post

পরিবেশ সংরক্ষণ প্রেক্ষিত ইসলাম

১৫ জুন ২০১৩

মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম

সমগ্র বিশ্বে ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়ে থাকে। প্রত্যেক দেশের সরকার স্ব স্ব দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে আবহাওয়া, জলবায়ু, মাটির প্রকৃতি, প্রাকৃতিক পরিবেশ, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, ভৌগোলিক পরিবেশ ইত্যাদি বিবেচনায় এনে পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন ও বৃক্ষ রোপণ অভিযান পরিচালনা করে। এই পৃথিবীতে মানুষ টিকে থাকতে হলে, সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশের গ্যারাটি নিজেদেরকেই দিতে হবে। এ ব্যাপারে বিশ্ব সংস্থাগুলো স্ব স্ব দেশের পরিবেশ সংস্থাগুলো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে কালজয়ী মতাদর্শ ইসলামে কী নির্দেশনা আছে তা আমরা আলোচনা করার চেষ্টা করব। পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলামের অনন্য নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পেয়ে একটি সুস্থ পরিবেশ বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠবে। আমাদেরক বনাঞ্চল উজাড়, বৃক্ষ নিধন না করে প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাহাড় না কাটা, বন্যপ্রাণী নির্বিচারে শিকার বন্ধ, যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া, মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতা বন্ধ করা ইত্যাদির ব্যাপারে দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়া। বিশ্ব প্রসঙ্গ বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে সচেতনতা সৃষ্টির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন একদল পরিবেশবাদী। আন্তর্জাতিকভাবে নিউজিল্যান্ডের ‘গ্রিনপিস’ অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। দেশে দেশে গবেষণা, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য কিভাবে রক্ষা হবে? বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশ দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এর জন্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো শিল্পোন্নত দেশগুলোকে দায়ী করছে। এক রিপার্টে জানা গেছে, ‘সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এর জন্য তৃতীয় বিশ্ব নয়, বরং উন্নত বিশ্বই দায়ী।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশ সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য শুধু সচেতনতা বাড়ালেই চলবে না। যথাযথ আইন-প্রণয়ন ও প্রয়োগের ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। সুইডেনের স্টকহোমে ৭ দিন ব্যাপী ডড়ৎষফ ডধঃবৎ ডববশ-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে বক্তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন এই বলে যে, “আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা যখন আরো ৩০০ কোটির মতো বেড়ে যাবে তখন পানি সঙ্কট ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।’ জীবন ধারণের জন্য পানির কি প্রয়োজনীয়তা রয়েছে সকলেই অবগত। পানি সঙ্কট মানেই পরিবেশের ওপর মারাত্মক হুমকি। সর্বকালের অন্যতম সেরা পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বিশ্ব পরিবেশ দিবস (২০০৬)-এর ভাবনা হিসেবে ণধযড়ড় বিন ংরঃব ব্যবহারকারীদের প্রতি প্রশ্ন রাখেন, ‘রাজনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ এ পৃথিবীকে আরো ১০০ বছর টিকে থাকার জন্য মানুষকে কোন্ উপায় অবলম্বন করতে হবে?’ গত ১০-১-২০০১ মুম্বাইতে "ঞযব ঁহরাবৎংব রহ ধ হঁঃংযবষষ. শীর্ষক এক সেমিনারে গ্রিন হাউজ ইফেক্টের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্টিফেন হকিং। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব যে ক্রমশ উষ্ণ হয়ে পড়ছে, এ ব্যাপারে আমাদের কাছে নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, গ্রিন হাউজ ইফেক্ট হয়তো রোধ করা যাবে না, সেক্ষেত্রে মানবজাতির অস্তিত্ব এক হাজার বছরের মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পৃথিবীর আবহাওয়া হয়ে যাবে শুক্র গ্রহের মতো। শুক্র গ্রহে সালফিউরিক এসিড বৃষ্টি ঝরে।’ গ্রিন হাউজ ইফেক্টের বিরুদ্ধ শক্তিশালী জনমত তৈরির আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, এটা করা না গেলে আমরা আর এক হাজার বছরও টিকব না।’ বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ ঢেউয়ের নিচে অদৃশ্য হয়ে যাবে বাংলাদশ। এ খবর কি অবিশ্বাস্য নয়! অবিশ্বাস্য হলেও বাংলাদেশ ঘুরে গিয়ে নিষ্ঠুর এ পূর্বাভাস দিয়েছেন প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট-এর জোহান হ্যারি। তার প্রকাশিত (২০.৬.২০০৮) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, বঙ্গোপসাগরের পানির স্তর বৃদ্ধি এবং হিমালয় পর্বতমালা গলতে থাকায় পর্বত পরিবেষ্টিত সমতল বাংলাদেশ এ নির্মম পরিণতির শিকার হতে যাচ্ছে। এ পরিণতির জন্য মানুষকে দায়ী করে প্রতিবেদনের ইতি টানা হয় এভাবেÑ “আমরা যা করছি, তা যদি করতে থাকি, বাংলাদেশের মৃত্যু অত্যাসন্ন। যারা পরিবেশকে ধ্বংস করছে দেশটির সাথে তাদের সলিল সমাধি হবে অথবা অন্য কোন উপকূল ভেসে গিয়ে উদ্বাস্তু হবে তারা। নিহত কিংবা উদ্বাস্তুর সংখ্যা দাঁড়াবে কোটি কোটি। বাংলাদেশের কবরের ওপর খোদাই করা থাকবেÑ বাংলা দেশ ১৯৭১-২০৭১ : রক্তে জন্ম জলে মৃত্যু।’ যুক্তরাষ্ট্রেরও একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানায়, ‘বাংলাদেশ কয়েক দশকের মধ্যে সাগরের বুকে বিলীন হয়ে যেতে পারে।’ পরিবেশ বিজ্ঞানীরা শুধু বাংলাদেশ নয়, এ তালিকায় মালদ্বীপ ও হল্যান্ডের নামও রেখেছেন। এই তিনটি দেশ সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে নিচে অবস্থিত। এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা গ্রিন হাউজ ইফেক্টের প্রভাব বলে উল্লেখ করেন। গ্রিন হাউজ ইফেক্টের কারণে মরু অঞ্চলের তাপমাত্রা বেড়ে বরফ গলতে শুরু করেছে। এ কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সমুদ্র উপকূলীয় দেশগুলো প্লাবিত হবার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞগণ বাংলাদেশের পরিবেশ ব্যবস্থাপনার সার্বিক চিত্রে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। পরিবেশ আইন ও নীতি থাকলেও এর যথাযথ ব্যবহার ও প্রয়োগ নেই। তবে আশার কথা এই যে, ইদানীং বেশ কিছু সংস্থা পরিবেশ সংরক্ষণের সচেতনতা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) নামের সংস্থাগুলোর কার্যক্রম মাঝে মাঝে চোখ পড়ে। কম-বেশে সবাই জানেন, বিশ্বে পরিবেশ দূষণের জন্য উন্নত বিশ্বই বেশি দায়ী। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তাদের ভূমিকাও আরো বেশি হওয়া উচিত। বাংলাদেশের ব্যাপারে জনগণকেই সচেতন হতে হবে এবং সরকারকে এ জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। জনগণকে কল-কারখানার বর্জ্য, বৃক্ষ নিধন, পাহাড় কাটা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, রাসায়নিক সারের ব্যবহার সীমিতকরণ ও পলিথিন ব্যবহারে আরো যতœশীল হতে হবে। বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে বড় একটি কারণ ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের উজানে মারণবাঁধ ফারাক্কা নির্মাণ করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়া। আর্সেনিক দূষণের কারণও ফারাক্কা বাঁধ। বাংলাদেশের উজানে ৫৪টি নদীতে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশ পানিশূন্য করে দেয়ার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হওয়ায় আমরা গ্রীষ্মে পানির অভাবে থাকি আর বর্ষায় পানির ওপর ভাসি। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় মাঝে-মধ্যে আঘাত হেনে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। ফলে পরিবেশের স্বাভাবিকত্ব মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। আবহাওয়া ও পরিবেশবিদগণ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, “ফারাক্কার বর্তমান পানি বণ্টন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে কয়েক দশকের মধ্যেই দেশের উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে।’ এক জরিপে দেখা গেছে, ‘ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্য, শিল্প ও পরিবেশসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা।’ এক দেশের বিরুদ্ধ অন্য দেশ আগ্রাসী মনোভাব বজায় রাখলে কিভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ করা যাবে, যে দেশ ছোট ও দুর্বল। ভারত আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেয়ার কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হচ্ছে তার জন্য বাংলাদেশ সরকারের উচিত জাতিসংঘের সহযোগিতা চাওয়া। পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলাম ইসলামকে বলা হয় ফিতরাত বা স্বভাবগত বা প্রকৃতির ধর্ম। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ মূলত সামাজিক জীব। মানুষকে ঘিরেই পরিবেশ-প্রকৃতি ও সমাজের সৃষ্টি। আর পরিবার, পরিবেশ ও সমাজ নিয়ে ইসলামের পরিবেশগত চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। লন্ডনের ইসলামিক কালচারাল সেন্টার থেকে প্রকাশিত, ‘দি ইসলামিক কোয়ার্টারলি’ পত্রিকার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর সাইয়্যেদ নাসের হোসাইন, ‘ইসলাম এন্ড এনভায়রনমেন্ট ক্রাইসিস’ নামক এক প্রবন্ধে বলেন, ‘পরিবেশ সঙ্কট’ আধুনিক মানুষের প্রকৃতিকে আধ্যাত্মিক নিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচনা করারই ফল।’ কুরআনে আল্লাহপাক নিজেকে আল্ মুহিত বলে ঘোষণা করেছেন। আল্ মুহিত হিসাবে আল্লাহকে স্মরণ করার অর্থ হচ্ছে প্রকৃতির পবিত্রতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া। প্রকৃতির বাস্তবতাকে আল্লাহর নিদর্শন হিসাবে দেখা এবং সচেতন থাকা। তার মতে, ‘প্রাকৃতিক পরিবেশ-সংক্রান্ত ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ঐশী পরিবেশ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের এক অনস্বীকার্য স্থায়ী সম্পর্কের ওপর প্রতিষ্ঠিত।’ আল্ কুরআন ও আল্ হাদিস থেকে পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী তা আলোকপাত করা হবে। কুরআনের আলোক সম্পাত বা আল্লাহপাকের বাণী পরিবেশের সাধারণ সংজ্ঞা হচ্ছেÑ আমাদের চারপার্শ্বস্ত সবকিছুকেই পরিবেশ বলে। আল্ কুরআনের ভাষায় পরিবেশের সংজ্ঞা হচ্ছে : তোমরা যে দিকেই মুখ ফিরাও না কেন, সেদিকই আল্লাহর দিক। (সূরা বাকারা : ১১৫) পরিবেশে জীবের বাসোপযোগী গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে পানি ও মাটি। মূলত মাটি থেকেই অনেক কিছু উৎপন্ন হয় এবং উৎপাদিত শস্য পানি দ্বারা জীবিত থাকে। কুরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের জন্য নিদর্শন একটি মৃতভূমি। আমি একে সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য, তারা তা ভক্ষণ করে। আমি তাতে উৎপন্ন করি খেজুর এবং প্রবাহিত করি ঝর্নাধারা, যাতে তারা ফল খায়।’ (সূরা ইয়াসিন : ৩৩) অন্য আয় তে বলা হয়েছে, ‘যে পবিত্র সত্তা তোমাদের জন্য ভূমিকে বিছানা ও আকাশকে ছাদরূপে স্থাপন করেছেন, আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য ফল-ফসল উৎপন্ন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসাবে। অতএব আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করো না। বস্তুত তোমরা এসব জানো।” (সূরা বাকারা : ২২) পরিবেশের বাহ্যিক আরো একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হচ্ছে আলো। আল্ কুরআনে আলো-আঁধার, দিন-রাত সম্পর্কে অনেক আয়াত কারিমা আছে। এরশাদ হয়েছে : ‘তারা কি অনুধাবন করে না যে, আমি রাত সৃষ্টি করেছি তাদের বিশ্রামের জন্য এবং দিনকে করেছি আলোকিত। এতে মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা নমল : ৮৬) পরিবেশ সুস্থ, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখতে রয়েছে ইসলামের তাকিদ। এরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা নিজেদের ধ্বংস নিজেরা ডেকে এনো না।’ (সূরা বাকারা : ১৯৫) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুণ সমুদ্র ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে।’ (সূরা রম : ৪১) অন্য আয়াতে আছে, ‘তোমরা কি দেখ না কিভাবে পৃথিবীর সবকিছুকে আল্লাহ তোমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন করে দিয়েছেন।’ (সূরা হজ : ৬৫) পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচতে হলে পরিচ্ছন্নতা অপরিহার্য। আল্ কুরআনে তাহারাত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে অনেকবার বলা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে : “আল্লাহ তওবাকারীদের ভালেবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে তাদেরও।” (সূরা বাকারা : ২২২) আল্লাহপাক পৃথিবীতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা জীবজগতের অস্তিত্ব রক্ষায় বৃক্ষ সৃষ্টি করেছেন। এরশাদ হচ্ছে : “আমি বিস্তৃত করেছি ভূমিকে ও তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং উৎপন্ন করেছি নয়নাভিরাম বিবিধ উদ্ভিদরাজি। এটি আল্লাহর অনুরাগী বান্দাদের জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ।” (সূরা কাফ : ৭-৮) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “তিনিই ভূতলকে বিস্তৃত করেছেন এবং তাতে পর্বত ও নদী সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেক প্রকার ফল সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায়।’ (সূরা রাদ : ৩) অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, ‘উহারা কি লক্ষ্য করে না? আমি উহাতে প্রত্যেক প্রকারের কতো উৎকৃষ্ট উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি?’ (সূরা শুয়ারা) সমগ্র সৃষ্টি জগতের কল্যাণের জন্য আল্লাহপাক পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি করেছেন। ভূমিকম্প কিংবা অন্য কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যাতে মানুষকে নিয়ে এ পৃথিবী নড়াচড়া করতে না পারে। সে জন্য আল্লাহপাক্ পাহাড়সমূহকে পেরেকের মতো গেড়ে দিয়েছেন বলে এরশাদ করেছেন, “এবং তিনি পৃথিবীতে সুদৃঢ় পর্বত স্থাপন করেছেন যাতে পৃথিবী তোমাদের নিয়ে আন্দোলিত না হয়।” (সূরা আন্ নহল : ১৫) অন্যত্র বলা হয়েছে, “তিনিই স্থাপন করেছেন ভূপৃষ্ঠে অটল পর্বতমালা এবং তাতে রেখেছেন কল্যাণ।” (সূরা হা-মীম-আস্ সজদা : ১০) অন্য আয়াতে আছে, “আর পাহাড়গুলোকে পেরেকের মতো গেড়ে দিয়েছি।” (সূরা নাবা : ৭) আরো এরশাদ হয়েছে, “আর পাহাড়কে শক্ত করে দাঁড় করানো হয়েছে।” (সূরা গাশিয়া : ১৯) অথচ আমরা নিজেরাই পাহাড় কেটে, গাছ কেটে, পুকুর ভরাট করে পরিবেশ ধ্বংস করছি। পৃথিবীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছি। আল্লাহপাক এরশাদ করেছেন, “তোমরা শান্তি স্থাপনের পর বিপর্যয় ঘটাবে না।” (সূরা আরাফ : ৮৫) “এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেরিয়ো না।” (সূরা হুদ : ৮৫) হাদিসের আলোকসম্পাত বা মহানবী (সা)-এর শিক্ষা বৃক্ষ বা গাছ মানুষ ও পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু। সবুজ গাছপালার ওপরই নির্ভর করে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর টিকে থাকা। জীবের জন্য গাছপালা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভিদ খাদ্য প্রস্তুত করে। শুধু খাদ্য তৈরি নয়, সালোক-সংশ্লেষণের সময় তারা কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে ও অক্সিজেন বের করে দেয়। ফলে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ভারসাম্য রক্ষা হয়। ‘গাছের প্রাণ আছে’Ñ এ সত্যটি প্রমাণ করেছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চদ্র বসু। অথচ ১৪শত বছর পূর্বে মহানবী (সা) গাছের প্রাণ আছে এ সত্যটি আমাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন। হাদিসে রাসূল (সা) থেকে জানা যায়, একজন লোক যখন অকারণে একটি গাছের ডাল ভাঙে তখন নবী করিম (সা) সে লোকটির চুল মৃদুভাবে টান দিয়ে বলেন, “তুমি যেমন শরীরে আঘাত বা কেটে গেলে ব্যথা পাও, গাছের পাতা বা ডাল ছিঁড়লে গাছও তেমন ব্যথা পায়।” পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য গাছ লাগাবার শিক্ষা আমরা মহানবী (সা) থেকে পাই। তিনি বলেছেন, “যদি তুমি মনে করো আগামীকাল কিয়ামত হবে, তবু আজ একটি গাছ লাগাও।” রাসূল (সা) বৃক্ষরোপণক উৎসাহিত করে বলেছেন, “বৃক্ষরোপণ সদকায়ে জারিয়া হিসাবে পরিগণিত হবে।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম) হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা) বলেছেন, “কোনো মুসলমান যদি একটি বৃক্ষ বা গাছ রোপণ করে, অতঃপর তা হতে মানুষ, পাখি বা কোনো প্রাণী ভক্ষণ করে, তা তার জন্য সদকার সওয়াব হবে।” সুন্দর ও শৃঙ্খলাপূর্ণ সামাজিক পরিবেশ গঠনে খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য। মানুষের প্রতি দয়ার নবী বলেছেন, “ঈমানের ৭৩টি শাখা, তন্মধ্যে সর্বোত্তমটি হলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আর সর্বনিম্নটি হলো, রাস্তা থেকে ক্ষতিকারক বস্তু দূরীভূত করা। তিনি আরো বলেছেন, “পবিত্রতা ঈমানের অর্ধাংশ।” হযরত জাবির (রা) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা) পানিতে প্রস্্রাব করতে নিষেধ করেছেন। হযরত মু’য়াজ বিন জাবাল (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, “তোমরা লানত পাওয়ার তিনটি কাজ অর্থাৎ পানির ঘাট, রাস্তার মাঝে এবং বৃক্ষের ছায়া তলে মলত্যাগ থেকে বিরত থাক।” হাদিসে রাসূল (সা) থেকে আরো জানা যায়, মৃত শরীরের কোনো অংশ তিনি যত্রতত্র ফেলতেন না, কারণ তা একসময় শুকিয়ে বাতাসের সাথে মিশে যেতে পারে। যা পুঁতে না ফেললে তা কোনো প্রাণী বা পাখির দ্বারা ছড়িয়ে পরিবেশ দূষিত করতে পারে। এজন্য রাসূল (সা) রক্ত বা গোশত মাটিতে পুঁতে ফেলতেন বা পুঁতে ফেলার নির্দেশ দিতেন। উম্মুল মোমেনীন হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, নবীজী (সা) যখন সিঙ্গা লাগাতেন বা লোম পরিষ্কার করতেন বা নখ কাটতেন, তখন তিনি তা জান্নাতুল বাকী গোরস্তানে নিয়ে গিয়ে পুঁতে ফেলতেন। বায়ু দূষিত হয়ে একজনের রোগ অন্যজনের কাছে স্থানান্তর হয়। আমরা অনেক সময় হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় মুখ ঢাকি না। এতে করে নির্গত ময়লা ও জীবাণু দ্বারা অন্যের ক্ষতি হতে পারে। হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসূল (সা) যখন হাঁচি দিতেন, তখন তিনি তাঁর মুখ ঢেকে নিতেন। অগ্নিকাণ্ডের ফলে পুড়ে যায় দালান-কোঠা, ঘরবাড়ি, দোকানপাট অনেক কিছু। সেখান থেকে নির্গত ধোঁয়া পরিবেশ দূষিত করে। অগ্নিকাণ্ডে এমন সব পদার্থ পুড়ে বাতাসে মিশে যা স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য হানিকর। হযরত আবু মুসা আশয়ারী (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, “আগুন তোমাদের শত্রু। যখন ঘুমাতে যাব, তখন আগুন নিভিয়ে ফেলব।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম) হযরত জাবির (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, “রাতে শোবার আগে পাত্র ঢেকে রাখ, মশকের (পানির পাত্র) মুখ ঢেকে রাখ, ঘরের জানালা বন্ধ করো এবং বাতি নিভিয়ে দাও।” (সহীস মুসলিম)। ধূমপানের মাধ্যমেও বায়ু তথা পরিবেশ দূষিত হয়। পাড়া তামাকের গন্ধ পরিবেশের জন্য কতখানি ক্ষতিকর তা নিয়ে বিজ্ঞানীরাও শঙ্কিত। সিগারেটের নিকোটিন এত মারাত্মক ক্ষতিকর যে, দু’টো সিগারেটে যা পরিমাণ নিকোটিন আছে, তা দ্বারা কোনো সুস্থ মানুষের দেহে প্রবেশ করলে মৃত্যু নির্ঘাত। মহানবী (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি দুগর্ন্ধযুক্ত দ্রব্য খায়, সে যেন (ঐ অবস্থায়) মসজিদের নিকটবর্তীও না হয়। বিশেষজ্ঞদের মত, একটা জ্বলন্ত সিগারেটে কম করে হলেও চার হাজার বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়। প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ইবন সিনা বলেছেন, “পৃথিবীর এত ধুলা-বালি, ধোঁয়া ও গ্যাস যদি মানুষের ফুসফুসে না ঢুকতো তাহলে মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারত।” এই অনন্ত মহাবিশ্ব পৃথিবী নামক ছোট গ্রহে জীবের বেঁচে থাকার জন্য সকল উপাদান দিয়ে আল্লাহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। আমাদের অত্যাচারে পৃথিবীর পরিবেশ দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ফলে জীবের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার পরিবেশ হারাচ্ছে। গ্রিন হাউজ ইফেক্টের ফলে বিশ্বের কিছু কিছু নিম্নভূমি বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইসলামের সুমহান পরিবেশ নীতির আলাকে বিশ্বের পরিবেশক আবার সুন্দর কর গড় তুলত পারি। প্রাকৃতিক গ্যাস আহরণ সুষ্ঠু নিয়ম মেনে চলা, মারণাস্ত্রর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হওয়া, বন-বনানী থেকে বৃক্ষ উজাড় না করা, গগনচুম্বী অট্টালিকা তৈরির জন্য পাহাড় না কাটা, পশু-পাখি নির্বিচারে শিকার না করা কল-কারখানার বর্জ্য নিষ্কাষণ যথাযথ নিয়ম মেনে চলা, যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়ার বিরুদ্ধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং জনসাধারণকে আরো অধিক সচেতন হওয়া অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় আইন রচনা করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়াটাও অত্যন্ত জরুরি। পরিবেশ দূষণের জন্য কে বা কারা দায়ী? উন্নত না অনুন্নত বিশ্ব পারস্পরিক দোষারোপ বন্ধ করে কাজ করতে হবে। প্রতিনিয়ত আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, আমরা কি ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাচ্ছি?

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির