post

ভারতে হিন্দু

এবনে গোলাম সামাদ

০১ জুন ২০২২

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ দিয়ে জার্মানিতে ঘটেছিল নাৎসিবাদের উদ্ভব। নাৎসিবাদের অন্যতম গোড়ার কথা ছিল ‘আর্যতত্ত্ব’। নাৎসি দল দাবি করেছিল জার্মানরা হলো খাঁটি আর্য। আর্যরা সৃষ্টি করেছে বিশ্বের নানা স্থলে নানা সভ্যতা। জার্মান জাতিকেও করতে হবে অনুরূপ সভ্যতার প্রতিষ্ঠা। বিশ্বে স্থাপন করতে হবে শান্তিশৃঙ্খলা।

আর্যবাদের ভিত্তি ‘আর্য’ শব্দটা এসেছে বৈদিক সংস্কৃত ভাষা থেকে। শব্দগত অর্থে সম্ভ্রান্ত। লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস (Warren Hastings) ১৭৮৪ সালে স্থাপন করেন, অ্যাসিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল (Asiatic Society of Bengal) নামে প্রাচ্য গবেষণা কেন্দ্র। এর প্রথম সভাপতি হন, ভাষাতাত্ত্বিক উইলিয়াম জোন্স (William Jones)। ইনি কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসাবেও নিয়োগ পান। ভাষাতাত্ত্বিক জোন্স অভিমত দেন যে, গ্রিক, লাতিন, জার্মান, ইংরেজি, কেলটিক, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষা আদিতে ছিল এক। অর্থাৎ একটি আদি ভাষা থেকে ক্রমশ পৃথক হয়ে হতে পেরেছে এইসব ভাষার উৎপত্তি। এই আদি ভাষার উদ্ভব যাদের মধ্যে হতে পেরেছিল, সেই জাতির নাম জোন্স দেন উইরোজ (Wiros))। পরে জার্মান ভাষাতাত্ত্বিক ম্যাক্স ম্যুলার (Max Mullar, 1823-1900) এদের নামকরণ করেন আর্য (Aryans)। তিনি বলেন, আর্য জাতির আদি নিবাস ছিল মধ্য এশিয়ার আইরিনা নামক দেশে। সেখান থেকে তারা ছড়িয়ে পড়ে নানা জায়গায়। গড়ে সভ্যতা। আর্যরা প্রথম চাকা আবিষ্কার করে। বানায় চাকাযুক্ত ঘোড়ায় টানা রথ। রথে চড়ে তীর-ধনুক দিয়ে যুদ্ধ করত আর্যরা। তাই তাদের সঙ্গে যুদ্ধে এঁটে উঠতে পারত না কেউ। জার্মান আর্যবাদ জার্মানিতে নাৎসিরা বলেন, তারা হলেন খাঁটি আর্য। জার্মান ইহুদিরা তা নন। জার্মান ইহুদিদের নিধন করে জার্মানকে করতে হবে বিশুদ্ধ জার্মান। জার্মানিতে শুরু হয় ইহুদি নিধন। বলা হয়, হিটলারের শাসনামলে প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদিকে মেরে ফেলা হয়েছিল গ্যাস চেম্বারে। ভারতে এখন কতকটা একইভাবে বলা হচ্ছে, মুসলমানরা আর্য নয়। হিন্দুরা হচ্ছেন আর্য। হিন্দুদের খাঁটি হিন্দু করতে হলে, করতে হবে দেশ থেকে মুসলিম বিতাড়ন। জার্মান নাৎসিবাদ প্রচার করেছিল ইহুদিবিদ্বেষ। বিজেপি প্রচার করছে মুসলিমবিদ্বেষ। আমি বুঝি না কেন কী কারণে এই উপমহাদেশে ইতিহাস লিখতে গিয়ে আর্যদের ওপর ঐতিহাসিকরা এতটা গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ, মহেনজোদারোতে ১৯২৩ সালে আবিষ্কৃত হয়েছে খুবই উন্নতমানের সভ্যতা। যাকে অধিকাংশ ঐতিহাসিক এখন বলছেন, অনার্য সভ্যতা। আর্যদের কোন লিখিত সাহিত্য ছিল না। অর্থাৎ তাদের ছিল না অক্ষরজ্ঞান। কিন্তু মহেনজোদারোবাসীদের তা ছিল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ ১৯৬২ থেকে ৬৫ সালের মধ্যে বর্ধমান জেলার পান্ডু রাজার ঢিবি নামক স্থানে এবং সন্নিকটস্থ বিরভূম জেলার মহিশাদল নামক জায়গায় খননকার্য চালান। এর ফলে আবিষ্কৃত হতে পেরেছে খ্রিষ্টপূর্ব দেড় হাজার সালের কাছাকাছি সময়ের ঐ অঞ্চলে এক প্রাক-আর্য সভ্যতার নিদর্শন। ঐ অঞ্চলের মানুষ ধান চাষ করত, তামার তৈরি বড়শি দিয়ে মাছ ধরত। নানা রকম গড়নের এবং নকশা সমৃদ্ধ পোড়ামাটির পাত্র ব্যবহার করত। কিন্তু তথাপি বিজেপি এখন গৌরব করছে কেবলই ভারতের আর্য সভ্যতা নিয়ে। আর পেতে পারছে বিপুল জনসমর্থন। তবে এই সমর্থন পাবার একমাত্র কারণ, আর্য সভ্যতা নিয়ে গৌরব করা নয়, এর মূল কারণ মুসলিমবিদ্বেষের প্রচার। যেমন জার্মানিতে ছিল ইহুদিবিদ্বেষ প্রচার, যা নাৎসিদের করেছিল বিশেষভাবে জনপ্রিয়। সেটা ১৯৬৬ সাল। তখন বাংলাদেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান। তিনি একটা বই লিখেন, যার নাম হলো ‘সাম্প্রদায়িকতা’। জানি না কেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু খ্যাতনামা শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও উনি আমাকে বইটার একটি সমালোচনা লিখতে বললেন। আমি একটি সমালোচনা লিখি, যা প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘সমকাল’ নামক মাসিক পত্রিকায়। আমার সমালোচনা পড়ে উমর সাহেব খুব ক্ষুব্ধ হন। কেননা, আমি বলেছিলাম সাম্প্রদায়িকতা ব্যাপারটা কেবল মুসলমানকেন্দ্রিক নয়। হিন্দুরাও সাম্প্রদায়িকতার জন্য বিশেষভাবে দায়ী। এই উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব কেবল মুসলমানের জন্য সৃষ্টি হয়নি। এর সৃষ্টি হতে পেরেছে হিন্দুদের মুসলমানকে ম্লেচ্ছ ভাবার জন্য। বদরুদ্দীন উমর দীর্ঘ জীবন লাভ করেছেন। আমি তার দীর্ঘায়ু কামনা করি। তিনি এখনও বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রসঙ্গে স্তম্ভ রচনা করে চলেছেন। জানি না, তিনি ভারতে এখন যে হিন্দু নাৎসিবাদের উদয় হয়েছে, সে সম্পর্কে কী বলেন। আসলে এ দেশের সব বাম চিন্তক এক সময় ভেবেছেন যে, মুসলমানরা হলেন ধর্মান্ধ। কিন্তু হিন্দুরা তা নন। যেটা ছিল একটা গুরুতর ভুল। আমার খুব অদ্ভুত লেগেছিল যে, উমর তার পিতা বিখ্যাত মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিম (১৯০৫-১৯৭৪)-এর হাত ধরে প্রাণ ভয়ে বর্ধমান ছেড়ে পালিয়ে আসেন ঢাকায়। কিন্তু তিনি লিখতে পারছেন, সাম্প্রদায়িকতার মত বই; মুসলমানকে খাটো করে। উমর দাবি করতেন, তিনি মার্কসবাদী। কার্ল মার্কস মানুষের ইতিহাস ব্যাখ্যায় দিয়েছেন অনেক ক্ষেত্রে অর্থনীতির ওপর অধিক গুরুত্ব। যা পাওয়া উচিত নয়। তিনি মানুষের মনকে করে ফেলেছেন নিষ্ক্রিয়। কিন্তু মানুষের মনে আছে ধর্মের বিরাট প্রভাব। মানুষ পরিচালিত হয় ধর্মীয় ধ্যান ধারণার দ্বারাও। কার্ল মার্কসের প্রপিতামহ ছিলেন ইহুদি। কিন্তু কার্ল মার্কসের পিতা গ্রহণ করেন লুথেরান খ্রিস্টান ধর্ম। জার্মানিতে এক সময় লুথেরান, প্রটেস্টান্ট ও ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের মধ্যে ঘটতে পেরেছে রক্ত-ক্ষরা সংঘাত। যা কেবল অর্থনীতি শাস্ত্রের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা যায় না।

বঙ্কিমচন্দ্রের রাষ্ট্র ও হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদ বিখ্যাত সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) ‘বাঙ্গালীর উৎপত্তি’ নামক একটি প্রবন্ধ লেখেন। এতে তিনি বাংলাভাষী মানুষকে এক জাতি বলতে চাননি। বলেছেন, বাংলাভাষী মানুষ আসলে হলো বহুজাতি। তিনি ইংরেজকে বলেছেন একজাতি। যদিও তারা গঠিত হয়েছে স্যাকসন, নর্মান ও ডেনদের সংমিশ্রণে। কিন্তু নর্মান, স্যাকসন ও ডেনরা সকলেই আদিতে হলেন আর্য বংশোদ্ভব। পক্ষান্তরে বাংলা ভাষাভাষীরা সকলে আর্য বংশোদ্ভব নয়। তাদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় চার রকম মানুষ। এক রকম মানুষকে বলা চলে আর্য বংশোদ্ভব। আর্য বংশোদ্ভবের বিশুদ্ধ দৃষ্টান্ত হলো বাংলাভাষী ব্রাহ্মণ। এ ছাড়া বাংলাভাষী মানুষের মধ্যে আছে কোল বংশোদ্ভব মানুষ। আছে দ্রাবিড় বংশোদ্ভব জাতি। আছে কোল ও দ্রাবিড় সংমিশ্রণে উদ্ভূত জনসমষ্টি। আর আছে বাংলাভাষী মুসলমান। এরা একে আরেক থেকে পৃথক থাকতে চায়। নিজেদের মনে করে না অন্যদের সঙ্গে গাঁথা। বঙ্কিমচন্দ্র অনেক উপন্যাস লেখেন। এর মধ্যে একটি হলো ‘আনন্দমঠ (১৮৮২)’। এতে আছে হিন্দু সন্ন্যাসীদের হিন্দু রাষ্ট্র গড়ে তুলবার চেষ্টার কথা। পরে বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের সন্ন্যাসীদের অনুকরণে বাংলাদেশে গড়ে ওঠে ‘অনুশীলন সমিতি’ নামে একটা সন্ত্রাসবাদী দল। ব্রিটিশ শাসন আমলে নাগপুর থেকে কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে আসেন কেশব বলরাম হেজওয়ার। তিনি কলকাতায় ছাত্র অবস্থায় আসেন অনুশীলন সমিতির সংস্পর্শে। ইনি কলকাতায় তার পাঠ শেষ করে ফিরে যান নাগপুরে। ১৯২৫ সালে গড়েন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS) নামে দল। যার লক্ষ্য হয় বল প্রয়োগের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে একটা আদর্শ হিন্দু-রাষ্ট্র গড়া। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের নেতৃত্ব পরে আসে মাধব সাদাশিব গোলওয়াকার (Madhab Sadashiv Golwalkar) নামক নেতার হাতে। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অকুণ্ঠ সমর্থন জানান হের হিটলারকে; তাঁর আর্যবাদী ধ্যান ধারণার জন্য। রাষ্ট্রী স্বয়ংসেবক সংঘকে নির্ভর করেই গড়ে উঠতে পেরেছে ভারতের বর্তমান শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। যা চাচ্ছে বৈদিক আদর্শে ভারতীয় সমাজ জীবনকে গড়ে তুলতে। হিন্দুত্বের আওয়াজ তুলে ভারতের জাতীয় ঐক্যকে মজবুত করতে।

সাভারকারের হিন্দুত্ব হিন্দুত্ববাদের চিন্তা-চেতনার একটা উৎস হিসেবে কাজ করছে বিনায়ক দামোদর সাভারকার-এর চিন্তা-চেতনা। বিনায়ক দামোদর সাভারকার (১৮৮৩-১৯৬৬) ছিলেন মারাঠি। তিনি বিশেষভাবে প্রচার করেন হিন্দুত্বের ধারণা। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড মুসলিমবিদ্বেষী। তিনি বলেন মুসলমানরা কেবল বিধর্মী নয়; তারা হলো বিদেশী। বিদেশ থেকে তারা এসে ভারতে রাজত্ব করছে। যেখান থেকে তারা এসেছে, সেখানে তাদের বিতাড়িত করতে হবে। যতগুলো কারণে পাকিস্তান আন্দোলন জোরালো হয়ে ওঠে, সারা ভারতের মুসলমানরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিকে সমর্থন করেন, তার একটা কারণ হলো বিনায়ক দামোদর সাভারকার-এর এই মুসলিম বিতাড়নের আওয়াজ। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। এতে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন: তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। খেলার দিকে আর নজর নাই। (শেখ মুজিব ভালো ফুটবল খেলতেন) শুধু মুসলিম লীগ আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচবার উপায় নাই (পৃষ্ঠা ১৫)। তিনি তাঁর এই অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আরও বলেছেন: আমাদের বাঙালিদের মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো আমরা মুসলমান, আর একটা হলো আমরা বাঙালি (পৃষ্ঠা ৪৭)। শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী একটা মূল্যবান রাজনৈতিক দলিল। অনেকের লেখা পড়লে মনে হয়, বাংলাভাষী মুসলমান পাকিস্তান চায়নি। পাঞ্জাবি মুসলমানরা পাকিস্তানকে জোর করে চাপিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা বাংলাভাষী মুসলমান পাকিস্তান চেয়েছিলেন বলেই পাকিস্তান হতে পেরেছিল। না হলে হতে পারত বলে মনে হয় না। ব্রিটিশ শাসন আমলে সারা ভারতের মোট মুসলমানের শতকরা প্রায় ৩৫ ভাগ মুসলমান বাস করতেন তখনকার বাংলা প্রদেশে। ১৯৪৬ সালের আইনসভার নির্বাচনে একমাত্র বাংলা ও সিন্ধু প্রদেশ ছাড়া আর কোথাও মুসলিম লীগ নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি। লাহোরের চাইতে কলকাতা ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের অনেক জোরালো ঘাঁটি। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র। সেখানকার ছাত্ররা পাকিস্তান আন্দোলনে নিয়েছিলেন উল্লেখযোগ্য অংশ। ইসলামিয়া কলেজের এখন নাম হয়েছে মাওলানা আবুল কালাম কলেজ।

লেখক : বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট

[ঘোষণা : এবারের বইমেলা ২০২০-এ এবনে গোলাম সামাদের দেশ, জাতি, সমাজ, বর্তমান পরিস্থিতি এবং বর্তমানে আমাদের করণীয় কী, তা নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী বই ‘আমার স্বদেশ ভাবনা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে ‘পরিলেখ’ প্রকাশনী থেকে। বইমেলায় পাওয়া যাবে পরিলেখের ৭১৩ নং স্টলে।]

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির