post

মুহাম্মদ সা. এর জীবনে খাদিজা রা. এর ভূমিকা

মুনিম সিদ্দিকী

১৫ ডিসেম্বর ২০১৫
মুহাম্মদ সা. এর রেসালাতের দায়িত্ব বুঝে সেই লক্ষ্য অর্জনে যারা তাঁর পাশে সংযুক্ত হয়েছিলেন তাঁদের সর্বপ্রথম ছিলেন এই উদারচিত্ত, প্রজ্ঞার গুণে গুণান্বিত, প্রভাব ও বিত্তে প্রতিষ্ঠিত, তাঁরই সহধর্মিণী, এক মহীয়সী নারী হজরত খাদিজাতুল কুবরা রা., যার জান ও মাল নিবেদিত ছিল এই ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায়। প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম যখন পা পা করে হাঁটতে শুরু করে তখন তাঁরই ধন-মালের ওপর দিয়ে শুরু হয় সেই হাঁটা, সেই পথ চলা। “হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও।” (৩৩-৩২) এখানে আল্লাহ যা স্পষ্ট করে দিয়েছেন তা হলো এই যে নবী পত্নীগণ সেই অর্থে অন্যান্য নারীদের মতো নন যে তারা যেখানে ইচ্ছা সেখানে চলাফেরা করতে পারবেন, এইভাবে চলাফেরা করলে কোথাও আল্লাহর দ্বীনের কাজ ব্যাহত হতে পারে। তাদের এই বিশেষ অবস্থানের কারণে কিয়ামতে তাদের পুরস্কার দ্বিগুণ হবে আর এবং এই অবস্থান থেকে কোন অন্যায় করেন তাহলে তার জন্য শাস্তিও দ্বিগুণ হবে। আল্লাহ তাঁদেরকে এই অবস্থানের জন্য উম্মতে মুসলিমায় এক অতি উঁচু মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছেন। নবুওয়তের অনেক আগ থেকেই আল্লাহ পাক খাদিজা রা.-কে তাঁর সহধর্মিণী হিসেবে নির্বাচন করেন, কেননা খাদিজা রা.-এর মধ্যে এমনসব গুণাবলি ছিল যা সকল দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে, দ্বীনের খেদমতে শির উঁচু করে, স্থবিরচিত্তে অগ্রসর হওয়ার অনুকূল ছিল। খাদিজা রা. সমস্ত উম্মাহর মধ্যে সেরা সাহাবী এবং ব্যক্তিত্বশালী ছিলেন শুধু তাই নয়, সর্বকালের সেরা চার মহিলার মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন। খাদিজা রা.-এর পুরো নাম হচ্ছে খাদিজা বিনত খাওয়াইলিদ ইবনে আসাদ ইবনে আবদেল ওজ্জা ইবনে কুসাই। তাঁর বংশতালিকা কুসাই পর্যন্ত গিয়ে মুহাম্মদ সা. এর বংশের তালিকার সাথে মিলেছে। তিনি তাঁর মায়ের দিক দিয়েও সম্পর্কিত ছিলেন। তাঁর মায়ের বংশতালিকাও মুহাম্মদ সা. এর সপ্তম প্রপিতামহ লো’আই-এর সাথে মিলিত হয়েছে। অতএব খাদিজা রা.-কে নবী সা. এর বংশের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের স্ত্রী হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এই স্ত্রীর সন্তান ফাতিমা রা. এবং জায়নাব রা.-এর মাধ্যমে মুহাম্মদ সা. এর বংশধরদের বিস্তৃতি বজায় রয়েছে। প্রাক-ইসলামি মক্কি সমাজে নারীদের তেমন কোন সামাজিক মর্যাদা ছিল না। সেই সময়ে নিজের জ্ঞান বুদ্ধি আর পরিশ্রম দ্বারা প্রতিকূল পরিবেশে তিনি সম্মানিত মহিলার স্থান অর্জন করেছিলেন এবং চরম অশ্লীলতায় ভেসে যাওয়া সমাজে তাঁর শালীনতা বোধ রক্ষা করে তাহিরা উপনামে খ্যাত হয়েছিলেন এবং ব্যবসায়িক জ্ঞানের দ্বারা বিশাল বাণিজ্য পরিচালক হিসেবে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। ধীশক্তি আর সৌন্দর্যে, দৃঢ় চরিত্র এবং নরম হৃদয়ের সম্মিলন ছিলেন এই মহীয়সী, এই সমস্ত সকল গুণরাজি তাকে দিয়েছিল সূক্ষ্ম জ্ঞান এবং মানুষ আর ঘটনাকে বিচার করার পরিপক্ব ক্ষমতা। মুহাম্মদ সা. এর সাথে বিয়ের পূর্বে খাদিজা রা.-এর দুই দুই বার বিয়ে হয়েছিল। প্রথম স্বামী ছিলেন আতেক আল- মাখযোমি, যিনি বিয়ের কয়েক বছর পর মারা গিয়েছিলেন। সেই বিয়ের তাদের দু’টি সন্তান ছিলেন : একজন ছেলে এবং অপরজন মেয়ে। দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন আবু হালা আল-তামিমি। এই স্বামীর ঔরসে তাঁর আরো দু-জন সন্তান ছিলেন। যখন দ্বিতীয় স্বামী মারা যান তখন খাদিজা রা.-এর বয়স ৩৭ ছিল। (ইতিহাসে প্রথম স্বামী কোন্ জন ছিলেন, তা নিয়ে দ্বিমত পাওয়া যায়)। প্রথম স্বামী মারা যাবার পর উত্তরাধিকার সূত্রে বিপুল সম্পত্তি লাভ করেছিলেন। (এই সম্পত্তি লাভের বিষয় নিয়েও ভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়, আমরা ধরে নিচ্ছি যে, যেহেতু খাদিজা রা.-এর বাবা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন তাই বাবার উত্তরাধিকার সূত্র থেকে পাওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করা যাবে না। পরবর্তীতে স্বামীদের কাছ থেকেও সম্পত্তি লাভ করে থাকবেন)। যেহেতু তিনি বুদ্ধিমতী ছিলেন তাই এই সমুদয় সম্পত্তি ব্যবসায় নিয়োগ করেন। চরম পুরুষবাদী সমাজে একজন নারী হয়েও প্রতিকূল পরিবেশে অত্যন্ত দক্ষ-হস্তে ব্যবসাকে সমৃদ্ধ করে তোলেন এবং ক্রমান্বয়ে এক সময় মক্কার সেরা ব্যবসায়ীতে পরিণত হোন। দ্বিতীয় বারের বিধবা, কয়েক সন্তানের মা এবং বয়স ৩৭ হওয়া সত্ত্বেও মক্কার কত গণ্যমান্য তরুণ, সুদর্শন যুবক, বীর যোদ্ধা, ধনী আমির তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাবগুলো কঠোরভাবে ফিরিয়ে দিয়ে ছিলেন। কারণ দুই স্বামীর অকাল মৃত্যুর জন্য তিনি আবার বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। তাই দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যুর পর ৩ বছর পর্যন্ত একা ছিলেন। তাঁর কাছে শুধু তাঁর ছোট ছেলে হিন্দ ছিল বাকি তিন সন্তানকে আগেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। যেহেতু তাঁর স্বামী নেই, তার বিশাল ব্যবসা বাণিজ্য তদারকির জন্য একজন নির্ভরযোগ্য বিশ্বাসী লোকের খোঁজ করছিলেন যাকে তাঁর আগামী সিরিয়াগামী বিরাট বাণিজ্য কাফেলার দায়িত্ব দিতে পারেন। সারা মক্কায় সেদিনের সমাজে যে ব্যক্তিকে একমাত্র সৎ হিসেবে জানা ছিল সেই ব্যক্তিটি ছিলেন যুবক মুহাম্মদ সা.। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২২ বছর ছিল। খাদিজা রা. তখন এই যুবক মুহাম্মদ সা.কে এই পদে নিয়োগ দানের কথা ভাবছিলেন। সে বছর আরবে দারুণ দুর্ভিক্ষ চলছিল, আবু তালিব অর্থনৈতিক দুঃসময়ে তাকে সাহায্য করার জন্য খাদিজা রা.-এর বাণিজ্য কাফেলার দায়িত্ব নেবার জন্য মুহাম্মদ সা.-কে উপদেশ দেন। এই আবু তালিব তাঁকে শিশুকাল থেকে পিতৃস্নেহে লালন-পালন করে বড় করেছিলেন। কিন্তু মুহাম্মদ সা. নিজ থেকে উপযাচক হয়ে তা করতে রাজি হন নাই, তিনি উত্তর দিলেন- খাদিজা রা. যদি নিজ থেকে প্রয়োজন মনে করেন তাহলে তিনি নিজেই প্রস্তাব পাঠাবেন। আবু তালিব মুহাম্মদ সা. এর জবাব শুনে শঙ্কিত হলেন এই ভেবে যে, খাদিজা রা. ঐ পদে হয়তো অন্য কাউকে নিয়োগ দিয়ে দেবেন। তাই তিনি নিজ থেকেই খাদিজা রা.-এর কাছে এসে পরামর্শ দিলেন- আপনি কি মুহাম্মদ সা. এর কাছে আপনার সিরিয়াগামী কাফেলার দায়িত্ব নেবার প্রস্তাব করতে পারবেন? খাদিজা রা. তাঁর উত্তরে জানান, আপনি যদি এক অপরিচিত কাউকে প্রস্তাব করতেন তা আমি রাখতাম, কিন্তু আপনি যার নাম উল্লেখ করেছেন তাকে কেন আমি প্রস্তাব করতে যাবো না? খাদিজা রা. তাঁর সিরিয়াগামী বাণিজ্যিক কাফেলার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেয়ার জন্য যুবক মুহাম্মদ সা.কে প্রস্তাব দেন এবং তাঁকে অন্য লোকদের চেয়ে দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দেয়ার কথা উল্লেখ করেন। মুহাম্মদ সা. সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেন। খাদিজা রা.-এর এক বালক দাস ছিল, যার নাম ছিল মায়সারা। তিনি মায়সারাকে এতই বিশ্বাস করতেন যে তাকে নিজ ‘চোখ’ বলে বিবেচনা করতেন। মায়সারা বাণিজ্যিক কাফেলার খবরদারির দায়িত্বে থাকতেন। মুহাম্মদ সা. এর নেতৃত্বে এবং মায়সারার তত্ত্বাবধানে সেবার খাদিজা রা.-এর বাণিজ্যিক কাফেলা সিরিয়ায় যায়। প্রত্যাশার অধিক মুনাফা নিয়ে মুহাম্মদ সা. মক্কায় ফিরে আসেন। খাদিজা রা. এহেন বাণিজ্যের ফলাফল দেখে চমকিত হোন। তিনি মায়সারাকে ডেকে মুহাম্মদ সা. এর কাজকর্ম সম্পর্কে খোঁজখবর নেন; বাণিজ্যে সফরের সময় তাঁর ব্যবহার কেমন ছিল, দীর্ঘ বাণিজ্য যাত্রায় তিনি কী কী করেছিলেন ইত্যাদি। পরবর্তী সময়ে তিনি মুহাম্মদ সা.কে আবার ইয়েমেনে বাণিজ্য কাফেলা দিয়ে পাঠান, সেই কাফেলায়ও মুহাম্মদ সা. তাঁর নিজস্ব বাণিজ্যিক দক্ষতার দ্বারা প্রচুর লাভ অর্জন করেছিলেন। খাদিজা রা. বাণিজ্য চলাকালে আমানতদারিতা, ব্যবসায় কর্মরত সকল কর্মীর সাথে ন্যায়পরায়ণ ব্যবহার, নির্লোভ, নির্মোহ এবং ব্যবসায় তীক্ষè ধীর অধিকারী মুহাম্মদ সা. এর ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। তাঁর আচার-আচরণ, ন্যায়-নিষ্ঠা, কোমল ব্যবহার ইত্যাদি গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতে থাকেন। খাদিজা রা. যেহেতু উচ্চ বংশের সম্মানিত মহিলা ছিলেন তাই তিনি মুহাম্মাদ সা.কে স্বামী হিসেবে পাবার ইচ্ছা লালন করলেও সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব না দিয়ে সংযমের সাথে অন্যের মাধ্যম ব্যবহার করেন। তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ বিশ্বস্ত বান্ধবী নাসিফা বিনতে মুনিয়ার কাছে কৌশলে বিষয়টি তুলে ধরেন। খাদিজা রা. নাসিফা রা.কে জানালেন যে মুহাম্মদ সা. হচ্ছেন একজন অসামান্য, অনন্য চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিত্ব। তবে তাঁর মুহাম্মদ সা.এর প্রতি কোন প্রেম বা অনুরাগের কথা উল্লেখ করেন নাই। নাসিফা রা. নিজেও জানতেন মুহাম্মদ সা. কে ছিলেন, কেমন ছিলেন। খাদিজা রা.-এর মুখ থেকে প্রশংসা শুনেই নাসিফা রা. বলে ওঠেন, আমি বিশ্বাস করি, মুহাম্মদ সা. হতে পারেন তোমার জন্য চমৎকার এক স্বামী। পাঠক, লক্ষ্য করুন, এটি ছিল নাসিফা রা.-এর নিজের ধারণা। তারপর নাফিসা রা. এই বিষয়ে মধ্যস্থতা করার জন্য খাদিজা রা.-এর অনুমতি চাইলেন। খাদিজা রা. তাকে সেই অনুমতি দিলেন। নাসিফা রা. মুহাম্মদ সা. এর কাছে যান এবং তার একান্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারপর একপর্যায়ে জানতে চান, আপনি বিয়ে করছেন না কেন? (তবে কোন অবস্থায় খাদিজা রা.-এর বিষয়ে কিছু বলেন নাই)। সে সময় মুহাম্মদ সা. বয়স হয়েছিল মাত্র ২৫ বছর। মুহাম্মদ সা. নাফিসা রা.-এর প্রশ্নের জবাবে জানান, বিয়ে করার জন্য যে অর্থ-বিত্তের দরকার, তা এখনও আমি অর্জন করতে পারিনি। নাসিফা রা. জিজ্ঞাস করেন, যদি আপনার বিয়েতে সেই অর্থ-বিত্তের দরকার না পড়ে, আর যদি একজন অর্থশালী, সুন্দরী মহিলা কোন কিছুর দাবি ছাড়াই আপনাকে বিয়ে করতে চান, তাহলে আপনার কী অভিমত? মুহাম্মদ সা. প্রশ্ন করেন, কে সেই মহিলা? নাসিফা রা. জবাব দেন, খাদিজা রা.! সাথে সাথে জানতে চান- খাদিজা রা. কি আমাকে গ্রহণ করবেন? নাসিফা রা. বলেন, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারি। তারপর, তিনি সেই শুভ সংবাদ নিয়ে খাদিজা রা.-এর কাছে ফিরে আসেন। পাঠক, এখান থেকে শুরু হয়েছিল পৃথিবীর এক অমর সম্পর্কের আখ্যান। সে আখ্যানে তাঁদের বিবাহিত জীবনের ২৫টি চমকপ্রদ বছর কেটে গিয়েছিল এবং তা খাদিজা রা. ওফাতের পরও ১৫টি বছর পর্যন্ত বহাল রয়ে গিয়েছিল। ইতিহাসে কোথাও এমন একটি বাক্য নেই যেখানে মুহাম্মদ সা. এমন কোন নেতিবাচক শব্দ প্রয়োগ করে গিয়েছিলেন এই খাদিজা রা. সম্পর্কে! এখানেও আল্লাহর এক কারিশমা কাজ করেছে বলে আমার বিশ্বাস। বিয়ের চিরন্তন ও শাশ্বত রীতি অনুযায়ী মুহাম্মদ সা. তাঁর চাচা আবু তালিবকে সব জানান। এই বিয়ে খাদিজা রা.-এর সম্মতি জানতে পেরে আবু তালিব যথানিয়মে খাদিজা রা.-এর চাচা আমর বিন আসের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পেশ করেন। সকলের সম্মতিক্রমে বিয়ের দিন তারিখ এবং মোহর ঠিক হয়। পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা মোহর ধার্য করা হয়। খাদিজা রা. নিজেই উভয় পক্ষের যাবতীয় খরচ বহন করেন। তিনি দুই উকিয়া সোনা ও রুপো মুহাম্মদ সা. এর নিকট পাঠান এবং তা দিয়ে উভয়ের পোশাক ও ওয়ালিমার বন্দোবস্ত করেন। এভাবেই নবুওয়তের পরবর্তীতে হযরত খাদিজা রা. মুসলিম উম্মাহর প্রথম ‘উম্মুল মোমিনিন’, মু’মিনগণের মা হওয়ার সম্মান অর্জন করেন। মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে দু’জনের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই বিয়েতে আবু তালিব যে খুতবা পাঠ করেন আরবি সাহিত্যের মানের দিক দিয়ে এ খুতবা জাহেলি যুগের আরবি গদ্য সাহিত্যে বিশেষ স্থান দখল করে। সেই খুতবার উত্তর প্রদান করেছিলেন খাদিজা রা. এর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা বিন নওফেল। (মোস্তফা চরিত ২৮৫-২৮৬) ইতিহাসের পাতায় তাদের বিয়ের পর থেকে মুহাম্মদ সা. এর নবুওয়ত লাভ পর্যন্ত ১৫ বছরের শুধু হাজরে আসওয়াদের ঘটনা ছাড়া আর তেমন কোন কিছুর উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে উল্লেখ আছে যে ঐ সময়ের মধ্যে তাঁদের চার কন্যা : জায়নাব রা., রোকাইয়া রা., উম কুলসুম রা., ফাতিমা রা. এবং দুই পুত্র : আল কাসেম, আবদুল্লাহ বা আল তাহেরের জন্মের কথা। আরও জানা যায় তাদের প্রতিপালক পুত্র ছিলেন আলি ইবনে আবি তালিব রা., জাইদ ইবনে হারিস রা., আল যুবায়ের ইবনে আওয়াম রা. পালক পুত্রদের এবং হিন্দ রা. নামক খাদিজা রা.-এর আগের পক্ষের পুত্রকে লালন পালনের কথা। আমরা অনুধাবন করতে পারি এত বড় পরিবারের তত্ত্বাবধান করতে খাদিজা রা. কত ব্যস্ত ছিলেন! উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিরা পরবর্তীতে ইসলামের ইতিহাসে নিজ নিজ গুণে ঐতিহাসিক নেতৃত্বের ভূমিকায় আসেন। তারা সেই পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পেছনে খাদিজা রা.-এর ভূমিকা ছিল ব্যাপক। খাদিজা রা.-এর বয়স যখন ৫০ বছরের উপরে তখন থেকেই মুহাম্মদ সা. নির্জন এলাকায় ধ্যান-সাধনার মগ্ন হয়ে পড়েন। সাধনার উদ্দেশ্যে কয়েক সপ্তাহের জন্য শহরের কোলাহল থেকে দূরে গিয়ে জবল-ই-নুর পাহাড়ের হেরা নামক এক গুহায় নির্জন-বাস শুরু করেন। সেই সময়ে খাদিজা রা.ও তাঁর স্বামীর ধ্যান-তপস্যায় যেন কোনরূপ বিঘœতা না হয় সেদিকে সব সময় নজর রাখতেন। সেই বয়সে স্বামীর জন্য খাদ্য পানীয় এবং আনুষঙ্গিক ব্যবহার্য অন্যান্য উপকরণ নিজে বহন করে সেই উঁচু পাহাড়ের গুহায় নিয়ে যেতেন। মুহাম্মদ সা. সবেমাত্র ৪০ বছর বয়সে পা দিয়েছেন এবং খাদিজা রা. ৫৫ বছর বয়স। সেই অভিজ্ঞতার কথা স্বয়ং মুহাম্মদ সা. এর মুখে শুনুন : ‘সে রাতে আমি ছিলাম গুহায়। আমি দেখতে পেলাম জিবরাইল আ: আমার পাশে দাঁড়ানো এবং আমাকে আলিঙ্গন করে চাপ দিয়ে বললেন, পড়! আমি জানালাম, আমি তো পড়তে জানি না। তখন তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে আবার আলিঙ্গনের দ্বারা চাপ দিলেন এবং সেই চাপের কারণে আমি অনুভব করলাম যেন আমি মারা যাচ্ছি। তিনি আবার বললেন, পড়! আমি বললাম, আমি তো পড়তে জানি না। তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে এবার আরও অধিক জোরে আমাকে চাপ দিয়ে বললেন, পড়! তখন আমি জানতে চাই কি আমি পড়ব? তিনি বললেন, পড় তোমার সৃষ্টিকর্তার নামে, পড়ো! (হে নবী), তোমার রব এবং পালনকর্তার নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (কুরআন : ৯৬:০১) ৬১০ খ্রিষ্টাব্দের রমজান মাসে প্রাপ্ত এই একটি মাত্র বার্তা পৃথিবীর ইতিহাসের চাকাকে নতুন মোড়ে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এই বার্তা দিয়েই নতুন জীবনব্যবস্থা ইসলামের পৃথিবীতে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার যাত্রা শুরু হয়েছিল। যখন জিবরাইল (আ:) অদৃশ্য হয়ে গেলেন। মুহাম্মদ সা. এত ভয় পেয়ে যান যে সারা শরীরে কম্পন শুরু হয়। তিনি বুঝতে পারছিলেন না আসলে কী ঘটে গেয়েছিল। তিনি দ্রুততার সাথে মক্কায় ফিরে আসেন। এই অবস্থায় তিনি তাঁর প্রাণের বন্ধু আবু বকর রা.-এর কাছে পরামর্শের জন্য ছুটে যাননি, যাননি বিজ্ঞ অভিজ্ঞ প্রবীণ ব্যক্তিত্ব তাঁর আপন চাচা আবু তালিবের কাছে যিনি তাঁকে লালন পালন করে বড় করেছিলেন। তিনি শুধু ছুটে গিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী খাদিজা রা.-এর কাছে! থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে নিজ ঘরে হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করেই খাদিজা রা. কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং কম্বল দিয়ে নিজের গা জড়িয়ে দেয়ার জন্য বলেন। বারবার বলতে থাকেন, ‘আমাকে আবৃত কর!’ ‘আমাকে আবৃত কর!’ খাদিজা রা. স্বামীর এই অবস্থা দেখে তাঁকে গভীরভাবে জড়িয়ে রাখলেন। কম্পিত দেহের শঙ্কা কমানোর চেষ্টা করলেন, অভয় দিলেন, আশঙ্কা দূর করার চেষ্টা করলেন। জিজ্ঞাস করেন, আপনার কী হয়েছে তো বলুন? তিনি জবাব দিলেন যে, সম্ভবত শয়তান আমাকে আশ্রয় করেছে! সাথে সাথে এই সম্ভাবনার কথা খাদিজা রা. নাকচ করে দিয়ে বলেন, না, আল্লাহর কসম, তিনি এই ভাবে আপনার মর্যাদাহানি করতে পারেন না! খাদিজা রা. তাঁর স্বামীকে অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন দিলেন এবং স্বামীকে দিলেন তাঁর দ্ব্যর্থহীন আস্থা। সঙ্কটকালে খাদিজা রা.-এর ওপর মুহাম্মদ সা. এর গভীর নির্ভরশীলতা ছিল। (এইভাবে উম্মতে মুহাম্মদীর সকল পুরুষের উচিত তাদের স্ত্রীদের ওপর নির্ভর করা) খাদিজা রা. সর্বপ্রথম নবী মুহাম্মদ সা. এর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। খাদিজা রা.ই তাঁকে নবী হিসেবে প্রথম তাঁকে অনুসরণ করেন এবং তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলামী রীতি রেওয়াজ চর্চা শুরু করেন। (উম্মতে মুহাম্মদীর নারীদেরও উচিত সঙ্কটকালে খাদিজা রা.-এর মতো স্বামীর পাশে দাঁড়ানোর।) ভীতি দূর করার জন্য মুহাম্মদ সা.কে নিয়ে? খাদিজা তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে যান। সেই জাহেলি যুগে তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। হিব্রু ভাষায় ইনজিল কিতাব লিখতেন। তিনি তখন বৃদ্ধও দৃষ্টিহীন। এই সেই নওফেল যার আপন বোন কাতিলা বিনত নওফেল একদিন মুহাম্মদ সা. এর পিতা আবদুল্লাহর কাছে বিয়ে বসার জন্য নিজেই আবদুল্লাহকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আবার তার চাচাতো বোন খাদির রা.কে দেখতে পেয়েছি যিনি মুহাম্মদ সা.কে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। (শিবলী নুমান-বিশ্ব নবীর জীবনী পৃ: ৭৪৪) খাদিজা রা. ওরাকাকে বললেন, শুনুন আপনার ভাতিজা কি বলে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ভাতিজা, তোমার বিষয় কী? মুহাম্মদ সা. পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন। শুনে ওয়ারাকা বললেন, এই তো সেই ‘নামুস’ (ফেরেশতা), আল্লাহ যাকে মূসা ক:-এর নিকট পাঠিয়েছিলেন। নওফেল তাঁকে শেষ নবী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তারপর জানান, আফসোস! সেদিন তোমার দেশবাসী তোমাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে। মুহাম্মদ সা. জিজ্ঞেস করলেন, এরা আমাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তুমি যা নিয়ে এসেছ, যখনই কোন ব্যক্তি তা নিয়ে এসেছে, সারা দুনিয়া তাঁর বিরোধী হয়ে গিয়েছে। যদি সে সময় পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকি, তোমাকে সব ধরনের সাহায্য করব, কিন্তু এই ঘটনার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ওয়ারাকার মৃত্যু হয়। খাদিজা রা. রাসূল সা. এর ওপর প্রত্যাদেশ অবতরণের পর বুঝতে পারেন যে, এটি প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাঁর স্বামীকে পুরো আরবের সকল সমাজের মানুষের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে হবে। (কারণ তৎকালীন পৌত্তলিক নেতৃত্বের ভিত ধ্বংস করা ব্যতীত ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার অন্য কোন উপায় ছিল না) তখন থেকে দিন-রাত্রি তিনি তাঁর পরিচিত জনদের মধ্যে ইসলামের বার্তাকে প্রসারিত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি অনেক টাকা পয়সা খরচ করে আরও অনেক দাস ক্রয় করেন মুহাম্মদ সা.কে নিরাপদ রাখার জন্য। আবু লাহাবের (যিনি মুহাম্মদ সা. আপন চাচা ছিলেন) দুই ছেলের সাথে মুহাম্মদ সা. দুই মেয়ে রোকাইয়া রা. উম কুলসুম রা. বিয়ে হয়েছিল। (খুব সম্ভব তখন রোকাইয়া রা.-এর বয়স ৯ এবং উম কুলসুম রা.-এর বয়স ৭ বছর ছিল) মেয়ে দুইজন মুসলিম হয়ে যাবার কারণে সে বিয়ে ভেঙে যায়। পরবর্তীতে রোকাইয়া রা. এর সাথে উসমান ইবনে আফফান রা.-এর সাথে বিয়ে হয়। পরে স্বামীর সাথে হাবাসা হিজরত করেন। নামাজ ফরজ হওয়ার হুকুম তখনও নাজিল হয়নি। হযরত খাদিজা রা.-এর ঘরের মধ্যে মুহাম্মদ সা. এর সাথে সেই প্রথম থেকেই নামাজ আদায় করতেন। ইবনে ইসহাক উল্লেখ করেছেন, একদিন আলী রা. দেখতে পেলেন তাঁরা দু’জন অর্থাৎ নবী সা. ও খাদিজা রা. নামাজ আদায় করছেন। আলী রা. জিজ্ঞেস করলেন, মুহাম্মদ সা. এ কী? মুহাম্মদ সা. তখন নতুন দ্বীনের দাওয়াত আলীর কাছে পেশ করলেন এবং এ কথা কাউকে বলতে নিষেধ করলেন। এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, উম্মতে মুহাম্মদী সা. এর মধ্যে সর্বপ্রথম খাদিজা রা. রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে নামাজ আদায় করার গৌরব অর্জন করেন। আফিফ আল কিন্দি নামক এক ব্যক্তি কিছু কেনাকাটার জন্য মক্কায় এসেছিলেন। তিনি হযরত আব্বাস রা.-এর বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। একদিন সকালে লক্ষ্য করলেন, এক যুবক কা’বার কাছে এসে আসমানের দিকে তাকালো। তারপর ক্বিবলামুখী হয়ে দাঁড়াল। একজন কিশোর এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর চলে এলো এক মহিলা সেও তাঁদের পেছনে দাঁড়াল। তাঁরা নামাজ শেষ করে চলে গেল। দৃশ্যটি আফিফ কিন্দি দেখলেন। আব্বাস রা.-কে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, বড় রকমের একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে? আব্বাস রা. বললেন, হ্যাঁ। তিনি আরো বললেন, এ যুবক আমার ভাতিজা মুহাম্মদ সা., কিশোরটি আমার আরেক ভাতিজা আলী রা. এবং মহিলাটি মুহাম্মদ সা. এর স্ত্রী, আমার জানামতে দুনিয়ায় তারা তিনজনই নতুন ধর্মের অনুসারী। ইসলামের কাজে অনেক টাকা ব্যয় হচ্ছিল। তাই রাসূলকে সা. একদিন বিমর্ষ দেখায়। খাদিজা জিজ্ঞেস করেন, কি ব্যাপার, মন খারাপ করে বসে আছেন যে? তিনি বলেন, আমি যে দীনি কাজে তোমার টাকা খরচ করে যাচ্ছি। তখন খাদিজা কোরেশের কিছু লোকজনকে ডেকে ধনসম্পদ বের করে বলেন, আমার যা কিছু ছিল এ মুহূর্তে সবই আপনার। আপনি যেভাবে ইচ্ছা তা ব্যয় করতে পারেন। আমি কেবল আপনার সেবায় থাকতে চাই।’ খাদিজা রা.-এর এই ঘোষণার পর মুহাম্মদ সা. মক্কার শ্রেষ্ঠ ধনীদের একজন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু খাদিজা রা.-এর দেয়া ধনসম্পদ তিনি ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাসে ব্যয় করলেন না। সকল ধনসম্পদ তিনি এতিম, মিসকিন, অভাবী ও অনাথদের মাঝে বিলিয়ে দিলেন। এভাবে ধন-সম্পদ বিলিয়ে দেয়ার পরও তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল অত্যন্ত মধুর। এই ইসলামী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কারণে খাদিজা রা. সম্পদ দ্রুত কমে যেতে লাগল, কিন্তু তাঁদের হৃদয় আগের চেয়ে আরও বেশি একতাবদ্ধ হতে থাকে। এরপর ৬১৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁদের ওপর নেমে আসে চরম দুর্দশা, যখন কুরাইশরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তারা আবি তালিবের পুরো গোত্র এবং মুহাম্মদ সা. এর অনুসারীদেরকে শাস্তি দিতে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করবে। এর ফলে মক্কার কোন গোত্র তাদের সাথে কোনও প্রকার সামাজিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ রাখতে পারবে না। সম্পূর্ণ বয়কট। এভাবে তাদেরকে তিন বছর ‘শিয়াবে আবু তালিব’ নামক গিরিখাতে অবরোধ করে রাখা হয়। সেই অবরোধের সময় তাদের চরম অনাহারে থাকতে হয়েছে। এমন কি ক্ষুধা নিবারণ করতে গিয়ে গাছের শুকনা পাতা পর্যন্ত তাদের খেতে হয়েছিল। এবং এই পাতাগুলো খাদিজা রা. সংগ্রহ করে এনেছিলেন যদিও তাঁকে কুরাইশদের অবরোধের আওতা থেকে মুক্ত রাখা হয়েছিল। কিন্তু ধনাঢ্য মহিলা তাঁর মুসলিম অনুসারীদের সাথে ক্ষুধার জ্বালাকে বরণ করে নেন এবং ক্রমান্বয়ে ভয়ানকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কুরাইশদের কিছু লোক যারা খাদিজা রা.-এর আত্মীয় ছিলেন। তারা তার এই অবস্থা দেখে এই চিন্তায় পড়েন। তারা ভাবেন, খাদিজা রা. হয়তো মারা যেতে পারেন। আর এটা ঘটলে তাদের জন্য চরম মর্যাদাহানি হবে। তখন তারা লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁর কাছে খাদ্য পাঠাতে শুরু করেন। এই তিনজন হলেন : তাঁর ভাতিজা-হাকিম ইবনে হিযাম, আবুল বুখতারী ও যুমআ ইবনুল আসওয়াদ। তাঁরা সকলে ছিলেন কুরাইশ নেতৃবর্গের অন্যতম। অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা বিভিন্নভাবে মুসলমানদের কাছে খাদ্যশস্য পাঠাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। একদিন হাকিম ইবনে হিসাম তাঁর চাকরের মাধ্যমে ফুপু খাদিজা রা.-এর কাছে কিছু গম পাঠাচ্ছিলেন। পথে আবু জাহেল বাধা দেয়। হঠাৎ আবুল বুখতারী সেখানে উপস্থিত হন। তিনি আবু জাহেলকে বললেন, এক ব্যক্তি তাঁর ফুপুকে সামান্য খাদ্য পাঠাচ্ছে, তুমি তাঁকে বাধা দিচ্ছ? এই খাদ্যগুলো তিনি না খেয়ে অবরুদ্ধ মুসলিমদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। এমনকি যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে তাঁর সময় শেষ হয়ে আসছে, তখনও তিনি ইসলামের প্রতি আহ্বান জারি রাখেন। ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে ১০ রমজান যখন মুহাম্মদ সা. এর অতি প্রিয়তম স্ত্রী মারা যাচ্ছেন তখন জিবরাইল আ: তাঁর নিকট আসেন এবং বলেন, হে মুহাম্মদ সা. আপনি খাদিজা রা.কে আল্লাহর তরফে সালাম পৌঁছান। তাঁকে জানিয়ে দিন যে, আল্লাহ তাঁর জন্য বেহেস্তে মুক্তা দিয়ে দুর্গ বানিয়ে রেখেছেন, যেখানে কোন ধরনের গোলমাল এবং যন্ত্রণা থাকবে না। বলা হয়ে থাকে জান্নাতের পুরস্কার তাঁর জন্য দুনিয়াতে থাকতেই নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছিল এবং এইটি ছিল তাঁর প্রাপ্য। জানাজা নামাজের বিধান তখনো চালু হয়নি। সুতরাং বিনা জানাজায় তাঁকে মক্কার কবরস্থান জান্নাতুল মুয়াল্লায় দাফন করা হয়। মুহাম্মদ সা. নিজেই তাঁর লাশ কবরে নামান। মুহাম্মদ সা. খাদিজা রা.-এর ওফাতের কারণে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। সেই একই সময়ে তাঁর চাচা আবু তালিবও মারা যান। সাহেবায়ে কেরামগণ সেই বছরকে দুঃখের বছর বলে উল্লেখ করেন। অন্য যে কারো চেয়ে খাদিজা রা.-এর জন্য তাঁর ভালোবাসা তাঁর হৃদয়ে গভীরভাবে আজীবন সতেজ এবং উজ্জ্বল থাকে। অনেক বছর পর একদিন নবী সা. এর সাথে আয়েশা রা. বসা ছিলেন। তখন কেউ একজন দরজায় করাঘাত করে ভেতরে আসার অনুমতি প্রার্থনা করে। তখন মুহাম্মদ সা. বলে ওঠেন, খাদিজা রা.! এবং দ্রুত ওঠে দরজা খুলার সময় বলেন- ও আল্লাহ এই যেন হা’লা হয়! হা’লা ছিলেন খাদিজা রা.-এর বোন। আর সত্যিই তখন হা’লাই এসেছিলেন। আর হালাহ রা.-এর কণ্ঠস্বর ছিল বিবি খাদিজা রা.-এর কণ্ঠের মত। যখন তিনি পশু কোরবানি দিতেন তখন তাঁর গোশত উপহারস্বরূপ খাদিজা রা.-এর পরিচিত মহলে পাঠিয়ে দিতেন। এর এই কারণে আয়েশা রা. খাদিজা রা.কে ঈর্ষা করতেন। একদিন সেটি প্রকাশ করে ফেলেন। বললেন, খাদিজা, মনে হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীতেই শুধু খাদিজা। মুহাম্মদ সা. উত্তর দেন, আয়েশা, এইভাবে খাদিজাকে নিয়ে কথা বলবে না। আমি তাকে ভালোবাসি এবং যে তাকে ভালোবাসবে আমি তাকে ভালোবাসব। আরেক সময়ের একটি ঘটনা। মুসলিমগণ মুহাম্মদ সা. এর মেয়ের স্বামীকে বন্দী করে। তার নাম আল-আস ইবনে আল রাবী। তিনি মুসলিম ছিলেন না এবং মুসলিমদের বিপক্ষে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আল-আস ধরা পড়ার পর তার স্ত্রী জায়নাব রা. (মুহাম্মদ সা. এর বড় মেয়ে) তাকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরিয়ে নিতে চান। তিনি তাঁর মা খাদিজা রা.-এর দেয়া উপহার মুক্তার-হার বাহকের মারফত মুক্তিপণ হিসেবে পাঠান। মুহাম্মদ সা. যখন সেই হারটি দেখতে পান তখন খাদিজা রা.-এর কথা মনে পড়ে ব্যাকুল হয়ে পড়েন। তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে বলেন, তোমরা যদি তাঁর স্বামীকে এবং তাঁর হারকে ফেরত দেয়া ভালো বিবেচনা কর, তাহলে তা করতে পার। সাহাবীগণ মুহাম্মদ সা. এর মর্মবেদনা বুঝতে পেরে তাঁর প্রস্তাবকে মেনে নেন। তিনি জায়নাব রা. প্রেরিত হারটি বাহকের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, এটি জায়নাবকে ফিরিয়ে দিয়ে বলবে, তিনি যেন এই হারটি নিরাপদে রাখেন। যেদিন মুহাম্মদ সা. মক্কা বিজয় করেন, তখন কোরাইশগণ তাঁর চারপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সময় এক বৃদ্ধ মহিলা আসেন। মুহাম্মদ সা. তাঁর সাহাবীদের ছেড়ে এই মহিলাকে একপাশে নিয়ে গিয়ে নিজের গায়ের কাপড় মাটিতে বিছিয়ে দিয়ে তাতে সেই মহিলাকে বসিয়ে অনেকক্ষণ কথা বললেন। আয়েশা রা. তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই মহিলা কে? তিনি জবাব দেন, এই মহিলা খাদিজা রা.-এর বান্ধবী। তখন আয়েশা রা. আবার জিজ্ঞাসা করেন, আপনারা কোন বিষয়ে আলাপ করলেন? তিনি বললেন, আমরা খাদিজা রা. এর পুরনো দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেছি। আয়েশা রা. তখন জানতে চাইলেন- আপনি এখনও কি সেই বৃদ্ধ মহিলার কথা স্মরণ করে চলছেন যেখানে আল্লাহ আপনাকে তাঁর চেয়ে উত্তম স্ত্রী দান করেছেন? এই কথা শুনে মুহাম্মদ সা. রাগ করে ফেলেন এবং বলেন, না, আল্লাহর কসম, তিনি আমাকে খাদিজার রা.-এর চেয়ে ভালো কাউকে দান করেন নাই। মানুষ যখন আমাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, তখন সে আমাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে। সবাই যখন কাফির ছিল তখন সে ছিল মুসলমান। কেউ যখন আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি, তখন সে আমায় সাহায্য করেছে। তাঁর গর্ভেই আমার সন্তান হয়েছে। (আল্লামা শিবলী নুমানীর সিরাতুন নবী গ্রন্থ ২য় খন্ড, পৃ. ৮২৮)। আয়েশা রা. বুঝতে পারলেন যে তিনি আল্লাহর রাসুলকে রাগান্বিত করে ভুল করে ফেলেছেন। তাই তিনি মুহাম্মদ সা.কে বললেন, আপনি আল্লাহর কাছে আমার ভুল সম্পর্কে ক্ষমা চান! মুহাম্মদ সা. রাজি হোন। তিনি জানান, আপনি আল্লাহর কাজে খাদিজা রা.-এর জন্য ক্ষমা চান। শেষে তিনি বলেন, চার জন মহিলা : মারিয়াম বিনত ইমরান, ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া, খাদিজা বিনত খাওয়ালিদ এবং ফাতিমা বিনত মুহাম্মদ ছাড়া কোন মহিলাই পরিপূর্ণতার স্তরে পৌঁছতে পারবেন না। ইসলামে খাদিজা রা.-এর অবদান এবং তাঁর মূল্যায়ন বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। ওপরে যে কয়টি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে সেগুলো যদি আমরা খোলা মনে পর্যালোচনা করি তাহলে অবাক বিস্ময়ে অনেক বৃহত্তর মৌলিক বিষয় লক্ষ্য করে থাকব। আরবের সেই অন্ধকার যুগে খাদিজা রা. আত্মার উৎকর্ষ সাধনে, পরকালে মুক্তির লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ হন, এই পথ নিজের ও সমাজের জন্য উৎকৃষ্ট পথ হিসেবে বিবেচনা করেন, এই পথেই ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির পরিত্রাণ নিহিতÑএই সত্য উপলব্ধি করেন। শুধু তাই নয়, এই কাজে নিজের জীবন, অর্থ-বিত্ত নিয়োগ করেন। তিনি নিঃসঙ্কোচে মুহাম্মদ সা. এর নবুওয়তে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সংশয় ও সন্দেহ ছিল না। মুহাম্মদ সা. এর নবুওয়ত লাভের পূর্ব থেকে খাদিজা রা. দৃঢ়প্রত্যয়ী ব্যক্তিসত্তা ছিলেন। মুহাম্মদের সা. চরিত্র ও আচরণে তিনি এক মহান উদ্দেশ্য লক্ষ্য করেছিলেন। তাই জিবরাইল আ:-এর আগমনের পর ক্ষণিকের জন্যও তাঁর মনে কোন রকম ইতস্তত-ভাব দেখা দেয়নি। এসব যাবতীয় বিষয়ে খাদিজা রা. এর গভীর দূরদৃষ্টি ও তীক্ষè পর্যবেক্ষণক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নবুওয়ত লাভের পূর্বে ও পরে সর্বদাই তিনি মুহাম্মদ সা. কে সম্মান করেছেন, তাঁর প্রতিটি কথা বিশ্বাস করেছেন। পঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে তিনি অনড় ব্যক্তিও ছিলেন। সেই জাহিলি যুগেও তিনি ছিলেন পূত-পবিত্র। তিনি কখনো মূর্তিপূজা তো করেননি এমনকি তাদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেন না। খাদিজা রা. নবুওয়তে মুহাম্মদী সা. এর ওপর প্রথম বিশ্বাস স্থাপনকারী এবং তাঁর সাথে প্রথম সালাত আদায়কারী। শুধু তাই নয়, তিনি ইসলামের সূচনালগ্নে ছিলেন মুহাম্মদ সা. এর পরামর্শদাত্রী। ইসলামের ঘোর দুর্দিনে তিনি শক্তি জুগিয়েছেন। তার স্মৃতি শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয়, মানবসভ্যতার ইতিহাসে চিরদিন অমর, অম্লান হয়ে থাকবে।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির