post

বইমেলা পরিণত হোক বই পড়ার উৎসবে । সালাহউদ্দিন আইউবী

১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বইমেলা পরিণত হোক বই পড়ার উৎসবেউৎসব আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অনেকের ধারণা, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে উৎসবপ্রিয় জাতির নাম বাঙালি।’ বিভিন্ন সময় আয়োজিত মেলাসমূহ এই উৎসবের অন্যতম স্থান দখল করে আছে। বাংলাদেশী মেলার শেষ নেই। বারো মাসে তেরো মেলা। বছরের শুরুতেই জানুয়ারি মাসে বাণিজ্যমেলা থেকে শুরু করে শেষ হয় ডিসেম্বর মাসে বিজয়মেলা দিয়ে। এর মাঝখানে বৈশাখী মেলা, চৈত্র সংক্রান্তি মেলা আরো কত কী? তবে সর্বজনগৃহীত; সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রশংসিত মেলার নাম ‘একুশে বইমেলা’। জাতীয় পর্যায়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত এই মেলা আজ দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে গিয়েছে। প্রায় শতাধিক উপজেলায় গতবছর বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বইমেলার আয়োজন করা হয়েছে। এই মেলা শুধু দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নয় সমগ্র বিশ্বজুড়ে অন্যতম আয়োজন-এর নাম। পৃথিবীর বিভিন্ন বইমেলা কয়েক শতাব্দী ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সুনামের সাথে। আমরা আজকে সে রকম বিখ্যাত কিছু বই মেলার তথ্য জানবো।

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা, জার্মানি চলতি বছরের ১১ অক্টোবর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলাকে বলা হয় বাণিজ্যিক দিকে থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলা। আর দর্শনার্থীর আগমনের দিক থেকে ইউরোপে এর অবস্থান দ্বিতীয়। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে প্রতি বছর অক্টোবরের মাঝামাঝিতে এই মেলার আয়োজন করা হয়। পাঁচ দিনব্যপী মেলার প্রথম তিনদিন থাকে কেবল বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আগমনকারীদের জন্য। পরবর্তী দুই দিন মেলা উন্মুক্ত থাকে সবার জন্য। সারা পৃথিবী থেকে মানুষ এই মেলায় আসেন বইয়ের আন্তর্জাতিক প্রকাশনা স্বত্ব ও লাইসেন্সিং ফি নিয়ে দর কষাকষি করতে। ‘জার্মান পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স অ্যাসোসিয়েশন’ এর একটি সহযোগী সংগঠন এই মেলার আয়োজন করে। ১০০টিরও বেশি দেশ থেকে অন্তত ৭,০০০ সংস্থা অংশ নেয় এই মেলায়। আর মেলায় এখন প্রায় তিন লক্ষ মানুষের আগমন ঘটে। প্রকাশনা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি ও বাণিজ্যের জন্য এই বইমেলাকে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইমেলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আয়োজনে প্রথমবারের মত বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। ছাপানো বইয়ের যুগ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সাধারণ বাণিজ্যমেলাতে কেবল বইয়ের পাণ্ডুলিপি বিক্রি করা হতো। এই বইমেলা শুরু হওয়ার পর এখানে বিদ্বান ব্যক্তিবর্গ ও বইয়ের ব্যবসায় আগ্রহী বণিকরা আসা শুরু করলেন। ১৭ শতকের শেষ পর্যন্ত এটি ছিল ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইমেলা। ইউরোপের এনলাইটেনমেন্টের যুগে লিপজিগ বইমেলা এর জায়গাটা দখল করে নিলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আবার হারানো শীর্ষস্থান ফিরে পায় ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা। ১৯৫০ সাল থেকে প্রতি বছর এই বইমেলা চলাকালীন ‘পিস প্রাইজ অব দ্য জার্মান বুক ট্রেড’ পুরস্কার প্রদান করা হয়।

কায়রো ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার, মিসর মিসরের কায়রোতে বড় পরিসরে ‘কায়রো ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার’ নামে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই মেলা বিশ্বের শীর্ষ বইমেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং আরব বিশ্বে সেরা বইমেলা। এর যাত্রা শুরু ১৯৬৯ সালে। মিসরের সরকারি প্রকাশক ও বিক্রেতাদের সংস্থা জেনারেল ইজিপশিয়ান বুক অরগানাইজেশন এই মেলার আয়োজন করে, সে বছরে কায়রো শহর প্রতিষ্ঠার ১০০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে। তখন থেকেই মেলা আয়োজনের দায়িত্বে আছে এই প্রতিষ্ঠানটি। প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে এই আয়োজন। এটি আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলাও বটে। কারণ আরবি ভাষায় রচিত বইগুলোর প্রতি পাঁচটি বইয়ের মধ্যে তিনটিই প্রকাশ করে কায়রো ভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থাগুলো। ফলে আরব বিশ্বে বইয়ের জন্য সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন এই মেলা। ২০০৬ সালে কায়রো বইমেলা ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার পর দ্বিতীয় প্রধান বইমেলা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল কায়রো বইমেলা। মিসরের সরকারি প্রকাশক ও বিক্রেতাদের সংস্থা জেনারেল ইজিপশিয়ান বুক অর্গানাইজেশন এই মেলার আয়োজন করে। প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় এই বইমেলা। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে এই মেলা বসে এবং তিন সপ্তাহ ধরে চলে। মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই কায়রো ইন্টারন্যাশনাল গ্রাউন্ডে এই মেলা আয়োজিত হয়ে আসছে।

কলকাতা বইমেলা, ভারত এশিয়ার শ্রেষ্ঠ বইমেলার স্থানটি দখল করে আছে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। কারণ এখানে সবচেয়ে বেশি পাঠক সমাবেশ ঘটে। আবার অনেকে এই বইমেলাকে অবাণিজ্যিক বইমেলা হিসেবেও সম্বোধন করে থাকেন। বাংলা ভাষাভাষীর পাঠকদের জন্য কলকাতা বইমেলার গুরুত্ব অন্যতম। বর্তমানে সায়েন্স সিটির পাশে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই বইমেলা। ‘কলকাতা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড’ ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আয়োজনে ১৯৯২-এর আগ পর্যন্ত দুটি পৃথক বইমেলা হতো। এখন সে দু’টি মেলা একীভূত করা হয়েছে। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা নামেই সারা বিশ্বে এখন পরিচিত এটি। প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষের সমাগম হয় এখানে। কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশের জন্যও একটি আলাদা প্যাভিলিয়ন থাকে। সাধারণত প্রতি বছর জানুয়ারির শেষ বুধবারে শুরু হয় মেলা।

বইমেলা পরিণত হোক বই পড়ার উৎসবেলন্ডন বুক ফেয়ার, ইংল্যান্ড লন্ডন বুক ফেয়ার ইংল্যান্ডের লন্ডনে আয়োজিত সবচেয়ে বড় বইমেলা। সাধারণত এই মেলা বসে প্রতি বছর এপ্রিল মাসে। একশোটিরও বেশি দেশের প্রায় ২৩ হাজার প্রকাশক, গ্রন্থবিক্রেতা, লিটারারি এজেন্ট, গ্রন্থাগারিক, গণমাধ্যম ও শিল্প সরবরাহকারী এই মেলায় অংশ নিয়ে থাকেন। বই প্রকাশকরা লন্ডনে এসে তাদের প্রকাশিতব্য বইয়ের প্রচার চালান এবং অন্যান্য প্রকাশনী থেকে বইয়ের পরিবেশনা ও অনুবাদ স্বত্ব কেনেন। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে একটি হোটেলের বেজমেন্টে লিওনেল লেভেনথাল নামক একজন প্রকাশকের উদ্যোগে এই বইমেলার গোড়াপত্তন হয়। প্রকাশকদের বইগুলো লাইব্রেরি মালিকদের কাছে সহজে প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই মূলত নেয়া হয়েছিল এই উদ্যোগ। সেবারেই প্রতিষ্ঠা হয় ‘দ্য স্পেশালিস্ট পাবলিশার্স এগজিবিশন ফর লাইব্রেরিয়ানস (ঝচঊঢ)’ নামক প্রতিষ্ঠান। প্রথমবারের উদ্যোগের সফলতার কারণে ১৯৭২ সালের নভেম্বরে আবার প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। সেবারেও অনুষ্ঠানটির সাফল্য দেখে নিয়মিতভাবে প্রতি বছর আরও বড় হতে থাকে আয়োজন। ১৯৭৫ সালে মেলার নাম দেয়া হয়, ‘ঝচঊঢ’৭৫: ঞযব খড়হফড়হ ইড়ড়শ ঋধরৎ’। দুই বছর পর থেকে ঝচঊঢ অংশটি বাদ দিয়ে মেলা আয়োজিত হতে থাকে লন্ডন বুক ফেয়ার নামে। ইউরোপের বইপ্রেমীদের অন্যতম বৃহৎ মিলনমেলা ঘটে লন্ডন বইমেলায়।

বুয়েন্স আয়ার্স ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার, আর্জেন্টিনা বিশ্বের অন্যতম প্রধান বইমেলার একটি হলো বুয়েন্স আয়ার্স ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার। এই মেলা ১৯৭৫ সাল থেকে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্স শহরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রতি বছর বুয়েন্স আয়ার্স বইমেলা বসে এপ্রিল মাসে। এই মেলার আয়োজন হয় আর্জেন্টাইন রুরাল সোসাইটির ৪৫ হাজার বর্গ মিটার এলাকা নিয়ে। প্রচুর দেশি-বিদেশি লেখকের মিলনমেলা ঘটে এখানে। সাড়ে সাত হাজার বর্গমিটার জায়গা নিয়ে অনুষ্ঠিত প্রথমবারের মতো বুয়েন্স আয়ার্স আন্তর্জাতিক বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। সময়টা ১৯৭৫ সালের মার্চে। সেই মেলায় ৫০ জন লেখক এবং আর্জেন্টিনার বাইরের আরও ৭টি দেশ অংশ নিয়েছিল এবং দর্শনার্থী হয়েছিল প্রায় দেড় লাখ। এখন অন্তত ৫০টি দেশের অংশগ্রহণে এই মেলায় দর্শনার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ লাখে। প্রতি বছর এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হওয়া এই মেলা চলে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত। আর্জেন্টাইন সোসাইটি অব রাইটার্স-এর প্রতিষ্ঠিত একটি সংস্থা ‘ফান্দাসিঁও এল লিব্রো’ বুয়েন্স আয়ার্স বইমেলার আয়োজন করে থাকে।

বলগ্না চিল্ড্রেনস বুক ফেয়ার, ইতালি শিশুসাহিত্যের জন্য ‘বলগ্না চিল্ড্রেনস বুক ফেয়ার’ একটি প্রধান বইমেলা। ১৯৬৩ সাল থেকে প্রতি বছর মার্চ এবং এপ্রিলের চার দিন এই মেলা ইতালির বলগ্নায় অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ১ হাজার ৫০০ প্রকাশক মেলায় অংশ নিয়ে থাকেন। শিশু সাহিত্য, শিশু চলচ্চিত্র এবং এনিমেশন নিয়ে যারা বিশ্বজুড়ে কাজ করেন তাদের জন্য এই মেলা যেন তীর্থস্থানীয়। বিশ্বজুড়ে সবার কাছেই বইমেলা অসম্ভব জনপ্রিয়। তারাই মূলত এখানে শিশুসাহিত্য সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে আসেন। শুধু জ্ঞান আহরণের জন্য নয় বরং আনন্দ উপভোগের জন্যও বই পড়া যায়। অনেক পাঠকই আছেন যাদের কাছে বই পড়ার আনন্দ সত্যিই অতুলনীয়। আর শিশুদের বেশি বেশি বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যই মেলার প্রধান উদ্দেশ্য। বইমেলার বিভিন্ন স্টলে প্রায়ই বড় করে লেখা থাকে— ‘রিডিং ফর প্লেজার’ যার একটাই অর্থ, ‘পড়ুন আনন্দের জন্য।’ অর্থাৎ শিশুদের একাডেমিক বই পড়ার পাশাপাশি বই পড়ার আনন্দ উপভোগের সুযোগ করে দিতে হবে। প্রতি বছর ৭০ থেকে ৮০টি দেশের প্রতিনিধিরা এই মেলায় অংশ নিয়ে থাকে। এই মেলা চলাকালীন আরও কিছু প্রধান অ্যাওয়ার্ড ঘোষণা করা হয়। যেগুলোর মধ্যে বিয়ানুয়াল হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডার্সন অ্যওয়ার্ডস এবং দ্যা লিন্ড গ্রিন মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড অন্যতম।

মিয়ামি আন্তর্জাতিক বইমেলা, ফ্লোরিডা; যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অনুষ্ঠিত হয় মিয়ামি আন্তর্জাতিক বইমেলা। এই বইমেলা এক যুগ ধরে নিয়মিত আয়োজিত হয়ে আসছে। এখানে সারা বিশ্ব থেকে প্রায় ৩৫০ জনের উপরে লেখক অংশগ্রহণ করেন। তাই অনেকে লেখকদের মিলনমেলা বলেও সম্বোধন করে থাকেন। প্রায় ২৫০-এর বেশি প্রকাশনা কেন্দ্র মেলায় অংশগ্রহণ করে। এই মেলার একটি বিশেষত্ব হলো এখানে প্রকাশিত বইয়ের লেখক প্রদত্ত পাণ্ডুলিপি প্রদর্শন করা হয়।

মস্কো আন্তর্জাতিক বইমেলা, রাশিয়া পৃথিবীর অন্যতম বইমেলা বসে মস্কোতে। প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের ৩ থেকে ৭ তারিখের মধ্যে মস্কো এক্সিভিশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় মস্কো ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার বা মস্কো আন্তর্জাতিক বইমেলা। মেলা চলাকালীন প্রতিদিনই মেলায় বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে নানা ধরনের ওয়ার্কশপ, গোলটেবিল বৈঠক, লেখকদের নিজস্ব আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে। সেই সঙ্গে আগত অতিথিদের অটোগ্রাফ সংগ্রহের আলাদা ব্যবস্থা থাকে এবং লেখকদের সঙ্গে সরাসরি আলাপচারিতার একটি ভালো সুযোগ মেলে। ১৯৭৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর মস্কোতে এই বইমেলা প্রথম শুরু হয়েছিল। এখানে রাশিয়াসহ আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থাগুলো অংশ নেয়। পাঠকরা বিশেষ মূল্যে বই কিনতে পারে। এই মেলায় শিশুদের জন্য ‘লেটস রিডস’ নামে একটি কর্নার নির্ধারিত আছে। যেখানে শিশু সাহিত্য নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়। মস্কোতে শরতের সময় আয়োজিত এই বইমেলায় বইপ্রেমীদের ভিড়ে মুখরিত হয় প্রাঙ্গণ।

গুয়াডাললাজারা বইমেলা, স্পেন স্প্যানিশ ভাষাভাষীদের জন্য সবচেয়ে প্রখ্যাত বইমেলা হলো গুয়াডাললাজারা বইমেলা। প্রতি বছর শেষ দিকে এই মেলার আয়োজন করা হয়। এ বছরও এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। ২৫ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে গুয়াডাললাজারা আন্তর্জাতিক বইমেলা। এটি হলো স্প্যানিশ সাহিত্য অনুরাগীদের জন্য এক প্রকার তীর্থ স্থান এবং আগত দর্শনার্থীর দিক থেকে বুয়েন আয়ার্সের বইমেলার পরেই এর অবস্থান। প্রচুর বইপ্রেমীর আগমন ঘটে এই মেলায়। বিশ্ব মিডিয়ায় বইমেলাটি এর স্প্যানিশ নামের আদ্যাক্ষরগুলোর সমন্বয়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। গুয়াডাললাজারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে এই বইমেলা প্রথম শুরু হয়। সময়টা তখন ১৯৮৭ সাল। এই মেলা মূলত মেক্সিকোর জালসিকোতে আরম্ভ হয় প্রতি বছর নভেম্বরের শেষ শনিবারে। চলে একটানা নয় দিন। ৪০ হাজার বর্গ মিটার জায়গাজুড়ে মেলা বসে। ২০১৬ সালে এই মেলায় অংশ নিয়েছে ৪৩টি দেশ থেকে প্রায় দুই হাজার প্রকাশনা সংস্থা। সেবার মেলায় দর্শনার্থী আসে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ।

বইমেলা পরিণত হোক বই পড়ার উৎসবেপৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বইমেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পড়ে অনেকের মুখে লালা এসেছে। ইস! যদি সবগুলো বই মেলায় গিয়ে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে পারতাম! উৎসবের আমেজে বইমেলায় ঘুরতে যাওয়া, ছবি তোলা, লেখক-সাহিত্যিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা বইমেলার কোনো উদ্দেশ্যের মধ্যে পড়ে না। পাঠকের হাতে নতুন চিন্তার খোরাক হিসেবে চিন্তাশীল মানুষের সুচিন্তিত লেখনীগুলো পৌঁছে দেয়াই বইমেলার অন্যতম উদ্দেশ্য। বিশেষ করে সুস্থ চিন্তা প্রতিষ্ঠায় যারা সংগ্রাম করছেন। তাদের জন্য বইমেলা একটি বড় সুযোগ। আমাদেরকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। যুব সমাজের পড়ালেখার অভ্যাস নানা কারণে কমে গিয়েছে। নতুন বইয়ের চমৎকার প্রচ্ছদ আর বইমেলার উৎসবের আমেজ ফিরিয়ে আনতে পারে এই সোনালী অভ্যাস। বই মেলা থেকে বই কিনে পড়ার চেয়ে এখন অনলাইনভিত্তিক নানা মাধ্যমে পড়ালেখায় অভ্যস্ত অনেকেই। ডিজিটাল পৃথিবীর সুফলে বইয়ের ক্রেতার সংখ্যা দিন দিন কমছে। আমরা যারা এই সমাজের তৃণমূলের পরিবর্তন চাই, নতুন প্রজন্মকে পথের দিশা দিতে আলোর পথিক হয়ে সামনে থাকতে চাই তাদেরকে তাদেরকে হতে হবে স্রোতের বিপরীতে এক নতুন প্রজন্ম। সমগ্র বিশ্বে যখন বই কেনার অভ্যাস কমছে তখন আমাদেরকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে হবে বই কেনা। আমাদের অনেকেই বই কিনতে যতটা অভ্যস্ত বই পড়তে ততটা অভ্যস্ত নয়। পড়ার টেবিলে নতুন বইয়ের বাহারি সাজে দৃশ্য বারবার চোখে পড়লেও পড়ার অভ্যাস অনেক কম। আমাদেরকে বাড়াতে হবে বই পড়ার অভ্যাস। এখন বই পড়া কিছুটা ব্যয়সাপেক্ষ তা স্বীকার করতেই হবে। বইয়ের দাম বেড়েছে। বিদেশী বই কিনতে আগের তিন থেকে দশগুণ বেশি অর্থ খরচ করতে হয়। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ বই না পড়ার অজুহাত হিসেবে এই দাম বাড়ার বিষয়টিকে তুলে ধরে। একটি ছেলে বা মেয়ে স্মার্টফোন এবং তাতে ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনতে মাসে যে অর্থ ব্যয় করে, তা দিয়ে সারা মাসের জন্য বেশ ক’টি বই কেনার সুযোগ এখনো আছে বলে মনে করি। যারা ঈদের সময় ২০-৩০ হাজার টাকা দিয়ে লেহেঙ্গা কেনে, সমাজের সেই ধনিক শ্রেণীর মেয়েরা বই পড়ে না। যে তরুণটি এক জোড়া কেডস কিনতে ২৫ হাজার টাকা ব্যয় করে, তার কাছে বই পড়া মানে নিছক সময়ের অপচয়। সে কম্পিউটারে, টিভিতে, সিনেপ্লেক্সে ইংরেজি সিনেমা দেখে বিজাতীয় জীবন সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা নেয়ার চেষ্টা করে। বিদেশ ট্যুরে গিয়ে বিদেশীদের সম্পর্কে ভাসা ভাসা জ্ঞান আহরণ করে এবং নিজের দেশ, সমাজ, সংস্কৃতিকে হেয় করতে, অবজ্ঞা করতে শিখে। সে সব সময় এ দেশের সমাজ-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ অবিলম্বে পাল্টে ফেলার সুপারিশ করে বক্তৃতাবাজি করবে। আমরা এ ধরনের শেকড়বিহীন মানুষের কথা বলতে চাই না। আমরা চাই নিজের সমাজ, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে ধারণ করে একে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার, একে উন্নততর করে তোলার লক্ষ্যে নিরন্তর কাজ করে যাওয়ার মানসিকতাসম্পন্ন সত্যিকারের আলোকিত মানুষ; যারা দেশকে ভালোবাসবে শর্তহীন সরলতায়, শুধুই এ দেশের কাদা-মাটিতে, জলে-হাওয়ায় বেড়ে ওঠার কৃতজ্ঞতায়। আর এটি করতে হলে প্রথম যে কাজটি করতে হবে সেটি হলো পড়া। নিজেকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নানা ধরনের বই পড়তে হবে। পড়তে হবে, গভীর অভিনিবেশে, মেধা ও হৃদয়ের যুগপৎ ব্যবহারে। বলা হয়ে থাকে, ‘বই পড়া পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ’। বই পড়া যতই কঠিন হোক এ কাজ ছাড়া আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা কোনভাবেই সম্ভব নয়। বই মানুষের মনের পুষ্টি জোগায়, মনকে উদার ও মানবিক করে তোলে, জীবনের শাশ্বত সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে এবং মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়, তার জীবনকে করে পরিমার্জিত। পণ্ডিতজন বলে গেছেন, একটি ভালো বই হচ্ছে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ যার সাথে কোনো পার্থিব ধনসম্পদের তুলনা হতে পারে না। ধনসম্পদ একদিন শেষ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু একটি কালজয়ী বইয়ের আবেদন কখনো ফুরাবার নয়। বই পড়তে হবে এ কারণেই। আমাদের ইসলাম ধর্মে জ্ঞানচর্চার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আর এ কথা কে না জানে, ইসলামি বিশ্বে যত দিন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ছিল, তত দিনই তারা বিশ্ব শাসন করেছেন। বিশ্বের রাজনৈতিক ও জ্ঞানের জগৎ একসাথে অধিকার করে রেখেছে। বই সম্পর্কিত কিছু উদ্ধৃতি দিই বিশিষ্টজনের মুখ থেকে। মার্কিন লেখক রে ব্রাডবেরি বলেন, ‘একটি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে তোমাকে বই পোড়াতে হবে না। স্রেফ মানুষের বই পড়া বন্ধ করতে পারলেই হলো।’ তার মানে হলো, আমরা যদি বই না পড়ি তাহলে আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি আপনাআপনিই ধ্বংস হয়ে যাবে, কোনো যুদ্ধবিগ্রহের দরকার হবে না। নোবেল বিজয়ী রুশ কবি ও লেখক জোসেফ ব্রডস্কিও বলেছেন প্রায় একই রকম কথা। তিনি বলেন, ‘বই পোড়ানোর চেয়েও বড় অপরাধ আছে। তার মধ্যে একটি হলো, বই না পড়া।’ মার্কিন দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনের নেতা ফ্রেডরিক ডগলাস বলেছেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা। তিনি বলেন, ‘একবার তুমি পড়তে শেখো, তুমি চিরকালের জন্য স্বাধীন।’ স্বাধীনতা মানুষের চিরন্তন আকাক্সক্ষা, ব্যক্তিজীবনে এবং জাতীয়পর্যায়ে সব মানুষই স্বাধীনতা চায়, শৃঙ্খলিত জীবনের অবসান চায়। আর সেজন্যই মানুষের নিরন্তর পথচলা, অবিশ্রান্ত সংগ্রাম। উদ্ধৃতি হয়তো বেশি হলেও আরো অন্তত তিনটি উদ্ধৃতি না দিয়ে শেষ করতে পারছি না। বিশ্ববিজয়ী বীর নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘অন্তত ষাট হাজার বই সাথে না থাকলে জীবন অচল।’ জন ম্যাকলে বলেন, ‘প্রচুর বই নিয়ে গরিব হয়ে চিলেকোঠায় বসবাস করব, তবু এমন রাজা হতে চাই না, যে বই পড়ে না।’ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন- বই, বই এবং বই।’ লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক প্রেরণা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির