post

যে কারণে বাড়ছে ধর্ষণ

এইচ এম আব্দুর রহিম

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অপহরণ করে শারীরিক নির্যাতনের পর অজ্ঞান করে ধর্ষণ করা করা হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনায় যখন সারা দেশ প্রতিবাদে সোচ্চার, ঠিক তখন গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারলাম, পঞ্চগড়ে ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর আত্মহত্যা করেছে। গত ৬ জানুয়ারি পঞ্চগড় সদর উপজেলার গরিনাবাড়ী ইউনিয়নে ঘটনাটি ঘটে। এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়। সারা দেশে অহরহ ঘটছে। কোনটির খবর পাচ্ছি আবার কোনটির খবর পাচ্ছি না। কোনটির প্রতিবাদ হচ্ছে আবার কোনটির প্রতিবাদ হচ্ছে না। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের একজন শিক্ষার্থী যখন ধর্ষিতা হচ্ছেন, তখন অন্য একজন ধর্ষিত হওয়ার ব্যাপারটি কতটা স্বাভাবিক হতে পারে! বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীধর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে একটি দেশের ভাবমূর্তি কতটা ক্ষুণ্ন হতে পারে তা সবার কাছে অনুমেয়। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ২০১৯ সালে দেশে ১ হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে। ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৭৩২ জন নারী। অন্য দিকে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের হিসাব মতে, ২০১৯ সালে এক হাজারের বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে ৮৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৫১ জন। ধর্ষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে ২০০ জন নারীকে। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ২২১ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২২ জনকে। ধর্মীয় অনুশাসন না মানার কারণে ধর্ষণ বেড়েছে বলে অভিজ্ঞ মহলের অভিমত। সাম্প্রতিক সময়ে নারী শিশু ধর্ষণ, হত্যার মতো লোমহর্ষক ঘটনা দেশকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। জনগণ নিজেরা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। গত ২৫ জুন বরগুনা জেলা শহরে সরকারি কলেজের সামনে কয়জন সন্ত্রাসী স্ত্রীর সামনে রিফাত নামে এক যুবককে রামদা দিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় হত্যা করেছে। স্ত্রী আয়েশার কান্নার চিৎকার শুনে কেউ এগিয়ে আসেনি। এছাড়া প্রতিদিন ধর্ষণ হত্যার খবর পত্রিকার পাতায় ভেসে আসছে। ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। এসব অপরাধীর দৃটান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। যে কারণে একের পর এক অপরাধ ঘটে চলেছে। নির্মমভাবে কিছু মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে আর কিছু মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখছে। এ কেমন বর্বরতা! আমাদের এই সমাজে নির্মমতাও পৈশাচিকতা এখন প্রকট হয়ে উঠেছে। মানবিক মূল্যবোধ লোপ পেয়েছে। মানুষের মধ্যে মায়ামমতা নেই। মানুষ কেমন নিষ্ঠুর ও বর্বর হয়ে গেল। পারিবারিক সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ছে। তা না হলে মা-বাবা সন্তানকে, সন্তান মা বাবাকে, ভাই ভাইকে, স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে খুন করতে পারে? ৯ মাসের নবজাতক থেকে শুরু করে শতবর্ষী বৃদ্ধাকে ধর্ষণ করতে পারে? এ আলামত কোন রাষ্ট্র সমাজের? দুঃখের বিষয় হলো যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তারা বিষয়টা আমলে নিচ্ছেন না। তাদের একটাই নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে উন্নয়ন করতে হবে। এ কথা ভাবছে না এ উন্নয়ন কাদের জন্য। যে সমাজ ক্রমান্বয়ে বর্বর, অসভ্য, নিষ্ঠুরতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। সেই পরিবারের জন্য উন্নয়ন কোন কাজে আসবে না। আর এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে তারা সুরক্ষিত থাকবেন এ গ্যারান্টি কি দেয়া যায়? কারণ ফ্রাঙ্কেনটাইনকে তার সৃষ্ট দানবের হাতে প্রাণ দিতে হয়ে ছিল। এ দেশে ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতন ও অপহরণের ঘটনা উদ্বেগজনক বৃদ্ধি পেয়েছে। পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা টেলিভিশনের সংবাদের দিকে দৃষ্টিপাত করলে প্রতিদিন চোখে পড়ে এ সংক্রান্ত সংবাদ। নিঃসন্দেহে এটা আমাদের জন্য চরম লজ্জা ও অপমানের। এসব ঘটনা বহির্বিশ্বে আমাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করছে। বাংলাদেশ পীর আউলিয়ার দেশ। এ দেশের মানুষ ইসলামী চেতনায় উজ্জীবিত। ধর্র্মপ্রাণ মুসলিম দেশে এ জাতীয় বর্বরতা কাম্য নয় । আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আজকের শিশুরাই জাতির কর্ণধার। এই শিশুরা এ দেশজাতির নেতৃত্ব দেবে এটাই স্বাভাবিক। এসব কথাবার্তা বিভিন্ন সভা সেমিনারে শোনা যায়। তবে বাংলাদেশে শিশুদের চিত্র ভয়াবহ। বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কত তার পরিসংখ্যান দেয়া সম্ভব নয়। তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থার জরিপ অনুযায়ী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। শিশুরা নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। ধর্ষণের পাশাপাশি মুক্তিপণ, পারিবারিক কলহ, দারিদ্র্য, পিতা-মাতার পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়া, জমিজমা নিয়ে বিরোধ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, মা বাবার সম্পর্কের জটিলতা নানা কারণে শিশু হত্যার মতো জঘন্য ও ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। তবে শিশুধর্ষণের ঘটনাটি দেশে ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে দুই হাজারের বেশি নারী-মেয়েশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩১ জন। গণধর্ষণ, ধর্ষণের পরে অন্যান্য নির্যাতনের হারও অন্য সময়ের চেয়ে বেশি। গত ৩রা জুন বর্তমান জাতীয় পরিস্থিতি, অব্যাহত নারী শিশু নির্যাতনের প্রতিবাদ ও সামাজিক নিরাপত্তার দাবিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানানো হয়। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে এই সম্মেলনের আয়োজন করে মহিলা পরিষদ। এতে বলা হয়, নারী শিশুদের উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা বেড়ে চলেছে। গত বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দুই হাজার ৮৩ জন নারীও সহিংতার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১১৩ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৬ জনকে। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২৩ জনকে। এ ছাড়া বিভিন্ন কারণে এই সময়ে ২৭৬ জন নারী ও মেয়ে শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছ ৭০ জন। এ সময়ে মারধরের শিকার হয়েছেন ১৪৭ জন। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৯৪ জন। সূত্র মতে, ৩-৪ শতাংশ অপরাধী সাজা পায় আর বাকিরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায়। বিচারহীন সংস্কৃতির কারণে অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। আমরা পিছনের দিকে তাকালে দেখতে পাই বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যানুযায়ী, ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত পর্যন্ত দেশে ৯৪০টি বেশি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছিল। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২ সালে ২০৯ জন, ২০১৩ সালে ২১৮ জন এবং ১০১৪ সালে ৩৫০ জন শিশুকে হত্যা করা হয়। পুলিশ সদর দফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ সালে সারা দেশে ২১ হাজার ২২০টি নারী শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেছেন, অধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্ষণ আইনের সংশোধন ও সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি দ্রুত বিচারের মাধ্যমে অপরাধীকে দৃটান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। অন্যরা যাতে এ জাতীয় অপরাধ থেকে দূরে থাকে। এ জন্য রাজনৈতিক সংস্কারও জরুরি। গত ৫ মে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার দক্ষিণ পাথরঘাটা গ্রামে দশম শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণ করতে না পেরে মা-মেয়েকে কামড়িয়ে জখম করে। গত মে মাসে প্রথম ৮ দিনে সারা দেশে ৪১টি শিশুধর্ষণ ও ৩টি শিশুধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৩৭টি মেয়ে শিশুধর্ষণ ও ৪টি ছেলে শিশু বলাৎকারের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গেছে ৩ জন। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ৯ মে সংবাদ সম্মেলন করে এই হিসাব দিয়েছে। দেশে শিশুধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা শিশুধর্ষণের প্রতি চলমান সহিংসতা ও নির্যাতন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলছে, বিচারহীনতার কারণে নারী শিশু নির্যাতনের ঘটনা অসহনীয় অবস্থায় উপনীত হয়েছে। শিশুধর্ষণের ঘটনায় শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক জীবনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। গত বছর অ্যাকশন এইডের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের শতকরা ৮৮ জন নারী রাস্তায় চলার পথে যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্যের মুখোমুখি হন। এদের ৮৬ ভাগ গণপরিবহনের চালক ও হেলপারদের দ্বারা হয়রানিমূলক মন্তব্যের শিকার হয়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির রিপোর্টে ১৩ মাসে গণপরিবহনে ২১ নারী ধর্ষণের কথা বলা হয়। বাস, প্রাইভেটকার, অটোরিকশা ও ট্রাকে এসব ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে গণপরিবহনের চালক হেলপারসহ সহযোগীরা মিলে ৯টি গণ ধর্ষণ ৮টি ধর্ষণও ৪টি শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটায়। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেয়া পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গত ৫ বছরে বাংলাদেশে ৩ হাজার ৫৮৭ জন নারীধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৭৮ জনকে। এর মধ্যে ৮৬ শতাংশ শিশু কিশোরী। এর মধ্যে ৬ থেকে ১২ বছরের মেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। চলতি বছর জানুয়ারির ১৮ দিনে ২৩টি ধর্ষণের চেষ্টার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৫ জন শিশু কিশোর। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয় এরাই বেশি। এ ছাড়া ধর্ষণের পর শতকরা ৯০ শতাংশ ঘটনা লোকলজ্জার ভয়ে অনেকে প্রকাশ করে না। কী এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে আমরা দিনাতিপাত করছি। তবে আমাদের মধ্যে মস্তবড় এক গলদ রয়েছে- রাষ্ট্রব্যবস্থায় সদিচ্ছার ভিতরে। সেই গলদের নাম বিচারহীন সংস্কৃতি। তুচ্ছ কারণে ধর্ষণের মতো ঘটনা তখনই সংঘটিত হয়, যখন রাষ্ট্রে বিচারহীনতার পরিবেশ বিদ্যমান থাকে। এ সমস্যাটি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এ কারণে যে, এই দেশে ধর্ষণের বিচার করার ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের দুর্বলতা ও দীর্ঘসূত্রতা এখন প্রকট। আইন প্রয়োগকারীদের একটি অংশ ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি বিরূপ ধারণা প্রকাশ করেন। তারা নারীটির ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেন। ফলে ধর্ষণের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এরা আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করার জন্য যতটা আন্তরিকতার সাথে আইন প্রয়োগ করা প্রয়োজন, বাস্তবে তা ঘটতে দেখা যায় না। শুধু আইন প্রয়োগকারীদের মধ্যে নয়, অধিকাংশ সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। ফলে কঠোর আইন থাকার সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে। চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণ নারী নির্যাতনসহ গণপরিবহনে যাত্রীকে পিটিয়ে হত্যা, গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে হত্যা, ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য ও যাত্রীদের জিম্মি করাসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা পরিবহন শ্রমিকরা করছে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাদের বিরুদ্ধে দৃটান্তমূলক শাস্তির নজির নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় গণপরিবহনে নারী নির্যাতন ধর্ষণের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। রূপা গণধর্ষণ-হত্যাসহ আগের ঘটনাগুলোর যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতো এবং গণপরিবহনের মালিকরা যদি শ্রমিকদের যথাযথভাবে সচেতন করতে পারতেন তাহলে এ ধরণের ঘটনা কমে আসতো। গত বছর বাংলাদেশের একটি গণমাধ্যমে চলন্ত বাসে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টায় ২০টি ঘটনা পর্যালোচনা করে। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ২০১৩ সালে দু’টি, ২০১৫ সালে চারটি, ২০১৬ সালে তিনটি, ২০১৭ সালে ৬টি, ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৭টি। এখন এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, নারী শিশু বালক কেউ নিরাপদ নয়। ঘরে বাইরে মাঠে ঘাটে, অফিস আদালতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে, নৌকায়, হাটে-বাজারে ধর্মালয়ে এ ধরনের ধর্ষণের ঘটনা একের পর এক ঘটে চলেছে। কোন জায়গা বাকি নেই। বয়সের কোন সীমা নেই। তবে ভয়াবহ দিক হলো ধর্ষণের পর হত্যা করা হচ্ছে। মাদরাসার অধ্যক্ষের যৌন অপরাধের ঢাকতে মাদরাসাছাত্রীকে পুড়িয়ে মারার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। নুসরাত মাদরাসা অধ্যক্ষের মনোস্কামনা পূরণ করলে এভাবে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হতো না। নুসরাতের মত চরিত্রবান মেয়ে এ দেশের সম্পদ। আমরা আশা করি দেশে আরও নুসরাতের জন্ম হবে। এই সমাজের নুসরাত-শাহিনুর তনু-মিতুর মতো অসংখ্য নারী হিংসার বলি হচ্ছেন। রাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি । তবে আইন সালিশের জরিপে যে পাঁচ বছরে ৩ হাজার ৫৮৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, পুলিশ সদর দফতরের হিসাবে এই সময়ে ধর্ষণ সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ১৯ হাজারের বেশি। দেশে প্রতিদিন ১১টি করে ধর্ষণের মামলা হচ্ছে। কিন্তু মামলার নিষ্পত্তির হার অত্যন্ত কম। ন্যায্যবিচার থেকে অনেকে বঞ্চিত। ক্ষমতা আর অর্থের দাপটে অনেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন। ফলে বিচার না পেয়ে আদালতের সিঁড়ি চোখের পানিতে ভিজাচ্ছে অনেকেই। আজ দেখা যাবে নুসরাতের হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন হচ্ছে। তার পর অন্যান্য ঘটনার মতো হারিয়ে যাবে। এভাবে আর কত নুসরাতের জীবন দিতে হবে এ দেশের মানুষ তা জানে না। মেয়েরা আর কত যৌন হয়রানির শিকার হবে? দেশের ছাত্রীদেরকে যৌন হয়রানি থেকে উদ্ধার করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। যৌন হয়রানি বন্ধে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করে তার কার্যক্রম জোরদার করাসহ বিভিন্ন নির্দেশনা বাস্তবায়নের সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ কমিটি গঠনের নির্দেশনা থাকলেও কাগজ কলমে সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট কর্মস্থল এবং শিক্ষাঙ্গনে নারী ও শিশু যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য দিকনির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্ট বিভাগে জনস্বার্থে একটি রিট আবেদন করেন। শুনানি শেষে ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট রায় দেন। এ রায়ে হাইকোর্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ সব প্রতিষ্ঠানে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি’ নামে কমিটি গঠন করার আদেশ দেন। হাইকোর্টের এ রায়ের পর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন জিসিইউ একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে দেশের সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। তাই এখন যৌন নির্যাতন বন্ধে মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি কমিটি গঠনে রাষ্ট্রের কঠোর নির্দেশ প্রয়োজন। হাইকোর্টের ওই রায়ে বলা হয়, কমিটিতে ৫ জন সদস্য থাকবেন। এই কমিটির বেশির ভাগ সদস্য হবেন নারী। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে দু’জন সদস্য নিতে হবে। সম্ভব হলে একজন নারীকে কমিটি প্রধান করতে হবে। যাতে মেয়েরা তাদের অভিযোগগুলো মহিলাদের কাছে পেশ করতে পারে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি শিক্ষাবর্ষের পাঠদান কার্যক্রমের শুরুতে এবং প্রতি মাসে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ওরিয়েন্টশনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সংবিধানের বর্ণিত লিঙ্গীয় সমতা ও যৌন নিপীড়ন সম্পর্কিত দিকনির্দেশনাটি বই আকারে প্রকাশ করতে হবে। হাইকোর্টের এই নির্দেশনাটি আইনে রূপান্তরিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ নির্দেশনাই আইন হিসেবে কাজ করবে এবং সব সরকারি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নীতিমালা প্রযোজ্য হবে। হাইকোর্টের রায়ে যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞায় বলা হয়, শারীরিক ও মানষিক যে কোনো ধরনের নির্যাতন যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে। ই- মেইল, এসএমএস, টেলিফোনে বিড়ন্বনা, পর্নোগ্রাফি, যে কোন ধরনের অশালীন চিত্র, অশালীন উক্তিসহ কাউকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে সুন্দরী বলা ও যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। এ দিকে বিচারাধীন কিছু মামলার দ্রুত সুরাহার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে নির্দিষ্টভাবে নারী নির্যাতন মামলা নেই। দেশের প্রায় ১০ ধরনের ট্রাইব্যুনাল করা সব ধরনের মামলার মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাই উচ্চ আদালতের নির্দেশে সব থেকে বেশি স্থগিত থাকছে। বর্তমানে ১ লাখ ৬০ হাজার ৭৫১টি বিচারাধীন নারী নির্যাতন মামলার মধ্যে ৯৪৯টি মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। বিচারহীনতার দিক থেকে নারীরা সব থেকে পিছিয়ে আছে। সারা দেশের দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা উচ্চ আদালতে স্থগিত হয়। সারা দেশে সব ধরনের ফৌজদারি অপরাধের দীর্ঘসূত্রতার সঙ্গে তুলনায় দেখা যায়, নারীদের মামলাগুলোর বিচার হতে বেশি সময় লাগে। ২০১৮ সালের ৮ মার্চ থেকে ২৩ শে মের একটি প্রথম আলোর ছয় পর্বের অনুসন্ধানী প্রতিদেনে দেখানো হয়, দেশে সব অপরাধের মামলায় দণ্ড লাভের গড় হার ১৫ শতাংশের বেশি। অথচ ঢাকাতেই নারী নির্যাতনের ছয়টি অপরাধের মামলায় সাজার হার ৩ শতাংশের কম। এই পরিসংখ্যান কিন্তু প্রকারান্তরে নারীর মামলাতেই উচ্চ আদালতের স্থগিতকরণের হারটা বেশি, তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বর্তমান দেশের ৬৪ জেলায় ৫৮টি ট্রাইব্যুনালে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলমান নারী নির্যাতনের মামলার সংখ্যা ৩৭ হাজারের বেশি। দেশের ৫৮ জেলায় পৃথক নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল থাকলেও ৬টি জেলায় আলাদা কোনো ট্রাইব্যুনাল নেই। সুতরাং ২০০০ সালের আইনে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করার বিধান রয়েছে। বিচার যত বিলন্ব হবে, তত সাক্ষীর স্মৃতিভ্রম, প্রমাণের ক্ষয় ঘটে, আবার এর মধ্যে কেউ মারা যেতে পারে। ফলে বাদি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন আর আসামি আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। লেখক : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির