post

বিজয়ের ৪৫ বছর কী পেল বাংলাদেশ

মোবারক হোসাইন

০৪ ডিসেম্বর ২০১৭
অনেক হয়েছে মহাজীবনের ক্ষয় অনেক হয়েছে বেদনার সঞ্চয় তবুও পূর্ণ জয়ের সূর্য এখনো আকাশে ভাসেনি যে অনেক বিজয় এসেছে আবার অনেক বিজয় আসেনি যে! - কবি মতিউর রহমান মল্লিক ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের একটি ইতিহাস। আমাদের ইতিহাস নির্মাণের বছর। যে ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকা; নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ- আমাদের প্রেরণার মিনার। দীর্ঘ শোষণ ও বঞ্চনার অবসান হয়ে স্বস্তির বাতাস এসে সুগন্ধির সুঘ্রাণ ছড়িয়ে দিয়ে গেল। আমাদের মাঝ থেকে ইতোমধ্যে ৪৫ বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। কী পেল বাংলাদেশ! সুজলা-সুফলা আমাদের এই বাংলাদেশ নিয়ে অনেকেই ঈর্ষা করেন। এই দেশের নাগরিক না হতে পারার দরুন আফসোস করেন। আমার দেশের মাটিতে সোনা ফলে। কবির ভাষায়- এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/ সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি/- দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। সকল শ্রেণীর পেশার মানুষের প্রাণপণ দাবি এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আজকের বাংলাদেশ। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের তীব্র আকাক্সক্ষা মনের মুকুরে গেঁথে থই থই ভালোবাসা নিয়ে জীবন বাজি রেখেছিল; একটি কল্যাণময় সুখী, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের সন্ধানে। ইতিহাস পড়লেই একটাই প্রশ্ন- একটি ভূখন্ড ছাড়া কী পেলাম আমরা? এখনো প্রতিদিন দাসত্বের শৃঙ্খলে উঠবোস করতে হয়; পায়রবি ছাড়া এক কদম অগ্রসর হওয়ার হিম্মত আজো হয়ে ওঠেনি। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও অর্থনৈতিক শোষণ পিছু ছাড়েনি আমাদের। অনেকটা অন্যের হাতের মোয়া কিংবা খেলনা পুতুল হয়ে হামাগুড়ি দিয়ে দিনাতিপাত করছে এই আমার বাংলাদেশ। আজ গর্বে বুক ফুলিয়ে, শিরদাঁড়া উঁচু করে উদ্বেলিত কণ্ঠে আওয়াজ তোলার কথা ছিল। অথচ আজ এক বুক বেদনায় আহত হৃদয়। এই দেশ নিয়ে আমাদের কতই না স্বপ্ন ছিল। স্বপ্নগুলো কি ফানুস হয়ে উড়ে যাবে দূর নীলিমার ঐ আকাশে। মেঘের ভাঁজে কি আড়াল হয়ে যাবে প্রত্যাশার সূর্য! ফিরিয়ে দিতে হবে মানুষের অধিকার যারা দেশকে ভালোবাসেন, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে জিইয়ে রাখতে চান সেই দেশপ্রেমিক মানুষগুলোকে আজ নানাভাবে হয়রানির মাধ্যমে কৌশলে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। নেই সাধারণ মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা; নেই স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। প্রতিদিন গুম, খুন ও ধর্ষণের ঘটনা অহরহ ঘটছে। সকল অপকর্মের সাথে সরকার সমর্থকদের সংশ্লিষ্টতার সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এমন কর্মকান্ডের পরেও দেশে যে স্বাধীনতা আছে কিভাবে বলি? এই অবস্থায় একটি দেশ চলতে পারে না। সকল ষড়যন্ত্রের প্রাসাদ ভেঙে দিতে এখনই প্রয়োজন শক্তিশালী সম্মিলিত ঐক্য। মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনতে আবার নতুন করে জ্বলে উঠি আর আমাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হোক- এই দেশের জন্য যদি করতে হয়/ আমার এ জীবন দান/ তবু দেব না দেব না লুটাতে ধুলায় / আমার দেশের সম্মান। ষড়যন্ত্রের নতুন আরেক ফাঁদ সংখ্যালঘু নির্যাতন সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ নিয়ে আমাদের সমাজ সংসার। আমরা একে অন্যের সহযোগী। নানা ধর্ম-বর্ণ, আদর্শ নিয়ে আমরা একেক জন পথ চলি, জীবন গড়ি। পারস্পরিক সম্প্রীতির স্মারক প্রতিষ্ঠায় আমাদের ইতিহাস উজ্জ্বল। আমাদের ঐতিহ্যের শেকড় খুব গভীরে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের চিত্রগুলো সে ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে দিয়ে একটি কলঙ্কের ডায়েরি সৃজনে ব্যস্ত সময়। আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মূলে নতুন করে আগাছা জন্মানোর জন্যই কি এই ষড়যন্ত্র? বারবারই একটি মহল ইসলাম ও মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী ও সমাজের উদভ্রান্ত শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। রামুর কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে এখন রংপুর। সকল ঘটনার একই কেস স্টাডি। কাট, কপি, পেস্টের কন্ট্রোল রাজনীতি। তবে মিডিয়ার বরাত দিয়ে মূল ঘটনা এখন মানুষের কাছে সুস্পষ্ট। মূলত বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে কাবু করতে এই চক্রান্ত। প্রতিটি ঘটনা ঘটার সাথে সাথে বিএনপি ও জামায়াতের ঘাড়ে দোষ চাপানোর অপসংস্কৃতি চালু হয়েছে। সেলুকাস! অথচ প্রতিটি ঘটনা সরকার সমর্থকরা পরিকল্পিতভাবে ঘটিয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থের এই অপরাজনীতি বন্ধ হোক। আমাদের বিশ্বাস বরাবরই বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনুপম দৃষ্টান্ত পেশ করবে। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য চাই সুস্থ রাজনীতিক সংস্কৃতি একটি দেশের উন্নয়নের জন্য সুস্থ রাজনীতির বিকল্প নেই। তবে আজকের বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। সুস্থ রাজনীতি যেন অলীক স্বপ্নের ন্যায়। পরিবারতন্ত্র, রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্রের কবলে আমাদের রাজনীতি। এ পরিস্থিতির অবসানে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছে এ দেশের আপামর জনতা। স্বাধীনতার প্রায় ৫ দশক পূর্ণ হতে চলেছে অথচ আমরা কি একটি কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ; একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের সন্ধান পেলাম? অধরাই রয়ে গেছে আমাদের স্বপ্নকথা। একটি দেশের উন্নয়নে প্রয়োজন সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক। অথচ আমরা কী দেখছি! প্রতিনিয়ত সবখানে দলীয়করণ ও প্রতিহিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। গণতন্ত্র আজ কফিনে মোড়ানো এক মৃত্যুপথযাত্রী। এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না। ‘উন্নয়নের মহাসড়কে চলছে বাংলাদেশ’। এটি নিছক একটি শ্লোগান। আর এই সব শ্লোগান দিয়ে দেশ পরিবর্তন সম্ভব নয়। দেশ পরিবর্তনে প্রয়োজন আদর্শিক ও নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন যোগ্য কান্ডারি। পরিবর্তন আসুক আমাদের রাজনীতির সংস্কৃতিতে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি সুবহে সাদিকের প্রত্যাশা; এই প্রত্যাশা নিয়ে প্রতি রাতে ঘুমিয়ে পড়ে এ দেশের কোটি কোটি জনতা। একটি দেশ গড়তে যুবশক্তির মূল্যায়ন একটি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য একদল দুঃসাহসী তরুণদের ভূমিকা অনিবার্য। আজ বড় অবহেলার শিকার আমাদের এই তরুণ বন্ধুরা। যাদের চোখে মুখে আলোর ঝলকানি, দেশপ্রেমের সিম্ফনি এবং হৃদয়ে বাংলাদেশ আঁকা থাকার কথা ছিল, কিন্তু তাদের দু’চোখ জুড়ে আজ হতাশার প্রতিচ্ছবি। বেকার ও শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা আজ দিন দিন বেড়ে চলেছে। ফুরিয়ে যাচ্ছে তাদের কর্মক্ষমতা; মিলছে না কর্মসংস্থানের ঠিকানা। অবেলায় অনাদরে ঝরে যাচ্ছে সম্ভাবনাময়ী সূর্যতরুণ। ফলে অনেকে নিরুপায় হয়ে বিপথগামী হচ্ছে। অপর দিকে তরুণ বন্ধুদের বিরাট একটি অংশ দেশের কাজে অনুপযোগী, অযোগ্য ঘোষণা করা হচ্ছে। দেশপ্রেমিক এই সব তরুণদেরকে পিছিয়ে রাখা, দেশের উন্নয়নে কাজে না লাগানোটাও আমাদের উন্নয়নের পথে বড় একটি বাধা। এর জন্য প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এই দেশে জন্মগ্রহণকারী প্রতিটি নাগরিক নাগরিক-জীবনের সুযোগসুবিধা ভোগের অধিকার রাখে। অযথা শর্তারোপ কিংবা অযাচিত নোটিশ জাতির জন্য অশনি সঙ্কেত। খুব বেশি প্রয়োজন এই অসুস্থ মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসা। শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতা সময়ের অপরিহার্য দাবি ভালো বীজ ছাড়া ভালো ফসল পাওয়া যায় না। আমাদের সন্তানেরা যখন বখে যাচ্ছে তখন আমরা খুব বেশি আফসোস করছি। আসলেই এই আফসোসে কিছু যায় আসে? আফসোসের মাধ্যমে কি আমাদের সন্তানটি নৈতিকবোধসম্পন্ন হয়ে উঠবে? গোড়ায় গন্ডগোল। প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামীকরণ। অথচ আমাদের সমাজব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা আজ ইসলাম শব্দটি শুনতে পারছে না। প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে আমরা জেগে উঠি। পত্রিকায় নিউজ হয়; লিড নিউজ। আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি। এই বুঝি প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ হয়ে যাবে। নৈতিকতার বানে ভেসে যাবে অন্যায়। কিন্তু কী দেখতে পাচ্ছি। ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আবারো আহত হয় আমাদের হৃদয় কিন্তু কোনোভাবে এই অপকর্মের বিলুপ্তি সম্ভব হয়ে উঠছে না। একটি মাত্র কারণ আমরা শুরু থেকে শুরু করতে পারছি না। প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ের কভার পেজে হয়তো ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ লেখা থাকলেও পাঠ্যসূচিতে নেই আলোর বিচ্ছুরণ। তাহলে কিভাবে আপনি আপনার সন্তানকে আলোকিত দেখতে চান? আর সমাজ আলোকিত তো অনেক দূর। এখনই সময় নতুন করে ভাববার। আমাদের দেশ, আমাদের স্বপ্নগুলো যেন অঙ্কুরেই বিনাশ না হয়। প্রিয় সন্তানগুলো যেন গড়ে উঠতে পারে দেশ ও জাতির জন্য। ওরা আগামীর বাংলাদেশ, আমাদের ভবিষ্যৎ। যারা আগামীর বাংলাদেশ গড়তে চায়; একটি দুর্নীতিমুক্ত, সুখী ও সমৃদ্ধ দেশের স্বপ্ন যাদের চোখে মুখে তাদেরকে গড়ে তুলতে হবে নৈতিকবোধসম্পন্ন ও আদর্শিক ও দেশপ্রেমী হিসেবে। আর সেই স্বপ্ন পূরণে এখনই প্রয়োজন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে চিন্তা করার। শিক্ষাব্যবস্থায় চাই নৈতিক পাঠের সমন্বয়। তাহলেই কেবল সম্ভব স্বপ্নের বাংলাদেশ কিংবা সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা। আমাদের এগিয়ে যেতেই হবে অনেক ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করতে হয়েছে, আরো অনেক পথ হয়তো আমাদের পাড়ি দিতে হবে। বিভেদের দেয়াল চৌচির করে ভ্রাতৃত্বের সৌধ নির্মাণের মাধ্যমে একটি কাক্সিক্ষত বাংলাদেশের প্রত্যাশায় আমরা শপথ নিই নতুন করে। লেখক : সম্পাদক, মাসিক প্রেরণা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির