post

যে বিপর্যয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে

২৬ নভেম্বর ২০১১
ফিরোজ মাহবুব কামাল দেশ বিক্রির হাতিয়ার বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা শতাধিক। দলগুলোর সাথে জড়িত বহু লক্ষ নেতা-কর্মী ও সমর্থক। দলের পক্ষে তারা প্রচারণা করেন, মিছিল-মিটিং করেন, অর্থ দেন, ভোট দেন, প্রয়োজনে রক্তও দেন। বাংলাদেশের সমগ্র ইতিহাসে আর কোন কালেই এত দল জন্ম নেয়নি, এত বিপুলসংখ্যক মানুষও রাজনীতিতে অংশ নেয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এত বিপুলসংখ্যক মানুষের সংশ্লিষ্টতায় রাজনীতি কতটুকু সৃষ্টিশীল হয়েছে, দেশ এবং দেশবাসীরই বা কতটুকু কল্যাণ হয়েছে? আর সে কল্যাণ পরিমাপের মাপকাঠিই বা কী? যে কোন ব্যবসায় লাভ-লোকসানের হিসাব হয়, নইলে সে ব্যবসায় ভরাডুবি হয়। তেমনি সুস্থ রাজনীতির স্বার্থে বাংলাদেশের এ রাজনীতিরও হিসাব হওয়া উচিত। এ নিবন্ধটি লেখা হচ্ছে বস্তুত তেমনি একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে। ভাল-মন্দ সব কর্মেরই সুস্পষ্ট লক্ষ্য থাকে। ভিক্ষুকও উদ্দেশ্য ছাড়া রাস্তায় নামে না। কাক্সিক্ষত লক্ষ্য এবং অর্জিত সে লক্ষ্য পরিমাপেরও সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি থাকে। সফলতা যাচাই হয় সে লক্ষ্যটি কতটা অর্জিত হলো সে বিচার থেকে। প্রশ্ন হলো রাজনীতির সে লক্ষ্যটি কী? রাজনীতির সে লক্ষ্যটি হলো দেশের কল্যাণ। সে কল্যাণ নানাভাবে এবং সম্ভাব্য সকল উপায়ে। জনসেবার এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। দেশবাসীর নীতি-নৈতিকতা, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-আদালত, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও রাস্তাঘাটসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনীতির অঙ্গন থেকে। তবে সে রাজনীতি দুষ্ট খাতে প্রবাহিত হলে দেশ ও দেশবাসীর সবচেয়ে অকল্যাণ ঘটায়। দেশ কোন হাসপাতালে মারা যায় না, মারা যায় ভ্রান্ত রাজনীতির কারণে। তাই রাজনীতিবিদদের কাজ শুধু দল গড়া বা দলাদলি করা নয়। নিছক নির্বাচনে অংশ নেয়া বা নির্বাচন শেষে সরকার গঠন করাও নয়। বরং লক্ষ্য, দেশের কল্যাণে সম্ভাব্য সবকিছু করা। রাজনীতির সফলতা যাচাই হয়, সে লক্ষ্য অর্জনে রাজনীতি কতটা সফল হলো তা থেকে। রাজনীতি কোন ব্যক্তি, পরিবার বা দলের ব্যবসা নয়, এর সাথে জড়িত সমগ্র রাষ্ট্র। ওতপ্রোতভাবে জড়িত রাষ্ট্রে বসবাসরত প্রতিটি নাগরিক। একটি গাড়ি কতটা নিরাপদভাবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে যায় তার ওপর নির্ভর করে যাত্রীদের নিরাপত্তা ও সঠিক গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর বিষয়। অযোগ্য চালক যাত্রীদের গন্তব্যস্থলে না পৌঁছিয়ে বরং তাদের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করতে পারে। তেমনি ভয়ানক অঘটন ঘটতে পারে রাষ্ট্র কোন অযোগ্য ও দুর্বৃত্তের হাতে পড়লে। মানব ইতিহাসের বড় বড় বিপর্যয়গুলো ক্ষেত-খামার বা কলকারখানায় ঘটেনি। জীবজন্তুর হামলায় যেমন হয়নি, তেমনি খরা-প্লাবন ও ভূমিকম্প-সুনামিতেও ঘটেনি। ঘটেছে অতি দুর্বৃত্ত মানুষের হাতে রাজনীতি যাওয়াতে। রাজনীতির মঞ্চে এরা কখনও বা হালাকু, চেঙ্গিজ বা ক্লাইভ-মীরজাফর বেশে হাজির হয়েছে, আবার কখনো বা আবির্ভূত হয়েছে হিটলার-মুসোলিনি ও বুশ-ব্লেয়ারের বেশে। মানবজাতিকে এ দুর্বৃত্তরাই বহু হাজার যুদ্ধ উপহার দিয়েছে। গত শতাব্দীতে দু’টি বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে তারা সাত কোটির বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। সম্প্রতি লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে এবং এখনও করছে আফগানিস্তান, ইরাক, কাশ্মীর, ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে। বাংলাদেশে এরাই একাত্তরে যুদ্ধ, চুয়াত্তরে দুর্ভিক্ষ, পঁচাত্তরে বাকশালী স্বৈরাচার ডেকে এনেছে। এবং আজ উপহার দিচ্ছে লগি-বৈঠার রাজনীতি, সন্ত্রাস, মিথ্যা মামলা এবং মামলার নামে রিমান্ড ও ডাণ্ডাবেড়ির নির্যাতন। মীরজাফরদের হাতে রাজনীতি যাওয়াতে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশের হাতে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীনতা গেছে, তেমনি আজকের মীরজাফরগণও বিলিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। লুণ্ঠিত হচ্ছে পদ্মা-তিস্তা-মেঘনার পানিই শুধু নয়, বরং তাদের দখলে যাচ্ছে পণ্যের বাজার এবং অধিকৃত হচ্ছে রাস্তাঘাট ও বন্দর। এভাবে রাজনীতি পরিণত হয়েছে দেশকে শত্রুর হাতে তুলে দেয়ার হাতিয়ারে। দেশধ্বংসী এ রাজনীতির কারণে বাংলার স্বাধীনতা লুণ্ঠনে অতীতে যেমন আগ্রাসী শত্রুর যুদ্ধ লড়তে হয়নি, তেমনি আজও লড়তে হচ্ছে না। অথচ রাজনীতি সৃষ্টিশীল ভাল মানুষদের হাতে গেলে দেশে শান্তি-সমৃদ্ধি ও কল্যাণের প্লাবন শুরু হয়। গড়ে ওঠে উচ্চতর সভ্যতা। বিশ্বের বহু দেশের মানুষ এখনও যে আদিম অজ্ঞতা নিয়ে বসবাস করে সেটি তো রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণে। মানুষের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিশীলতা নিছক কৃষি, শিল্প, স্থাপত্য বা বিজ্ঞানের আবিষ্কারে নয়, বরং সেটি উচ্চতর মানুষ সৃষ্টিতে। রাজনীতির কাজ সে সৃষ্টিশীলতাকে বেগবান করা। আর মানুষ গড়ার সে মহান সৃষ্টিশীলতা ও শিল্পটি স্কুল-কলেজে বা ল্যাবরেটরিতে শেখা যায় না। কোন ইজম বা মতবাদ থেকেও নয়। সেটি সম্ভব হলে পাশ্চাত্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে হিটলার, মুসোলিনি, বুশ, ব্লেয়ারের ন্যায় যুদ্ধাপরাধী বের হতো না। উপনিবেশবাদ, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বস্তুবাদ, সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের ন্যায় মানবতাধ্বংসী মতবাদও জন্ম নিত না। উচ্চতর মানুষ গড়ার সে শিল্পটি হাতে-কলমে শেখাতেই মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর শ্রেষ্ঠ মানুষদের দুনিয়ার বুকে নবী-রাসূল করে পাঠিয়েছেন। এভাবে মানুষ পেয়েছে সঠিক পথ। আর পথ দেখানোর এ কাজটি তো একমাত্র মহান আল্লাহর। পবিত্র কুরআনে তাই বর্ণিত হয়েছে “ইন্না আলাইনাল হুদা।” অর্থাৎ পথ দেখানোর দায়িত্ব একমাত্র আমার। (সূরা লাইল)। রাজনীতিবিদদের কাজ হলো সে প্রদর্শিত পথ বেয়ে মানুষকে চলতে সাহায্য করা। শয়তানের পথ থেকে মানুষ একমাত্র তখনই মুক্তি পেতে পারে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র তখন সিরাতুল মোস্তাকিমে চলে। মানবজাতি একমাত্র তখনই সঠিক নির্দেশনা পেয়েছে এবং রাষ্ট্র তখন কল্যাণময় কর্মে ভরে উঠেছে। ইসলামের বড় কল্যাণ তো এখানেই। নবীজী (সা) ও তাঁর মহান সাহাবাদের ন্যায় ব্যক্তির হাতে রাজনীতি যাওয়াতেই মানবজাতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা নির্মিত হয়েছে। ঈমানদারের কাজ তাই শুধু নবীজী (সা) থেকে নামাজ-রোজা-হজ-জাকাত শেখা নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজকে তার অনুসৃত পথে পরিচালিত করতে শেখা। রাষ্ট্র ও মানুষ গড়ার সে মহান শিল্পে পারদর্শী হওয়া। কুরআন-হাদিস তো সেটাই শেখায়। রাজনীতির গুণাগুণ যাচাই হয় সে নবীজী (সা)-এর সে নীতি কতটা অনুসৃত হলো তা থেকে। অর্পিত দায়ভার ও ব্যর্থতা অফিস-আদাতে সবার মানমর্যাদা সমান হয় না। মর্যাদা নির্ধারিত হয় অর্পিত দায়িত্বের গুণে। মানুষ তেমনি সমগ্র সৃষ্টিকুলে আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মর্যাদাটি পেয়েছে তার ওপর অর্পিত দায়ভারের কারণে। সে দায়ভারটি আল্লাহর খলিফা রূপে দায়িত্ব পালনের। আর সে দায়িত্ব পালন জায়নামাজে বসে তসবিহ পাঠে যেমন হয় না। তেমনি মাসভর রোজা পালনেও হয় না। বরং সেটি পালিত হয় রাষ্ট্রের বুকে আল্লাহর আইনের বিজয় আনার মধ্য দিয়ে। নামাজ-রোজা-হজ-জাকাত তো ব্যক্তির মাঝে সে বিপ্লবেরই দায়িত্ব-সচেতনতা বাড়ায়। ইসলামে এটাই তাকওয়া। ঈমানদারের জীবনে সে দায়ভারটি স্পষ্টতর করতেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, “তোমাদের মধ্য থেকে অবশ্যই একটি দল থাকতে হবে যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে ডাকবে এবং ন্যায়-কর্মের নির্দেশ দেবে এবং অন্যায়কে রুখবে। এবং তারাই হলো প্রকৃত সফলকাম।” (সূরা আল ইমরান, আয়াত ১০৪) বলা হয়েছে “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও।” (সূরা সাফ, আয়াত ১৪) বলা হয়েছে “তোমরা কখনই প্রকৃত কল্যাণটি পাবে না যতক্ষণ না তোমাদের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি আল্লাহর রাস্তায় খরচ না করছো।” (সূরা আল ইমরান, আয়াত ৯২) ফলে দল গড়া ঈমানদারের জীবনে নেশা নয় এবং পেশাও নয়। নিছক রাজনৈতিক কোনো এজেন্ডাও নয়। বরং অবশ্য পালনীয় একটি ফরজ। তবে সে দলের লক্ষ্য হবে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি যেমন নয়, তেমনি দলাদলি বাড়ানোও নয়। সেটি নিজ ভাষা, নিজ গোত্র ও নিজ বর্ণের নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও সে রাষ্ট্রের গৌরব বৃদ্ধিও নয়। বরং সে দল গড়বে একমাত্র ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়ের প্রতিরোধে। দল গড়বে বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিজয় আনতে। রাজনীতি তার লক্ষ্য হবে কোন নেতার অভিপ্রায় পূরণ নয়, বরং একমাত্র মহান আল্লাহর অভিপ্রায় পূরণ। আর মহান আল্লাহর সে অভিপ্রায়টি ঘোষিত হয়েছে এভাবে, “তিনিই সেই মহান আল্লাহ যিনি হেদায়েত ও সত্যদ্বীনসহ রাসূলকে পাঠিয়েছেন যাতে সকল মত ও ধর্মের ওপর বিজয়ী হতে পারে। যদিও সেটি মুশরিকদের জন্য অপছন্দের।” (সূরা সাফ, আয়াত ৯) আর এখানেই ঈমানদারের রাজনীতির মূল হেতু ও প্রেরণা। আল্লাহর অভিপ্রায়ের সাথে গভীর সম্পৃক্ততার এ রাজনীতি তখন ঈমানদারের জীবনে বাঁচার মূল প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে মুসলমান সেক্যুলার হয় না। জাতীয়তাবাদী বা সমাজতন্ত্রীও হয় না। বরং সে আত্মত্যাগী মুজাহিদ হয়, নির্ভেজাল জিহাদে পরিণত হয় তাঁর রাজনীতি। জিহাদের এ রাজনীতিতে প্রাণদান তখন শহীদের মর্যাদা আনে। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতি মুসলমানদের জীবনে এখানেই এনেছে সবচেয়ে বড় বিচ্যুতি ও বিপর্যয়। সেক্যুলার এ রাজনীতি বাড়িয়েছে সিরাতুল মোস্তাকিম থেকে ভয়ানক পথভ্রষ্টতা। জনগণকে যে তারা মূর্তিপূজায় ফিরিয়ে নিয়ে গেছে তা নয়। বরং লক্ষ্যচ্যুত করেছে বাঁচার মূল প্রেরণা ও উদ্দেশ্য থেকে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনগণের জীবনে এখানেই ঘটেছে সবচেয়ে বড় অকল্যাণ ও বিপর্যয়। রাজনীতির সফলতার মাপকাঠি এ নয় যে, দেশে কতটা পিরামিড, প্রাসাদ বা তাজমহল নির্মিত হলো। অতীতে বহু দুর্বৃত্ত শাসক এসবের নির্মাণে বিস্ময়কর সফলতা দেখিয়েছে। সেগুলোর নির্মাণে হাজার মানুষ যেমন পাথর চাপা পড়েছে, তেমনি কষ্টার্জিত সম্পদের বিশাল অপচয়ও হয়েছে। অথচ তা দিয়ে কোটি কোটি মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষার ব্যবস্থা হতে পারতো। এখানে মহান আল্লাহর বিচারের মানদণ্ড ভিন্ন। তিনি দেখতে চান, রাষ্ট্রের বুক থেকে কতটা অন্যায় ও পাপাচার নির্মূল হলো। এবং কতটা প্রতিষ্ঠা পেল ন্যায়নীতি ও সৎকর্ম। যুগে যুগে মানবের সবচেয়ে বড় অকল্যাণটি ঘটে সমাজে অন্যায় কর্ম ব্যাপকতর হওয়ার ফলে। তাই গুরুত্বপূর্ণ ধর্মকর্ম হলো সে অন্যায়কে প্রতিরোধ করা। সেই সাথে আল্লাহর প্রদর্শিত ন্যায় ও সৎকর্মকে ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠা দেয়া। সে দায়িত্বটি প্রতিটি ব্যক্তির। সে দায়িত্ব পালন শুধু সারাক্ষণ জায়নামাজে কাটালে বা সারা জীবন রোজা রাখলে যেমন হয় না। তেমনি প্রতি মহল্লায় মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণেও হয় না। অন্যায়ের বিলুপ্তিতে সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী হাতিয়ার হলো রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের হাতেই আইন-আদালত, পুলিশ, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা। তাই অন্যায়ের রোধে ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের ওপর দখলদারিটি নিতে হয়, ব্যবহার করতে হয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে। মহান নবীজী (সা)-এর এটাই মহান সুন্নত। কল্যাণকর রাষ্ট্র নির্মাণের স্বার্থেই তিনি নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেছেন। নামাজ-রোজা তো গুহাতে বসেও চলে। কিন্তু তাতে রাষ্ট্র নির্মিত হয় না, সভ্যতাও নির্মিত হয় না। বিশ্বশক্তি রূপে ইসলামের প্রতিষ্ঠাও ঘটে না। কল্যাণকর রাষ্ট্রের নির্মাণে নবীজী (সা) সাহাবাদের নিয়ে বারবার সশস্ত্র জিহাদে নেমেছেন, সেসব জিহাদে প্রায় ৬০% সাহাবী শহীদ হয়েছেন। অর্থ, শ্রম ও রক্তের এত বড় কোরবানি মসজিদ-মাদরাসার নির্মাণে যেমন হয়নি, কৃষি বা শিল্পে সমৃদ্ধি আনতেও নয়। অধিকৃত দেশ ও রাজনীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যর্থতা কোন একক ক্ষেত্রে নয়, বরং সর্বক্ষেত্রে। এবং সেগুলো বিশাল বিশাল আকারে। সে ব্যর্থতা যেমন দরিদ্রতা ও বেকারত্বে সীমাবদ্ধ নয়, তেমনি রাস্তা-ঘাটের দুরবস্থা বা পানি ও বিদ্যুতের অভাবেও নয়। তবে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাটি ঘটেছে অন্যায়ের নির্মূলে এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। এ ব্যর্থতার কারণেই দেশটি দুর্নীতিতে ৫ বার বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে। পবিত্র কুরআনের ওপর বর্ণিত আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা সফলতা পরিমাপের যে মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছেন সে অনুসারে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার ও প্রশাসন যে কতটা নিচে নেমেছে এ হলো তার প্রমাণ। দেশের জন্য এটি এক লজ্জাজনক রেকর্ড, শুধু বিশ্ববাসীর সামনে নয়, মহান আল্লাহতায়ালার সামনেও। সর্বদ্রষ্টা মহান আল্লাহর দৃষ্টি থেকে কি এ ব্যর্থতা লুকানো যাবে? তবে এ ব্যর্থতাটি শুধু ইসলামে অঙ্গীকারশূন্য সেক্যুলারদের নয়, ঈমানদাররূপে পরিচয় দানকারীদেরও। তারা ব্যস্ত থেকেছে স্রেফ মসজিদ-মাদরাসা গড়ায়। অথচ তাদেরই চোখের সামনে রাষ্ট্রের দখল চলে গেছে শয়তানি শক্তির হাতে। তাদের পক্ষ থেকে এ দখলদারির বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধ ওঠেনি, প্রতিবাদও ওঠেনি। অথচ শয়তানি শক্তি মসজিদের দখল নিতে এতটা উৎসাহী নয়, সেখানে মূর্তি রাখা নিয়েও তাদের আগ্রহ নেই। বরং তারা তো মসজিদের নির্মাণে ভূমি ও অর্থ দিতেও রাজি। এমনকি হোয়াইট হাউজেও তারা জায়নামাজ পেতে দেয় এবং ইফতারিও পেশ করে। তারা তো চায় রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর নিজেদের দখলদারির প্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্রকে তারা নিরঙ্কুশ ব্যবহার করতে চায় ন্যায়ের প্রতিরোধ এবং অন্যায়ের প্রতিষ্ঠায়। সেখানে রুখতে চায় শরিয়তের প্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্র থেকে বিদায় দিতে চায় মহান আল্লাহর কর্তৃত্ব। নির্মম বাস্তবতা হলো, মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ আজ প্রবলভাবে অধিকৃত এসব শয়তানি শক্তির হাতে এবং সে শয়তানি শক্তির হাতে বাংলাদেশ যে কতটা অধিকৃত তার প্রমাণ মেলে দেশের নগরে-বন্দরে পতিতাপল্লী, সুদী ব্যাংক, মদের দোকান, মদ্যশালা সেক্যুলার আইন-আদালত, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির প্রবল প্রতিষ্ঠা দেখে। দেশটিতে রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে অপরাধী দুর্বৃত্তদের নিরাপত্তা দিতে। দেশের প্রেসিডেন্ট এ দেশে সাজাপ্রাপ্ত খুনিকে শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। আইন বিভাগের কাজ হচ্ছে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত শত শত অপরাধের মামলাকে বেছে বেছে খারিজ করা এবং সে সাথে বিরোধীদলীয় কর্মীদের জেলহাজতে ঢোকানো। ১৯৯৮ সালে জসিমউদ্দীন মানিক নামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রলীগ নেতা ধর্ষণে সেঞ্চুরি করেছিল এবং তা নিয়ে উৎসবও করেছিল। অপরাধকর্মে নিজের পারঙ্গমতা নিয়ে বিকৃত মানসিকতার এক জঘন্য অপরাধী জন-সম্মুখে যেরূপ ঔদ্ধত্য নিয়ে উৎসব করেছিল সেটি শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, মানবজাতির ইতিহাসেও বিরল। ডাকাতও তার অপরাধ লুকাতে অপরাধগুলো রাতের আঁধারে করে। কিন্তু এ অপরাধীর সে লজ্জা-শরম ছিল না। রাষ্ট্রের সভ্যতার মান নির্ধারণ হয় এমন অসভ্য অপরাধীর বিচার কতটা সুষ্ঠুভাবে হয় তা থেকে। বনে জঙ্গলে পশুদের মাঝে কে ধর্ষিত হলো বা খুন হলো সেটি কেউ দেখে না। তা নিয়ে বিচারও হয় না। তাই সেটি পশু সমাজ। তবে সে বিচার বাংলাদেশেও হয়নি। অথচ এমন অপরাধের বিচার বসাতে বড় রকমের ধার্মিক বা অতি মানবিক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সামান্য কিছু মানবিক মূল্যবোধ থাকলেই যে কোন সরকার এমন অপরাধীর বিচারে আপসহীন হয়। কিন্তু সে সামান্য মানবিক মূল্যবোধের পরিচয় সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পেশ করতে পারেননি। কথা হলো, মানবিক মূল্যবোধের বিচারে এতটা নিচে না নামলে কি দুর্বৃত্তিতে বিশ্ব রেকর্ড গড়া যায়? শেখ হাসিনা বরং তার কর্মীদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলেন, একটি লাশের বদলে দশটি লাশ ফেলার। এমন লাশ ফেলার ব্রত নিয়ে তার দলীয় কর্মীরা লগি-বৈঠা নিয়ে ময়দানে নেমেছিল এবং ঢাকার রাস্তায় বহু লাশও ফেলেছিল। তার দলের কর্মীরা যাত্রীভর্তি বাসে আগুনও দিয়েছিল। এভাবে নিছক রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যাপক দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে রাজনীতিতে। শেখ হাসিনা নিজেকে মুসলমান রূপে দাবি করেন। তিনি যে নামাজ পড়েন সে ঘোষণাটিও তিনি জনসভায় দিয়ে থাকেন। কিন্তু এটি কি কোন নামাজী মুসলমানের কাজ? মুসলমান হওয়ার অর্থ তো প্রতি পদে মহান আল্লাহতায়ালার প্রতিটি হুকুম মেনে চলা। সে হুকুমের সামান্য অবাধ্যতাই হলো কুফুরি। সে অবাধ্যতা ব্যক্তিকে কাফেরে পরিণত করে। মহান আল্লাহর হুকুম তো হলো, অন্যায়ের নির্মূল এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। এক লাশের বদলে দশ লাশ ফেলা বা লগি-বৈঠা নিয়ে রাস্তায় নামা নয়। ধর্ষণে সেঞ্চুরিকারীকে বিচার থেকে রেহাই দেয়াও নয়। আর খুন বা অন্যায়ের হুকুম দিলে কি অন্যায়ের নির্মূল হয়? বাংলাদেশে অন্যায় ও অবিচার ব্যাপকভাবে বেড়েছে রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে অপরাধীদের প্রশ্রয় ও আশ্রয় দেয়ার কারণে। বেছে বেছে ভয়ানক অপরাধীদের এখানে রাজনীতিতে নামানো হয়েছে স্রেফ দলীয় লাঠিয়াল রূপে তাদের ব্যবহার করার লক্ষ্যে। বাংলাদেশের সকল ডাকাত সর্দার মিলেও এত অপরাধীদের অপরাধ জগতে নামাতে পারেনি যা নামিয়েছেন শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার ন্যায় রাজনৈতিক নেতারা। তাদের হাতে রাজস্বের শত শত কোটি টাকা যেমন অতীতে ডাকাতি হয়েছে, তেমনি এখনও হচ্ছে। ডাকাতি হয়ে যাচ্ছে রাস্তা ও বনভূমির গাছ, নদীর পাড়, সরকারি খাসজমি এবং বিদেশী ঋণের অর্থ। সরকারি দলের পক্ষ থেকে এমন দুর্বৃত্তি এখন আর কোন গোপন বিষয় নয়। এ খবর বিশ্বের নানা প্রান্তে পৌঁছে গেছে। তাই ক্ষমতাসীন দলের ডাকাতদের হাত থেকে পদ্মা সেতুর ঋণের অর্থ বাঁচাতে বিশ্বব্যাংক তার বরাদ্দকৃত ঋণই বাতিল করে দিয়েছে। মুজিব আমলেও এমনটিই ঘটেছিল। তখন বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে ভিক্ষা দিতেও অনীহা দেখাতো। তখন বাংলাদেশকে তারা তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি বলতো। ভিক্ষা দিলে সে ভিক্ষা থলিতে থাকবে না সে ভয় তাদের মধ্যে তখন প্রবলভাবে ছিল। দুর্ভিক্ষে সে সময় লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। সেটিও কোন পেশাদার ডাকাতদলের কাণ্ড ছিল না, ঘটেছিল এ রাজনৈতিক ডাকাতদের লুণ্ঠনের ফলে। যে হাতিয়ার বিভক্তির মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে শুধু একতা প্রতিষ্ঠার হুকুমটিই আসেনি, এসেছে বিভক্তির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারিটিও। তাই একতাবদ্ধ হওয়া ইসলামে ফরজ এবং বিভক্ত হওয়া হারাম। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা আল্লাহর রশি তথা কুরআনকে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (সূরা আল ইমরান, আয়াত ১০৩) তবে মুসলমানের সে একতা শুধু জায়নামাজে কাতারবদ্ধ হওয়ার একতা নয়। শুধু জায়নামাজে কাতার বাঁধলে কি শয়তানি শক্তিকে পরাজিত করা যায়? তাতে কি আল্লাহর দ্বীনের বিজয় আসে? এ জন্য একতাকে জায়নামাজের বাইরে রাজনীতির ময়দানেও নিয়ে যেতে হয়। মসজিদের মেঝেতে একত্রিত হয় একটি গ্রাম বা মহল্লার মানুষ। আর রাজনীতির ময়দানে একত্রিত হয় সমগ্র দেশের মানুষ। নানা ভাষা, নানা বর্ণ ও নানা মাজহাবের মানুষ এখানে একতাবদ্ধ হয়। রাজনৈতিক দল এভাবে জনগণের মাঝে একতা গড়তে শক্তিশালী মাধ্যমরূপ কাজ করে। ভারতের মুসলমানেরা এক সময় বাংলা, বিহার, আসাম, পাঞ্জাব, সিন্ধু, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান এরূপ নানা প্রদেশে নানা ভাষা ও নানা মাজহাবে বিভক্ত ছিল। একতার রাজনীতি তাদেরকে প্রচণ্ডভাবে শক্তিশালী করেছিল। সে একতার বলেই ১৯৪৭ সালে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল। অপরদিকে বিভক্তির কারণে বিশাল আরব ভূমি আজ শক্তিহীন ও ইজ্জতহীন। বিভক্তির কারণেই আরবরা আজ লাশ হচ্ছে নানা দেশে। রাজনীতির এ হাতিয়ারটি বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়েছে জনগণের মাঝে ঘৃণা ও বিভক্তি ছড়ানোর কাজে। রাজনৈতিক মতপার্থক্য কোন দেশে ও কোন সমাজে নেই। এমন বিভক্তির মাঝে একতা গড়ার মহান শিল্পটি হলো রাজনীতি। নানা মত, নানা ভাষা ও নানা বর্ণে বিভক্ত জনগণকে এটি শান্তিপূর্ণভাবে একত্রে বসবাস করতে শেখায়। তাই যে দেশে রাজনীতিতে উচ্চতর মূল্যবোধ ও পরিপক্বতা আসে সে দেশের রাজনীতিতে দলের সংখ্যা যেমন কমে, তেমনি সংঘাতও কমে। বাংলাদেশে শতাধিক রাজনৈতিক দল দেখে নিশ্চিত বলা যায়, একতা গড়ার সে ফরজ এ সমাজে পালিত হয়নি। নবীজী (সা)-এর আমলে আউস ও খাজরাজ গোত্রের শত শত বছরের রক্তাক্ত সংঘাত বিলুপ্ত হয়েছিল এবং সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় এক মজবুত উম্মাহতে পরিণত হয়েছিল। ইতিহাসের নানা বাঁকে নানা বিষয়ে যেকোনো দেশেই রাজনৈতিক ময়দানে সংঘাত আসে, তাতে জাতীয় জীবনে ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং প্রচুর রক্তপাতও ঘটে। বিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের কাজ হলো সে ক্ষতগুলোকে শুকানোর ব্যবস্থা করা। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটছে উল্টোটি। বহু বছরের পুরনো জখমগুলোকে আজ শুধু তাজাই করা হচ্ছে না, তাতে মরিচও লাগানো হচ্ছে। ১৯৪৭ সালে বহু লক্ষ মানুষ পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু সে কারণে কাউকে জেলে নেয়া হয়নি, কারো পায়ে ডাণ্ডাবেড়িও পরানো হয়নি। সেদিন কংগ্রেসি নেতারা পাকিস্তানের সংসদে বসার সুযোগ পেয়েছেন। অথচ আজ ১৯৭১-এ বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতার জন্য তাদের যুদ্ধাপরাধী রূপে চিত্রিত করা হচ্ছে, সে অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৪০ বছরেরও বেশি কাল পর আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। রাজনীতিবিদদের কাজ শুধু প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষা, শিল্প, বিচার-আদালত, বাণিজ্য, সমাজ-সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে অগ্রগতি আনা নয়, বরং তাদের ওপর বড় দায়ভার হলো দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করা। রাজনীতির মধ্য দিয়ে কথা বলে একটি দেশের জনগণের জীবন-লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এর মধ্য দিয়ে বিমূর্ত হয় তাদের আশা-আকাক্সক্ষা ও চেতনা। প্রকাশ পায় দেশের স্বাধীনতার প্রতি অঙ্গীকার। তবে রাজনীতির গুরুত্ব ইসলামে আরো বিশাল। রাষ্ট্রকে এখানে কাজ করতে হয় মহান রাব্বুল আলামিনের নিজস্ব ইনস্টিটিউশন রূপে। মানব সভ্যতার এটি এক শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, সে সাথে শক্তিশালী সৃষ্টিও। আদিম যুগে এর অস্তিত্বই ছিল না। ইসলামের এ মহান ইনস্টিটিউশনের প্রধান রূপে যিনি সর্ব প্রথম দায়িত্ব নিয়েছিলেন খোদ রাসূলুল্লাহ (সা)। তাঁর ইন্তেকালের পর দায়িত্ব নিয়েছেন হজরত আবু বকর (রা), হজরত উমর (রা), হজরত ওসমান (রা), হজরত আলী (রা)-এর মতো ইতিহাসের অতি শ্রেষ্ঠ মানুষেরা। রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় কাজটি হলো উন্নত মানুষ গড়া। এ দুনিয়ায় সুখসমৃদ্ধি এবং আখেরাতে জান্নাতপ্রাপ্তির কাজ সহজতর করা। এভাবেই রাষ্ট্র দ্বারা মানুষের সবচেয়ে বড় কল্যাণটি সমাধা হয়। রাষ্ট্র এ জন্যই মানবসভ্যতার সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের হাতে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য শ্রেষ্ঠ মানুষ এবং সেই সাথে মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সভ্যতা। এ গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিছক মসজিদ-মাদরাসার সংখ্যা বাড়িয়ে সম্ভব নয়। সম্ভব নয় শুধু নামাজী, রোজাদার ও হাজীর সংখ্যা বাড়িয়েও। আর সম্ভব যে নয় তার প্রমাণ আজকের মুসলিম উম্মাহ। মসজিদ-মাদরাসার সংখ্যা আজ বিপুলভাবে বেড়েছে কিন্তু বাড়েনি সভ্যতর মানুষ। বরং রেকর্ড গড়ছে দুর্নীতিতে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীনদের মূল লক্ষ্য কী করে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকা যায় সেটি। স্বাধীনতা, আইনশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা নাগরিক অধিকার নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। একমাত্র মাথা ব্যথা নিজেদের স্বার্থচিন্তা নিয়ে। সে স্বার্থ চেতনায় রাজনীতিকেরা অতীতে ভারতের সাথে ৭ দফা চুক্তি করে দেশটির জন্মের আগেই শৃঙ্খলিত করেছিল। এরপর ২৫ সালা চুক্তি করে সে বন্দিদশাকে দীর্ঘায়িত করেছিল। জনগণকে শৃঙ্খলিত করেছে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে। পদ্মার পানি লুণ্ঠিত হচ্ছে, আজ লুণ্ঠিত হতে যাচ্ছে সুরমা, কুশিয়ারা, মেঘনা, তিস্তার পানি, কিন্তু তাতেও এ বাকশালীদের মাথা ব্যথা নেই। তারা দেশের বাজার তুলে দিয়েছে ভারতীয়দের হাতে। ভারতের জন্য দিয়েছে দেশের মধ্যভাগ দিয়ে করিডোর। দিয়েছে চট্টগ্রাম এবং চালনা বন্দরে ট্রানজিট সুবিধা। সরকারের মাথাব্যথা বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে রাজপথে হামলা, মামলা এবং মামলার নামে বছরের পর বছর কারারুদ্ধ করে রাখা। রাজনীতি পরিণত হয়েছে স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ারে। ভাবনা ক’জনের? ইসলামের বড় শিক্ষা এবং সে সাথে নবীজী (সা)-এর সবচেয়ে বড় সুন্নত হলো, রাষ্ট্র পরিচালনার এ দায়িত্বটি পাবে রাষ্ট্রের সবচেয়ে আল্লাহভীরু উত্তম ব্যক্তিটি। রাজনীতিতে ঈমানদারদের বড় দায়িত্বটি হলো সে বিষয়টি নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে ইসলামের সাথে বড় গাদ্দারি বা বিশ্বাসঘাতকতা হলো ইসলামে অঙ্গীকারহীনদের অর্থদান বা ভোটদান। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতিতে সে গাদ্দারিটাই বেশি বেশি হচ্ছে। ঈমানদারদের দায়িত্ব নিছক মুসলিম দেশের সীমানা, নিজ গৃহও নিজ ব্যবসা বা মসজিদ-মাদরাসা পাহারা দেয়া নয়। বরং মহান আল্লাহর এ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে শয়তানি শক্তির হাত থেকে রক্ষা করা। কারণ এ প্রতিষ্ঠানটি একবার হাতছাড়া হলে অতি দ্রুত এটি শয়তানের শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়। তখন দ্বীনের পরাজয় আর শুধু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থাকে না, পরাজিত হয় খোদ মসজিদ-মাদরাসার অভ্যন্তরেও। ইসলাম শুধু নামাজ-রোজা-হজ-জাকাতের সবকই দেয় না, শিক্ষা দেয় কী করে রাষ্ট্রের ন্যায় শক্তিশালী প্রতিষ্ঠাটিকে আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ে কাজে লাগাতে হয়। রাষ্ট্র একবার শয়তানি শক্তির দখলে গেলে শয়তান তখন বাসা বাঁধে ব্যক্তির মন-মগজে। তখন ডি-ইসলামাইজেশন তথা ইসলাম থেকে দূরে সরানোর জোয়ার হাজার হাজার মসজিদ-মাদরাসা গড়েও রুখা যায় না। সিরাতুল মোস্তাকিমের বদলে তখন দেশজুড়ে গড়ে ওঠে সিরাতুশ শায়তান তথা শয়তানের পথ। জোয়ারে ভাসা কচুরিপানার ন্যায় মানুষ তখন ভেসে যায় জাহিলিয়াতের জোয়ারে। এ জন্যই কুফরশাসিত রাষ্ট্রে ইসলামের বিজয়ে লড়াই করবে এমন মানুষ অতি দুর্লভ। এখানে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা জনগণকে ঈমানদার রূপে গড়ে না তোলার। একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? বাংলাদেশ মূলত বেঁচে আছে সে ব্যর্থতা নিয়েই। আর এতে ব্যর্থ হচ্ছে দেশের প্রায় ১৫ কোটি মুসলমানের প্রকৃত মুসলমান রূপে বেঁচে থাকার বিষয়টি। ফলে বিপদে পড়ছে শুধু তাদের ইহকালের বাঁচাটি নয়, আখেরাতের বাঁচাটিও। একজন মুসলমানের জীবনে এর চেয়ে বড় দুর্ভাবনার বিষয় আর কী হতে পারে? অথচ রাজনীতির কাজ সে ভাবনাকে জাগ্রত করা এবং সেটিকে রাজনৈতিক এজেন্ডায় পরিণত করা। কিন্তু তা নিয়েই বা ভাবনা ক’জনের?

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির