post

ফরায়েজি আন্দোলন শ্রেণিসংগ্রাম নয়

সরদার আবদুর রহমান

৩১ মে ২০২২

ইংরেজ শাসনকালের মধ্যে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ‘সিপাহি বিপ্লব’ ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বাধিক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। এটি যেমন সত্য, তেমনই এই বিপ্লবের পটভূমি রচনায় বাংলায় গড়ে ওঠা ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। এ নিয়ে ইতিহাসে বহু আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। নানাভাবে এই ঘটনার বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তবে পরবর্তীকালের তথা বিংশ শতাব্দীর আলোচিত ‘সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম’ তথা কমিউনিস্ট আন্দোলনের চিন্তকগণ এসব ঘটনাবলিকে নিজেদের শ্রেণিসংগ্রামের চেতনার আলোকে ব্যাখ্যা করতে সর্বাধিক প্রয়াসী হয়েছেন। এসব চিন্তা ও ব্যাখ্যার প্রভাবও কম নয়। সমাজতন্ত্রের পতনের পরও এই প্রভাব অনেকাংশে বিদ্যমান- এ কথা অস্বীকারের জো নেই। তবে এটিও জোর দিয়ে বলা যায় যে, ফরায়েজি আন্দোলন কোনো শ্রেণিসংগ্রাম নয়- ইসলামের যে প্রতিরোধচেতনা। তাই ব্রিটিশ শাসক ও তাদের পরিপুষ্ট জমিদার-জোতদারদের প্রতিষ্ঠিত জুলুমতন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে। বলা বাহুল্য, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সফল হওয়ার বহু পূর্বেই কৃষকদের নিয়ে একটি কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে সমর্থ হন এই আন্দোলনের উদ্ভাবক ও পরিচালকগণ।

আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় আগেই বলা হয়েছে, তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফরায়েজি আন্দোলন। যদিও এর বিস্তৃতি অনেকটাই বাংলা অঞ্চলের মধ্যে সীমিত ছিল। তবে এর রেশ ছড়ায় ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রায় সকল সীমানায়। এই আন্দোলনের মূল ব্যক্তিত্ব ছিলেন বিখ্যাত সমাজসংস্কারক ও আলেম হাজি শরীয়ত উল্লাহ। শরীয়ত উল্লাহর ইন্তেকালের পর তাঁর পুত্র মোহসীন উদ্দীন দুদু মিয়া এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তবে পিতা ও পুত্রের নীতি ও কর্মসূচিতে কিছু পার্থক্য থাকলেও আন্দোলনের মূল্য লক্ষ্য ছিল একই। ইসলামের অবশ্য করণীয় কাজকে বলা হয় ‘ফরজ’। এই ‘ফরজ’ শব্দ থেকেই ‘ফরায়েজি’ এসেছে। আবার কারো মতে ফরাজি শব্দটি ফরাজ অথবা ফরাইজ অর্থাৎ ঊর্ধ্বতন মানে দিব্য আজ্ঞা থেকে এসেছে। যাই হোক, এই আন্দোলন নিছক ধর্মীয় সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি কৃষক, চাষি, মজুর প্রমুখ প্রান্তিক মানুষদেরকে তখনকার জমিদার-জোতদার ও নীলকরদের অত্যাচার ও শোষণ থেকে মুক্ত করা ছিল এই আন্দোলনের লক্ষ্য। হাজি শরীয়ত উল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দুদু মিয়া এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।

ব্রিটিশ শাসনের দীর্ঘ পটভূমিতে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে বেশ কিছু ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিকৃতি অনুপ্রবেশ করে। হিন্দু, বৌদ্ধ, প্রকৃতি পূজারি প্রভৃতির নানা অনুশীলন মুসলমানদের মধ্যেও প্রভাব সৃষ্টি করে। অন্য দিকে বিদেশি শাসক ব্রিটিশের ছত্রছায়ায় স্থানীয় জমিদার-নীলকরদের শাসন-শোষণে প্রবলভাবে নিপীড়িত হতে থাকে গ্রাম-জনপদের কৃষক, চাষি, মজুর প্রভৃতি খেটে খাওয়া মানুষেরা। এই দ্বিবিধ পরিস্থিতির মোকাবিলায় উদ্যোগী হন হাজি শরীয়তুল্লাহ। উইকিপিডিয়ার মতে, ফরায়েজি আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ বাংলার ধর্মীয় আন্দোলনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- যা পরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। বাংলায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই মুসলমানদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় ঘটে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, চাকরি, জমিদারি প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের শিকার মুসলমানদের আত্মসচেতনতা সৃষ্টি ও ধর্মীয় বিষয়গুলো ঠিকমতো পালনের পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে হাজি শরীয়ত উল্লাহ তার আন্দোলন শুরু করেন।১

শরীয়ত উল্লাহর সংক্ষিপ্ত পরিচয় বাংলার ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে গবেষকগণ হাজি শরীয়ত উল্লাহ ও তার আন্দোলনকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারেননি। তবে তার পরিচয় বিবৃত করা হয়েছে বিভিন্নভাবে। ইসলামী বিশ্বকোষের বিবরণে হাজি শরীয়ত উল্লাহকে একজন প্রখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্ব, আলিম, মুজাহিদ, সংস্কারক ও ফরায়েজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের মতে, ফরজ বিষয়ের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপের ফলেই এই সম্প্রদায়কে ফরায়েজি নামে চিহ্নিত করা হয়। তিনি বৃহত্তর ফরিদপুরের মাদারীপুর জেলার শামাইল গ্রামে ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আবদুল জলিল তালুকদার শরীয়ত উল্লাহর ৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন মধ্যবিত্ত তালুকদার পরিবারের সন্তান। স্থানীয় একজন মুজাহিদ আলিম মাওলানা বাশারাত আলীর সান্নিধ্য লাভ করে লেখাপড়ায় উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা পান। ইংরেজ সরকারের রোষানলে পড়ে মাওলানা বাশারাত আলী ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র মক্কায় হিজরত করেন। হাজি শরীয়ত উল্লাহও তার সঙ্গে গমন করেন।২ ইতিহাস রচয়িতা আব্বাস আলী খান উল্লেখ করেন, শরীয়ত উল্লাহ হজ্জ করতে মক্কা গমন করে অন্য হাজিগণের মতো স্বদেশে প্রত্যাবর্তন না করে সেখানেই শিক্ষা গ্রহণের জন্য থেকে যান। ১৮-১৯ বছর সেখানে কাটিয়ে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি দেশে ফিরে আসেন। মক্কায় অবস্থানকালে তিনি বুঝতে পারেন যে, বাংলার মুসলমানরা প্রকৃত ইসলাম থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। তাই দেশে ফিরে তিনি মুসলিম সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এই কারণে তিনি ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ শুরু করেন। আব্বাস আলী খানের মতে, তিনি আঠারো বছর সেখানেই অবস্থান করে ধর্ম, সমাজবিজ্ঞান ও রাজনীতিতে শিক্ষা গ্রহণ করেন। ইসলাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা এবং ইসলামী জীবনদর্শন সম্পর্কে জ্ঞানলাভ সম্ভবত তিনি এ সময়েই করেন। ইসলাম নিছক কতিপয় ক্রিয়া অনুষ্ঠানের সমষ্টিই নয়, বরঞ্চ এ হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যতিরেকে ইসলামের পরিপূর্ণ অনুশাসন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পালন করে চলা কিছুতেই সম্ভব নয়- এই তত্ত্বজ্ঞানও তিনি লাভ করেন।৩

দুদু মিয়ার সংক্ষিপ্ত পরিচয় মোহসীন উদ্দীন দুদু মিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে। বাল্যকালে তিনি পিতার নিকট আরবী ও ফারসি ভাষা শিক্ষা করেন। শিক্ষার জন্য ১২ বছর বয়সেই তাকে মক্কা শরীফ পাঠানো হয়। সেখানে পাঁচ বছরকাল শিক্ষা লাভ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি পিতার কার্যক্রমে আত্মনিয়োগ করেন এবং তাতে বিপুলভাবে সফলতা লাভ করেন। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে হাজি শরীয়ত উল্লাহর মৃত্যু হলে ফরায়েজিগণ দুদু মিয়াকে তাদের উস্তাদ বা নেতা মনোনীত করেন।৪ বাংলাপিডিয়ার মতে, হাজি শরীয়ত উল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র পুত্র মোহসীন উদ্দীন ওরফে দুদু মিয়াকে ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা ঘোষণা করা হয়। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক স্বার্থ-প্রণোদিত একটি জমিদারশ্রেণি গড়ে তোলে। প্রজাদের কাছ থেকে জোর করে যতটা সম্ভব অর্থ আদায় করা ছাড়া অপর কোন চিন্তা-ভাবনাই তাদের ছিল না। তারা বহুসংখ্যক লাঠিয়াল পুষতো এবং তাদের সাহায্যে প্রজাদের উপর নির্যাতন চালাতো। এ ব্যবস্থা জমিদারদের বস্তুত সামন্তাধিকার প্রদান করে এবং কৃষকশ্রেণিকে পরিণত করে প্রায় ভূমিদাসে। পিতার মতোই দুদু মিয়া কৃষকদের পক্ষের এই আন্দোলনকে এগিয়ে নেন। তবে তিনি আরও প্রবল প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে দুদু মিয়া ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার নাবালক পুত্র গিয়াসউদ্দীন হায়দার ও আবদুল গফুর ওরফে নয়া মিয়ার তত্ত্বাবধানের জন্য একটি অভিভাবক পরিষদ গঠন করেন। এই দুই পুত্র পরপর ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন।৫

‘শ্রেণিসংগ্রাম’ নিয়ে কথা ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক তথা শ্রেণিসংগ্রামের চিন্তা-চেতনার সবেমাত্র শুরু যে সময়ে- তখনও ঠিক সেভাবে যা দানা বাঁধেনি- সেই সময়েই হাজি শরীয়ত উল্লাহর কৃষক আন্দোলন তুঙ্গে। ফলে এই শ্রেণিতত্ত্বের সঙ্গে এই আন্দোলনকে জুড়ে দেওয়ার কোনো অবকাশ দেখা যায় না। বলা হয়ে থাকে, মার্কসীয় তত্ত্বে ‘শ্রেণি’ শব্দের প্রধান ব্যবহার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। জীবন ধারণের সম্পদের মালিকানা এবং অ-মালিকানার ভিত্তিতে কোনো সমাজের মানুষকে চিহ্নিত করার তত্ত্ব। মার্কসবাদের মতে, মানবসমাজের আদিতে সামাজিক সম্পদের কোনো ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। সে হিসেবে সেই আদিকালের মনুষ্যসমাজ শ্রেণিহীন ছিল বলে অনুমান করা চলে। জীবন যাপনের হাতিয়ার বা যন্ত্রপাতির বিকাশের একটা বিশেষ পর্যায়ে সম্পদের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা যখন সমাজের কোনো অংশের পক্ষে সম্ভব হয়, তখনই সমাজে এরূপ অর্থনৈতিক শ্রেণির উদ্ভব হয় এবং তারপর থেকে সমাজ বিকাশের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে সম্পদের এরূপ মালিক শ্রেণি এবং সম্পদের মালিকানাবিহীন সম্পদহীন শ্রেণির মধ্যকার দ্বন্দ্ব এবং সংগ্রাম কাজ করে আসছে বলে মার্কসবাদ মনে করে।৬ এই সংজ্ঞার আলোকেই ফরায়েজি আন্দোলনকে কেউ কেউ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। যেমন প্রখ্যাত ভারতীয় চিন্তাবিদ সুরজিৎ দাশগুপ্ত মনে করেন যে ফরায়েজি আন্দোলনে যে উত্থান ঘটে সেটিও একই প্রকৃতির কৃষক উত্থান। তাঁর মতে, আধুনিক পরিভাষায় এগুলি প্রাথমিক শ্রেণিসংগ্রাম। তিনি উল্লেখ করেন, “... বাংলার কৃষক সমাজের বৃহত্তর অংশই ধর্মত মুসলমান এবং স্বভাবতই কৃষক বিদ্রোহ মানে প্রধানত মুসলমানদের বিদ্রোহ, কিন্তু উচ্চ সমাজের মুসলমান ও কৃষক সমাজের মুসলমান চরিত্রের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর, উপরন্তু বৈষয়িক স্বার্থে হিন্দু কৃষক ও মুসলমান কৃষক পরস্পরের সুহৃদ ও সহায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর থেকে স্বশ্রমভোজী এবং পরশ্রমভোজী শ্রেণির ব্যবধান দ্রুত বিস্তৃত হতে থাকে: উর্দুভাষী পশ্চিমবঙ্গবাসী বিত্তবান মুসলমানকে যে মর্যাদা সাধারণভাবে শিক্ষিত বাঙালি হিন্দু দিয়ে থাকে, তা একজন বাংলাভাষী পূর্ববঙ্গবাসী দরিদ্র মুসলমানকে কখনোই দেয় না এবং আজকের দিনে এই বৈষম্যমূলক আচরণের পেছনে যতই সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বিশ্লেষণ করা হোক-না কেন, এর পেছনে আসলে শ্রেণিসত্তাই সবচেয়ে বেশি সক্রিয়।” সুরজিৎ দাশগুপ্ত আরও উল্লেখ করেন, “মোটের ওপর ফরায়েজিদের বক্তব্যে প্রকৃত যৌক্তিকতা ছিল। ফলে তাদের আন্দোলনও সামগ্রিকভাবে কৃষকদের মধ্যে উৎসাহ জাগিয়েছিল; কিন্তু যেহেতু কৃষকদের মধ্যে মুসলমানরাই আর জমিদারদের মধ্যে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল তাই এই অর্থনৈতিক বিরোধের মধ্যে ধর্মীয় তথা সাম্প্রদায়িক বিরোধের অবকাশ ছিল প্রশস্ত, তবু ফরায়েজি আন্দোলনের চরিত্র যে সাধারণত অর্থনৈতিকই ছিল এটা বিস্ময়কর বৈকি। দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ঢাকা ও ফরিদপুরে কৃষক বিদ্রোহ এমন প্রচণ্ড আকার ধারণ করে যে কোম্পানি সরকার বুঝতে পারে, শুধু সামরিক বাহিনীর দমনমূলক তৎপরতায় সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, তার জন্য কৃষক অসন্তোষের মূল কারণগুলো নির্ণয় করা এবং যথাসাধ্য নির্ণীত কারণগুলো দূর করা উচিত। অতঃপর কৃষক অসন্তোষের বিষয়ে কারণ অনুসন্ধানের জন্য সরকার কর্তৃক সমিতি গঠিত হয়।”৭ সুরজিৎ দাশগুপ্ত সরাসরি না হলেও দুই তত্ত্বের মধ্যে একটি সম্পর্ক জুড়ে দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন বলে মনে করা যেতে পারে।

জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থান শাসকশ্রেণি হোক বা ব্যক্তি পর্যায়ে- জুলুম নির্যাতন যে পক্ষ থেকেই হোক না কেন- এর বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার এবং কঠোর। হাজি শরীয়ত উল্লাহর সে বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ছিল। তাই তিনি ইসলামের বিধিবিধান প্রতিপালনের পাশাপাশি নানান অপসংস্কৃতির কবল থেকে মুসলমানদের উদ্ধারে প্রয়াসী হন। এই সঙ্গে সে সময় শাসকশ্রেণির শাসন-শোষণের বেড়ি থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্ত করতে আন্দোলন গড়ে তোলেন। মজলুম-নির্যাতিতের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আদেশ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে তিনি বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের কী হলো যে তোমরা আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করছো না দুর্বল সেই পুরুষ, নারী ও শিশুদের পক্ষে, যারা বলে হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের এই জনপদ থেকে নিষ্কৃতি দান করো; এখানকার অধিবাসীরা অত্যাচারী। আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য পক্ষাবলম্বনকারী নির্ধারণ করে দাও এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী নির্ধারণ করে দাও।’ (সূরা নিসা : ৭৫)। তিনি জালিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান চালাতে ও তাদের মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা জালিম সম্প্রদায়ের মোকাবিলায় তোমাদের সাধ্যানুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করো’। (সূরা আনফাল : ৬০)। আল্লাহ বলেন, ‘সাবধান! জালিমদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ’। (সূরা হুদ : ৮)।

এ বিষয়ে হাদিসের ভাষ্য দেখুন। হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা. বলেন, ‘তোমার ভাইকে সাহায্য করো- সে জালিম হোক অথবা মজলুম। আনাস রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! মজলুমকে সাহায্য করবো তা তো বুঝলাম- কিন্তু জালিমকে কী করে সাহায্য করবো? তিনি বললেন, তুমি তার হাত ধরে তাকে বিরত রাখবে।’ (বুখারি-২৪৪৪)। আরেকটি হাদিস বারা ইবনে আজিব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সা. আমাকে সাতটি বিষয়ের আদেশ দিয়েছেন, সেগুলির মধ্যে রয়েছে ‘রোগীর সেবা-শুশ্রƒষা করা ও মজলুমকে সহায়তা করা।’ (বুখারি-৫১৭৫)। দেখা যাচ্ছে যে, মানুষের উপর মানুষের জুলুমের এক দীর্ঘ ধারাবাহিকতা রয়েছে। আর তার বিরুদ্ধে ইসলামের সুনির্দিষ্ট প্রতিরোধমূলক কর্মকৌশলও রয়েছে। কুরআনের বিধানের আলোকে রাসূলে করিম সা. তার প্রতিবিধানও করেছেন। ভারতীয় পটভূমিতে বেড়ে ওঠা হাজি শরীয়ত উল্লাহ মক্কা-মদীনার সেই জ্ঞানে পরিপুষ্ট হন এবং এক স্বচ্ছ ও পরিপূর্ণ চেতনা নিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। এখন দেখে নেয়া যেতে পারে ভারতে প্রকৃত পরিস্থিতি সেসময় কীরূপ ছিল।

সেসময়ের প্রকৃত অবস্থা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ভারতে ইংরেজরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে যে ব্যবস্থা গড়ে তোলে তার সুবিধা নিয়ে একটি নিপীড়ক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এদের নিপীড়নের মাত্রা এতোটাই চরমে উঠে যে, অতি সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে তা সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ইতিহাস রচয়িতা আব্বাস আলী খান উল্লেখ করেন, “একদিকে ব্রিটিশ এবং অপরদিকে অত্যাচারী হিন্দু জমিদার মহাজনদের উপর্যুপরি অত্যাচার-নিষ্পেষণে মুসলমানরা অনন্যোপায় হয়ে মাথানত করে সবকিছু সহ্য করে যাচ্ছিল। শরীয়তুল্লাহর আহবানে নিপীড়িত মুসলমানগণ দলে দলে তাঁর কাছে এসে জমায়েত হতে লাগলো এবং ব্রিটিশ ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার শপথ গ্রহণ করলো।”৮ তিনি আরও উল্লেখ করেন, হাজি শরীয়ত উল্লাহর জীবদ্দশায় যে আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল, তা ছিল মুখ্যত ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন। অত্যাচারী জমিদারদের প্ররোচনায় দু’একটি সংঘর্ষ ব্যতীত কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে তাঁর আন্দোলনের সংঘর্ষ হয়নি। কিন্তু দুদু মিয়ার সময়ে আন্দোলন অনেকটা রাজনৈতিক রূপ ধারণ করে। সকল জমিদার ও নীলকরগণ তাঁর আন্দোলনের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়। তাই দুদু মিয়ার সারা জীবন তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই কেটে গেছে। একদিকে গরিব প্রজাদের উপর জমিদার-নীলকরদের নানাপ্রকার উৎপীড়ন এবং তাদের দুঃখ মোচনে দুদু মিয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা তাদেরকে দুদু মিয়ার নেতৃত্বে একতাবদ্ধ করে। দুদু মিয়ার সাংগঠনিক যোগ্যতাও ছিল অসাধারণ। বাংলার জমিদারগণ ছিল প্রায়ই হিন্দু এবং নীলকরগণ ছিল ইংরেজ খ্রিস্টান ও তাদের গোমস্তা কর্মচারী ছিল সবই হিন্দু। এ কারণেও কৃষক প্রজাগণ জমিদার-নীলকরদের বিরুদ্ধে দুদু মিয়ার নেতৃত্বে একতাবদ্ধ হয়েছিল। দুদু মিয়ার সারা জীবন জমিদার-নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতেই কেটে যায়। নিত্য নতুন মিথ্যা মামলা-মোকদ্দমায় তাঁকে জড়িত করা হয়। এসবের জন্যে তাঁকে শেষ পর্যন্ত দারিদ্র্য বরণ করতে হয়।৯ ভারতীয় পণ্ডিত সুরজিৎ দাশগুপ্ত উল্লেখ করেন, দুদু মিয়ার মতে, মানুষ মাত্রেই সমান, কেননা ঈশ্বরের সৃষ্টিতে উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ নেই এবং এ কারণেই কৃষক ও জমিদারদের সম্পর্কটাও কৃত্রিম বা স্বার্থপ্রসূত অর্থাৎ কৃষকের উপরে কর বসানোর কোনো ন্যায়সঙ্গত অধিকার জমিদারের নেই। মনে রাখা ভালো যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জোরে জমিদাররা অজ¯্র রকমের কর হামেশাই বসাতো এবং জমিদারের বাড়িতে কোনো উৎসব হলে, বিবাহ বা অন্নপ্রাশন হলে, এমনকি জামাই এলেও প্রজাদের উপর কর বসিয়ে খরচ তোলা হতো। আর বিশেষত হিন্দু জমিদারদের ক্ষেত্রে বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকতো।১০ এ বিষয়ে বাংলাপিডিয়া একটি ভাষ্যে উল্লেখ করে, মি. জেমস ওয়াইজ হাজি শরীয়ত উল্লাহকে নিজেদের দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে উদাসীন ও অসচেতন বাংলার মুসলমান কৃষকদের আত্মসচেতন ও উজ্জীবিত করার কাজে নিয়োজিত একজন একনিষ্ঠ ও সহানুভূতিশীল প্রচারকরূপে গণ্য করেন। ফরায়েজি আন্দোলন অসামান্য দ্রুততার সঙ্গে ঢাকা, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ (বর্তমান বরিশাল), ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা), চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলাসমূহে এবং আসাম প্রদেশে বিস্তার লাভ করে। যেসব এলাকায় নব্য হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরগণ শক্তিশালী ছিল এবং কৃষকদের উপর অত্যাচার চালাতো সেখানেই এ আন্দোলন সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কিন্তু বাংলার সমাজব্যবস্থার রক্ষণশীল পরিবেশ এবং বিচ্ছিন্ন আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে ফরায়েজি আন্দোলন অব্যাহতভাবে চলতে পারেনি। হিন্দু জমিদারগণ ফরায়েজি ও রক্ষণশীল গোঁড়া মুসলমানদের মধ্যে কিছু কিছু ধর্মীয় বিষয়ে সৃষ্ট বিরোধে হস্তক্ষেপ করার মোক্ষম সুযোগ লাভ করে। ঢাকার জমিদাররা পুলিশের সহায়তায় রামনগর বা নয়াবাড়িতে অবস্থিত প্রচারকেন্দ্র থেকে শরীয়ত উল্লাহকে বহিষ্কার করেন। হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরদের সঙ্গে অবিরাম সংঘর্ষের ফলে আন্দোলনটি ক্রমান্বয়ে আর্থ-সামাজিক রূপ পরিগ্রহ করে। বাংলাপিডিয়ায় আরও বলা হয়, উনিশ শতকে মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নব্য শ্রেণির হিন্দু জমিদারগণ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত নয় এমন বহু অতিরিক্ত আবওয়াব (অবৈধ কর) কৃষকদের উপর চাপিয়ে দেয়।

১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেটের এক তদন্তে প্রকাশ পায় যে, কৃষকদের উপর জমিদারদের আরোপিত অবৈধ করের সংখ্যা ২৩-এর কম নয়। এমনকি, তারা মুসলমান প্রজাদের কাছ থেকে কালিপূজা, দুর্গাপূজা ইত্যাদি অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য কর আদায় করতো। শরীয়ত উল্লাহ এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং জমিদারদের এসব অবৈধ কর প্রদান না করার জন্য তার শিষ্যদের নির্দেশ দেন। জমিদাররা বিশেষ করে ঈদুল আজহা উপলক্ষে গরু জবাইয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। গরু কোরবানি করা মুসলমানদের প্রচলিত ধর্মীয় প্রথা এবং মুসলমানদের খাদ্য হিসেবে অন্যান্য মাংসের তুলনায় গরুর মাংসের মূল্য কম বিধায় শরীয়ত উল্লাহ এ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করার জন্য মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করেন। জমিদারগণ কলকাতার সংবাদপত্র এবং ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত আলাপ আলোচনাকালে ফরায়েজিদের বিদ্রোহী ভাবাপন্ন দল হিসেবে বিজড়িত করে প্রচারাভিযান শুরু করে। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে তারা শরীয়ত উল্লাহকে তিতুমীর-এর ন্যায় একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। তারা ফরায়েজিদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের করে এবং এতে তারা ইউরোপীয় নীলকরদের সক্রিয় সহযোগিতা লাভ করে। কিন্তু তাদের অভিযোগসমূহ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন হওয়ায় কোনটিই তারা আদালতে প্রমাণ করতে পারেনি। অবশ্য ফরিদপুরে শান্তিভঙ্গ ও গোলযোগ সৃষ্টির অভিযোগে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে শরীয়ত উল্লাহ একাধিকবার পুলিশি হেফাজতে ছিলেন।১১ বাংলাপিডিয়ার আরেকটি বিবরণে দেখা যায়, নীলকরদের পাশাপাশি সংঘবদ্ধ মাড়োয়ারি সম্প্রদায় ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-এর অধীনে বড় বড় জমিদারি ক্রয় করতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় নিয়োজিত গোমস্তাগণ ছিল মধ্যস্থতাকারী তৃতীয় গ্রুপ। এরা ছিল প্রধানত মাড়োয়ারি এবং তাদের বাঙালি সহযোগীগণ। এই গোমস্তাদের ছিল সারা দেশের হাট-বাজার ও নদী-বন্দরের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। যৌথভাবে পরিচালিত হিং¯্রতা ও অত্যাচার মানুষজনকে মধ্যযুগীয় ইউরোপের ক্রীতদাসদের পর্যায়ে উপনীত করে। এই ভয়াবহ সামাজিক পরিবর্তন তৎকালীন ইংরেজ পুলিশ কমিশনারের বার্ষিক রিপোর্টে ‘ঘৃণ্য বিপ্লব’ হিসেবে আখ্যাত হয়েছে। হাজি শরীয়ত উল্লাহ অনুসারীদেরকে নির্দেশ দেন যে, জমিদার কর্তৃক তাদের ওপর আরোপিত কোন ধরনের ফসলিকরও প্রদান করা যাবে না। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত আইনানুগ রাজস্বই কেবল প্রদান করা যাবে। এই নীতি সদ্য সৃষ্ট হিন্দু ভূস্বামীগণকে শরীয়ত উল্লাহর আন্দোলনের বিরোধীপক্ষ হিসেবে প্রকাশ ঘটায়। হিন্দু ভূ-স্বামীগণ কৌশলে রক্ষণশীল মুসলিম কৃষকসহ তাদের পৃষ্ঠপোষক শক্তিসমূহকে একত্রিত করেন এবং নীলকরদেরকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। এভাবে ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে উভয়পক্ষ ক্রমশ সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যায়। এ অবস্থায় ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে হাজি শরীয়ত উল্লাহ মারা যান এবং তাঁর পুত্র দুদু মিয়া ফরায়েজিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।১২ হাজি শরীয়ত উল্লাহর আদেশে তাঁর শাগরিদগণ জমিদারদের প্রবর্তিত শিরক কালীবৃত্তি, ঈশ্বরবৃত্তি নামক পূজার চাঁদা দেওয়া বন্ধ করেন এবং সবধরনের কুরবানি করতে আরম্ভ করেন। এতে হিন্দু জমিদারগণ তাঁর বিরুদ্ধে নানারূপ ষড়যন্ত্র ও মিথ্যা মোকদ্দমা দায়ের করে তাঁকে জব্দ করতে চেষ্টা করে। হাজি শরীয়ত উল্লাহর প্রচারের ফলে মুসলিম কৃষকগণ সংঘবদ্ধ হয়ে উঠে এবং তাদের আত্মবিশ্বাসও দৃঢ় হয়ে উঠে। এতে জমিদারগণ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে দ্বন্দ্ব শুরু হওয়ার কারণে তাঁকে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয় এবং ঢাকা জেলার নয়া বাড়ির বাসস্থান থেকে তাঁকে বিতাড়িত করা হয়। তিনি বাধ্য হয়ে জন্মভূমি ফরিদপুর জেলায় ফিরে আসেন। নিজ এলাকায় তিনি ধর্মগুরুর মর্যাদা ও আসন লাভ করেন। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, অকপট সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার ও নিষ্কলঙ্ক আদর্শ ও চরিত্রগুণে অতি অল্পদিনের মধ্যেই তিনি মুসলিম জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন লাভে কৃতকার্য হন। তাঁর প্রভাব ছিল অসীম। কেউ তাঁর আদেশ অমান্য করতে এতটুকু সাহস পেতো না।১৩ মোহসীন উদ্দীন দুদু মিয়া সম্পর্কে প্রাপ্ত বিবরণে দেখা যায়, তিনি ও তাঁর অনুসারীগণ তদানীন্তন হিন্দু, প্রাচীনপন্থী মুসলমান ও ইউরোপীয় নীলকর ও জমিদারগণের নিকট ভীষণ আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠেন। কারণ কোনো অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যেতো না। জমিদারগণের অযৌক্তিক কর ধার্যকরণের বিরুদ্ধে দুদু মিয়া রুখে দাঁড়ান। এই বিষয়ে তিনি ন্যায্য পথই গ্রহণ করেন। এরূপ অতিরিক্ত কর আদায় প্রচলিত রাখা ছিল জমিদারদের চিরাচরিত প্রথা এবং তারা সেই প্রথা জনগণের উপর চাপিয়ে রাখতে আগ্রহান্বিত ছিল। দুদু মিয়া এইখানেই ক্ষান্ত হননি। তিনি আরও অগ্রসর হয়ে ঘোষণা করেন, এই পৃথিবী আল্লাহর, উত্তরাধিকারবলে এখানে কারো একচেটিয়া কায়েমি স্বত্ব নেই। কারো কর ধার্য করার অধিকার নেই। তাঁর উৎসাহ-উদ্দীপনায় অনুপ্রেরণা লাভ করে কৃষকগণ সরকারি খাসমহল জমিতে বসবাস স্থাপন করে, সরকারি খাজনা ব্যতীত অন্য কোনো প্রকার কর দেওয়া বন্ধ করে দেয়। দুদু মিয়ার এই সকল প্রচেষ্টায় দ্রুত সফলতা দেখে তৎকালীন অত্যাচারী জমিদারগণের ঈর্ষার উদ্রেক হয় এবং তারা তাঁর বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা মোকদ্দমা চাপিয়ে দেয়। তার বিরুদ্ধে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে কতকগুলি বাড়ি লুটপাট করার উসকানি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে খুনের অভিযোগে তাঁকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। কিন্তু তিনি বেকসুর খালাস পান। এছাড়াও তাঁকে বহুবার বহু ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু তিনি প্রতিক্ষেত্রেই সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস পান। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহি বিদ্রোহ আরম্ভ হলে দুদু মিয়াকে কলকাতায় নজরবন্দী করে রাখা হয়। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পেয়ে বাহাদুরপুর পৌঁছালে পুলিশ আবার তাঁকে ফরিদপুরে বিনা বিচারে আটক করে রাখে। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তার নিজ বসতবাড়ি বাহাদুরপুরে তিনি অধিকাংশ সময় বাস করতেন। সেখানে প্রত্যেক আগন্তুক মুসলমান মেহমানকে পরিতুষ্টির সঙ্গে আহার করাতেন। সমগ্র পূর্ব বাংলায় তাঁর গুপ্ত সংবাদ সংগ্রাহকগণ পরিভ্রমণ করতেন। নিকটস্থ সমগ্র অঞ্চলের জনগণের স্বার্থ রক্ষার বিষয় তাঁর উপর ন্যস্ত ছিল। তিনি ঘরোয়া বিবাদ-বিসংবাদ আপসে মীমাংসা করে দিতেন এবং বিচার-আচার করতেন। কোনো হিন্দু, মুসলমান বা খ্রিস্টান তাঁকে না জানিয়ে ঋণের টাকা আদায়ের জন্য কোনো মোকদ্দমা মুনসেফ আদালতে দায়ের করলে তিনি তাকে শাস্তি প্রদান করতেন। গুপ্তচরগণ তাঁর আদেশ-নির্দেশ দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলে বহন করতেন।১৪ বাংলাপিডিয়ার মতে, দুদু মিয়ার দুটি লক্ষ্য ছিল: ১. হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরদের অত্যাচার থেকে কৃষক সম্প্রদায়কে রক্ষা করা এবং ২. জনগণের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। প্রথম লক্ষ্যটি অর্জনের জন্য তিনি এক স্বেচ্ছাসেবক লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন এবং তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি অর্জনের জন্য তিনি ফরায়েজিদের নেতৃত্বে সনাতন স্থানীয় সরকারব্যবস্থা (পঞ্চায়েত) পুনঃপ্রবর্তন করেন। প্রথমটি সিয়াসতি বা রাজনৈতিক শাখা এবং পরেরটি ‘দ্বীনি’ বা ধর্মীয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এ দুটি শাখা একীভূত করে খিলাফত ব্যবস্থার রূপ দেওয়া হয়।১৫

উপসংহার আলোচনায় দেখা যায়, দরিদ্র ও মেহনতি মানুষদের পাশে থেকে শুধু ব্রিটিশ-ইংরেজ নয়- দেশীয় ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাস তৈরি করেছেন নিষ্ঠাবান মুসলিম নেতৃবৃন্দ। একাধারে শহীদ নিসার আলী তিতুমীর, হাজি শরীয়ত উল্লাহ, মোহসীন উদ্দীন দুদু মিয়া প্রমুখের ধারাবাহিকতায় সিপাহি বিপ্লবেরও শীর্ষে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মুসলিমগণ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশে ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মধ্যবিত্তের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। তিতুমীর, শরীয়তুল্লাহ ও দুদু মিয়া প্রমুখের নেতৃত্বে এদেশে ইউরাপীয় ও তাদের দালালদের জুলুম-অত্যাচার থেকে জনগণ রেহাই পায়। এটি না ছিল কোনো শ্রেণিসংগ্রাম আর না ছিল কোনো সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নির্যাতিত অসহায় মানুষদের উদ্ধারে এই কর্মকাণ্ড ছিল ইসলামের বিপ্লবী চেতনা¯œাত। সেভাবেই এর মূল্যায়ন হওয়া জরুরি।

তথ্যসূত্র: ১ উইকিপিডিয়া। ২ ইসলামী বিশ্বকোষ (২৩ শ’ খণ্ড), ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৯৭ ৩ আব্বাস আলী খান: বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা, জুন ১৯৯৪, পৃ. ১৯৯। ৪ ইসলামী বিশ্বকোষ (১৪ শ’ খণ্ড) ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৯৯৩। ৫ মঈন-উদ-দীন আহমদ খান: বাংলাপিডিয়া (খণ্ড ৯) বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, মার্চ ২০০৩। ৬ https://www.roddure.com/encyclopedia/marxist-glossary/what-is-class-struggle. ৭ সুরজিৎ দাশগুপ্ত: ভারতবর্ষ ও ইসলাম, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০৪। ৮ আব্বাস আলী খান: বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা, জুন ১৯৯৪, পৃ. ১৯৯। ৯ প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৫। ১০ সুরজিৎ দাশগুপ্ত: ভারতবর্ষ ও ইসলাম, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০৪। ১১ মঈন-উদ-দীন আহমদ খান: বাংলাপিডিয়া (খণ্ড-৬) বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, মার্চ ২০০৩। ১২ প্রাগুক্ত। ১৩ ইসলামী বিশ্বকোষ (১৪ শ’ খণ্ড), ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ১৯৯৩। ১৪ প্রাগুক্ত। ১৫ মঈন-উদ-দীন আহমদ খান: বাংলাপিডিয়া (খণ্ড-৬) বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, মার্চ ২০০৩। লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গ্রন্থপ্রণেতা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির