post

ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয় ও আমাদের বিচারব্যবস্থা । মুহাম্মদ আবদুল জব্বার

০৩ আগস্ট ২০১৯

ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয় ও আমাদের বিচারব্যবস্থা । মুহাম্মদ আবদুল জব্বারওহ! কী অমানবিক! ক’দিন আগে ঢাকার ওয়ারীতে সাত বছরের শিশু সামিয়া আফরিন সায়মাকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় প্রতিটি বিবেকবান মানুষের হৃদয় কেঁদেছে! বরগুনায় দিনদুপুরে জনসম্মুখে রামদা দিয়ে কুপিয়ে রিফাত হত্যার মতো বর্বরতায় সবাই আঁতকে উঠেছে! সর্বত্র যেন কবরের সুনসান নীরবতা! এ যেন আরো একটি নির্দয় ঘটনা সংঘটিত হতে চলেছে! না জানি কখন আমি বা আমার পরিবারও এহেন ঘটনার শিকার হচ্ছি। এই আত্মজিজ্ঞাসা যেন প্রতিটি মানুষের। এই ধরনের অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি রুখবে কে? সমাজ রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ যেন নির্বিকার। দেশের প্রতিটি নাগরিক মুক্তির প্রত্যাশায় হন্যে হয়ে মুখিয়ে আছে। এমন পরিস্থিতি থেকে দেশের মানুষকে বাঁচানো আজ সময়ের অনিবার্য দাবি। নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার বিশ্বজিতের পরিবার সুবিচারের আশায় বুক বেঁধেছিল। সময়ের পরিক্রমায় ওই ঘটনার সাথে জড়িত প্রকৃত আসামিদের যথাযথ বিচার নিশ্চিত হয়নি। ইতঃপূর্বে দেশে এমন কতই না ঘটনা ঘটেছিল। প্রতিটি নির্মম ঘটনা নিয়ে মিডিয়া, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও সুশীলসমাজে হইচই হলেও কোন ঘটনার প্রকৃত সুরাহা হয় না। কে জানে মাদরাসাছাত্রী নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সুবিচার আদৌ হবে কিনা! বিবেকবান প্রতিটি মানুষ মনে করে সংঘটিত সকল ঘটনার ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত না হওয়ার কারণে সর্বত্র নৈতিক অধঃপতন মানুষের মধ্যে হু হু করে বেড়েই চলছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় একদল মানুষ তাদের মনুষ্যত্ব হারিয়ে অপরাধে লিপ্ত হওয়ার এক অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। তারা আইন আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিষিয়ে তুলেছে। এর পেছনের কারণ হলো, সমাজপতিরা এসব দুষ্টু চক্রের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এ ছাড়াও প্রকৃত অপরাধীরা বিচারিক দুর্বলতা ও প্রশাসনিক অপরাজনীতির কারণে পার পেয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে দেশের মানুষ প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও বিচারকের ওপর আরো বেশি আস্থা হারাবে। যার ইফেক্ট সমাজ-রাষ্ট্রে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়বে, এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। প্রকৃত অপরাধীদেরকে আড়াল করতে পুলিশ প্রশাসনের একদল ক্রীড়নক নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। ক’দিন আগে সোনাগাজীতে নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সিরাজউদদৌলাকে রক্ষা করতে থানার ওসি মোয়াজ্জম হোসেন কী না করেছে? তিনি অপরাজনীতি ও অর্থের কাছে নিজের দায়িত্ববোধকে বিকিয়ে দিয়েছেন! যদিওবা মিডিয়ার যথাযথ ভূমিকার কারণে ওসি মোয়াজ্জম তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এমনি কত ঘটনা লোক চোখের অন্তরালে সমাজে ঘটেই চলছে তার ইয়ত্তা কে বা রাখে? আমাদের দেশে যখন কোনো খুন খারাবির ঘটনা খুব আলোচিত হয়, তখন কমন পিকচার হলো ক্রসফায়ারের নামে অভিযুক্ত আসামিকে হত্যা করা। এর মধ্য দিয়ে একটি ঘটনার অপমৃত্যু হয়। কিন্তু মূল অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। দেশে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ অতিপরিচিত নাম। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালেই দু’চারজন ক্রসফায়ারের অভিযুক্ত আসামির নিহতের খবর দেখা মিলে। অধিকাংশ ঘটনার বিবরণ পুলিশের বরাত দিয়ে ক্রসফায়ারের নিউজ প্রচার করে মিডিয়া। ঠিক এমন ভাষায়-‘অমুক স্থানে অমুক আসামি অবস্থান করছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ অভিযান পরিচালনা করে, পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে পুলিশ পাল্টা গুলি ছুড়ে। এতে সন্ত্রাসী চক্রের প্রধান অমুক গুলিবিদ্ধ হয়ে অথবা সংঘর্ষ চলাকালে নিজেদের গুলিতে মারাত্মকভাবে জখম হয়ে নিহত হয়।’ আমজনতা এমন ঘটনায় এক সময় পুলকিত হলেও এখন তা বিশ্বাস করে না। কারণ এর অধিকাংশ ঘটনা বানোয়াট ও সাজানো। এ ছাড়াও এর মধ্য দিয়ে ঘটনার প্রকৃত খল নায়করা আইনের বেড়াজাল থেকে রেহাই পেয়ে যায়। যার ফলে সমাজ থেকে অন্যায় অবিচার সমূলে মূলোৎপাটন করা সম্ভব হয় না। একসময় প্রকৃত সন্ত্রাস দমনের উদ্দেশ্যেই ক্রসফায়ারের মতো ঘটনা ঘটত। তখন সাধারণ মানুষ এমন ঘটনাসমূহকে সাধুবাদ জানাত, আর এখন প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতে পুলিশ ক্রসফায়ারকে পুঁজি করে ঘটনার নেপথ্য শক্তিকে রক্ষা করতে ক্রসফায়ারের নাটক সাজাচ্ছে বলে অহরহ অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি বরগুনার কলেজছাত্র রিফাত হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামি নয়ন বন্ড পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা সবাই জানে। সিসি টিভির ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, গত ২৬ জুন বুধবার সকাল থেকেই বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে নানা পরিকল্পনা করতে থাকে ‘বন্ড ০০৭’ গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা। হঠাৎ কলেজ থেকে তারা জোর করে রিফাত শরীফকে বের করে নিয়ে যায়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ওইদিন সরাসরি ১৫ থেকে ২০ জনের মতো লোক জড়িত ছিল। তবে কিলিং মিশনে মূল ভূমিকা পালন করে আসামি রিফাত ফরাজি। সকাল ১০টা ১৩ মিনিটে ঘাতক রিফাত ফরাজি নিহত রিফাত শরীফকে বরগুনা সরকারি কলেজের গেটে এসে গ্রুপের সদস্যদের সহায়তায় জোর করে নয়ন বন্ডের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে সবাই তাকে কিল ঘুষি মারতে থাকলেও রিফাত ফরাজি ও একজন দৌড়ে গিয়ে তিনটি রামদা নিয়ে আসে। রিফাত ফরাজির দুই হাতে থাকা দু’টি দায়ের একটি নয়নকে দেয় ও আরেকটি দিয়ে নিজেই কোপাতে শুরু করে। (সূত্র : ৭/৭/২০১৯ এর অধিকাংশ জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় এই ঘটনার বিবরণ প্রকাশিত হয়)। বিভিন্ন পত্রিকার খবরে প্রকাশিত হয়েছে- বরগুনা আওয়ামী লীগের দুই বিবদমান গ্রুপের নেতারা বলেছিলেন, ‘নয়ন আমাদের নয়, ওদের লোক।’ নয়ন বন্ড বেঁচে থাকলে হয়ত বলতে পারতেন, সত্যি সত্যি তিনি কার লোক ছিলেন। এমন ঘটনা শুধু বরগুনা নয়, আরও অনেক ঘটনায় দেখা গেছে, কোনো অপরাধী বা সন্ত্রাসী হাতেনাতে ধরা পড়লে নেতারা অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। এটা কারও অজানা নয় যে, রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে থাকেন। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে তারা খুবই পারঙ্গম। অভিযোগ আছে, নয়ন বন্ড আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাকে যুবলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় থাকতে দেখা যেত। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বলেছেন, নয়ন ছিলেন সাংসদ পুত্র সুনাম দেবনাথের খুবই ঘনিষ্ঠ। আর সাংসদ পুত্রের অভিযোগ, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানই তাদের আশ্রয়দাতা। জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ওই শীর্ষ নেতার ছত্রছায়ায়ই মূলত নিজের সন্ত্রাসের রাজত্ব গড়ে তোলে নয়ন বন্ড। এমনকি রিফাত শরীফকে হত্যার পর ওই নেতা নয়ন বন্ডকে ছাত্রলীগের কর্মী বলেও গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। যদিও তা অস্বীকার করে পাল্টা বিবৃতি দেন বরগুনা জেলা ছাত্রলীগ। প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় থাকায় তাকে কেউ কিছু বলারও সাহস পেত না। এ ছাড়াও আসামি রিফাত ফরাজী বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, সাবেক এমপি এবং বর্তমানে বরগুনা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের আপন ভাগ্নে। (সূত্র : ২৯/৫/১৯ দৈনিক যুগান্তর)। এই ঘটনায় অনেকে মনে করেন রিফাত ফরাজীকে জিজ্ঞাসাবাদেই ঘটনার মূলনায়ক কে তা জানা যাবে। রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করার কথা বললেও বর্তমানে তা কেবলমাত্র নীতিবাক্যের রূপ ধারণ করেছে! আমাদের বিচারিক ব্যবস্থা কতটা দুর্বল তা অপরাধে সংঘটনের মাত্রাতিরিক্ততার পুনরাবৃত্তিতে তা সহজে অনুমেয়। কারণ আইন আদালতে নয়ন বন্ডরা যে কারখানায় তৈরি হয় সে কারখানার মালিক ও পৃষ্ঠপোষকদেরকে বধ করতে পারেনি। যতদিন পর্যন্ত প্রকৃত অপরাধীদের যথোপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত না হবে ততদিন দেশের সর্বত্র নয়ন বন্ডরা জন্ম লাভ করতেই থাকবে! এ দায় কার? কেনইবা স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরেও বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে? ত্রুটিপূর্ণ ও অপরিপূর্ণ বিচারকার্যক্রমের কারণে কত জজ মিয়া ও জাহালমের কারান্তরালে জীবন-যৌবন সব নিঃশেষ হয়ে যায়! আমজনতার কাছে বিচারকদের ওপর ফরিয়াদির বিশ্বাস নেই বললে চলে। কারণ বিচারকরা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও আর্থিক প্রভাবে প্রকৃত অপরাধীর বিরুদ্ধে যথার্থ রায় দিতে পারেন না। বাজারে কমন কথা প্রচলিত আছে ‘জোর যার মুল্লুক তার’। নির্যাতিতরা সবসময় সুবিচার বঞ্চিত হয়। এহেন পরিস্থিতির বিহিত একটা হওয়া প্রয়োজন। কারণ আইন আদালতের মারপ্যাঁচে অকারণে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনের নীরবতা, রাজনৈতিক আশ্রয়ে এমন অপরাধীরা সদর্পে ঘুরে বেড়ায়, ত্রাস সৃষ্টি করে। নতুন নতুন অঘটন ঘটায়। প্রকৃত বিষয় হলো সরকার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারলে এমন অরাজক ভয়াবহ সামাজিক ত্রাস থেকে মানুষকে বাঁচানোর কোনো উপায় নেই। তাই প্রয়োজন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও সৎ যোগ্য নেতৃত্বকে দেশপরিচালনার দায়ভার গ্রহণ করা। অসৎ, অযোগ্য, স্বার্থপর নেতৃত্ব দিয়ে কোন জাতির ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হতে পারে না। লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির