post

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় আওয়ামী লীগে উৎকণ্ঠা সঙ্কটে দেশ

ড. মুহাম্মাদ রেজাউল করিম

০৭ মার্চ ২০২২

১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে রুশো আক্ষেপ করে বলেছিলেন, মানুষ স্বাধীন সত্তা হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেও সে সর্বত্র শৃঙ্খলাবদ্ধ। Fundamental rights, basic human rights. স্লোগান না যত চমকপ্রদ তার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক, মনুষ্যত্বহীনতা, মানবিকতা, পাশবিকতার বিকৃত বাস্তবতা নিয়ে নাগরিকরা সময় অতিবাহিত করছে। সম্প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ড. বেনজীর আহমেদ ও ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বেনজীর আহমেদ বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক (আইজিপি)। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর জানিয়েছে, মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের জন্য গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি নিষেধাজ্ঞা কর্মসূচির অধীনে দেশটির ট্রেজারি বিভাগ র‌্যাব, বেনজীর আহমেদ ও অন্য ছয় কর্মকর্তাকে এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনেছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো মূল্যবোধকে সামনে রেখে বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাসহ যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটিকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনের পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে বাইডেন প্রশাসনের কৌশলগত অবস্থান হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে এই নিষেধাজ্ঞা আরো বাড়তে পারে। এতে উদ্বিগ্নতা ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে আওয়ামী লীগের মধ্যে চরমভাবে। শুধু তাই নয় সরকারের উচ্চপদস্থ এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা মানে হচ্ছে তাদের মানসিক শক্তিকে দুর্বল করা, যাতে করে গুম খুন ক্রসফায়ার এবং রাজনৈতিক মতের ওপর বল প্রয়োগ বন্ধ হয়। দেশের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি যদি অন্যায়ভাবে হামলা-মামলা, গুম খুন ক্রসফায়ার ও বলপ্রয়োগের মুখোমুখি থেকে মুক্ত হয়ে রাজপথে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই করতে পারে তাহলে সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে পড়বে।

তাছাড়া গত বছর গণতন্ত্র সম্মেলন থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মানবাধিকার দিবসে বিশেষ বাহিনী র‌্যাব ও কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। একই সঙ্গে লেখক অভীজিৎ রায়ের পলাতক খুনিদের তথ্যের জন্য পাঁচ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে দেশটি। মূলত পৃথিবীতে মৌলিক অধিকার ব্যতীত মানুষ স্বাধীনভাবে সম্মানের সাথে বসবাস করতে পারে না। জাতি, ধর্ম, গোত্র, বর্ণ সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু রাষ্ট্র যখন নাগরিক অধিকারের বাধা হয়ে দাঁড়ায় তখন মানুষকে রক্ষা করবে কে? মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, সভা সমিতি করার স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম পালন করার অধিকার, আইনের সুশাসন, ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, জীবিকা অর্জন, সম্পত্তির অধিকার ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে চাহিদা পূরণের অধিকার এসব কিছুই মানুষের সাংবিধানিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সুরক্ষা দেয়। এর কোন কিছুই মানুষের প্রতি কারো করুণা নয়, সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার।

মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, মূল্যবোধ এবং চলাফেরার স্বাভাবিক অধিকার যখনই নষ্ট হয় তখন মানুষ তার প্রকৃত নাগরিক অধিকার থেকেই শুধু বঞ্চিতই হয় না বরং যে অথবা যারা এটিকে বাধাগ্রস্ত করে, মৌলিক অধিকার হরণ করে, তারা বরং জঘন্যতম অপরাধে অপরাধী হয়ে পড়ে। অর্থাৎ মানুষের প্রকৃতিগত চাহিদা ও মর্যাদা স্বাধীনতা সমতা ও সমৃদ্ধি ইত্যাদি অধিকারের কথা ব্যক্ত করে থাকে। মানুষের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের শপথেরই অংশ। এটি লঙ্ঘন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশের র‌্যাব বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সময় সাপেক্ষ এবং জটিল হবে ধারণা করছেন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সামনে রেখে দেয়া এ বিধি-নিষেধ প্রত্যাহারে বাংলাদেশ সরকারের নানামুখী তৎপরতা চালাতে হবে। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ১২ ডিসেম্বর মার্কিন এই সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এর পেছনে ‘বাংলাদেশ বিরোধী কিছু ব্যক্তি ও অপশক্তির’ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। অর্থাৎ তিনি জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই বিষয়টি সমাধানের চেয়ে একে রাজনীতিকরণের দিকে ঠেলে দিয়ে অপরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছেন।

বিরোধী মতের রাজনীতিকরাও অবশ্য সরকারের পেশিশক্তির ব্যবহারের কারণেই এই নিষেধাজ্ঞা বলে দাবি করছেন। পাশাপাশি অনেকের ভিন্নমতও আছে বাংলাদেশের সকল মানুষের সামনে এটি একটি জাতীয় সমস্যা। আর জাতীয় সমস্যা জাতীয়ভাবে সবাইকে নিয়ে সমাধান করতে হয়। আর সেটা তখনই সম্ভব যখন দেশ একটি গণতান্ত্রিক সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নতুন নয়। বর্তমান সরকারের শুরু থেকেই এই অভিযোগ হয়ে আসছে এবং তা ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে প্রবলতর হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচন কমিশনসহ সব প্রতিষ্ঠান সরকারের কুক্ষিগত হয়েছে। সেখানে বসানো হয়েছে অনুগত লোকদের। তারা যা ইচ্ছে তাই করছে। কোনো কিছুরই জবাবদিহি নেই কোথাও। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হওয়াসহ সব অপরাধ ব্যাপকতর হয়েছে।

মানবাধিকার রক্ষা করার জন্য দেশ-বিদেশের প্রায় সব মানবাধিকার সংগঠন বারবার আহ্বান জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান নিচে দেখানো হয়েছে। উপরন্তু কোনো কোনো রিপোর্টে বলা হয়েছে, হাইব্রিড গণতন্ত্র, কর্তৃত্ববাদী সরকার ইত্যাদি। তবুও পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি। বরং ক্রমাবনতি হয়েছে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা মানববন্ধন করেছেন, তাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। কবর কোথায় দেওয়া হয়েছে জানতে চেয়েছেন, যাতে তারা গিয়ে কবর জিয়ারত করতে পারেন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের কিছু ফেরত এসেছে। কিন্তু তাদের কেউই মুখ খোলেনি। কিন্তু ৫০ বছর ধরে স্বাধীন একটি দেশে মানবাধিকারের এই পরিস্থিতি কেন চলমান? যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের সেরা শক্তিধর। এটা আর্থিক, সামরিক, উদ্ভাবন তথা সব দিক দিয়েই। অবশ্য কতিপয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অভিমত, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি শক্তিধর চীন। তার পর যুক্তরাষ্ট্র। শক্তির দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম হোক আর দ্বিতীয়ই হোক, তা বিবেচনার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বিশ্বে এখনো প্রভাব বেশি যুক্তরাষ্ট্রের। এমনকি সেটা জাতিসংঘে পর্যন্ত। সংস্থাটি চলে সদস্যদের চাঁদায়, যার প্রায় অর্ধেক দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপেরও প্রায় সব দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সখ্য সর্বাধিক। বাংলাদেশের রফতানি মূলত গার্মেন্টস, যার অধিকাংশই যায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সর্বাধিক সদস্য রয়েছে বাংলাদেশের। এ খাতেও দেশের প্রচুর অর্থ আয় হয়।

বাংলাদেশের আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে সর্বাধিক হচ্ছে জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলোর। ঋণের ক্ষেত্রেও তদ্রƒপ। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতার কারণে এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের খুবই ঘনিষ্ঠতা রয়েছে চীন ও ভারতের সাথে। ঋণ প্রদান ও উন্নয়নকর্মে সহায়তার ক্ষেত্রে চীন সর্বাধিক। এ নিয়ে ভারত প্রায়ই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সৃষ্ট নবতর সঙ্কট থেকে উত্তরণের প্রধান উপায় হলো জাতীয় ঐক্য। তাই দল মতের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় জোর তৎপরতা চালাতে হবে। দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে কার্যকর গণতন্ত্র। কিন্তু দেশে কার্যকর গণতন্ত্র কায়েম করতে হলে প্রথমে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন, যা চলমান সরকারের আমলে আর সম্ভব নয় তা নির্বাচন কমিশন গঠনের নতুন আইন দেখেই বোধগম্য হয়। কিন্তু জনগণ এই অচলাবস্থা থেকে মুক্তি চায় যার স্বরূপ পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এর বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে তুমুল জন-আন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে নির্বাচন-পূর্ব সময়ে। শুধু সঠিক নেতৃত্বের অভাব এবং ভালো বিকল্প না থাকায় জন আন্দোলন গড়ে উঠছে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এক্ষেত্রে কোন কোন দল তাদের ব্যক্তিগত ও দলীয় ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত থাকায় জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। কিন্তু ছোট ছোট অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ পরিহার করে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। অনেকে মনে করছেন বড় রাজনৈতিক দলগুলো যদি আগামী জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে তাহলে জনগণ তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হবে। কারণ এদেশের মানুষ কখনো অন্যায় অবিচার, স্বৈরাচার ও অগণতান্ত্রিক শক্তির কাছে মাথা নত করেনি। Dr. D. P Khanna এর কথা দিয়ে শেষ করতে চাই- তিনি বলেছেন, The most startling feature of the concept of Human rights is that it is so easy to understand. So difficult to define add impossible to ignore. অর্থাৎ মানবাধিকার ধারণাটির অত্যন্ত চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হলো, ইহা বোঝা অত্যন্ত সহজ, সংজ্ঞায়িত করা অত্যন্ত কঠিন এবং অবজ্ঞা করা অসম্ভব। আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাকলোয়েন চার্লস সমসাময়িক কালের মানুষের দুরবস্থা সম্পর্কে পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমার মতে ইতিহাসের কোনো যুগেই কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের পক্ষ হতে এত কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়নি, প্রশাসনের সামনে বিচার বিভাগ কখনও এতটা অসহায়ত্ব বোধ করেনি, এই বিপদ অনুভব করা এবং তার প্রতিকারের ব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্বে কখনও চিন্তা করার এতটা তীব্র প্রয়োজন দেখা দেয়নি যতটা আজ দেখা দিয়েছে। (Mcllwain Chareles, Howard, ‘Constitutionalism’, Great Seal Books, New York, B 1947, P 140)|

১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে মানুষের মৌলিক অধিকার যেসব বিপদের সম্মুখীন তার মূল্যায়ন করতে গিয়ে রবার্ট ডেবি তাঁর দুশ্চিন্তার কথা নি¤েœাক্ত বাক্যে প্রকাশ করেন: ‘প্রায় দুইশত বছর পূর্বেকার এক বৈপ্লবিক সংঘাতের কথা, যা আজকের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চেয়ে ভিন্নতর কিছু ছিল না, উল্লেখ করে টমাস পেইন নিজের সমসাময়িক লোকদের অন্ধ চোখগুলোকে একটি তিক্ত সত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।’ তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতা পৃথিবীর আনাচে কানাচে থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, এই পলাতককে ধর এবং মানবতার জন্য সময়মতো একটি আশ্রয়স্থল নির্মাণ কর। আজ হাজারো বেদনাপূর্ণ কথা, হাজারো প্রচার ও ঘোষণাপত্রের পরও স্বাধীনতা এখনও রূপকথার পাখি। আমেরিকাই হোক অথবা রাশিয়া, পর্তুগাল, অ্যাঙ্গোলা, ইংল্যান্ড, রোডেশিয়া বা বোস্টনই হোক কোথাও তার নাম নিশানাও নাই।’ জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র সত্ত্বেও আজকের মানুষও রুশোর যুগের মানুষের মতো সর্বত্র পরাধীনতা শৃঙ্খলে আবদ্ধ এবং পূর্বে প্রফেসর ম্যাকলোয়েন মানুষের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ হতে যে বিপদের আশঙ্কা করেছিলেন তা কেবল মারাত্মক আকারই ধারণ করেনি, বরং যতই দিন যাচ্ছে তা আরও অধিক মারাত্মক হচ্ছে। মানুষ নিজের জন্য জীবনের কোনো পথ নিজেই রচনা করতে পারে না। সামগ্রিক জীবনের সমস্ত সমস্যার দিকে পুরোপুরি লক্ষ করা হবে। ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক জীবনে সুবিচার, ইনসাফ ও সত্যদৃষ্টি সহকারে ব্যবহার করা। বস্তুত মানুষ নিজেই যখন নিজের পথ-প্রদর্শক ও আইনপ্রণেতা হয়ে বসেছে।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট যে মহাসনদ ঘোষণা করেছিল তা যেন এই ক্ষেত্রে ছিল মানবীয় প্রচেষ্টার সর্বোচ্চ উত্থান। ৩০ দফা সংবলিত এই মহাসনদ। মানব পরিবারের সকল সদস্যের সহজাত মর্যাদা ও সম অবিচ্ছেদ্য অধিকারসমূহের স্বীকৃতি বিশ্বে স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও শান্তির ভিত্তি; যেহেতু মানবিক অধিকারসমূহের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা মানবজাতির বিবেকের পক্ষে অপমানজনক বর্বরোচিত কার্যকলাপে পরিণতি লাভ করেছে। মানুষের সর্বোচ্চ আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হিসেবে এমন একটি পৃথিবীর সূচনা ঘোষিত হয়েছে যেখানে মানুষ বাক ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং ভয় ও অভাব হতে নিষ্কৃতি লাভ করবে; যেহেতু চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে মানুষকে অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে বাধ্য না করা হলে মানবিক অধিকারসমূহ অবশ্যই আইনের শাসনের দ্বারা সংরক্ষিত করা উচিত। জাতিসংঘভুক্ত জনগণ সনদের মাধ্যমে মৌল মানবিক অধিকারসমূহ, মানুষের মর্যাদা ও মূল্য এবং নারী ও পুরুষের সম-অধিকারের প্রতি আস্থা পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং সামাজিক অগ্রগতি ও ব্যাপকতর স্বাধীনতায় উন্নততর জীবনমান প্রতিষ্ঠাকল্পে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ; যেহেতু সদস্য রাষ্ট্রসমূহ জাতিসংঘের সহযোগিতায় মানবিক অধিকার ও মৌল স্বাধিকারসমূহের প্রতি সার্বজনীন শ্রদ্ধা ও মান্যতা বৃদ্ধি অর্জনে অঙ্গীকারাবদ্ধ; যেহেতু সকল অধিকার ও স্বাধিকারের ব্যাপারে একটি সাধারণ সমঝোতা উক্ত অঙ্গীকার সম্পূর্ণরূপে আদায় করার জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রের অধ্যয়ন এবং তৎসম্পর্কিত পর্যালোচনায় এ কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবজাতির সমষ্টিগত প্রচেষ্টাও তার জন্য সম্মানজনক ও নিরাপদ জীবন যাপনের কোনো গ্যারান্টি দিতে পারেনি। তারা আগেও নিজ নিজ দেশে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর স্বৈরাচারের যতটা শিকার ছিল আজও তদ্রƒপ রয়ে গেছে। বরং সরকারের কার্যক্ষেত্রের পরিসীমার প্রসার এবং তার এখতিয়ারের ক্রমবৃদ্ধি মৌলিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণ অর্থহীন করে তুলেছে। মানবাধিকারের সনদ একটি চিত্তাকর্ষক দলিলের অতিরিক্ত কিছু নয়। এর মধ্যে অধিকারসমূহের একটি তালিকা ঠিকই সন্নিবেশ করা হয়েছে, কিন্তু এর কোনো অধিকার কার্যকর করার মতো শক্তি এর পেছনে নেই। তা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উপর আইনগত বিধিনিষেধ আরোপ করে তাদেরকে মৌলিক অধিকার আত্মসাৎ হতে বিরত রাখার না কোন ব্যবস্থা করেছে, আর না কোনো ব্যক্তিকে অধিকার বঞ্চিত করার ক্ষেত্রে কোনরূপ আইনগত প্রতিকার প্রার্থনার সুযোগ করে দিতে পেরেছে। এভাবে মানবাধিকারের হেফাজতের বেলায় উক্ত সনদ সম্পূর্ণ অকৃতকার্য ও অনির্ভরযোগ্য দলিলে পরিণত হয়েছে। তা থেকে সর্বাধিক উপকার এতটুকুই পাওয়া গেছে যে, তা মানবাধিকারের একটি মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করেছে এবং বিশ্বভ্রাতৃত্বকে নিজেদের অধিকার রক্ষার ক্রমবিকাশমান অনুভূতি ও চেতনা দান করেছে, সমাজে ব্যক্তির গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছে এবং তার সাহায্যে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলো নিজেদের আইন কানুন রচনার সময় মৌলিক অধিকারের প্রথাগত অধ্যায়টি অনায়াসে সংযোজন করে নিচ্ছে। উল্লিখিত ঘোষণাপত্রের মর্যাদা সম্পূর্ণ নৈতিক। আইনগত দৃষ্টিকোণ হতে তার কোন ওজন ও মর্যাদা নেই। মৌলিক অধিকারের রক্ষক হিসেবে উক্ত সনদপত্রের শক্তি ও গুরুত্ব এই বাস্তব সত্য হতে অনুমান করা যায় যে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক বন্দীদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশ্ব মানবাধিকার কমিশন (Amnesty International) নামক আন্তর্জাতিক সংগঠনের ১৯৭৫-৭৬ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী সম্মিলিত জাতিসংঘের ১৪২টি সদস্য দেশের মধ্যে ১১৩টি দেশে মৌলিক অধিকার চরমভাবে পদদলিত হয়েছে এবং শক্তির অপব্যবহার, অবৈধ ধরপাকড়, রাজনৈতিক আটক, নির্যাতন নিষ্পেষণ, মৃত্যুদণ্ডের ঘটনা, প্রচারমাধ্যমের উপর বিধিনিষেধ আরোপ, বিচার বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস, স্বৈরাচারী আইন জারি এবং মৌলিক অধিকারসমূহ বাতিল বা স্থগিত করার পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুঃখজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

মানবজাতির মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে জাতীয় সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মহাসনদের ব্যর্থতার মূল্যায়ন করার পর এখন আমরা এই মৌলিক প্রশ্নে আসছি যে, শেষ পর্যন্ত মানবজাতি নিজেদের অধিকার সংরক্ষণে কোনো সন্তোষজনক ব্যবস্থা নির্ধারণে এখন পর্যন্ত কেন সফল হতে পারেনি এবং এ প্রসঙ্গে তাদের চিন্তাধারা এবং দৃষ্টিভঙ্গির অকৃতকার্যতা এবং বুদ্ধিবৃত্তি ও চেতনাশক্তির ব্যর্থতার মূল কারণসমূহ কী? উপরোক্ত প্রশ্নের সুস্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ জবাব আমরা কুরআন মজিদে পেয়ে যাচ্ছি। কুরআনে হাকিম আমাদের বলে দিচ্ছে যে, এই সমস্ত অপ্রীতিকর অবস্থার কারণ মাত্র একটি। তোমরা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সত্তার স্থান ও মর্যাদার পরিবর্তন করে দিয়েছ এবং যেসব মনগড়া প্রভুদের নিজেদের আনুগত্যের কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে নিয়েছ তারাই আজ তোমাদের ঘাড় মটকাচ্ছে এবং তোমাদের অধিকারসমূহ পদদলিত করছে। কুরআন বলে যে, মানবজাতির সর্বপ্রথম চুক্তি তাদের সৃষ্টিকর্তা ও অধিপতি এবং এই বিশ্বজগতের প্রকৃত শাহেন শাহ ও শাসকের সাথে হয়েছিল এবং এই চুক্তির আলোকে আল্লাহ তায়ালাকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মেনে নিয়ে প্রত্যেকের নিকট হতে এ শপথ গ্রহণ করা হয়েছিল যে, তাঁকে ছাড়া আর কাউকে আইনদাতা ও প্রতিপালক হিসেবে মান্য করা যাবে না এবং তাঁর সত্তা, গুণাবলি অথবা ক্ষমতায় কাউকে অংশীদারও সাব্যস্ত করা যাবে না। এই শপথ ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ মানবজাতিকে নিজের প্রতিনিধি (খলিফা) নিয়োগ করে এবং একটি জীবনব্যবস্থা দান করে স্বীয় রাজ্যে প্রেরণ করেন, যেখানে তাদের সমস্ত ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত বিষয় ঐ জীবনব্যবস্থা অনুযায়ী এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীর পক্ষ হতে সময়ে সময়ে নিজের নবীগণ, আসমানি কিতাবসমূহ ও সহিফার মাধ্যমে প্রাপ্ত নির্দেশনার অধীনে পরিচালনা করার কথা ছিল। এই চুক্তিতে বারবার যার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, যা ক্রমাগত নবায়িতও হয়ে আসছিল এবং যা আখেরি জামানার নবী হযরত মুহাম্মাদ সা.-এর উপর পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ আকারে নাজিল করে এবং যে কোন প্রকারের বিকৃতি হতে নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা করে কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য পথ প্রদর্শনের স্থায়ী ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়েছে। এই চুক্তিপত্রে সর্বময় কর্তৃত্বের মালিকের অধিকার ও এখতিয়ার, তাঁর রাজত্বের সীমারেখা, তাঁর সাথে মানুষের সম্পর্কের ধরন, পৃথিবীতে মানুষের মর্যাদা, তার জীবনের উদ্দেশ্য, উদ্দেশ্য লাভের উপায়-উপকরণ, সাফল্য ও ব্যর্থতার মাপকাঠি, মানুষ ও মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনের কর্মক্ষেত্র, খোদায়ী রাজত্বে তাঁর বান্দাদের সামগ্রিক বিষয়ে তত্ত্বাবধানকারী কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার সীমারেখা, ব্যক্তির মৌলিক অধিকার, আনুগত্যের সীমা ও শর্তাবলি এবং আখিরাতে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারীর সামনে ব্যক্তির প্রতিটি কাজের জবাবদিহির পর আমলনামা অনুযায়ী পুরস্কার অথবা শাস্তি লাভের এমন সুস্পষ্ট বক্তব্য পেশ করা হয়েছে যে, তার আলোকে জীবনের সঠিক পথ পরিষ্কার ও উদ্ভাসিত হয়ে তোমাদের সামনে এসে গেছে। সেই সর্বপ্রথম প্রতিশ্রুতি কি ছিল যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের নিকট হতে গ্রহণ করেছেন। “স্মরণ কর! তোমার প্রতিপালক আদম সন্তানের পৃষ্ঠদেশ হতে তাদের বংশধর বের করেন এবং তাদের নিকট হতে নিজেদের সম্পর্কে সাক্ষ্য গ্রহণ করেন- আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলল, নিশ্চয়ই, আমরা সাক্ষী রইলাম। এই স্বীকারোক্তি গ্রহণ এই জন্য যে, তোমরা যেন কিয়ামতের দিন না বল: আমাদের পূর্বপুরুষরাই তো আমাদের পূর্বে শিরক করেছে, আর আমরা তো তাদের পরবর্তী বংশধর। তবে কি পথভ্রষ্টদের কৃতকর্মের জন্য তুমি আমাদের ধ্বংস করবে।” (সূরা আরাফ : ১৭২-১৭৩)। তাই ইসলামের সার্বজনীন মানবাধিকার অনুসরণের মাধ্যমেই কেবল ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি সম্ভব হবে।

লেখক : সহকারী সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির