post

মধ্যবর্তী নির্বাচন ও কিছু কথা

সামছুল আরেফীন

২৮ জুলাই ২০১৫
ঘুরে ফিরেই এখন মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা সামনে চলে আসছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার খবরও মিডিয়ায় আসছে। মধ্যবর্তী নির্বাচন সহসাই অনুষ্ঠান হবে কিনা এবং হওয়া উচিত কি উচিত নয়- কিছুটা বিরতি দিয়ে নতুন করে এ নিয়ে আবার আলাপ-আলোচনা চলছে। তবে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে বিদেশীদের দিক থেকে চাপ আরও প্রবল হয়েছে। আর ২০ দলের পক্ষ থেকেও নির্বাচনের দাবি জোরালো হচ্ছে। ঈদের পর দল পুনর্গঠনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। তবে সরকারের একটি অংশ মনে করছে, অপ্রস্তুত অবস্থায় নির্বাচন দেয়া হলে সরকারই লাভবান হবে বেশি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের সময়ই ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে পশ্চিমা দেশ এবং গুরুত্বপূর্ণ দাতাদের এমন বার্তা দেয়া হয়েছিল যে, ওই নির্বাচনটি নিয়ম রক্ষার জন্য ও যথা শিগগিরই সম্ভব সব দলের অংশগ্রহণে নতুন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হবে। সেই থেকে মধ্যবর্তী বা নতুন একটি নির্বাচনের সম্ভাবনার কথা পশ্চিমা দুনিয়ায় এবং দেশের নানা পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা চলছিল। কিভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানটি সম্ভব তা নিয়ে বিএনপির সমর্থক পেশাজীবীদের পক্ষ থেকে একটি উদ্যোগও ওই দলটির মধ্যে বজায় ছিল কিছুকাল। কিন্তু এটা খুব একটা এগোয়নি, মূলত সরকারের দিক থেকে কোনো সঙ্কেত না পাওয়ায়। ওই পেশাজীবীদের একটি অংশের পক্ষ থেকে বিএনপির মধ্যে এই ধারণার জন্ম দেয়া হয়েছিল যে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়াটা হবে নতুন একটি সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়ায়, দেশী-বিদেশী কেউই আর বিশ্বাস করতে পারছেন না যে, এই সরকারের অধীনে কোনো অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরপরই ওই নির্বাচন যথাযথভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং ভোটারবিহীন বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছরই হবে- প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের পক্ষ থেকে এ কথা বারবার বলা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সরকারের ওপরে নতুন একটি নির্বাচনের চাপ পশ্চিমা দুনিয়ার পক্ষ থেকে রয়েছে। ২০১৪-এর নির্বাচনের সময় সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি চাপ ছিল বেশ বড়ভাবে। তবে এই দফার ব্যাপক এই চাপটি আসে ২০১৫-এর প্রথমদিকের আন্দোলনের সময়ই। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এই পর্যায়ে মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশের সঙ্কট নিরসনের দায়িত্ব দেন অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে। তারানকো ক্ষমতাসীনদের সাথে সরাসরি আলাপের জন্য ঢাকায় আসতে চেয়েছিলেন এবং এমন ইচ্ছার কথা তিনি জানিয়েও ছিলেন তাদের। সরকারের অনাগ্রহ এবং অসহযোগিতার কারণে তিনি তখন ঢাকা সফর করতে পারেননি। এরপরের চাপটি আসে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে এবং পরে। মূলত তিন সিটিতে কারচুপির নির্বাচনের পর এর পক্ষে দেশী-বিদেশী কারো সমর্থনই আদায় করতে পারেনি সরকার। এতে সরকার ভেতরে ভেতরে বেশ বিব্রত। কারণ, গত বছরের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ওই নির্বাচনের পক্ষে দেশী-বিদেশী কিছুটা হলেও সমর্থন আছে বলে দাবি করছিলো সরকার। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে তখন বিভিন্ন মহলের সমর্থন আদায়ে জোর প্রচেষ্টাও চালানো হয়েছিলো। যদিও বাস্তবে ৫ জানুয়ারিতে কোনো নির্বাচনই হয়নি বলে প্রায় সব মহলই মত দিয়েছিলেন। কেননা ভোটের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জনকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে রাখা হয়েছিলো। ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পরে ২০ দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো শতকরা ৫ ভাগ মানুষও ভোটকেন্দ্রে যায়নি। ওই নির্বাচনে ৪০টিরও বেশি ভোটকেন্দ্রে একজন ভোটারও উপস্থিত হয়নি। ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরের পরিবেশ আরো তিক্ত। ভোটের দিন ২৮ এপ্রিল বিকেল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের প্রভাবশালী প্রায় সব দেশের পক্ষ থেকেই নির্বাচনে অনিয়মে তদন্তের দাবি তোলা হয়েছে। ভোটে অনিয়ম হয়েছে মর্মে ১ মে শেখ হাসিনাকে ফোন করে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। এ দিকে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেন্স ব্লুুম বার্নিকাট গত ২ জুলাই বলেছেন, বাংলাদেশে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মর্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বদলায়নি। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হওয়া প্রয়োজন। দলগুলো চাইলে এই আলোচনার উদ্যোগ নিতে রাজি আছে যুক্তরাষ্ট্র। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বার্নিকাট বাংলাদেশের জন্য সুখবর রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন। মার্শা স্টিফেন্স ব্লুুম বার্নিকাটের বক্তব্যের তিন দিনের মাথায় ৫ জুলাই ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ‘কাউকে আগামী নির্বাচনে বাইরে রাখা হবে না’। আগাম নির্বাচন নিয়ে যখন নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে ঠিক তখনই আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের একজন সদস্যের এমন মন্তব্য খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন মোহাম্মদ নাসিমের এ বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক ধারার সূচনা হতে পারে। তবে সরকারের একটি অংশ মনে করে, বিরোধী দল বিএনপির বর্তমান সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতিতে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান তাদের জন্য সুবিধাজনক। ক্ষমতাসীনদের অপর অংশ মনে করে, সরকারের জনপ্রিয়তার মাপকাঠিটি সব সময়ই বিবেচনায় রাখা জরুরি। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে না পারাকে সরকারি মহল থেকে আন্দোলনের ব্যর্থতা বলে অভিহিত করা হলেও বাস্তবে আন্দোলন ব্যর্থ হয়নি। বরং নির্দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আরো জোরদার হয়েছে এবং এই দাবির প্রতি জনসম্পৃক্ততা বেড়েছে বলে মনে করে ২০ দলীয় জোট। সরকারের নজিরবিহীন দমননীতি আন্দোলন সফল না হওয়ার প্রধান কারণ। এতে সরকার ক্ষমতা না হারানোর সাফল্যে আত্মতৃপ্তিবোধ করলেও জনগণ থেকে তারা আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তাদের ভেতর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ-পাকিস্তানের বিগত ৬০-৭০ বছরের ইতিহাসে বর্তমান সরকারের দমন-পীড়নের এমন নজির নেই। বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে খুন, গাড়ি পোড়ানো, পেট্রোলবোমা মারাসহ ফৌজদারি অপরাধের মামলা দায়ের এবং রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের কোন নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস আমাদের সামনে রয়েছে। আর পুরাতন দল হিসেবে এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ভূমিকাই ছিল সর্বাধিক। হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও, গাড়ি পোড়ানো, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, রেল স্টেশনে আগুন, পুলিশকে মারধর, দিগম্বর করাসহ আন্দোলন সফল করতে নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড হয়েছে এবং তার সর্বাধিক রেকর্ডও আওয়ামী লীগের। কিন্তু কখনো কোন সরকারই এসব কাজকে ক্রিমিনাল অ্যাক্ট বলেনি। কোন নেতার বিরুদ্ধে এসব অপরাধের দায়ে খুনের অভিযোগ, গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগ এনে মামলা করা হয়নি বা রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়নি। হাজার হাজার মামলা ও লাখ লাখ নেতা-কর্মীকে আসামি করার ঘটনাও অতীতে ঘটেনি। হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে ক্রিমিনাল মামলা দিয়ে আটকে রাখার ঘটনারও নজির নেই। এসব হয়েছে কল্পনারও বাইরে এবং তা অব্যাহত রয়েছে। সরকারের হত্যা, নির্যাতন, গুম, খুনসহ ব্যাপক দমননীতিই সফল হয়েছে। এতে আন্দোলন সফল হয়নি, সফল হয়েছে সরকারের দমননীতি, যদিও অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বেড়েছে। সরকার বিরোধী দলের ওপর নজিরবিহীন দমন-পীড়ন চালাবার সাথে বিরোধী দলকে সন্ত্রাসী সাজাবার সর্বাত্মক প্রচার চালিয়েছে। এটা ছিল সরকারের একটা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ বিরোধী দলের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধেও সরকার কিছুটা সফল হয়েছে। বিরোধী দলের একটি অংশ সরকারের দমননীতির চেয়ে আন্দোলনের ব্যর্থতাকে বড় করে দেখছে। কর্মীরা দেখছে নেতারা রাস্তায় নামে না। তবে একটি চরম স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে কিভাবে আন্দোলন চলতে পারে সে বিষয়টি ভাবা হচ্ছে না। গণতন্ত্র, আইনের শাসন সবই পদদলিত করছে। দেশ বাঁচাতে, জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ে সর্বোপরি অনির্বাচিত সরকারের হাত থেকে জাতিকে উদ্ধারে আন্দোলন সফল করার বিকল্পও নেই। আর অবশেষে জয় জনগণেরই হবে। বেগম জিয়া দল পুনর্গঠন করে পুনরায় আন্দোলনে নামার কথা ভাবছেন যা তিনি ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়কালে বলেছেন। আসলে বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট ও সরকারের বাইরে থাকা দলগুলো তো বারবার একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করে সরকার যাচাইয়ের নির্বাচনী চ্যালেঞ্জটিই সরকারের প্রতি ছুড়ে দিয়েছে। কিন্তু সরকার বরাবর সে চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করা থেকে দূরে সরে রয়েছে। আসলে সবার অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের অভাবই আমাদের সামনে বড় বাধা হয়ে আছে। সরকারপক্ষের নেতানেত্রীরা বারবার বলছেন, বেগম জিয়া ও তার দল আজ জনবিচ্ছিন্ন। যদি তাই হয়, তবে একটি নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে তাদের এই দাবির প্রমাণ তারা সহজেই দিতে পারেন। তা না করে জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতায় থেকে বিরোধী মতাবলম্বীদের নিঃশেষ করে ক্ষমতায় থাকার অনৈতিক উপায় অবলম্বন করলে সামগ্রিকভাবে দেশকে তো এগিয়ে নেয়া যাবেই না, বরং নানা দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকাই নিশ্চিত হবে; যেমনটি আমাদের কারো কাম্য নয়। আসলে সরকার যত বেশি দমনপীড়নের পথ অবলম্বন করবে, সরকারের জনপ্রিয়তার পারদমাত্রার পতন ততই বেশি করে ঘটবে। লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির