post

বিপদ আসে ঝড়ের বেগে মিলিয়ে যায় বুদ্বুদ আকারে

৩০ জুন ২০১২
জাফর আহমাদ বাংলাদেশে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন এখন ঝড়ের কবলে পড়েছে। ইসলামের বৈরী ভাবাপন্ন সরকার কোনভাবেই ইসলাম ও ইসলামী দলকে সহ্য করতে পারছে না। তাই মিথ্যা অজুহাতে ইসলামী নেতৃবৃন্দকে অন্যায়ভাবে কারান্তরালে আটকে রেখেছে। ইসলামের অনুসারী কোন দলকে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার অগণতান্ত্রিকভাবে মাঠে-ময়দানেও দাঁড়াতে দিচ্ছে না। তাদের স্বাভাবিক অন্যান্য কার্যক্রমেও বাঁধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। নেতা-কর্মীদের যেখানে পাওয়া যাচ্ছে সেখান থেকে গ্রেফতার করে নতুন নতুন মিথ্যা মামলা টুকে জেলে পুরা হচ্ছে। রিমান্ডে নিয়ে মধ্য যুগীয় বর্বর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। নেতা-কর্মীরা বাসা-বাড়িতেও থাকতে পারছেন না,  ব্যবসা-বাণিজ্য ও স্বাভাবিক কাজ করতে পারছে না। একটি গণতান্ত্রিক দেশের এই চিত্র কি কল্পনা করা যায়? তবে ইসলামী আন্দোলনের জন্য এই দৃশ্য স্বাভাবিক। বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের বরৈন্য নেতা মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মুওদূদী (রহ) বলেছিলেন, ‘বিপদ আসে ঝড়ের বেগে, মিলিয়ে যায় বুদ্ বুদ্ আকারে।’ তিনি তাঁর এ উক্তির মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছেন যে, ইসলামী আন্দোলন মানে কোন কুসুমাস্তির্ণ পথ বা ফুলের বিছানা নয় অথবা  নিশ্চিন্তে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছার জন্য কায়েমী স্বার্থবাদী যারা দীর্ঘকাল থেকে রাস্তাটির অবৈধ দখল নিয়ে অত্যন্ত মজবুতভাবে বসে আছে, আর আপনার আগমনের সাথে সাথে রাস্তাটি ছেড়ে দিয়ে তারা দ’ুপাশে দাড়িয়ে যাবে কিংবা আশ্চর্যজনকভাবে একটি সুন্দর নিরাপদ পথ তৈরী হয়ে যাবে এমনতর আশা স্বপ্নে করা যেতে পারে। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের বাস্তবতার সাথে এর কোন যোগসুত্র নেই। যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে এমনটি খোঁজে পাওয়া যায়নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ট মানব আল্লাহর একান্তই প্রিয়জনদের ইতিহাস থেকে যেহেতু এমনটির নজির নেই। সুতরাং আমরাও এর ব্যতিক্রম আশা করতে পারি না। তবে এটিও সত্য যে, চরম এই ঘনঘটা দুর্যোগের মাঝে বরাবরই ইসলামী আন্দোলনের বিজয় হয়েছে। এটিও ইতিহাস স্বীকৃত। ইসলামী আন্দোলনের একজন কর্মী ভাল করেই জানে যে, ইসলামী আন্দোলন মানে নিজেকে বিশাল অগ্নীগর্ভে নিজেকে নিক্ষেপ করা, ইসলামী আন্দোলন মানে গভীর অরণ্যের তাবত হিংশ্র প্রাণীগুলোকে নিজেকে ছিঁড়ে ফেড়ে খাওয়ার জন্য আহবান জানানো, ইসলামী আন্দোলন মানে পাগলা কুকুরগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের পিছনে নিজেই লেলিয়ে দেয়া। ইসলামী আন্দোলন মানে স্বৈরাচারী শাসকদেরকে নির্যাতনের ষ্টীম রোলার চালানোর জন্য নিজেকে তাদের হাতে অর্পন করা, ইসলামী আন্দোলন মানে মখমলের বিছানা ছেড়ে দিয়ে অন্ধকার প্রকোষ্টে নিজের আবাস তৈরী করা, ইসলামী আন্দোলন মানে নিজের সকল প্রকার মান-সম্মান ও ইজ্জত আব্র“র ওপর জালিমদের মিথ্যা কালিমা লেপনের অনুমতি দেয়া, সর্বোপুরি ইসলামী আন্দোলন মানে প্রবল বেগে আসা মহা প্রলয়ঙ্ককারী ঘূর্নিঝড়ের আবর্তনে নিজেকে নিক্ষেপ করা। একজন ইসলামী আন্দোলনের কর্মী এতকিছু জেনে নিয়েই এ পথে পা বাড়ায়। যারা জানে না তারা পথিমধ্যে ছিটকে পড়ে। তবে শর্ত হলো, এই ঘনঘটা অন্ধকার দুর্যোগ দেখে বটকে গেলে চলবে না। মনে রাখতে হবে এবং বিশ্বাসও করতে হবে যে, বিপদ যখন আসে তখন ঝড়ের বেগেই আসে আর সেটি কেটে যায় বুদ বুদ আকারে। আরো বিশ্বাস করতে হবে যে, দুর্যোগের ঘনঘটা যা তৈয়ার করা হয়েছে, তা সবই মিথ্যা এবং মিথ্যার স্থায়ীত্ব খুবই কম হয়ে থাকে। তবে আমার জন্য যা করণীয় তাহলো, এ সময়টায় নিজের পা দূটিকে মজবুতভাবে জমিনের ওপর গেড়ে দিতে হবে, সিনাকে টান টান করে রাখতে হবে এবং হাত দু’টিকে শক্তভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে রাখতে হবে। সেই সাথে নিজেকে আল্লাহর হাওলায় সোপর্দ করে দিতে হবে এবং বেশি বেশি করে তাঁর সাহায্য কামনা করতে হবে। এই গুলো ধৈর্য্যরে উপাদানও বটে। ধৈর্যের এক অর্থ করা হয় যে, মুখ বুঝে অন্যের সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার  ও জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে যাওয়া। কিন্তু তা পুরোপুরি সঠিক নয়। বরং ধৈর্যের অর্থ হলো, অত্যন্ত সুকৌশলে (হিকমত সহকারে) পরিস্থিতির মোকাবেলা করা। নিজের সকল প্রকার যৌগ্যতার ব্যবহার সুনিশ্চিত করা। সকল পরিস্থিতিতে ঠিকে থাকার জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা। এবং যে কোন সময়ের তুলনায় আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া। সবর শব্দটির শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, বাধা দেয়া, বিরত রাখা ও বেধেঁ রাখা। শাব্দিক অর্থের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে প্রবৃত্তির আশা-আকাংখাকে এমনভাবে শৃংখলাবদ্ধ করা যাতে ব্যক্তি প্রবৃত্তির তাড়নায় ও বাইরের সমস্যাবলীর মোকাবেলায় নিজের হৃদয় ও বিবেকের পছন্দনীয় পথে অনবরত চলতে পারে। এ গুণের বদৌলতে মানুষ সুদৃঢ়ভাবে দাড়িয়ে বা টিকে (জবংরষরবহপব) থাকার এক বিশেষ ক্ষমতা লাভ করে। অর্থাৎ চারদিক থেকে প্রবলবেগে আসা ঘুর্ণি ঝড়ের ন্যায় আপদ ও বিপদের চাপে সামান্যতমও ধুমরে-মুচরে যায় না কিংবা খুব সহজেই নড়াচড়া বা হেলে-দুলে যায় না। কুরআন ও হাদীসে এ অসাধারণ গুণটির গুরুত্বারোপ করা হয়েছে অত্যধিক। প্রথম মহামানব প্রথম নবী হযরত আদম (আ) থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী মানবতার মহান বন্ধু হযরত মুহাম্মদসহ সঃ সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম, সাহাবা আজমাইন ও আল্লাহ তায়ালার প্রিয়জনেরা এ ধৈর্যের পাথরে নিজেদেরকে বাধাঁই করেছিলেন। আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে ধৈর্যের উপদেশ দিতে গিয়ে সূরা আহকাফের ৩৫ নং আয়াতে বলেন, “তুমি ধৈর্য ধারন করো যেমনিভাবে আমার দৃঢ়প্রতিষ্ঠ ও সাহসী নবীরা ধৈর্য ধারন করেছিল।” ধৈর্যের অদম্য শক্তিতে বলীয়ান আল্লাহর এ প্রিয়জনেরা অন্তহীন বিপদের সময় পাহাড়ের ন্যায় অবিচল দাঁড়িয়ে থাকতে সমর্থ হয়েছেন। শত নির্যাতন, অসহনীয় কঠিণ মহুর্তেগুলোতে ইস্পাত-কঠিণ ও সুদৃঢ় মজবুত ধৈর্যের বন্ধনে নিজেদের বেঁধে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে তাঁদের প্রত্যেকেই দুনিয়ার জীবনে সাফল্য পেয়েছিলেন। সত্যিই পৃথিবীর প্রতিটি কাজের সাফল্যের সাথে সবরের একটি গভীর যোগসুত্র রয়েছে। কারণ কণ্টকাকির্ণ এ পৃথিবী  মানুষের জন্য কখনো ফুলের বিছানা ছিল না। পৃথিবীর প্রতিটি কাজই কষ্ট সাধ্য ব্যাপার। এ কষ্টকে সহজতর করার জন্য ধৈর্য্যের কোন বিকল্প আবিস্কৃত হয়নি বা আর হবেও না। পৃথিবীর অমুসলিমসহ সকল মুসলিম স্কলারগণ একটি বিষয়ে ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন যে, বিনাশ্রমে কোনরূপ কঠিণ পরীক্ষা ছাড়া, অতি সহজে কোন কিছু হাসিল করা হলে, তা রক্ষা করার ক্ষমতা কারো থাকে না। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আসলে সংকীর্ণতার সাথে প্রশস্ততাও আছে।” (সূরা আলাম নাশরাহ : ৪) এই কথাটি দু’বার বলা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা) যেই কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন. তা বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকবে না বরং এরপর খুব শিগগির ভালো অবস্থা শুরু হবে, এ কথা তাঁকে বুঝিয়ে দেয়াই ছিল এ আয়াতের উদ্দেশ্য। আপাত দৃষ্টিতে সংকীর্ণতা ও প্রশস্ততা পাশাপাশি একই সময় একসাথে হতে পারে না। অথচ আল্লাহ বলছেন,“ সংকীর্ণতার সাথে প্রশস্ততাও আছে।” এর অর্থ হলো, কষ্টের পর সুখ এতটাই কাছাকাছি যেন মনে হচ্ছে যে, সাথে সাথেই চলে আসছে। রাত যত গভীর হয়, প্রভাত তত কাছে চলে আসে। তদ্রুপ বিপদ ও কষ্টের রাত যত গভীর হবে, মুক্তির সোনালী প্রভাত তত কাছে চলে আসে। তবে শর্ত হলো রাতের এ সময়টুকু অতিবাহিত করার জন্য অবশ্যই ধৈর্য্যকে সাথে নিতে হবে। ধৈর্যহীন মানুষ কখনো সাফল্যের সোনালী প্রভাতের দেখা পায় না। ধৈর্যহীন ব্যক্তি রাতের প্রথম ভাগেই  অথবা মধ্য রাতের আগেই রণভঙ্গ দিয়ে পালাবার পথ খুঁজতে থাকে। অধৈর্য তাকে তাড়া করে ফিরে। একটি ছোট্ট কাজেও ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। অধৈর্য একটি মানুষিক রোগও বটে। এ রোগ কাউকে কোন কাজের সফলতার দ্বার প্রান্তে পৌঁছতে দেয় না। আল্লাহর পথের যাত্রীদের জন্য তো এটি একটি অত্যাবশ্যকীয় বা অপরিহার্য্য বৈশিষ্ট্য। সবর ছাড়া কেহ এ পথে এক কদম চলার চিন্তাও করতে পারে না। পূবেই বলা হয়েছে এ পথ বরাবরই রক্তসিক্ত। ঈমানী পরীক্ষায় ভরপুর এ এক রক্তাক্ত ইতিহাস। দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, সমুদ্রের তর্জন-গর্জন ও বিশাল তরঙ্গ মালা পেরিয়ে, জালিমের রক্তচক্ষু ও শত উন্মুক্ত কৃপাণকে উপেক্ষা করে এরপর এ পথের যাত্রীদের সাফল্যের সোনালী মনজিলে পৌঁছতে হয়। এটিই সৃষ্টার দেয়া আমোঘ নিয়ম। কারণ ইসলামী অনুশাসণ প্রতিষ্ঠার চেয়ে ধরে রাখা আরো কঠিন বিধায় এ পথের যাত্রীদের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। যারা এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য ধৈর্য নামক বিষয়টিকে কড়ায় গন্ডায় আয়ত্ব করতে হবে। অন্যথায় পরীক্ষায় নিশ্চিত শোচনীয় পরাজয় বা ফেল করতেই হবে। তাছাড়া মানব সম্প্রদায়ের ইতিহাস যত পুরাতন, শয়তানের ষড়যন্ত্রের জাল তখন থেকেই পৃথিবীর আনাচে কানাচে বিস্তৃত করে রেখেছে। এ জালকে ছিন্ন করে আল্লাহর দ্বীনের পতাকাকে উড্ডীন রাখার জন্য ধৈর্যকে সাথে নিতে হয়। আবহমান কাল ধরে বীর মুজাহিদেরা এর প্রমাণ রেখে এসেছেন। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, “হে ঈমাদারগণ! (সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায়) ধৈর্য ধারণ করো, (এ ব্যাপারে) একে অপরে প্রতিযোগীতা করো, (ঈমানের ব্যাপারে) সদা সুদৃঢ় থেকো, আল্লাহকে ভয় করো, তাতে তোমরা সফলকাম হবে।” (সূরা আলে ইমরান : ২০০) লেখক : ব্যাংকার

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির