বকর! সুসংবাদ শোনো এই জিবরাইল (আ) টিলার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। এই যুদ্ধে ঈমানী শক্তির বিস্ময়কর নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়। বলতে গেলে মহান আল্লাহ খোদ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। বদর যুদ্ধে সাহাবীগণ পরস্পর বিজয়ের দাবিতে মেতে উঠল। মহান আল্লাহ বলেন, “সুতরাং তোমরা তাদেরকে হত্যা করোনি বরং আল্লাহ্ই তাদেরকে হত্যা করেছেন।” মাটি বা ধুলা আপনি নিক্ষেপ করেননি, যখন আপনি নিক্ষেপ করেছিলেন বরং তা নিক্ষেপ করেছিলেন স্বয়ং আল্লাহ। (সূরা আনফাল: ১৭) হযরত জিবরাইল (আ.) এর নেতৃত্বে ফেরেশতাদের এক বিশাল বহর এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এই উম্মতের ফেরাউন আবু জাহেলসহ কুরাইশ নেতৃবৃন্দের নিহত হওয়া এবং এই অভিযানে পিতা-পুত্রের ও ভাই ভাইয়ের মুখোমুখি হওয়া মহান আল্লাহর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে তলোয়ার কোষমুক্ত হয়েছে একে অপরের বিরুদ্ধে।

বদর যুদ্ধের মূল্যায়ন বদর যুদ্ধের বিজয় মূলত নৈতিকতা ও আদর্শের বিজয়। ধৈর্যশীল ও নৈতিক মানসম্পন্ন একটি ক্ষুদ্র দলও একটি বিরাট দলের উপর বিজয়ী হতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন, “বদরের যুদ্ধে মহান আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করেছেন অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল ও নগণ্য।” (সূরা আলে ইমরান : ১২৩) বদরী সাহাবী আল্লাহর সাহায্যের উপযোগী হওয়ার জন্য শর্ত পূরণ করছিলেন দুটো। এক. ধৈর্য, দ্বিতীয়. তাকওয়া। বদরের বিজয়কে মহান আল্লাহ ‘ইয়াউমুল ফুরকান’ অর্থাৎ হক ও বাতিলের মধ্যকার পার্থক্য সৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই দিন বদর যুদ্ধের ফলাফল মুসলমানদের পক্ষে না এলে হয়তো ইসলামের ইতিহাস ভিন্নভাবে মোড় নিতো। বাহ্যত এটি একটি স্থানীয় যুদ্ধ মনে হলেও বাস্তবে পৃথিবীর ইতিহাসে এর ফলে একটি সুমহান বিপ্লব সাধিত হয়।

অধ্যাপক হিট্টি বলেন : এটি ছিল ইসলামের সর্বপ্রথম প্রকাশ্য বিজয়। R.A Nichalson বলেন, The battle of Badar is not only the most celebrated battle in the memory of Muslims it was really also at a great historical importance. বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এতে ইসলাম ও খোদাদ্রোহী শক্তির চরম পরীক্ষা হয়। এটি ছিল মুসলমানদের নৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক বিজয়। হিট্টির ভাষায় ‘যত নগণ্যই হউক বদর যুদ্ধ মুহাম্মদ সা.-এর পার্থিব ও শক্তির ভিত্তি স্থাপন করে।’ বদর যুদ্ধের ফলাফল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। বদরের যুদ্ধের বিজয়ী মুসলিম উম্মাহ, ইসলামী আন্দোলনের কর্মী ও লড়াকু সৈনিকদের জন্য এক প্রেরণার উৎস। এটি কিয়ামত পর্যন্ত উৎসাহ ও প্রেরণা জোগাবে নিঃসন্দেহে। ঐতিহাসিক নিকলসনের ভাষায়, ‘ম্যারাথন সংগ্রামের ন্যায় বদর যুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বৃহত্তম স্মরণীয় সংগ্রাম। এটি সর্বকালের জন্য আরব দেশে ইসলাম এমনকি সমগ্র পৃথিবীর ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেছে।’ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগেও কোন জনগোষ্ঠীর আল-কুরআনের শর্ত পূরণ করতে পারলেই সফলতা, বিজয় ও সম্মান তাদের পদচুম্বন করবে। ঈমানী শক্তি, ধৈর্য ও নৈতিকতা অর্জনের মাধ্যমে মহান আল্লাহ আমাদেরকে আল-কুরআকে বিজয়ী করার তৌফিক দান করুন। আমিন

লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ ও অধ্যক্ষ; বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির