post

প্রধান বিচারপতির উপলব্ধি ও বাস্তবতা

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

৩০ জানুয়ারি ২০১৬
প্রধান বিচারপতির উপলব্ধি ও বাস্তবতা সৈয়দ মাসুদ মোস্তফালর্ড ব্রাইসের মতে here is no better test of the excellence of a government than the efficiency of its judicial system.  অর্থাৎ শাসনব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মানদন্ড বিচার বিভাগের দক্ষতা। মূলত দেশে আইনের শাসন ও সুশাসনের জন্য বিচার বিভাগের গুরুত্ব অপরিসীম। আসলে বিচার বিভাগের দক্ষতার ওপরই নির্ভর করে দেশের সুশাসন। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির অশুভ প্রভাবে বিচার বিভাগের ওপর গণমানুষের আস্থা কমতে কমতে তা এখন প্রায় প্রান্তিকপর্যায়ে নেমে এসেছে। আর এই ক্রান্তিকালে কিছুটা হলেও এগিয়ে এসেছেন বলে মনে হয় আমাদের মাননীয় প্রধান বিচারপতি মি. সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ‘বিচারকের অবসরের পর রায় লেখা বেআইনি ও অসাংবিধানিক’ মাননীয় প্রধান বিচারপতির এমন বক্তব্যে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন আবারও সরগরম হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকে যথার্থ বললেও আবার অন্যরা সঠিক মনে করছেন না। এমনকি আইনমন্ত্রী এবং অ্যাটর্নি জেনারেলও এ বিষয়ে একমত হতে পারেননি। অভিজ্ঞমহল বলছেন, প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সাথে একমত হওয়া বা না হওয়ার কোনো গুরুত্ব নেই; তিনি যা বলেছেন তার অবশ্যই একটা গুরুত্ব আছে। কারণ, প্রধান বিচারপতির বক্তব্যটা একেবারে কচুক্ষেতের কচরা নয়। মূলত বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আর প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগেরই অভিভাবক। তাই তার কথা একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। আমেরিকার আইনবিশেষজ্ঞ রলে (Rawle) বলেছেন, It is indispensable that there should be a judicial department to ascertain and decide rights, to punish crimes, to administer justice and to protect the innocent from the injury and usurpation. অর্থাৎ বিচার বিভাগ অপরিহার্য, কেননা তার দ্বারাই অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। অন্যায়ের শাস্তি বিধান করা হয়। ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় এবং নির্দোষ ব্যক্তিগণকে অন্যের হস্তক্ষেপ ও অন্যায় থেকে রক্ষা করা যায়। অবসরে যাওয়ার পর রায় লেখা যাবে কি না তা নিয়ে সাংবিধানিক ও আইনি ব্যাখ্যায় পরে আসছি। আগে এর যৌক্তিকতা কতখানি তা নিয়েই কথা বলার চেষ্টা করবো। একজন ব্যক্তি যদি কোন কারণে কর্মচ্যুত হন বা কর্মে ইস্তফা দেন বা অবসর গ্রহণ করেন তাহলে তিনি আর কর্মে নেই বলেই বিবেচিত হবেন। তাই অবসরকালীন সময়ে তার কাজের যেমন বৈধতা থাকে না, তেমনিভাবে কোন কাজ করতেও তিনি বাধ্য নন বা তার কোনো দায়বদ্ধতাও নেই। তাই দায়দায়িত্বহীন কোনো লোক দিয়ে আদালতের রায়ের মত কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ কোনোভাবেই বৈধ হওয়ার সুযোগ আছে বলে দৃশ্যত মনে হয় না। কেউ কেউ বলছেন যে, সংবিধানের কোথাও লেখা নেই অবসরকালীন সময়ে রায় লেখা যাবে না। কিন্তু তাদের বক্তব্য সঠিক বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ, সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদের ১ উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,  A person who has held office as a Judge (Otherwise than as an Additional Judge pursuant to the provisions of article 98), shall not, after his retirement or removal there from, plead or act before any court or authority or hold any office of profit in the service in the service of the republic not being a judicial or quasi-judicial office. অর্থাৎ কোন ব্যক্তি (এই সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদের বিধানাবলি অনুসারে অতিরিক্ত বিচারক রূপে দায়িত্ব পালন ব্যতীত) বিচারকরূপে দায়িত্ব পালন করিয়া থাকিলে উক্ত পদ হইতে অবসর গ্রহণের বা অপসারিত হইবার পর তিনি কোন আদালত বা কোন কর্তৃপক্ষের নিকট ওকালতি বা কার্য করিবেন না বা বিচার বিভাগীয় বা আধা-বিচার বিভাগীয় পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না। সংবিধানের বর্ণিত ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে কর্মচ্যুতি বা অবসর গ্রহণের পর বিচারকরা ‘কার্য করিবেন না’। এতে প্রমাণ হয় অবসরপ্রাপ্ত সংবিধানসম্পন্নভাবে বিচারসংক্রান্ত কোনো কাজই করতে পারবেন না। পক্ষান্তরে অবসর গ্রহণের পর রায় লেখা যাবে সংবিধানে তো এমন সুস্পষ্ট বিধান নেই-ই, এমনকি আকারে ইঙ্গিতেও এমন কথা কোথাও বলা হয়নি। তাই যারা বলছেন অবসরে যাওয়ার পর রায় না লেখার ব্যাপারে সংবিধান একেবারে নীরব, তাদের কথা তো ধোপে টেকে না। সাম্প্রতিক সময়ে রায় লেখাকে কেন্দ্র করেই দেশে মারাত্মক রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কেয়ারটেকার সরকারসংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত রায়ে আরো দু’টি জাতীয় নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হলেও পুর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশে অহেতুক বিলম্ব হওয়ায় প্রকাশিত রায়ে সংক্ষিপ্ত রায়ের কোনো প্রতিফলনই ঘটেনি। এমনকি অভিযোগ আছে যে, প্রথমবার রায় লিখে জমা দেয়ার পর তা আবার ফিরিয়ে এনে সরকারের মর্জিমাফিক তা আবার সংশোধনও করা হয়। মূলত রায় লেখায় অনাকাক্সিক্ষত বিলম্ব হওয়ায় এ ধরনের ‘বিচারিক অসদাচরণ’ এর ঘটনা ঘটেছে। এটা ইতিহাসের এক নজিরবিহীন ঘটনা। মূলত যে কোনো সুবিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সময়ানুবর্তিতা একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এ জন্য পাশ্চাত্য বিশ্বে প্রচলিত প্রবাদটি হচ্ছে- ‘জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড’। ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়ার আমলের প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ইওয়ার্ট গ্ল্যাডস্টোন ও ষোড়শ শতাব্দীর ইংরেজ দার্শনিক উইলিয়াম পেন বিষয়টির একটি যৌক্তিক পরিণতির চেষ্টা করেছিলেন। বিশেষ করে উইলিয়াম পেন ‘টু ডিলে জাস্টিস ইজ ইনজাস্টিস’ বা ‘বিচার বিলম্বিত করার অর্থই অবিচার’ কথাটি বলেছেন। অনুরূপে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আন্দোলনের পথিকৃৎ মার্টিন লুথার কিং তার ১৯৬৩ সালে রচিত ‘ লেটার ফ্রম বার্মিহাম জেল’ নামক একপত্রে ‘জাস্টিস টু লং ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড’ কথাটিও লিখেছেন। এ ক্ষেত্রে ১৯৭০ সালে আমেরিকান বার অ্যাসোসিয়েশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ওয়ারেন আর্ল বার্গার প্রদত্ত ভাষণটি প্রণিধানযোগ্য,A sense of confidence in the courts is essential to maintain the fabric of ordered liberty for a free people and three things could destroy that confidence and do incalculable damage to society: that people come to believe that inefficiency and delay will drain even a just judgment of its value; that people who have long been exploited in the smaller transactions of daily life come to believe that courts cannot vindicate their legal rights from fraud and over-reaching; that people come to believe the law– in the larger sense– cannot fulfill its primary function to protect them and their families in their homes, at their work, and on the public streets’. অর্থাৎ নিয়মতান্ত্রিক স্বাধীনতার জন্য কোর্টের প্রতি মুক্ত মানুষের আস্থা সমুন্নত রাখাটা জরুরি এবং তিনটি বিষয় সে আস্থা বিপন্ন করে অপরিমেয় সামাজিক ক্ষতিসাধন করতে পারে। যেমন- অদক্ষতা ও বিলম্বজনিত ন্যায়সঙ্গত বিচারের রায় ও মূল্যবোধটিও মানুষের বোধগম্যে জলাঞ্জলিত হবে, মানুষ বুঝবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ে সুদীর্ঘ সময়ব্যয়ে আইনি অধিকার দুর্নীতির কারণে অধরায় নিপতিত এবং মানুষ বুঝবে যে আইন ব্যাপক অর্থেই বাড়ি, কর্মক্ষেত্র ও রাজপথে জানমাল সুরক্ষায় অকার্যকর। মূলত মাননীয় প্রধান বিচারপতির সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যও এর সঙ্গে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘অবসরের পর বিচারপতিদের লেখা রায় বেআইনি ও সংবিধানপরিপন্থী’। কেননা এই বক্তব্যের ফলশ্রুতিতে সুনির্দিষ্টভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ, দশম পার্লামেন্ট নির্বাচন আয়োজন ও বর্তমান সরকারের বৈধতাটিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে টেলিভিশন টকশোর আলোচকরা ছাড়াও বিপর্যস্ত সংসদের বাইরের বিরোধী দলগুলোও বেশ সোচ্চার। মূলত এখন তাদের নির্বাচন বর্জন করার বিষয়টি যৌক্তিকতাও পাচ্ছে বলেই প্রতীয়মান। আসলে একটি রায়কে কেন্দ্র করেই দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। মাননীয় প্রধান বিচারপতির বক্তব্য অনুযায়ী যে রায় ‘বেআইনি ও সংবিধানপরিপন্থী’ মূলত এই রায় এবং রায় লেখায় দীর্ঘসূত্রতা ও সংক্ষিপ্ত রায়ের সাথে পূর্ণাঙ্গ রায়ের মারাত্মক অসঙ্গতির কারণেই যে সহিংসতা, হানাহানি ও জাতীয় বিপর্যয়সম রাজনৈতিক সঙ্কট বিদ্যমান, তার দায়িত্ব কার ওপর বর্তায়? এ প্রশ্ন এখন সচেতন মানুষের মুখে মুখে। স্মরণযোগ্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ওয়ারেন আর্ল বার্গার প্রদত্ত ভাষণটিতে যেমন বলা হয়েছে- নিয়মতান্ত্রিক স্বাধীনতার জন্য কোর্টের প্রতি মুক্ত মানুষের আস্থা বজায় রাখাটা জরুরি, সেই আস্থাটি কি যথাযথভাবে অক্ষত থেকেছে অথবা সর্বৈব রাজনৈতিক তোষণে কি ‘জাস্টিস ডিলেইড’ হয়নি? এই অকাট্য বাস্তবতাকে কি উপেক্ষা করার সুযোগ আছে? মূলত অবসরে গিয়ে রায় লেখা সংবিধানপরিপন্থী এই মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি ৫২ বছর আগে ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এ. আর কর্নেলিয়াসের দেয়া রায়ের প্রতিধ্বনি করেছেন মাত্র। কাজী মেহের দীন বনাম মিসেস মুরাদ বেগম মামলায় পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে রায় দেন যে, অবসরে গিয়ে রায় লেখা যাবে না। প্রবীণ আইনজীবী ও সাবেক বিচারপতির টি এইচ খান ইতঃপূর্বে এক সংবাদ সম্মেলনে ১৬ ডিএলআর, ৩৯২ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ওই রায়ের বরাতে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের অবসর জীবনে দেয়া রায়কে ‘অযথাযথ’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, যা সাংবিধানিক ব্যাখ্যার প্রতিধ্বনি বলেই প্রতীয়মান হয়। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, রায় লেখা একটি বিচারিক কর্ম বা জুডিশিয়াল ওয়ার্ক। কোনো বিচারক অবসরে গেলে আর বিচারক থাকেন না। তাই অবসরে রায় লেখা বৈধ নয়। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট এ প্রসঙ্গে দেওয়ানি কার্যবিধি সিপিসির অর্ডার ২২ এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, সিপিসি অবসর-পরবর্তী রায় প্রদানকে সমর্থন করে না। কারণ, একজন বিচারক অবসরে গেলে তিনি ‘ফাংটাস অফিসিও’ হয়ে যান। লাতিন আইনি পরিভাষা অনুযায়ী ‘ফাংটাস অফিসিও’ মানে তিনি আর কর্মে নিয়োজিত থাকেন না। তাই অফিসে থাকার যে এখতিয়ার সেটা তিনি হারিয়ে ফেলেন। যেহেতু তার অফিসে থাকারই অধিকার নেই। তাই অফিসের কোন কাজ করাও তার জন্য আইনসঙ্গত বলে মনে করার যৌক্তিক কোনো কারণ থাকতে পারে না। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকগণ মনে করেন, প্রধান বিচারপতির মন্তব্য কেবল ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতার পক্ষে-বিপক্ষের রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতার দিক থেকে দেখা সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ও বিচার বিভাগের প্রস্তাবিত সংস্কারের জন্য ক্ষতিকর। কারণ অনেক অভিজ্ঞ আইনবিদ জোর দিয়ে বলেছেন, এখন উচিত হবে প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের আলোকে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রুলসে উপযুক্ত সংশোধনী আনা। যাতে কোনো কর্মরত বিচারক অবসরে যাওয়ার আগের মাসগুলোতে বিপুল সংখ্যক মামলার রায়দানকারী হিসেবে গণ্য হতে না পারেন। কিন্তু এখানেও সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ প্রধান বিচারপতির বক্তব্য অনুযায়ী অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির যদি রায় লেখা ‘বেআইনি ও অসাংবিধানিক’ হয় তাহলে যেসব রায় বিচারকরা অবসর গ্রহণের পর লিখেছেন এসব রায়ের পরিণতিটা কী হবে তা এখন রীতিমতো ভাববার বিষয়। উল্লেখ্য, সাধারণভাবে অন্যান্য দেশের সুপ্রিম কোর্টের দেয়া রায়কে উপমহাদেশের সুপ্রিম কোর্টগুলো মান্য করে থাকেন। একই ধরনের পরিস্থিতিতে তারা এসব মামলার সিদ্ধান্তকে নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে থাকেন। আইনজ্ঞরা বলছেন, ১৯৬৪ সালের ২৮ এপ্রিলের ওই রায় গত ৫২ বছরের ইতিহাসে কখনো রহিত হয়নি। সুতরাং ওই মামলার রায়ের একটি ‘বোধযোগ্য মূল’ রয়েছে অবশ্যই। তাই তা উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। শুধু তাই নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের উচ্চ আদালতের বিচারকগণও অবসরে গিয়ে রায় লেখার কোনো রেওয়াজ নেই। আইনজ্ঞরা বলছেন, অবসরে গিয়ে রায় লেখার চেয়েও রায় লেখার ক্ষেত্রে অহেতুক কালক্ষেপণ, বিচারকের খেয়াল-খুশি ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে আমাদের দেশের বাস্তবতায়। এমনকি হত্যা মামলার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় পেতে বিচারপ্রার্থীদের ৩/৪ বছরও অপেক্ষা করতে হচ্ছে। যা আমাদের বিচারব্যবস্থাকে অহেতুক বিতর্কের মুখে ঠেলে দিয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলেন, প্রধান বিচারপতির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে গত কিছু দিন ধরে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় আইনবিদরা এক আইনি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। কিন্তু বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে বেশি দেখা হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি মনে করেন অবসর গ্রহণের পর রায় লেখা সংবিধানের পরিপন্থী। কারণ অবসরে গেলে বিচারকদের শপথ থাকে না, তারা সাধারণ নাগরিকে পরিণত হন। তাঁর এই মতামতকে লুফে নিয়েছেন বিরোধী দল সমর্থক জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা, কারণ তারা প্রধান বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে এখন নতুন করে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল মামলার রায়ের বৈধতার প্রশ্ন সামনে এনেছেন। আর তার একটা সাংবিধানিক ও যৌক্তিক ভিত্তিও রয়েছে। উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্ট ২০১০ সালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে রায় প্রদান করেন। কিন্তু তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তাঁর অবসরে যাওয়ার এক বছরের বেশি সময় পর মূল রায় লিখেছিলেন। অন্য দিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ অনেক আইনবিদ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বলেছেন, অবসরে গিয়ে রায় লেখা বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের একটা দীর্ঘকালীন রেওয়াজ। তাদের যুক্তি অবসরের আগেই তারা রায় দেন। কিন্তু লেখেন পরে। এ প্রসঙ্গে তারা বহুল আলোচিত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের উল্লেখ করছেন, যা অবসরে গিয়ে লিখেছিলেন প্রয়াত প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেছেন, সংবিধানে যদি লেখা থাকতো অবসরে গিয়ে কেউ রায় লিখতে পারবেন না তাহলে সেটা অসাংবিধানিক হতো। এ কারণে অসাংবিধানিক বলা যাবে না বেআইনিও বলা যাবে না। তাই প্রধান বিচারপতির বক্তব্য আইনি বা সংবিধানের দিক থেকে ঠিক নয়। আসলে সংবিধানসম্মত না হলে রেওয়াজ কোনো দিন আইন হতে পারে না। অতীতে কোন বিচারক কী করেছেন বা কী রেওয়াজ প্রচলিত ছিল তা যদি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে অবশ্যই তা পরিত্যাজ্য। আমাদের দেশের জাতীয় নির্বাচনে কেয়ারটেকার সরকার তো একটা ট্র্যাডিশনই হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এখন তা সংবিধান থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। আর আইনমন্ত্রী যে সংবিধানে অবসরকালে রায় লিখতে বাধা নেই বলছেন, তাও সঠিক বলে মনে হয় না। কারণ, বিষয়টি সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদের ১ উপ-অনুচ্ছেদে একেবারে স্পষ্ট। আসলে বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আর বিচারকের সততা, যোগ্যতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, আইন ও সংবিধানের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, প্রজ্ঞা ও ধীশক্তি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। অধ্যাপক গার্নারের (Garner)  ভাষায়, If the Judges lack wisdom, probity and freedom, the high purposes for which the judiciary is established can not be secured. অর্থাৎ বিচারকগণ যদি জ্ঞানের অধিকারী না হন এবং তাদের যদি ধৈর্য ও সিদ্ধান্ত দানের স্বাধীনতা না থাকে তবে যে মহান লক্ষ্যে বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠিত তা ব্যর্থ হয়। মাননীয় প্রধান বিচারপতির সর্বসাম্প্রতিক বক্তব্য বিচার বিভাগের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে বলে দেশের বিশিষ্টজনেরা মনে করছেন। কিন্তু তার এ বক্তব্যের আলোকে আইনগত ভিত্তিকে সুসংহত করতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা খুবই জরুরি। আর অবসরকালীন সময়ে যেসব রায় অতীতে লেখা হয়েছে, সেসব রায় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ হলে তা অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। মাননীয় প্রধান বিচারপতির এই উপলব্ধি বিলম্বিত হলেও বাস্তবসম্মত বলেই মনে করছেন বোদ্ধামহল। তাই দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই আমাদেরকে অশুভ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে সুকুমারবৃত্তির চর্চা করতে হবে। আর এটিই সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। লেখক : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির