post

মুসলমানদের অতীত

০৭ অক্টোবর ২০১৮

আজকের বিশ্ব অগণিত সমস্যায় জর্জরিত বিশ্বমানব আজ শান্তির সন্ধানে দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জড়বাদী সভ্যতার ঝলসানো মরীচিকার পেছনে উন্মাদের মত ছুটে চলেছে। শান্তির জন্য একের পর এক মানবসৃষ্ট মতবাদের বাস্তবতারও পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। মানবজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মানুষের মনগড়া সকল মতাদর্শ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মানবজাতি আজ মুক্তি, কল্যাণ, শান্তি, উন্নতি, অগ্রগতি ও প্রগতির নামে আজ দুঃখ-দুর্দশা, অনাচার, অত্যাচার, উৎপীড়ন, নিপীড়ন, হতাশা, ও বঞ্চনার সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে। মানব-সভ্যতার ক্রমবিকাশে মানবজীবনকে দুঃখ-দুর্দশা, বর্বরতা অসভ্যতা ও জুলুম নির্যাতন তথা নিষ্পেষণের জাঁতাকল হতে মুক্তি প্রদানে একদিন একমাত্র ইসলামের অবদান গোটা জাতিকে বিস্মিত ও মোহিত করেছিল। ইসলামের স্বর্ণযুগের ইতিহাস শুধু ভাবাবেগকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেনি বরং তা ঐতিহাসিক সত্যেও রৌদ্রালোকে সুস্পষ্ট, স্বচ্ছ ও সমুজ্জ্বল যে, শুধু মাত্র ইসলামী মূল্যবোধই মানবজীবনে কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় সাফল্য অর্জন করেছে। যা বিশ্বের ঐতিহাসিকগণ নির্দ্বিধায় স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। তৌহিদের হে চির সেবক বীর মুসলমান! আমি এখন মুসলমানদের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল স্বর্ণালি ইতিহাস, বর্তমান দিশেহারা নির্যাতিত মুসলিম জাতির দুরবস্থার কারণ ও ভবিষ্যতে ধ্বংসোন্মুখ মহাদুর্গতির চরম দুর্ভাবনাকে সামনে রেখে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছি। প্রথমেই আসুন আমরা বিশ্ব মুসলিমের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জেনে নিই। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, শিক্ষায়, সভ্যতায়, ইবাদতে, উপাসনায়, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, কাব্যে, সাহিত্যে, শিল্পে, বাণিজ্যে, বিজ্ঞানে, দর্শনে, ধর্মে-কর্মে, ত্যাগে-তিতিক্ষায়, মহানুভবতায়, পরোপকারিতায়, শৌর্যে-বীর্যে ও চরিত্রে মাধুর্যে মুসলিম জাতিই দুনিয়ায় শীর্ষস্থান অধিকার করেছিলেন। প্রিয় নবীর পর মাত্র এক শতাব্দীর মধ্যে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মধ্যে তারা ইসলামের সুমহান আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। মদিনা কুফা, বসরা, দামেশক, বাগদাদ, কর্ডোভা, সেভিল, গ্রানাডা, সমরখন্দ ও ইস্পাহান শহরগুলোকে ব্যবসা-বাণিজ্যে, পার্থিব সম্পদ, শিক্ষা, সভ্যতা তাহজিব ও তমদ্দুনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত করেছিলেন তারা। সোনালি অতীত, সুবিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত আলকিন্দি দর্শনশাস্ত্রের গোড়াপত্তন করেছিলেন। মুহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া একজন শ্রেষ্ঠ রসায়নশাস্ত্রবিশারদ ছিলেন । তিনি হীরাকষকে শোধন করে গন্ধক-দ্রাবক তুঁতিয়া প্রস্তুত করেছিলেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে সারা জগৎকে আবুল কাসেম আল্জাহ্রবী তাঁর আশ্চর্য দক্ষতা দেখিয়েছেন। তিনি একজন শ্রেষ্ঠতম অস্ত্রোচিকিৎসা বিশারদ ছিলেন। জাবের ইবনে হাইয়ানই রসায়নশাস্ত্রের জন্মদাতা। শুধু জাবের ইবনে হাইয়ানই নন। আল ফারাবি, ইবনে সিনা, আলবিরুনি, আলগাজ্জালি, ইবনে বাজা ও ইবনে রুশদের মত দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও প্রকৃতি বিজ্ঞানের চরমোৎকর্ষ সাধনকারী মুসলিম মনীষীগণ পৃথিবীর অমূল্য সম্পদ। মুসলিম মনীষী মুসা আল খারেজমি সৌরমণ্ডল ও জোতির্মণ্ডল সম্বন্ধে গবেষণা করে পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। শুধু তাই নয়, বীজগণিতের জন্মদাতা ছিলেন তিনিই। তাঁর ‘আল্-জবর’ নামক বীজগণিতের মৌলিক গ্রন্থ হতে ইউরোপীয় এলজেবরা শব্দটি চয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া আল-বাত্তানি, আল-ফারগানি, আল-বিরুনি, ওমর খৈয়াম ও নাসিরুদ্দিন তুসির মত মুসলিম মনীষীগণ জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতশাস্ত্রে মানুষের জ্ঞানভাণ্ডারকে বহুগুণে সমৃদ্ধ করে গেছেন। সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসশাস্ত্রে মুসলমানদের কাছে দুনিয়াবাসী ঋণী। বিখ্যাত মুসলিম মনীষী ইবনে খালদুন সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসশাস্ত্রের আবিষ্কারক ছিলেন। কেবলমাত্র ইবনে খালদুনই নন, বালাজুরির মত, হামাদানির মত, আল-বিরুনির মত, আল-তাবারির মত, আল-মাসুদির মত, ইবনে হজমের মত, ইবনুল আসির মত, ইবনে খল্লকানের মত ও শাহ ওয়ালিউল্যার মত শত শত বিশ্ব মুসলিম ঐতিহাসিকদের অবদানে মানব ইতিহাস সমৃদ্ধ ও উন্নত হয়েছে। মুসলিম বৈজ্ঞানিক আবুল হাসান সর্বপ্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন। আবুল হাসান ও আলী ইবনে আমাজুর সর্বপ্রথম চন্দ্র সম্বন্ধে গবেষণায় প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। কায়রোতে ইবনে ইউনুস নামে এক মহামনীষী সর্বপ্রথম পেন্ডুলাম আবিষ্কার করে তার দোলনের সাহায্যে সময় নিরূপণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। মুসলমানরাই স্থাপত্য শিল্পে জগতের শীর্ষস্থান অধিকার করেছিলেন। আগ্রার তাজমহল, জেরুসালেমের ওমরের মসজিদ, কনস্টান্টিনোপাল বা ইস্তাম্বুলের সেন্টসফিয়া মসজিদ, কর্ডোভার মসজিদ, স্পেনের আলহামরা, দিল্লির দেওয়ানে আম, দেওয়ানে খাস, মতি মসজিদ যার বাস্তব প্রমাণ। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে কামান ব্যবহার করে মুসলমানরাই দুনিয়াবাসীকে কামান ও বারুদের ব্যবহার শিখিয়েছেন। গ্রান্ডট্রাংক রোড তৈরি করে এ জাতিই রাস্তা নির্মাণের আদর্শ দেখিয়েছে। ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করে এ জাতিই ডাক বিভাগের সূত্রপাত করেছেন। আমরা যাকে চীনের প্রাচীন সভ্যতা বলে দেখতে পাই, আসলে তা মুসলমানদের জ্ঞানালোকবর্তিকা থেকে ধার করা স্ফুলিঙ্গ ছাড়া আর কিছুই না। সার্বিক উন্নতির অগ্রযাত্রায় বিশ্ববাসী যে মুসলমানদের কাছে ঋণী তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। যে জাতি মাত্র কয়েকটা বছরের মধ্যে এক অখণ্ড আদর্শ রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনে সক্ষম হয়েছিলেন। যে জাতির আদর্শ, শিক্ষা ও সভ্যতার জ্যোতি আরব ভূমি হতে বিকিরণ হয়ে সারা দুনিয়াকে উদ্ভাসিত করেছিল। সেই জাতি আজ চরম অধঃপতিত,নিগৃহীত। ভাবতেই অশ্রুরবানে দু’চোখ ভিজে যায়।

বর্তমানে মুসলিম জাতির চরম দুরবস্থার কিছু চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি। লর্ড বার্নার্ডশ-এর বিখ্যাত সেই উক্তি মনে পড়ে য়ায়। তার কাছে জনৈক ভদ্রলোক প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছিলেন ধর্মের মধ্যে কোন ধর্ম শ্রেষ্ঠ? তিনি উত্তরে বলেছিলেন- ধর্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম, নিকৃষ্ট জাতি সম্পর্কে প্রশ্ন করায় তিনি বলেছিলেন সবচেয়ে নিকৃষ্ট জাতি মুসলমান। আপতদৃষ্টিতে কথাটি মেনে নিতে কষ্ট হলেও আজ বাস্তবে তা প্রমাণিত সত্য। আয়নার পারদ আয়না থেকে ঝরে গেলে আয়নার যে দুরবস্থা হয় বর্তমানে মুসলমানদের ঠিক সেই অবস্থাই হয়েছে। এর কারণ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিতে গিয়ে শ্রেষ্ঠ দার্শনিক কবি স¤্রাট আল্লামা ইকবাল (রহ) বলেন- এই দুরবস্থার কারণ ইসলাম নয়-বরং ইসলামী আদর্শ থেকে বিচ্যুতি। তিনি এ দুর্ভোগের কারণ আরও পরিষ্কার করে বললেন নিম্নোক্ত ভাষায়- উহ জামানা মে মুয়াযযেয থে মুসলমাঁ হো কর আজ তোম যলিল ও খার হু-য়ে তারেকে কুরআঁ হো কর অর্থাৎ সে যুগের মুসলমান ছিল অতি মহান, আজ তারা লাঞ্ছিত হয়েছে ছাড়িয়া কোরআন । বাস্তবেও তাই আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি। এ ছাড়া ১৮৭০ সালে ব্র্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড গ্লার্ড স্টোন সংসদ অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে কোরআন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে নিজ হাতে কোরআন শরিফ উঁচু করে বলেছিলেন- ‘এই পুস্তকের বদৌলতে আরবের বেদুইনরা পারস্য ও রোমের মত শক্তিশালী সাম্রাজ্য বিজয় করেছিল। তাই যতদিন পর্যন্ত এই পুস্তক মুসলমানদের কাছে থাকবে ততদিন পর্যন্ত আমরা তাদের হুমকির ভয়াবহতা থেকে নিরাপদ হতে পারব না।’ আজ মুসলমানদের প্রত্যেক ঘরেই আক্ষরিক অর্থে কোরআনের পাণ্ডুলিপি বিদ্যমান। কিন্তু বাস্তবজীবনে এর প্রতিফলন না থাকায় আমাদের এহেন দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের জাতীয় জীবনে কোরআনের অলঙ্ঘনীয় বাণীকে উপেক্ষা করে দুনিয়ার চির অভিশপ্ত ইহুদি, নাসারাদের কৃষ্টি কালচার শিক্ষা সংস্কৃতি পোশাক-পরিচ্ছদ চাল-চলন, সভ্যতা, রাজনীতি, অর্থনীতি সমাজনীতি বরণ করে নিয়েছি। মানবতার সুমহান প্রতীক মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সুমহান আদর্শকে পরিত্যাগ করে মার্কস, লেনিন, হেগ, ডারউইনের মতাদর্শ গ্রহণ করেছি। এ অবস্থা উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লামা ইকবাল বলেন, আজকের মুসলমান পোশাক-পরিচ্ছদে খ্রিষ্টান ও শিক্ষা সংস্কৃতিতে হিন্দু। আমাদের প্রতি লক্ষ্য করে আক্ষেপ ছলে তিনি আরও বলেন- আজকের মুসলমানদের দিকে তাকালে ইহুদি নাসারারাও লজ্জায় মুখ ঢাকবে। জাতীয় জীবনে এহেন সমস্যা সমাধানকল্পে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা আমার কোরআনকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর। তোমরা কোরআন পালনের ব্যাপারে দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ো না। ( সূরা আলে ইমরান : ১০৩ ) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বিদায় হজের অমিয় বাণী তাই-ই প্রমাণ করে, তিনি বলেন তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত বিভ্রান্ত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর কিতাব (কোরআন ) ও আমার সুন্নতকে অবধারণ করে রাখবে। সর্বোপরি এটাই প্রমাণিত হয় যে, আমাদের জীবনে দুঃখ-দুর্দশা অশান্তি, অরাজকতা, নির্যাতন, নিষ্পেষণ, জুলুম, অন্যায়, অবিচার সবকিছুর মূল কারণ কোরআনকে আমাদের জীবনপথের সর্বস্তরে সংবিধান হিসেবে গ্রহণ না করা। শান্তি, স্বস্তি, উন্নতি, অগ্রগতি, প্রগতির জীবন্ত সাক্ষী হিসেবে দণ্ডায়মান মহাগ্রন্থ আল কোরআন ও বিশ্বনবীর সুমহান আদর্শ। মুসলমানরা যদি এই সঙ্কট, এই দুরবস্থার সমাধানে এগিয়ে না আসে তাহলে ভবিষ্যতে জাতীয় জীবনে মহা বিপদের আশঙ্কা থেকেই যায়। আত্মভোলা মুসলিম জাতির ভাবধারা দেখে শুনে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন- শক্তি সিন্ধু মাঝে রহি হায় শক্তি পেল না যে, মরিবার বহু পূর্বে জানিও মরিয়া গিয়াছে সে। মুসলিম জাতির হাতে সব কিছু থাকতে যদি তারা নিজেদের ঐতিহ্য রক্ষায় আজও সচেতন না হয়, তাহলে কবির কথাই বাস্তব রূপ নিবে। গতানুগতিকভাবে গড্ডালিকা প্রবাহে যদি মুসলমানরা বিজাতীয় অনুকরণ অনুসরণ করে চলতে থাকে তাহলে জাতীয় জীবনে নেমে আসবে এর চেয়ে মারাত্মক অভিশাপ। ফলে বিপন্ন হবে গোটা জাতি। নেমে আসবে জ্বালাময়ী ধ্বংসের বিভীষিকা। অশান্তির দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে পৃথিবীতে। তাই সুপ্ত মুসলিম মিল্লাত যদি সে মহাবিপদ ঠেকাতে চান, তাহলে আজই শপথ নিতে হবে মানবরচিত কোন মাতাদর্শ আমরা মানব না। শুধু তা-ই নয়, মানবরচিত সকল মতাদর্শকে খড় কুটার ন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে জাতীয় জীবনের সকল স্তরে আল কোরআনের প্রতিফলন ঘটাবো। আদর্শ নেতা হিসেবে মানবতার মুক্তির দিশারি প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে মেনে নেবো। যদি আমরা মুসলিম জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে আবার জেগে উঠি তথা হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ি তবে বিজয়ের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা সময়ের ব্যবধান মাত্র। লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির