post

নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী হওয়ার সহজ উপায়

০৩ মার্চ ২০১৪

মাসুদ মজুমদার

Probondhoএক. এখন নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী হওয়ার প্রকৃষ্ট উপায় হলো, পাঁচ ডজন অভিযোগে শেখ হাসিনাকে সমালোচনা করে শেষ লাইনে বলতে হবে খালেদার দায়ও কম নয়। ব্যস, ধোলাই হওয়া মগজ এবং নিরপেক্ষতার ড্রাইওয়াশের মধ্য দিয়ে বুকের ছাতি ফুলিয়ে বলতে পারবেন তিনি দলনিরপেক্ষ। এর সাথে যদি প্রগতিশীলও হতে চান, তাহলে আরেকটু কষ্ট করে ক’টা মুখরোচক শব্দ আওড়াতে হবেÑ বলতে হবে, তিনি জামায়াত-শিবিরের নিকুচি করেন। মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, মুর্দাবাদ। হেফাজতে ইসলাম গোল্লায় যাক। আরো বলতে হবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর থেকে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান। এরপর তার প্রগতিশীলতার তকমা ঠেকায় কে! একই সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও যদি ফেরি করতে চান, তাহলে বলতে হবেÑ একাত্তরের হার্মাদদের রুখে দিতে শাহবাগ মঞ্চ ঘরে ঘরে বানাতে হবে। অসমাপ্ত দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয়ী হতে হবে। এর সাথে আপনি যদি তত্ত্বীয় বুদ্ধিজীবী, সুশীল এবং টকশোর আঁতেল হতে চান, তাহলে শ্রেণিসংগ্রামের আদলে বর্তমান সময়কে স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষে রেখে একটি স্নায়ু ও ছায়া যুদ্ধের নকশা এঁকে দিতে হবে। আর তাতে জিতে যাওয়ার জন্য নতুন প্রজন্মকে আহ্বান জানাতে হবে। সেই সাথে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের শুধুই ফাঁসি চাইতে হবে। আপনি যদি একই সাথে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অতন্দ্র পাহারাদার হতে চান, তাহলে ড্যান মজিনাসহ ইউরোপ-আমেরিকার বিরুদ্ধে চোখটাটিয়ে গলাফুলিয়ে নিন্দাবাদ করতে হবে। ড্যান মজিনাদের বহিষ্কারের কথা বলতে হবে। পাকিস্তানি বর্বরদের পিণ্ডি চটকে বলতে হবে, পাকিস্তানি পণ্য ও খেলাধুলা, ব্যবসাবাণিজ্য বর্জন করতে হবে। ভারতীয় আধিপত্যবাদ, একচেটিয়া বাজার দখল, সীমান্ত হত্যা, সুজাতা সিং, পঙ্কজ শরণ এবং তাদের সব বাড়াবাড়িকে বন্ধুত্বের সংজ্ঞায় ফেলে কিল খেয়ে কিল হজমের মতো চুপ থাকতে হবে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তুখোড় ভাষায় নিন্দাবাদের কোরাস গাইতে হবে। সেই সাথে আপনার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও অসংখ্য নিষ্পত্তি না হওয়া ইস্যু ভুলে থাকতে হবে। এরপর আপনার দেশপ্রেম ঠেকায় কে? আপনি আরো চৌকস হতে চাইলে রানা প্লাজা, ব্যাংক লুণ্ঠন, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু দুর্নীতি, শেয়ারবাজারে তস্করি, রেলের কালো বিড়াল, খুন-গুম-হত্যার মোকাবেলায় খালেদা জিয়ার ‘গোপালী’ শব্দচয়নকে স্কাড ক্ষেপণাস্ত্রের মতো ছুড়ে দিতে হবে। এত হত্যার সাথে একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার প্রসঙ্গ টানতেই হবে। একাত্তরের প্রসঙ্গ তুলে শরীরকে ওয়ার্মআপ করতে হবে। ঘুণাক্ষরেও রক্ষীবাহিনীর হাতে ৩০ হাজার হত্যা, এই সময়ে শত শত লোক হত্যা, হেফাজতের বেশুমার মানুষ সম্পর্কে কোনো কথা বলা যাবে না।  সেই সাথে কিশোরগঞ্জ, ভোলা ও কালিহাতির নির্বাচন, ’৭৩ সালে ধানের ক্ষেতে ব্যালট বাক্স পাওয়া নিয়ে কথা না বলে মাগুরা ও ঢাকা-১০ নিয়ে তুখোড় সমালোচনা করতে হবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে বলতে হবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। এরপর আপনার তরক্কি আর ঠেকায় কে? এর পরও যদি আপনি ঠাঁই না পান, তাহলে মানবাধিকার কমিশন মিজানের মতো কিছু স্ববিরোধী বক্তব্য দিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করতে হবে। কোনোভাবে শেষ রক্ষার সুযোগ না হলে সংবিধান রক্ষার কোরাস গাইতে হবে। একই সাথে সংবিধান বিশেষজ্ঞের খ্যাতিটাও কিনতে চাইলে সংবিধানের গায়ের জোরে একটা উদ্ভট ব্যাখ্যা দিতে হবে। তারপর দেখবেন চ্যানেলগুলো আপনাকে লুফে নিচ্ছে। দক্ষিণ জনপদে একটি লোকগল্প চালু আছে। নাম জাগানোর জন্য শত অপকর্ম করেও নাম ‘চেতাতে’ পারল না। শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবেচিন্তে মামীশাশুড়িকে নিকা করে ফেলল। এরপর আর তার নাম ঠেকিয়ে রাখে কে? তার নাম সবার মুখে মুখে, কী! চেষ্টা করে দেখবেন নাকি! দুই. পঁচাত্তরের প্রেক্ষিত যখন সৃষ্টি হচ্ছিল, তখন মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবুল মনসুর আহমদ, খন্দকার আবদুল হামিদ, এম এ জি ওসমানী, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন প্রমুখ বাকশালের বিরোধিতা করে কি ভুল করেছিলেন? গণতন্ত্রের সপক্ষে তাদের ক্ষীণকণ্ঠ হলেও শক্ত অবস্থান কি ইতিহাস মূল্যায়ন করেনি? এরশাদ যখন একটি নির্বাচিত সরকারকে বন্দুকের জোরে উপড়ে ফেলে অবৈধ ও অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন তখন যারা তাকে অবৈধ, স্বৈরাচার, বিশ্ববেহায়া বলেছিলেন তাদের ভূমিকা কি সঠিক ছিল, না ভুল প্রমাণিত হয়েছে! ’৮৬ সালে এরশাদের সাজানো নির্বাচনে যারা বৈধতা দিয়েছিলেন, তারাই এক দিন আগে বলেছিলেন পাতানো নির্বাচনে যারা যাবে তারা হবে জাতীয় বিশ্বাসঘাতক। সেই আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা এবং জামায়াত যখন রাজপথে খালেদা জিয়াকে রেখে সেই নির্বাচনে গিয়েছিলেন, তখন তারা সঠিক ছিলেন, না খালেদা জিয়া? ’৮৮ সালের নির্বাচন অনুগত ক’জন ছাড়া সবাই বয়কট ও বর্জন করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গে আর কিছু না বলাই শ্রেয়। ’৯৬ সালে জনগণের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে তত্ত্বাবধায়ক দাবি মেনে কম গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে গঠিত সংসদে বিল পাস করে দ্রুত সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা যারা করেছিলেন, তারা ঠিক করেছেন, না সংবিধান থেকে সেই ব্যবস্থা উপড়ে ফেলে জাতীয় সঙ্কট সৃষ্টি করে ভোটারহীন প্রহসনের নির্বাচন করে ক্ষমতা আকড়ে আছেন তারা ঠিক কাজ করছেন! এর জবাব জনগণকেই খুঁজে পেতে হবে। এ ধরনের প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ উদ্ভট কিংবা অপ্রাসঙ্গিক কি না সেটি ভিন্ন বিষয়। তবে খালেদা জিয়া, আঠারোদলীয় জোট, বি চৌধুরী, ড. কামাল, আ স ম রব, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীসহ আরো যারা নির্বাচন বয়কট করে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেনÑ তারা এর জন্য অবশ্যই ইতিহাসে নন্দিত হবেন। ’৮৬ সালে খালেদা জিয়াকে রাজপথে রেখে যারা তাৎক্ষণিক লাভবান হয়েছিলেন বলে বগল বাজিয়েছিলেন, খালেদা জিয়াকে ভেবেছিলেন বেয়াক্কেলÑ শেষ পর্যন্ত তারা নন্দিত হননি, হয়েছেন খালেদা জিয়া। আজকের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে খালেদা জিয়া ও তার জোটের সীমাবদ্ধতা আছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার এবং সমমনাদের ভূমিকা ইতিহাসে নন্দিতই হবে। কারণ এরা ভোটের অধিকার, গণতন্ত্র রক্ষা ও গণতন্ত্র অনুসরণের তাড়না থেকে নির্বাচন বয়কট করে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। ’৮৬ সালে নির্বাচনের পর অনেকেই খালেদার রাজনীতি, আপসহীন অবস্থানকে কটাক্ষ করে এতিমের রাজনীতি বলেছিলেনÑ এরাই এখন আবার এতিমের মাল লুণ্ঠনের মতো ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় কখনো কখনো এমন ক্রান্তিকাল বা সন্ধিক্ষণ এসে দাঁড়ায়, তখন ভূমিকা হতে হয় সত্য-মিথ্যার লড়াইয়ের মতো। রাজনৈতিক লাভালাভ ও দলীয় স্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থ, গণতন্ত্রের দায়, সংবিধান রক্ষার তাগিদ বেড়ে যায়। বর্তমান সময়ে খালেদা জিয়ার অবস্থান সেই লক্ষ্যে ইতিবাচক এবং জরুরিও বটে। তিন. রণকৌশল যুদ্ধনীতির অংশ। চেয়ারম্যান মাও বলতেন, দশ কদম এগোনোর স্বার্থে তিন কদম পেছনে যাওয়া পরাজয় নয়, কৌশল। তা ছাড়া যুদ্ধ একধরনের ধোঁকা। প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানো সব যুগেই রণকৌশল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। চেয়ারম্যান মাও বলেছেন, বিপ্লব ধ্বংস নয়, সৃষ্টির প্রসববেদনা। কোনটা ধ্বংস, কোনটা প্রসববেদনার বিষয় সেটা বোঝা নেতৃত্বের প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করে। কর্মীদের ওপর দোষ চাপিয়ে নেতৃত্ব রেহাই পেতে পারে না। এ যাবৎ রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যারা জিতেছেন তারা জনযুদ্ধকে অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং গণ-অভ্যুত্থান অনিবার্য করে ঘরে ফিরেছেন। যারা হেরেছেনÑ তারা রোমাঞ্চকর ভাবনাতাড়িত হয়ে পথ চলেছেন। বুঝতে হবে দুর্গতিনাশিনী দুর্গার নাকি ১০ হাত, রাষ্ট্রশক্তির একুশ হাত। যারা রাষ্ট্রশক্তিকে চ্যালেঞ্জ করতে চান তাদেরও বাড়তি হাত থাকতে হয়। রবিনহুড, দস্যু বাহরাম, বনহুর, মাসুদ রানা কিংবা নীহার রঞ্জনের কিরিটি রায় হোন আপত্তি নেই, মাটি ও মানুষকে বশে না রেখে অথবা বিগড়ে দিয়ে কিছু হয় না, হবে না। রাষ্ট্রশক্তি ও সরকারের মধ্যে যারা তফাৎ ঘুচিয়ে দেয় তারা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনে। যারা সাত-পাঁচ না ভেবে, ভূতভবিষ্যৎ চিন্তা না করে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধায় তারা আহাম্মক, বোকার হদ্দ। ক’টা টাকা সঞ্চয় থাকলে যেমন বেহিসাবি হতে হয় না, তেমনি ক’গণ্ডা জনশক্তি থাকলেই রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহারে সিদ্ধহস্ত চিহ্নিত দুশমনদের মুখের গ্রাস বানাতে হয় না। মাও সে তুংয়ের লংমার্চের সময় তাড়া খেয়ে পলাতক চিয়াঙকাইশেখকে তাড়া করতে মাও ফরমোজা বা আজকের তাইওয়ান যাননি। পলাতক চিয়াঙকাইশেখকে ফরমোজায় রেখেই গণচীন পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া চলেছে। মাও এ কারণেই অংশত সফল। হুদাইবিয়ার সন্ধি হয়েছিল বলেই মদিনা সনদও কার্যকর হতে পেরেছে, মক্কা বিজয়ও সম্ভব হয়েছে। বাস্তিল দুর্গ পতনের আগেই সরকার রাষ্ট্রশক্তি ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। নীতিবাগীশদের কড়া নির্দেশনাÑ ভালো কাজটা খারাপ পদ্ধতিতে হয় না। রণকৌশল হিসেবে যখন প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানো হয়, তখনো নীতিকথাটা ভুলে গেলে চলে না। তখনো সস্তা আবেগের পূজা করলে হয় না। মোটাতাজা মানুষ আর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষ এক নয়। অসুস্থ মানুষ, দল, সংগঠন ও প্রাণীর শরীর কার্টুনের মতো ভারসাম্যহীন।  হাত চিকন, পেটমোটা, মাথা ছোট, পা শুকনো মানুষ কার্টুনসদৃশ। লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-কর্মসূচি, কর্মপদ্ধতি ও কর্মপরিকল্পনায় ভারসাম্যহীন হলে চলে না। লক্ষ্যভেদী হতে হলে কক্ষচ্যুত হওয়া যায় না। সময় মেপে পথ চলতে হয়। সরকার ও সরকারের প্রতিপক্ষ সবাই এখন অপরিণামদর্শী ও হঠকারী কি না সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে ভাবতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন যারা কথামালার খই ফুটাচ্ছেন, ক্ষমতার ফুটানি দেখাচ্ছেন, তারা নিশ্চিত পরাজয়ের মুখোমুখি দাঁড়াবেন। যারা নিজেদের ওজন না মেপে কণ্টকাকীর্ণ পথ চলছেন, তারাও অস্তিত্ব বিপন্ন করবেন। যারা তামাশা দেখছেন, তারাও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন। শেষপর্যন্ত জনগণ জিতবেই। বুকে হাত দিয়ে বলুন আত্মপ্রবঞ্চনার পথে আছেন- না দেশ, জাতি ও জনগণের পক্ষে আছেন। তাঁবেদারমুক্ত হলে জাগ্রত বিবেক জবাব দেবে। নয়তো ভুলকেও শুদ্ধ বলবেন। পতনকেও বিজয় ভাববেন। জনগণকেও প্রতিপক্ষে রেখে ছায়াযুদ্ধে জড়িয়ে যাবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির