post

যুদ্ধাপরাধের বিচারের রকমফের

১০ অক্টোবর ২০১১
সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা যা আওয়ামী লীগের পক্ষে যায় তা-ই হয়ে ওঠে যুগান্তকারী আর ঐতিহাসিক। শেখ মুজিব হত্যার আপিল শুনতে হাইকোর্টের বিচারপতি বিব্রত হওয়ায় আদালতের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো: নাসিমের নেতৃত্বে লাঠি মিছিল এবং ‘লাঠি কোথায় মারতে হয় আওয়ামী লীগ তা জানে’ আদালতের বিরুদ্ধে এহেন গর্হিত মন্তব্যও তাদের ভাষায় ঐতিহাসিক ও আদালতের ভাব মর্যাদা বৃদ্ধিতে খুবই সহায়ক (?) বৈকি! এমনকি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীনের কেয়ারটেকার সরকারের সময়ে প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মাননীয় প্রধান বিচারপতির এজলাস ভাঙচুর ও আদালতে নাশকতা চালানো এবং পরবর্তীতে আদালত ভাঙচুর মামলা ও হত্যা মামলার আসামিকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগও ঐতিহাসিক। একই ধরনের ঘটনায় আদালতে প্রতিপক্ষ আইনজীবীদের সাথে হাতাহাতির কারণে সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী অ্যাডভোকেট এম ইউ আহমদকে পুলিশ কর্তৃক পিটিয়ে হত্যা ও চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে হত্যা প্রচেষ্টাকে ঐতিহাসিক না বলে কোন উপায় নেই। একইভাবে আদালতের রায়ের অপব্যাখ্যা করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতি বাতিল ঐতিহাসিক, যুগান্তকারী ও জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার কালজয়ী পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছেন সদ্যবিলুপ্ত সংবিধান সংশোধন কমিটির কো-চেয়ারম্যান বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো তিনিই আবার ১৯৯৪ সালে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় দল নিরপেক্ষ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতিকে যুগান্তকারী আখ্যা দিয়েছিলেন। আদর্শিকভাবে দেউলিয়া হলেও এতটা নিচে নামা বোধ হয় আওয়ামী লীগের মত ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের জন্য মোটেই শোভনীয় হয়নি। বিষয়টি যদি এখানেই শেষ হতো তাহলে হয়তো বিষয়গুলো জনগণের বিম্মৃতির অন্তরালেই চলে যেত। কিন্তু যারা ইতিহাস সৃষ্টিতে করিৎকর্মা তাদের বোধ হয় সব সময়ই যুগান্তকারী হতে হয়। আর সে ধারাবাহিকতায় বাবু সেনগুপ্ত নতুন ফতোয়া জারি করে বসেছেন। তিনি বিগত ২৪ আগস্ট প্রয়াত আওয়ামী নেত্রী আইভি রহমানের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু অ্যাকাডেমি ঢাকা শাখা আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচারের চেয়ে ২১ আগস্ট হত্যার বিচার বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ এ কথা বলে বাবু সেনগুপ্ত লোক হাসালেও দেশের মানুষ এতে মোটেই বিস্মিত হয়নি। কারণ, অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কথিত যুদ্ধাপরাধকে জাতির এক নম্বর সমস্যা ও জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে কথিত বিচার শুরু করলেও এখন যুদ্ধাপরাধের বিচার কেন অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল তা নিয়ে দেশের মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নতুন করে এক রহস্যের জন্ম দিল। কিন্তু দেশের মানুষ এই রহস্য উদঘাটন করেই ছাড়বে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। একটা সময় ছিল যখন আওয়ামী লীগ দেশের ইসলামী শক্তি ও নেতৃত্বকে রাজাকার, আলবদর, আসশামস, মৌলবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে ব্যাপকভাবে গালমন্দ করেছে। উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দেশের মানুষের কাছে বিতর্কিত করার মাধ্যমে গণবিচ্ছিন্ন করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চরিত্র হনন করা। কিন্তু দীর্ঘ কালের পরিক্রমায় সে প্রচেষ্টায় তারা সফল হতে পারেনি বলেই প্রতীয়মান হয়। কারণ, আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্র শক্তিদের সম্মিলিত অপপ্রচারে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনে কোন রেখাপাত করেছে বল মনে হয় না বরং এই ধর্মীয় আদর্শের দলগুলোর শক্তিগুলো উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পেয়েছে। দেশের ইসলামী শক্তিগুলো দেশের ক্ষমতার পালাবদলে একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তারা ইতোমধ্যেই ক্ষমতার কোমল পরশ স্পর্শ করতেও সক্ষম হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের অবদান নেহাত কম নয় বরং তাদের অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ির কারণেই ইসলামী শক্তিগুলো জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে। আওয়ামী লীগ একটা জায়গায় মারাত্মকভাবে ব্যর্থতার পরিচয়ও দিয়েছে। আর তা হলো তারা ইসলামী শক্তিগুলোকে কখনোই বন্ধু বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করতে পারেনি বরং তারা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট ইসলামী শক্তিকে জানপ্রাণের শত্র“ই মনে করেছে। এ কথার প্রমাণ মেলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো: নাসিমের বক্তব্য থেকে। তিনি এক আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘‘বিএনপি-জমায়াত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয় বরং শত্র“।’ বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে প্রকাশ্যে শত্র“ ঘোষণা করা কোনভাবেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বা শিষ্টাচারের জন্য মোটেই সহায়ক নয়। আওয়ামী লীগ নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক দাবি করলেও অর্ধশতাব্দীর অধিক সময়ে তারা সে কথার যথার্থতা প্রমাণ করতে পারেনি। এর কারণ খুবই পরিষ্কার। কারণ, আওয়ামী লীগ নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি বলে দাবি করলেও আসলে তারা ভেতরে ভেতরে চরম ধর্মবিদ্বেষী। আর এই বিদ্বেষ থেকে আওয়ামী লীগের সাথে ইসলামী শক্তির যোজন যোজন ফারাক তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগ যদি তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ব্যাপারে এমন খামাখাই বিদ্বেষ সৃষ্টি না করতো, তাহলে হয়তো আমাদের দেশের রাজনীতির ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতো। কারণ, ইসলামী শক্তিগুলো যে বিএনপির সাথে অকৃত্রিমভাবে গাঁটছড়া বেঁধেছে, তা হয়তো হতো না। বিএনপির জাতীয়তাবাদী আদর্শ ও ইসলামী আদর্শের মধ্যে যোজন যোজন ফারাক থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র সহনশীল গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই বিএনপি’র সাথে ইসলামী দলগুলোর রাজনৈতিক ঐক্য এখন সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। কিন্তু আওয়ামী লীগের অসহিষ্ণু ও প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণেই ধর্মীয় শক্তিগুলোর আস্থা হারিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা না করে এখন আধিপত্যবাদী শক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে এবং তারা সব সময় পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসার সকল কলাকৌশলের অংশ হিসেবে দেশ, জনগণ ও দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়ে অতিমাত্রায় ভারত তোষণনীতি গ্রহণ করেছে। আর সে ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনার সরকার সিলেটের তামাবিলের ২৬১ একর জমি ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। অতীতে শেখ মুজিব ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন দক্ষিণ বেরুবাড়ী ইউনিয়ন। মুজিব দিয়েছিলেন ফারাক্কা বাঁধের অনুমোদন, আর হাসিনা দিচ্ছেন টিপাইমুখ বাঁধের উন্মুক্ত লাইসেন্স। দেশের সম্পদ ভারতের হাতে তুলে দেয়ার ব্যাপারে পিতা-কন্যার মধ্যে বেশ সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ সফরে বাংলাদেশ ভারতের সাথে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করতে পারেনি বরং ট্রানজিট চুক্তির আগেই আশুগঞ্জ দিয়ে ভারতকে ট্রানজিটের নামে করিডোর প্রদান করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ অতীতে বিভিন্ন রুঢ় ভাষায় ইসলামী শক্তিকে গালমন্দ করলেও এতে হালে পানি না পেয়ে এখন তাদের আক্রমণের পদ্ধতিটা কিছুটা পাল্টিয়েছে। অতীতে তারা ধর্মীয় শক্তিগুলোকে বিভিন্ন অপবিশেষণে বিশেষিত করে ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ হবার পর এখন নতুন জিগির তোলা হয়েছে। এখন তারা ইসলামী দলগুলোর জনপ্রিয় নেতাদেরকে কথিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করে তাদের বিচার করতে চায়। অতীতে তারা এ ধরনের কথা না বললেও বিগত ফখর-মইনের জরুরি সরকারের সময় কথিত যুদ্ধাপরাধ নিয়ে রীতিমত খিস্তিখেউর শুরু হয়। সে সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ইফতেখার আহমদ চৌধুরী বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করলে তা খুব একটা হালে পানি পায়নি। কিন্তু মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রত্যয় ঘোষণা করে জাতিকে কথিত কলঙ্ক মুক্তির বাণী শোনায়। তারা ঘোষণা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। ভাবসাব দেখলে মনে হয় কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারলেই মনে হয় দেশে আর কোন সমস্যা থাকবে না বরং দেশে এক অনাবিল শান্তির বন্যা বইয়ে যাবে। আইনমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে বহির্বিশ্বের সমর্থন লাভের জন্য বিভিন্ন দেশ সফর করেন। সর্বশেষ তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এসে আমাদেরকে শোনালেন যুদ্ধাপরাধ নয় বরং সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করবে। মূলত যারা যুদ্ধবিধি লংঘন করে যুদ্ধ করে তাদেরকে যুদ্ধাপরাধী বলা হয়। কিন্তু কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে যাদের বিচারের কথা বলা হচ্ছে তারা কোন যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। আসলে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তৎকালীন সরকার তদন্তের মাধ্যমে ১৯৫ জন পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এরপর ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে চিহ্নিত অপরাধীদের বিচারের কথা ঘোষণা করে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় : Investigations into the crimes committed by the Pakistani occupation forces and their auxiliaries are almost complete. Upon the evidence, it has been decided to try 195 persons of serious crimes, which include genocide, war crimes, crimes against humanity and breaches of article 3 of the Geneva conventions, murder, rape and arson. Trials shall be held in Dacca before a special tribunal consisting of having status of judges of the Supreme Court. The trials will be held in accordance with universally recognized judicial norms, eminent international jurists will be invited to observe the trial. The accused will be afforded facilities to arrange their defence and to engage counsel of their choice including foreign counsel. A comprehensive law providing for the constitution of the tribunal, the procedure to be adopted and other necessary materials is expected to be passed this month. The accused are expected to be produced before the tribunal by the end of May 1973. বাংলাদেশ সরকারের এই বিজ্ঞপ্তি অনুসারে যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর তালিকা করা হয়েছিল, তারা সবাই ছিল পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন সেনাকর্মকর্তা। এই তালিকায় কোন বেসামরিক ব্যক্তি বা বাংলাদেশীর নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এদের বিচারের জন্য বাংলাদেশের পার্লামেন্টে ১৯ জুলাই ১৯৭৩ একটি আইন পাস করা হয়। আর তা হচ্ছে Inernational Crime (tribunal) Act-1973. এই আইনটি পাস করার আগে ১৫ জুলাই ১৯৭৩ সংবিধান সংশোধন করা হয়। কারণ, এই আইনের অনেক বিধান সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকারের সাথে সংঘর্ষিক। পরবর্তী বছরের বিভিন্ন সময় পাকিস্তান ও ভারত, বাংলাদেশ ও ভারত এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে অব্যাহত আলোচনার ফল হিসেবে উপমহাদেশের শান্তি ও সমঝোতার স্বার্থে এবং পাকিস্তান সরকারের ভুল স্বীকার ও বাংলাদেশের জনগণের কাছে ভড়মরাব ধহফ ভড়ৎমবঃ-আবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চূড়ান্ত আলোচনা শেষে একটি চুক্তির মাধ্যমে চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং এবং পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমদ। এই চুক্তির ১৩, ১৪ ও ১৫ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত শর্তানুযায়ী যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তালিকাভুক্ত ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীকে ক্ষমা করে পাকিস্তানে পাঠানো হয়। এর আগে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার অভিযোগে দেশীয় সহযোগীদের বিচারের জন্য দালাল আইন প্রণয়ন করা হয়। স্বাধীনতা লাভের দেড় মাসের মধ্যে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস) নামে এ দালাল আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইন প্রণয়নের সাথে সাথে সারা দেশে ব্যাপক ধরপাকড় ও গ্রেফতার অভিযান শুরু হয়। এ আইনে লক্ষাধিক লোককে গ্রেফতার করা হয়। অভিযুক্ত করা হয় ৩৭ হাজার ৪৭১ জনকে। এদের মধ্যে ৩৪ হাজার ৬২৩ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষী-প্রমাণ না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করাই সম্ভব হয়নি। এদের মধ্যে মাত্র ২ হাজার ৮৪৮ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়। চূড়ান্ত বিচারে ৭৫২ জনের শাস্তি হয় এবং বাকিদের খালাস দেয়া হয়। দালাল আইন প্রণয়নের পর এ আইনে সারা দেশে ব্যাপকভাবে ধরপাকড় ও গণগ্রেফতার শুরু হলে তা সদ্য স্বাধীন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মারাত্মক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। এ থেকে সরকারি কর্মকর্তাসহ কোন শ্রেণীর মানুষ রেহাই পায়নি। ফলে সারা দেশে মারাত্মক আতঙ্ক ও অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এতে দেশে নতুন করে হানাহানি, বিভক্তি, অনৈক্য এবং প্রতিহিংসা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিভিন্ন মহল থেকে দালাল আইন সংশোধনের প্রস্তাব আসে। এমনি পরিস্থিতিতে আসে সাধারণ ক্ষমার বিষয়। দেশের সকল অনৈক্য, বিভক্তি, সন্দেহ মুছে ফেলে সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে দেশ গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ২৩ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। ১৯৭৩ সালের পয়লা ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় এ বিষয়ে পরিবেশিত খবরে বলা হয়, ‘সরকার দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত এবং বিচারাধীন সকল আটক ব্যক্তির প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। তবে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের অভিযোগে যারা সাজাভোগ করছে কিংবা বিচারাধীন রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এ ক্ষমা কার্যকর হবে না। তৃতীয় বিজয় উৎসবে তারা যাতে শরিক হতে পারে সে জন্য ১৬ ডিসেম্বরের আগেই শেখ মুজিবুর রহমান তাদের মুক্তির ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। যারা পলাতক তারা আদালতে উপস্থিত হয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেই এ ক্ষমার আওতায় পড়বে।’ উপরের আলোচনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার ত্রি-পক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর নিষ্পত্তি করেছে। মূলত এটি একটি মীমাংসিত ইস্যু। এরপর শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে কথিত দালালদেরও অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার শুধুই তাদের অধিপত্যবাদী প্রভুদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই ৪০ বছর আগে মীমাংসিত নন ইস্যু বানিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বিচার যে আসল উদ্দেশ্য নয় বরং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ আসল উদ্দেশ্য সে কথা সরকারের মন্ত্রীদের বিভিন্ন মন্তব্য থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। বিগত ২৭ মার্চ উত্তরায় এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেছেন, ‘নিজামী-মুজাহিদসহ ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই লালমনিরহাটসহ যেসব স্থানে ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে তার প্রেক্ষিতে তাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতারে নতুন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোন নির্দেশ দানের প্রয়োজন নেই।’ অথচ এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার মতে, ‘বিচারের আগে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। সন্দেহভাজনদের গ্রেফতারের বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তা ও আদালতের ওপর নির্ভরশীল।’ গত বছরের ১ মার্চ আইনমন্ত্রী ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠককালে বলেন, ‘তদন্তের পরই যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা প্রকাশ করা হবে।’ তদন্তের আগেই সরকারের যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা প্রকাশ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে অজ্ঞ।’ ২০ মার্চ মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িতদের গ্রেফতারের বিষয়ে বলেন, ‘তদন্ত কাজ শুরু হলে তদন্ত কর্মকর্তাই ঠিক করবেন বিষয়টি।’ গত ১৯ মার্চ রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে মাটিকাটা কলেজ মাঠে আয়োজিত এক সমাবেশে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন, ‘নিজামী-মুজাহিদদের মত যুদ্ধাপরাধীদের এদেশের মাটিতে বিচার করে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে।’ অন্য দিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আন্তর্জাতিক মান রক্ষার বিষয়ে সরকারের মন্ত্রীরা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রাখছেন। গত বছর ১৯ আগস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত ‘জঙ্গিবাদ ও বর্তমান বাংলাদেশ : আমাদের করণীয়’ শীর্ষক বৈঠকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাধা আসছে। একটা মহল আমাদের চাপ দিচ্ছে। সরকার এ বিষয়ে সজাগ আছে।’ সৈয়দ আশরাফেব বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের ওপর কোন চাপ নেই। তবে বিচারে সুষ্ঠু, আন্তর্জাতিক মানসম্মত এবং নিরপেক্ষ হয় সে বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থার তাগিদ রয়েছে।’ গত বছর ৩০ আগস্ট আইনমন্ত্রী তার দফতরে এ কথা বলেন। ২০ মার্চ মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আছে। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং এ বিষয়ে কেউ বিরোধিতা করবে না।’ ২০ এপ্রিল আইনমন্ত্রী তার দফতরে বলেন, ‘সরকার শুধু চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনবে। হাজার হাজার যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবে না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর যারা দোসর ছিল সেই সহযোগী বাহিনীর বিচার করা হবে। হানাদার বাহিনীকে যারা সহযোগিতা করছে, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট করেছে তাদের মূল নায়কদের বিচারের আওতায় আনা হবে।’ আইনমন্ত্রী বরাবরই বলে থাকেন যুদ্ধাপরাধ নয় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার হবে। অন্য দিকে আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম আগাগোড়া বলে আসছেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অপরাপর মন্ত্রী এবং কর্মকর্তারাও যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলছেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইস্তেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা উল্লেখ আছে। গত বছর ২৯ জানুয়ারি সংসদে যে প্রস্তাব পাস হয় তাতেও যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলা আছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের কথা নয়। যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে আইনমন্ত্রী দেশে ফিরে যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। ১৮ মার্চ যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক এক বৈঠকে যুদ্ধাপরাধের বদলে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঐ বৈঠকে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদ ছাড়াও আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের পর থেকে আইনমন্ত্রী মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের কথা বলা শুরু করলেও পরের দিন এক জনসভায় অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলেন। সরকার শুরু থেকেই যুদ্ধাপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখেই করা হবে বলে দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক মহলকে আশ্বস্ত করেছিল। কিন্তু কথিত বিচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার কথা বলা হলেও দেশী-বিদেশী খ্যাতনামা আইনবিদ ও বিশিষ্ট জন বলছেন অন্য কথা। কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ আইন নিয়ে দেশে বিদেশে তীব্র আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে। যে আইনের মাধ্যমে সরকার কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে খোদ সে আইনকেই মানবতাবিরোধী আইন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে দেশী-বিদেশী বিচারপতি, আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও বিশিষ্ট জনের পক্ষ থেকে। এ প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নয়। বিরোধী দলকে দমনের জন্যই এই বিচার।’ বিশিষ্ট ব্রিটিশ আইনজীবী জন কামেহ-এর মতে, ‘বিচারের নামে প্রহসনের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ।’ যুগোশ্লাভিয়া এবং রুয়ান্ডার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আইনজীবী এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ স্টিফেন কে কিউসি বলেছেন, ‘এটি একটি অদ্ভুত আদালত, যেখানে অভিযুক্তদের অধিকার ক্ষুণœ করা হয়েছে।’ যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধবিষয়ক বিশেষ রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র‌্যাপ বলেছেন, ‘এটি কোন আন্তর্জাতিক আদালত নয়। বাংলাদেশের আইনে এ আদালত স্থাপিত হয়েছে।’ এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল ফর রুয়ান্ডা’র বিচারপতি টি এইচ খান বলেছেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল শব্দ ছাড়া এ আইনে আন্তর্জাতিক আইনের কিছুই নেই।’ সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রতি আমাদের আস্থা নেই।’ বসনিয়া যুদ্ধাপরাধ মামলার প্রধান আইনজীবী, প্রখ্যাত ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যানের অভিমত, ‘আটককৃতরা কোন অভিযোগেই অভিযুক্ত নন এটা ছাড়া যে, তারা বিরোধী দলের লোক।’ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ট্রানজিশনাল জস্টিস-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘বিদ্যমান আইন বিচারের মানদণ্ড পূরণ করে না।’ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রউফ বলেছেন, ‘গোটা আইনই সংবিধান, ফৌজদারি কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন ও মৌলিক অধিকারের পরিপন্থ।’ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার জমির উদ্দীন সরকার বলেন, ‘এ আইন দুনিয়ার কোন সভ্য সমাজের আইন হতে পারে না।’ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রজ্জাকের ভাষায়, ‘এ আইনের অধীনে বিচার হবে অবৈধ ও অসাংবিধানিক।’ কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য প্রণীত আইন শুধু আন্তর্জাতিক মান উত্তীর্ণ করতেই ব্যর্থ হয়নি বরং এ আইনে দেশীয় মানও বজায় রাখা হয়নি। উপর্যুপরি সরকার যেসব আন্তর্জাতিক চুক্তি করেছে চলমান বিচারপ্রক্রিয়া তার সুস্পষ্ট লংঘন। উল্লেখ্য, যে, ২০১০ সালের ২৩ মার্চ বাংলাদেশ রোম চুক্তি অনুমোদন করেছে এবং এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পার্টি হিসাবে চুক্তির সদস্য হয়েছে। আইসিসি’র স্ট্যাটিউট এবং কর্মপদ্ধতি ও সাক্ষ্য আইনে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার সম্পর্কিত নিয়ম-নীতি রয়েছে, যার সাথে নিজ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জড়িত। ২০০০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ইন্টারন্যাশনাল ‘কভেনেন্ট অব সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস্’-এ স্বাক্ষর করার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার জাতীয় সীমার মধ্যে ফৌজদারি মামলার সুষ্ঠু বিচারের বিশ্বজনীন নীতি সমর্থন ও অনুসরণ করার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে। আইসিসিপিআর-এর অনুচ্ছেদ ১৪ এর মাধ্যমে বাংলাদেশ অন্য কিছুর পাশাপাশি ঘোষণা করেছে : ১৪.১ আদালত ও ট্রাইব্যুনালের সামনে সকল ব্যক্তি সমান বিবেচিত হবে। কারো বিরুদ্ধে কোন ফৌজদারি অভিযোগ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বা অতীত কোন মামলায় তার অধিকার ও দায়-দায়িত্বসমূহ নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রত্যেককে আইনত প্রতিষ্ঠিত উপযুক্ত, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালে সুষ্ঠু ও প্রকাশ্য শুনানির সুযোগ দেয়া হবে... এবং ১৪.২ ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেককে আইনগতভাবে দোষী প্রমাণিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নির্দোষ হিসেবে গণ্য করা হবে। এবং ১৪.৩ (ঞ) বিরুদ্ধেপক্ষের সাক্ষীদের জেরা করার অধিকার থাকবে। সাক্ষীরাও তাকে জেরা করতে পারবে। তার পক্ষের সাক্ষীদেরও সাক্ষ্য দেয়ার একই ধরনের সুযোগ থাকবে। এবং ১৪.৩( ছ) তাকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বা অপরাধ স্বীকার করতে বাধ্য করা যাবে না। অনুচ্ছেদ ১৫ তে বলা হয়েছে- এমন কোন ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে কাউকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা যাবে না যা সংগঠনকালে আন্তর্জাতিক বা জাতীয় আইন অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না। এই অনুচ্ছেদের কোন কিছু কোন ব্যক্তির এমন কোন কাজ করা বা না করা বিচার ও দণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করবে না যা ওই কাজ সংগঠনকালে জাতিসমূহের স্বীকৃত আইনের সাধারণ নীতি অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধ ছিল। অনুচ্ছেদ ২৬-এ বলা হয়েছে-সকল ব্যক্তিই আইনের সামনে সমান এবং কোন বৈষম্য ছাড়াই আইনের নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারী। সে অনুযায়ী আইন যে ধরনের বৈষম্যকে নিষিদ্ধ করবে এবং জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা, ধর্ম, রাজনৈতিক বা অন্য কোন মতাদর্শ, জাতীয় বা সামাজিক উৎস, সম্পত্তি, জন্ম বা অন্যকোন অবস্থানসহ সকল বিষয়ে প্রত্যেকে সমান ও কার্যকর নিরাপত্তা বিধান করবে। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রেও এসব বিষয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত কিছু অনুচ্ছেদ রয়েছে। অনুচ্ছেদ ৮ (৯), ৯ (১০), ১০ (১১) এবং ১১ (১২) সবই বিচারের সুষ্ঠুতা, সালিসের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা, নির্দোষিতা সম্পর্কে অনুমান এবং ফৌজদারি অপরাধের ব্যাপারে নিশ্চিন্ততার বিধান রেখেছে। জাতিসংঘের ১৯৬৮ সালের মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন এই মর্মে একমত হয়েছিল যে, এর ঘোষণাপত্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের জন্য ‘মানবাধিকার’ এর (১৪) ধারণা সম্পর্কিত সংজ্ঞাও ছিল, বাংলাদেশ যা আইনগতভাবে মানতে বাধ্য (১৬)। এ কথা পরিষ্কার যে, সংবিধানের ১৯৭৩ সালের সংশোধনীসমূহ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গৃহীত নীতির পরিপন্থী এবং এসব সংশোধনীর অবৈধতা সম্পর্কে ঘোষণা দেয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) সংশোধনী আইন ২০০৯ এবং কার্যপ্রণালি ২০১০ (১৭) ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে (সংশোধিত) ২০০৯-এ পরিণত করার জন্য প্রথম আইনটিকে সংশোধন করা হয়েছে। আইনটিতে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের বিচার করার এখতিয়ারসহ একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্যই আইনের সামনে ‘সকলের সমতার নীতি অপসারণ’ করে সাংবিধানিক সংশোধনী আনা হয়েছে। এ আইনটি এবং এর কার্যপ্রণালিই বাংলাদেশের মূল সংবিধান এবং রাষ্ট্রের দেয়া আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারসমূহের মধ্যে অসঙ্গতি ঘটিয়েছে। উপরের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ সরকার শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যই ৪০ বছর আগে মীমাংসিত যুদ্ধাপরাধকে ইস্যু বানিয়ে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চায়। এ জন্য তারা কোন নিয়ম-নীতি, আইন-কানুনের ধার ধারছে না। ১৯৭৩ সালের যে আইনে বিরোধীদলীয় নেতাদের বিচারের নামে প্রহসনের আয়োজন করা হয়েছে তা আন্তর্জাতিক মানে তো উত্তীর্ণ নয়ই বরং সে আইনে দেশীয় মানও রক্ষা করা হয়নি। অথচ সরকার কথিত ট্রাইব্যুনালের নাম দিয়েছে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারক তার আদালতের পরিচয় দিতে আদালতেই বলেছেন, ‘এটি একটি দেশীয় ট্রাইব্যুনাল, কিন্তু বিচারের মান হবে আন্তর্জাতিক মানের।’ কিন্তু তার কয়েক দিন পরেই ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার শাহিনুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এটা কোন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল নয় বরং দেশীয় ট্রাইব্যুনাল। তাই আন্তর্জাতিক মানের ধুয়া তুলে এই বিচারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না।’ আর ট্রাইব্যুনাল রেজিস্ট্রারের কথার সূত্র ধরেই আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দীন খান আলমগীর বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার কখনো আন্তর্জাতিক মানের হয় না। এতে দেশীয় মানই রক্ষা করা হয়।’ মূলত কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বিষয়ে বিচার সংশ্লিষ্টদের কারো কথার সাথে কারো কথার মিল নেই। ট্রাইব্যুনালের বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করছেন ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার। সরকারের এক মন্ত্রীর কথার সাথে আরেক মন্ত্রীর কথার কোন মিল নেই। এতে প্রমাণিত হয়েছে কথিত যুদ্ধাপরাধের পুরো বিচার প্রক্রিয়াটাই একটা প্রহসন। সরকার কথিত ট্রাইব্যুনালের কাছ থেকে একটি ফরমায়েসি রায় আদায় করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করতে চায়। পুরো বিচারপ্রক্রিয়া যে সরকার প্রভাবিত এ কথার প্রমাণ মেনে খোদ আইনমন্ত্রীর বক্তব্য থেকেই। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদ গত ১৯ জুন সচিবালয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার সংক্রান্ত এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আগামী জুলাই মাসেই যুদ্ধাপরাধের বিচার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হচ্ছে। আগামী মাসে আটক ২ জনের এবং আগস্ট মাসে অন্যদের বিচার হবে।’ আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্য ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রমের ওপর নির্বাহী বিভাগের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন আইনজ্ঞগণ। তারা বলেছেন, ‘আইনমন্ত্রীর বক্তব্য ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের ১১ (৪) ধারা এবং বিধি ৪৫ এর আলোকে একটি অপরাধমূলক কাজ। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী ফর্মাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করার পূর্বে সরকারের মন্ত্রীরা বিচারের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন সময় সীমা ঘোষণা করতে পারেন না। এ এখতিয়ার আইনমন্ত্রীর নেই। তিনি এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে বক্তব্য দিয়ে মূলত বিচারের জন্য আদালতকে ডিকটেড করেছেন। তার এ বক্তব্যের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে আদালতকে সরকারের নির্দেশিত পথে পরিচালনা ও সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে বিচারকার্যক্রম পরিচালনার জন্যই দলীয় লোকদের দিয়ে এ আদালত গঠন করা হয়েছে। তাই এই আদালতের ওপর জনগণের কোনই আস্থা নেই।’ এটা শুধু সরকার বিরোধীদের কথা নয়। বরং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বক্তব্য থেকে এ কথার সত্যতা মেলে। আইনমন্ত্রীর উপরোক্ত মন্তব্যে একদিন পর এক আলোচনা সভায় এই বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগার বলেছিলেন, ‘কোন দিন কার বিচার শুরু হবে এ কথা বলার এখতিয়ার কোন মন্ত্রীর নেই। মন্ত্রীরা যদি এমনটাই বলতে থাকেন তাহলে বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।’ সরকার পক্ষ বরাবরই বলে এসেছে যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুটি অতি জনগুরুত্বপূর্ণ। এমনকি সরকার এই বিচারপ্রক্রিয়া সমাপ্তির মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে চায় বলে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু সরকারি দলের নেতাদের বক্তব্যের কথিত যুদ্ধাপরাধ নিয়ে বক্তব্যের রকমফের পুরো বিচারপ্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিচারের ক্ষেত্রে সরকারি আন্তর্জাতিক আইনের তো অনুসরণ করেইনি বরং কথিত বিচারের নামে রাষ্ট্রের সংবিধানকেও পদদলিত করা হয়েছে। কথিত বিচারের ক্ষেত্রে সরকার প্রকার আইন ও বিধি লঙ্ঘন এবং আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে বিচারের নামে তাদের ভাষায় আরও একটি ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে কি না তা নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে নানান ধরনের আলোচনা শোনা যাচ্ছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ‘যুদ্ধাপরাধ মামলার চেয়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা গুরুত্বপূর্ণ’ বিষয়ক যে মন্তব্য করেছেন তাতে সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অন্তঃসারশূন্য বলেই মনে হয়। যেনতেনভাবে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগে মামলা দিয়ে বিরোধী দল দমনের নীল নকশা বাস্তবায়নের জন্যই সরকার একের পর এক বিরোধীদলীয় জনপ্রিয় নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে চায়। ইতঃপূর্বে রাষ্ট্রপক্ষ কথিত অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাথে ‘আন্তর্জাতিক’ শব্দটি সংযোজন করে বিচারের মানও আন্তর্জাতিক হবে বলে এসেছে। কিন্তু গত ৭ সেপ্টেম্বর বিচার ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও তদন্ত কর্মকর্তাদের জন্য দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল নয় বরং এটি অভ্যন্তরীণ ট্রাইব্যুনাল। যেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার হচ্ছে।’ সরকার কী আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার দেশীয় ট্রাইব্যুনালে করে আবারও একটি ইতিহাস সৃষ্টি করতে চায়? কিন্তু এতে তারা নিজেরাই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয় কি না তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে। [email protected]

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির