post

মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা)

এর বিচারব্যবস্থা

০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩

জাফর আহমদ

একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার যতগুলো দিক ও বিভাগ প্রয়োজন সেই সব দিক ও বিভাগ দিয়েই মানব সম্প্রদায়ের জন্য দ্বীন ইসলাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সেই সব বিভাগের একজন দক্ষ মহামানব। একজন পূর্ণাঙ্গ মহামানব হিসেবে তিনি ন্যায়পরায়ণ প্রশাসক, সাথে সাথে তিনি ন্যায়পরায়ণ প্রধান বিচারপতিও ছিলেন। দক্ষতার সাথে তিনি যেমন প্রশাসন পরিচালনা করেছেন, তেমনি তিনি ন্যায় ও ইনসাফের সাথে বিচারব্যবস্থা পরিচালনা করেছেন। তিনি তার জীবদ্দশায় আল্লাহর বিধান অনুযায়ী অনেক বিচার ফয়সালা করেছেন। পক্ষপাতিত্ব, প্রভাবিত, আবেগতাড়িত হয়ে কোন বিচারকার্য পরিচালনা করেছেন এমন একটি ছোট্ট ঘটনাও তার বিচারপতি জীবনের ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। তিনি ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করতে গিয়ে কোনদিন নিজের আহাল, আত্মীয়-পরিজন ও জলিল-কদর কোন সাহাবীর পক্ষও অবলম্বন করেননি। তিনি বলতেন, যদি মুহাম্মদের মেয়ে ফাতিমাও চুরি করে, তবে আমি তার বেলায়ও হাত কাটার নির্দেশ দিবো।’ এ জন্য তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে একজন শ্রেষ্ঠতর মহামানবের সাথে সাথে একজন শ্রেষ্ঠ প্রধান বিচারপতিও বটে। তাঁর এ ন্যায়বিচারের কারণেই হাজরা থেকে সান’আ মাউত পর্যন্ত সুন্দরী তনয়া, মূল্যবান অলঙ্কার পরিহিতা, একাকিনী দিনে রাতে পথ চলছে কেউ তাকে জিজ্ঞেস করবে তো দূরের কথা তার দিকে চোখ তুলে তাকাবার প্রয়োজন বোধ করতো না। তাঁর জীবদ্দশায় কয়টি বিচার তার আদালতে এসেছে জানা না থাকলেও অবশ্যই তা নগণ্যই হবে। কারণ সমাজ ও সভ্যতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে অপরাধপ্রবণতা একেবারেই কমে গিয়েছিল। মানুষ অপরাধ করলে বিবেকের অবিরত কশাঘাত সহ্য করতে না পেরে নিজের মামলা নিজেই দায়ের করতো। প্রসিদ্ধ সেই মহিলার ঘটনা আমরা জানি যে জেনা করে রাসূলের (সা) বিচারালয়ে নিজের কৃত অপরাধের বিচার প্রার্থনা করলেন। প্রধান বিচারপতি রাসূল (সা) প্রথমত সন্তান প্রসব, দ্বিতীয়ত আড়াই বছর দুগ্ধ পান করাবার নির্দেশ দিলেন। মহিলা কেঁদে কেঁদে এই ভয়ে চলে গেলেন যে, এ সময়ের মধ্যে যদি আমি বিনাবিচারে মৃত্যুবরণ করি তবে আহকামুল হাকিমিন মহান আল্লাহর বিচারের কাঠগড়ায় কী জবাব দিবো। এই ছিল একজন শ্রেষ্ঠ প্রধান বিচারপতির ন্যায়বিচারের সামাজিক প্রভাব। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় ইনসাফ ও ন্যায়বিচার দারুণভাবে উপেক্ষেত। বিশেষ করে যখন যেই সরকার ক্ষমতায় থাকেন, তাদের মন মর্জি ও হুকুম তামিল করতে গিয়ে ন্যায়বিচার আদালতের কঠিন দেয়ালে মাথা ঠুকে নিজেকে রক্তাক্ত করে। ন্যায়বিচারের করুণ আর্তনাদ ও গগনবিদারি কান্না আমাদের বর্তমান বিচারপতিদের হৃদয়কে ক্ষণিকের জন্য আহত করে না। কত নিরপরাধ নিরীহ বনিআদম চার দেয়ালের ভেতর থেকে পৃথিবীর আলো বাতাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মানবতা বা মানবিক মূল্যবোধ তো আজ গোবেচারা বয়সের ভারে ন্যুব্জ, পাইক-পেয়াদাদের মতো বড় বড় লেজার বুক নিয়ে এ অফিস থেকে ও অফিসে, কে তার কথা শোনে। মানবতার রক্ষক বিচারপতিরাই আজ মানবতাকে দূর কোন মহাসাগরের কালা পানির দেশে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। আদালতকে বলা হয় মানুষের বিচারের শেষ আশ্রয়স্থল। মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণের বিশেষ স্থান। আশাহত মানুষ এ দ্বার থেকে ও দ্বার শেষাবধি ভারসাম্যপূর্ণ দাঁড়িপাল্লার এ অফিসটির দ্বারস্থ হয়। কিন্তু এখানে দেখা যায়, মানবতার সাথে কী পরিমাণ অসদাচরণ করা হয়? প্রথিবীর দেশে দেশে প্রধান বিচারপতিদের সৌজন্যে রাসূল (সা) এর বিচারালয়ের ন্যায়-ইনসাফ ও নিরপেক্ষতার কিছু ইতিহাস আলোচনা করতে চাই। সম্মানিত বিচারপতিগণ যদি আহকামুল হাকিমের তথা সমস্ত বিচারপতিদের বিচারপতি আল্লাহ রাববুল আলামিনের কথা ভেবে রাসূলুল্লাহ (সা) এর বিচারব্যবস্থার দিকে দৃষ্টি দিয়ে নিজেদের মধ্যে ন্যায়-ইনসাফ ও নিরপেক্ষতাকে স্থান দিতে পারেন তবে নিজেরা যেমন প্রশান্তি লাভ করবেন, সাথে সাথে উপকৃত হবে বিশ্বমানবতা। হাশরের দিনের কথা একটু স্মরণ করুন, যখন ক্ষমতার সর্বময় দ- হাতে নিয়ে বিচারপতির আসনে আসীন হবেন তখন দুনিয়ার বিচারপতিদের কী অবস্থা হবে? যারা রাসূল (সা) অনুসৃত পন্থায় বিচার-ফয়সালা করেছেন তাদের জন্য কোন চিন্তা থাকবে না। রাসূল (সা) এর অনুসৃত নীতি ও বিচার ফয়সালাই কেবল মানবসমাজে ইনসাফ ও আদল পুনঃপ্রতিষ্ঠা হতে পারে। সূরা রহমানে তাকিদ করা হয়েছে : ওজনে বাড়াবাড়ি করো না, ঠিক ঠিকভাবে ইনসাফের সাথে ওজন করো এবং পাল্লায় কম করে দিয়ো না।’’ (্আয়াত ৮-৯) যেহেতু আমরা এমন একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্বলোকে বসবাস করছি যার গোটা ব্যবস্থাপনাই সুবিচার ও ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাই আমাদেরকেও সুবিচার ও ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। যে গণ্ডির মধ্যে আমাদেরকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে সেখানে যদি আমরা বে-ইনসাফী করি এবং হকদারদের যে হক আমাদের জিম্মায় দেয়া হয়েছে,তা যদি হরণ করি তাহলে তা হবে বিশ্ব প্রকৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শামিল। এ মহা বিশ্ব প্রকৃতি জুলুম তো দূরের কথা দাঁড়িপাল্লার ভারসাম্য বিঘিœত হলে কেউ যদি খরিদ্দারকে এক তোলা পরিমাণ জিনিস কম দেয় তাহলে সে বিশ্বলোকের ভারসাম্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। আল্লাহতায়ালা মিযান (দাঁড়িপাল্লা) কায়েম করেছেন অর্থ সুবিচার ও ইনসাফ কায়েম করেছেন। এ মিযানে কমবেশ করো না মানে অবিচার ও বে-ইনসাফী করো না। গোটা বিশ্ব দাড়িপাল্লার মতো ভারসাম্যপূর্ণ। এর মধ্যে সামান্য এদিক সেদিক হলে পৃথিবীতে প্রাণের কোন অবশিষ্ট থাকবে না। সুতরাং সামান্য ক্ষমতা পেয়ে যে ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি করো, আল্লাহ সামান্য আলো-বাতাস, অক্সিজেন, শ্বাস-প্রশ্বাস সামান্য সময়ের জন্য ক্ষমতাধারীর ক্ষেত্রে স্তব্ধ করে দেয়া হয়, তবে চিন্তা করুন কী অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করুন। দাঁড়িপাল্লায় ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি করো না। মনে রাখবেন ক্ষমতায় যারা আছে তাদের প্রাণ আর আপনার প্রাণের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আপনি যদি ন্যায়ের পথে থেকে বিচার-ফয়সালা করেন তবে পৃথিবীর কেউ আপনাকে কিছ্ইু করতে পারবে না। কারণ হায়াত-মওতের ফয়সালা আল্লাহর তরফ থেকেই হয়। আপনার মান-সম্মান, ইজ্জত-অপমান, রিজিকের মালিক মহান রব। প্রভাবশালী ও দুর্বলের বিচার ফয়সালা : বুখারী-মুসলিমে আছে একবার মাখজুমী গোত্রের এক কুরাইশী মহিলা চুরি করে ধরা পড়ে। নবী করীম (সা) তার হাত কেটে ফেলার নির্দেশ দেন। নির্দেশ শুনে লোকজন খুব পেরেশান হয়ে পড়লো। কারণ সেই মহিলা ছিল সম্ভ্রান্ত গোত্রের। তারা বলাবলি করতে লাগলো, উসামা ইবনু যায়িদ ছাড়া আর কে আছে, যাকে আল্লাহর রাসূল (সা) অত্যধিক ভালোবাসতেন। তারা উসামা (রা)কে সুপারিশের জন্য রাসূল (সা) এর কাছে পাঠালেন। যখন তিনি এ ব্যাপারে রাসূল (সা) এর সাথে কথা বললেন, তখন নবী করীম (সা) বললেন, ‘‘হে উসামা! তুমি কি আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা না করার সুপারিশ করতে এসেছো?’’ তখন উসামা ইবনু যায়িদ ভয় পেয়ে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে মাফ করে দিন। আমার ভুল হয়েছে। অতঃপর নবী আকরাম (সা) মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দিলেন। প্রথমে আল্লাহর হামদ ও সানা পেশের পর বললেন, ‘হে লোক সকল! তোমাদের পূর্ববর্তী লোকজন এ কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে। যখন তাদের মধ্যে কোন সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী লোক চুরি করতো তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত এবং দুর্বল লোক চুরি করলে তাকে শাস্তি দিত। ঐ সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ, আজ যদি মুহাম্মদের মেয়ে ফাতিমাও চুরি করতো তবে আমি তার বেলায়ও হাত কাটার নির্দেশ দিতাম।’ মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক বর্ণিত হয়েছে- রাসূলে করীম (সা) এর নিকট এক ক্রীতদাসকে হাজির করা হলো, যে চুরি করেছিল তাকে চারবার নবী করীম (সা) এর কাছে আনা হলে চারবারই তিনি তাকে ছেড়ে দিলেন। পঞ্চমবার তাকে হাজির করা হলে তখন রাসূল (সা) হাত কাটার নির্দেশ দিলেন। পরে ষষ্ঠবার হাজির করা হলে তার একটি পা কেটে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। সপ্তম বার তার অপর হাত কাটার আদেশ দিলেন। অষ্টমবার তার দ্বিতীয় পা কেটে দেন। রাসূলের (সা) আদালতের উল্লেখিত দু’টি বিচার এখানে উল্লেখ করার অর্থ হলো তাঁর বিচারব্যবস্থায় সমাজের প্রভাবশালী বা দুর্বল কোনটিই প্রভাব ফেলতে পারতো না। যা ন্যায়সঙ্গত, যা সঠিক তাই সেখানে বাস্তবায়িত হতো। বাকপটুতার দ্বারা রায় নিজের পক্ষে নেয়া মানে আগুনের টুকরা নেয়া : মুয়াত্তা, বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে- নবী (সা) বলেছেন, ‘আমি তো একজন মানুষ। দু’জন ঝগড়াকারী এসে আমার কাছে অভিযোগ করলে, যে অপেক্ষাকৃত বেশি বাকপটু আমি তার দিকে রায় দিতে পারি। এই মনে করে যে, সে সত্য বলেছে, সাবধান! তোমাদের কেউ যেন এরূপ না করে। এরূপ করলে এবং তার পক্ষে রায় দিলে, সে যেন আগুনের টুকরো নিয়ে গেল।’ বুখারীর অন্য বর্ণনায় আছে, ‘যাকে আমি (ভুল বুঝে) মুসলমানের সম্পদের মালিক বানিয়ে দেবো, তা আগুনের টুকরা মাত্র। ইচ্ছে করলে সে নিতে পারে অথবা ত্যাগ করতে পারে। উভয়ের বক্তব্য শুনে বিচার করা ও রায় দেয়া : আবু দাউদে হযরত আলী (রা) হতে বর্ণিত- তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইয়েমেনে (দায়িত্ব দিয়ে) পাঠাচ্ছেন অথচ আমার বয়স তখন কম, বিচার ফয়সালা করার মতো কোন জ্ঞান বা যোগ্যতা আমার নেই। তিনি বললেন, ‘আল্লাহ তোমার অন্তরকে হিদায়াত দেবেন এবং তোমার জবান দৃঢ় রাখবেন। যখন বাদি-বিবাদি তোমার সামনে এসে উপস্থিত হবে তখন একজনের বক্তব্য শুনেই রায় দেবে না বরং দু’জনের বক্তব্য শুনবে। এতে ফায়সালার দিগন্ত তোমার সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে।’ হযরত আলী (রা) বলেন, এরপর আমি সেখানে বিচার ফয়সালা করতে গেলাম কিন্তু কোনো বিচারের রায় দিতে গিয়ে আমি কখনো সন্দেহে পড়িনি। আসুন মানবতার মহান বন্ধু, ন্যায়পরায়ণ শাসক ও বিচারক মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) এর ন্যায় তাকওয়ার ভিত্তিতে বিচার ফয়সালা করি। আহকামুল হাকিমিনের সামনে হাজির হওয়ার আগে এমন কোন বিচার ফয়সালা না করি যাতে মহান প্রভুর সামনে অপমানিত হতে হয় এবং কঠিন আজাবের সম্মুখীন হতে হয়। আল্লাহ আমাদের শাসক ও বিচারপতিদের সুমতি দিন। লেখক : ব্যাংকার

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির