post

রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী

১২ জুলাই ২০১৩

এ.কে.এম. নাজির আহমদ (গত সংখ্যার পর)

ভারতের পার্লামেন্টে প্রস্তাব গ্রহণ ১৯৭১ সনের ৩১শে মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গানধি ভারতের পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন যা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। প্রস্তাবটি ছিলো নিম্নরূপ ঃ ‘This House expresses its deep anguish and grave concern at the recent developments in East Bengal. A massive attack by armed forces, despatched from West Pakistan, has unleashed against the entire people of East Bengal with a view to suppressing their urges and aspirations. Instead of respecting the will of the people so unmistakably expressed through the election in Pakistan in December 1970, the Government of Pakistan has chosen to flout the mandate of the people. The Government of Pakistan has not only refused to transfer power to legally elected representatives but has also arbitrarily prevented the National Assembly from assuming its rightful and sovereign role. The people of East Bengal are being sought to be suppressed by the naked use of force, by bayonets, machine guns, tanks, artillery and aircraft. The Government of the people of India has always desired and worked for peaceful, normal and fraternal relations with Pakistan. Situated as India is and bound as the people of the sub-continent are by centuries old ties of history, culture and tradition, this House cannot remain indifferent to the macabre tragedy being enacted so close to our border. Throughout the length and breadth of our land, our people have condemned in unmistakable terms, the atrocities now being perpetrated on an unprecedented scale upon an unarmed and innocent people. This House expresses its profound sympathy for and solidarity with the people of East Bengal in their struggle for a democratic way of life. Bearing in mind the permanent interests which India has in peace, committed as we are to uphold and defend human rights, this House demands immediate cessation of the use of force and the massacre of defenseless people. This House calls upon all peoples and Governments of the world to take urgent and constructive steps to prevail upon the Government of Pakistan to put an end immediately to the systematic decimation of the people which amounts to genocide.’১

অর্থাৎ ‘এই হাউস, ইস্ট বেংগলে সৃষ্ট সাম্প্রতিক ঘটনায় গভীর মর্মবেদনা ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রেরিত সেনাবাহিনীকে ইস্ট বেংগল-এর জনগণের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা দমনের জন্য বড়ো আকারের হামলা চালাতে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৯৭০ সনের নির্বাচনে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে জনগণের যেই রায় প্রকাশ পেয়েছে, তা পাকিস্তান সরকার অবজ্ঞাভরে উড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। পাকিস্তান সরকার কেবল যে বৈধভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তাই নয়, তারা অযৌক্তিকভাবে জাতীয় পরিষদকে ন্যায়সংগত ও সার্বভৌম ভূমিকা পালনের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। ইস্ট বেংগল-এর জনগণকে বেয়নেট, মেশিনগান, ট্যাংক, কামান ও বিমান ব্যবহার করে শক্তি প্রয়োগে দমন করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ভারতের জনগণের সরকার সব সময়ই কামনা করেছে এবং পাকিস্তানের সাথে শান্তিপূর্ণ, স্বাভাবিক ও ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করেছে। ভারতের অবস্থান এবং বহু শতাব্দীর ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের যেই বন্ধন এই উপমহাদেশের জাতিগুলোর মধ্যে বিরাজমান, সেই প্রেক্ষিতে সীমান্তের এতো নিকটের এই ভয়ংকর শোকাবহ ঘটনার প্রতি ভারত উদাসীন থাকতে পারে না। আমাদের সারাদেশের মানুষ নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষের ওপর যেই সীমাহীন নৃশংসতা চলছে তার তীব্র নিন্দা করছে। এই হাউস ইস্ট বেংগল-এর মানুষের প্রতি, যারা গণতান্ত্রিক জীবন ব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম করছে, গভীর সমবেদনা জানাচ্ছে এবং তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছে। শান্তির প্রতি ভারতের আগ্রহ, মানবাধিকার সমুন্নত রাখার বিষয়ে ভারতের অংগীকার স্মরণে রেখে, এই হাউস অবিলম্বে শক্তি প্রয়োগ এবং নিরাপত্তাহীন মানুষ নিধন বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছে। এই হাউস পৃথিবীর সকল জাতি ও সরকারসমূহের প্রতি দ্রুত ও গঠনমূলক পদক্ষেপ নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে মানুষ হত্যা, যা আসলে গণহত্যা, বন্ধ করার জন্য পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানাচ্ছে।’ লক্ষ্য করার বিষয়, এই প্রস্তাবের তিনটি স্থানে “ইস্ট বেংগল” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কোথাও পূর্ব পাকিস্তান শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। এর মাধ্যমে ইস্ট বেংগলের পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির প্রতি দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের পুরোনো নেতিবাচক মনোভংগিরই প্রকাশ ঘটেছে।

মুক্তিযুদ্ধের সূচনা আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ডান হাত। ২৫শে মার্চ সন্ধ্যার দিকে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ঢাকার কোন শহরতলীতে গিয়ে থাকতে বলেন যাতে প্রয়োজনে অল্প সময়ের মধ্যে তাঁরা একত্রিত হতে পারেন। লে. জেনারেল টিক্কা খানের উদ্যোগে আর্মি এ্যাকশন শুরু হলে এবং শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়ে গেলে অন্যদের মতো তিনিও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হড়ে পড়েন। ২৭শে মার্চ তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। ফরিদপুর-কুষ্টিয়ার পথে অগ্রসর হয়ে দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পৌঁছেন ৩০শে মার্চ সন্ধ্যায়। নিজের বুদ্ধিতেই তিনি দুইটি লক্ষ্য স্থির করে ফেলেন। এক. পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর প্রচণ্ড আঘাতের কারণে যেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তার হাত থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে সশস্ত্র প্রতিরোধ বা মুক্তির লড়াই শুরু করা। দুই. এই মুক্তি লড়াইকে সংগঠিত করার প্রয়োজনে ভারত ও অন্যান্য সহানুভূতিশীল দেশের সহযোগিতা লাভের জন্য অবিলম্বে সচেষ্ট হওয়া।

(ক)  ‘মুক্তিবাহিনী’ গঠন পঁচিশে মার্চ রাতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানের ইস্ট বেংগল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ বাহিনী এবং আনসার বাহিনীর যেইসব সদস্য বন্দিত্ব এড়াতে পেরেছেন কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও নির্দেশ ছাড়াই যে যার মতো লড়াই শুরু করেন। ২৭শে মার্চ চট্টগ্রাম থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা তেমনি একটি স্বতঃস্ফূর্ত সিদ্ধান্তের ফল। মেজর জিয়াউর রহমানের প্রথম বেতার ঘোষণাটি ছিলো নিম্নরূপ : “I, Major Ziaur Rahman, Provisional President and Commander–in-Chief of Liberation  Army do hereby proclaim independence of Bangladesh and appeal for joining our liberation struggle. Bangladesh is independent. We have waged war for the liberation of Bangladesh. Everybody is requested to participate in the liberation war with whatever we have. We will have to fight and liberate the country from the occupation of Pakistan Army.  Inshallah, victory is ours.”২ ‘আমি, মেজর জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশের প্রভিশনাল প্রেসিডেন্ট ও লিবারেশন আর্মি চীফ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য আবেদন জানাচ্ছি। বাংলাদেশ স্বাধীন। আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে নেমেছি। আপনারা যে যা পারেন সামর্থ অনুযায়ী অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়–ন। আমাদেরকে যুদ্ধ করতে হবে এবং পাকিস্তানী বাহিনীকে দেশ ছাড়া করতে হবে। ইনশাল্লাহ, বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত।’ ৪ঠা এপ্রিল ইস্ট বেংগল রেজিমেন্টের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কর্ণেল (অব.) মুহাম্মাদ আতাউল গনী ওসমানী, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর মমিন চৌধুরী প্রমুখ হবিগঞ্জ জিলার মাধবপুর উপজিলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোতে একটি মিটিংয়ে একত্রিত হন। আলাপ আলোচনার পর সমস্ত ইউনিটের সমন্বয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ‘মুক্তি ফৌজ’ গঠন করা হয়। ‘মুক্তি ফৌজের’ প্রধান নির্বাচিত হন কর্ণেল (অব.) মুহাম্মাদ আতাউল গনী ওসমানী। [চার মাস পর অর্থাৎ জুলাই মাসের শেষ ভাগে ‘মুক্তি ফৌজ’ নাম বদলিয়ে ‘মুক্তি বাহিনী’ রাখা হয়।] “১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সামরিক অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় সব পূর্ব পাকিস্তানি পুলিশ, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস, আনসার, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর কয়েকটি নিয়মিত ইউনিটের পূর্ব পাকিস্তানী সদস্যরা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এসব লোক নেতৃত্বসহ মুক্তিবাহিনীর নিউক্লিয়াস গঠন করে। ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর পর বিদ্রোহী বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিলো ১ লাখ ৬২ হাজার। ভারতীয় ও রুশরা পর্যায়ক্রমে আরো ১ লাখ ২৫ হাজার বেসামরিক লোককে প্রশিক্ষণ দেয়। এভাবে মুক্তিবাহিনীর মোট সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৭ হাজার ৫ শ’।”৩ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য রণাংগনকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। ১ নাম্বার সেকটার চট্টগ্রাম জিলা, পার্বত্য চট্টগ্রাম জিলা এবং ফেনী নদী পর্যন্ত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় এই সেকটার। এই সেকটারের দায়িত্ব অর্পিত হয় মেজর জিয়াউর রহমান ও মেজর মুহাম্মাদ রফিকের ওপর। ২ নাম্বার সেকটার নোয়াখালী জিলা, কুমিল্লা জিলার আখাড়উ-ভৈরব রেল লাইন পর্যন্ত ও ফরিদপুর জিলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয় এই সেকটার। এই সেকটারের দায়িত্ব অর্পিত হয় মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর এম.টি. হায়দারের ওপর। ৩ নাম্বার সেকটার হবিগঞ্জ জিলা, ঢাকা জিলার অংশবিশেষ, কিশোরগঞ্জ এবং আখাউড়া ভৈরব রেল লাইনের পূর্ব দিকের কুমিল্লা জিলার বাকি অংশ নিয়ে এই সেকটার গঠিত হয়। এই সেকটারের দায়িত্ব অর্পিত হয় মেজর কে.এম. সফিউল্লাহ ও মেজর নুরুজ্জামানের ওপর। ৪ নাম্বার সেকটার সিলেট জিলার পূর্বাঞ্চল, পূর্ব উত্তর দিকে সিলেট-ডাউকি রোড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো এই সেকটার। এই সেকটারের দায়িত্ব অর্পিত হয় মেজর সি.আর. দত্তের ওপর। ৫ নাম্বার সেকটার সিলেট জিলার পশ্চিমাঞ্চল ও ডাউকি-ময়মনসিংহ জিলার সীমান্ত পর্যন্ত অঞ্চল ছিলো এই সেকটারের অন্তর্ভুক্ত। এই সেকটারের দায়িত্ব অর্পিত হয় মেজর মীর শওকত আলীর ওপর। ৬ নাম্বার সেকটার ঠাকুরগাঁও জিলা ও ব্রহ্মপুত্রের তীরাঞ্চল ছাড়া সমগ্র রংপুর জিলা নিয়ে এই সেকটার গঠিত হয়। এই সেকটারের দায়িত্ব অর্পিত হয় উইং কমান্ডার এম. বাশারের ওপর। ৭ নাম্বার সেকটার রাজশাহী জিলা, পাবনা জিলা, দিনাজপুর জিলা, পঞ্চগড় জিলা ও ব্রহ্মপুত্রের তীরাঞ্চল ছাড়া বগুড়া জিলা নিয়ে গঠিত হয় এই সেকটার। এই সেকটারের দায়িত্ব অর্পিত হয় মেজর কাজী নুরুজ্জামানের ওপর। ৮ নাম্বার সেকটার কুষ্টিয়া জিলা, যশোর জিলা, ফরিদপুর জিলার অধিকাংশ নিয়ে ও খুলনা জিলার উত্তরাঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় এই সেকটার। এই সেকটারের দায়িত্ব অর্পিত হয় মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ও মেজর এম.এ. মঞ্জুর-এর ওপর। ৯ নাম্বার সেকটার বৃহত্তর খুলনার দক্ষিণাঞ্চল, বরিশাল জিলা ও পটুয়াখালী জিলা নিয়ে গঠিত হয় এই সেকটার। এই সেকটারের দায়িত্ব অর্পিত হয় মেজর এম.এ. জলিলের ওপর। ১০ নাম্বার সেকটার অভ্যন্তরীণ নদীপথ, দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ নদীপথ, চট্টগ্রাম এলাকার নদীপথ নিয়ে গঠিত হয়েছিলো এই সেকটার। নদীপথে পাকিস্তানী সৈন্যদের ওপর হামলা চালাবার জন্য হেড কোয়ার্টার্সের দায়িত্বে ছিলো এটি। ১১ নাম্বার সেকটার মোমেনশাহী জিলা, টাংগাইল জিলা, শেরপুর জিলা, জামালপুর জিলা ও যমুনা নদীর তীরাঞ্চল নিয়ে এই সেকটার গঠিত হয়। মেজর আবু তাহের ও ফ্লাইট লেফটেনেন্ট এম. হামিদুল্লাহ খানের ওপর অর্পিত হয় এই সেকটারের দায়িত্ব।৪

(খ)  ‘মুজিব বাহিনী’ গঠন এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কলকাতা পৌঁছেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমদ, আবদুর রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, আ.স.ম. আবদুর রব ও শাহজাহান সিরাজ। তাঁদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘মুজিব বাহিনী’। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মে. জেনারেল উবানের তত্বাবধানে দেরাদুনের অদূরে চাক্রাতা-য় মুজিব বাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিং শুরু হয়। ‘মুজিব বাহিনী’ সম্পর্কে ‘মূলধারা ’৭১’ এর লেখক মঈদুল হাসান বলেন, ‘মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা মুজিব বাহিনীর লক্ষ্য বলে প্রচার করা হলেও এই সংগ্রামে তাদের নির্দিষ্ট ভূমিকা, কার্যক্রম ও কৌশল কি, কোন্ এলাকায় এরা নিযুক্ত হবে, মুক্তিবাহিনীর অপরাপর ইউনিটের সাথে এদের তৎপরতার কিভাবে সমন্বয় ঘটবে, কি পরিমাণ বা কোন্ শর্তে এদের অস্ত্র ও রসদের যোগান ঘটছে, কোন্ প্রশাসনের এরা নিয়ন্ত্রণাধীন, কার শক্তিতে বা কোন্ উদ্দেশ্যে এরা অস্থায়ী সরকারের বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধাচরণ করে চলছে, এ সমুদয় তথ্যই বাংলাদেশ সরকারের জন্য রহস্যাবৃত থেকে যায়।’৫ মুজিব বাহিনীর একাংশ এই প্রচারণায় মত্ত ছিলো যে ‘তাজউদ্দিনই বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার হওয়ার কারণ’, ‘তাজউদ্দিন যতোদিন প্রধানমন্ত্রী, ততোদিন ভারতের পক্ষে বাংলাদেশের স্বীকৃতি অসম্ভব’, ‘তাজউদ্দিন ও তাঁর মন্ত্রীসভা যতোদিন ক্ষমতায় আসীন ততোদিন বাংলাদেশের মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়।’ তাজউদ্দিন আহমদের প্রতি শেখ ফজলুল হক মণি’র মনোভাব ছিলো খুবই নেতিবাচক।

(গ) ‘প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার’ গঠন ১৯৭১ সনের ১৭ই এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে। অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী হন তাজউদ্দিন আহমদ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ক্যাপ্টেন (অবসরপ্রাপ্ত) মনসুর আলী এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব খন্দকার মুশতাক আহমদের ওপর ন্যস্ত করা হয়। ‘মুক্তি বাহিনীর’ মাঝে কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কিংবা দলীয় স্বার্থ-চিন্তা ছিলো না। এটি  ছিলো জাতীয় স্বার্থের প্রতীক। ফলে ‘প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার’ গঠিত হলে সেই সরকারের আনুগত্য করতে মুক্তিবাহিনী বিন্দুমাত্রও দ্বিধা করেনি। পক্ষান্তরে ‘মুজিব বাহিনী’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে একটি স্বতন্ত্র ধারায় অবতীর্ণ হয়। এটি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্যশীল ছিলো না। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে মুজিব বাহিনী স্বাধীনভাবে এর তৎপরতা চালাতে থাকে।

কাদেরিয়া বাহিনী টাংগাইল জিলার এক টগবগে তরুণ আবদুল কাদের সিদ্দিকী স্বতন্ত্রভাবে একটি মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। এটি কাদেরিয়া বাহিনী নামে পরিচিত হয়। দেশের অভ্যন্তরে অবস্থান করে যমুনা নদীর পূর্ব তীরাঞ্চল এবং টাংগাইল জিলা ও মোমেনশাহী জিলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত করে এই বাহিনী নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী ব্যক্তিদের উভয় সংকট এই সময়টিতে পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী নেতা ও কর্মীগণ উভয় সংকটে পড়েন। তাঁরা আওয়ামী লীগের অনুসৃত পথে যেতে পারছিলেন না। অন্য দিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরতাকেও সমর্থন করতে পারছিলেন না। এমতাবস্থায় লে. জেনারেল টিককা খানের পক্ষ থেকে ব্রিগেডিয়ার রাও ফরমান আলী খান, ন্যাশনাল ডিমোক্রেটিক ফ্রন্টের নূরুল আমীন, মুসলিম লীগের খাজা খায়েরউদ্দিন, নেযামে ইসলাম পার্টির মৌলবী ফরিদ আহমাদ এবং জামায়াতে ইসলামীর অধ্যাপক গোলাম আযমের সাথে যোগাযোগ করে তাঁদেরকে রেডিওতে বক্তৃতা করার জন্য বলেন। উভয় সংকটে নিপতিত অবস্থায় জাতির উদ্দেশ্যে কী বক্তব্য রাখবেন স্থির করা ছিলো খুবই কঠিন। জনাব নূরুল আমীন তাঁর ভাষণে বলেন যে ‘১৯৪৬ সনের নির্বাচনে বাংলার মুসলিমদের ৯৭ জন পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের জনসংখ্যা শতকরা ৫৬ ভাগ পূর্ব পাকিস্তানী। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসনে বিজয়ী হয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। আজ হোক কাল হোক শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। তিনি আমাদের অধিকার আদায় করতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চাননি। আলাদা হতে চাইলে তিনি আত্মগোপন করে ভারতে চলে যেতেন।’ ভাষণে তিনি আশা ব্যক্ত করেন যে দেশে আইন-শৃংখলা বহাল হলেই শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে বেরিয়ে আসবেন এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সকল দাবি পূরণ করবেন। এরপর আসে মৌলবী ফরিদ আহমদের ভাষণ প্রদানের দিন। তিনি অত্যন্ত আবেগপূর্ণ একটি বক্তব্য রাখেন। তাঁর ভাষণ প্রধানত ভারতের বিরুদ্ধেই ছিলো। তিনি বলেন যে ‘ভারতের গোলামী থেকে বাঁচার জন্যই মুসলিমগণ পাকিস্তান বানিয়েছে। আমরা আবার তাদের গোলাম হতে চাই না। ভারত থেকে আমাদেরকে সাবধান থাকতে হবে।’ তিনিও তাঁর ভাষণে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কিছুই বলেননি। খাজা খায়েরউদ্দিনের ভাষণ মোটামুটি জনাব নূরুল আমীনের ভাষণের অনুরূপ ছিলো। অতপর অধ্যাপক গোলাম আযমের ভাষণের দিন আসে। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়া খান জুলফিকার আলী ভূট্টোর সাথে আঁতাত করে যেই রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছেন অধ্যাপক গোলাম আযম বারবার তার প্রতিবাদ করেছেন। রেডিও ভাষণে তিনি আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিবুর রহমান এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে কিছুই বলেননি। তিনি তাঁর ভাষণে ভারতের মুসলিমদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেছেন। চলমান রাজনৈতিক সংকটের সুযোগে বন্ধু সেজে ভারত এই দেশ দখল করতে চায় বলে তিনি সতর্ক থাকার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। অধ্যাপক গোলাম আযমের ভাষণে লে. জেনারেল টিককা খান খুশি হতে পারেননি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীকে তার শত্র“ পক্ষ গণ্য করে। ফলে সারাদেশেই জামায়াতে ইসলামীর জনশক্তি আওয়ামী লীগ থেকে হুমকির সম্মুখীন হয়।

‘শান্তি কমিটি’ গঠন ১৯৭১ সনের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি। কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি খাজা খায়েরউদ্দিন এবং নেযামে ইসলাম পার্টির সেক্রেটারী জেনারেল মৌলবী ফরিদ আহমদের উদ্যোগে ন্যাশনাল ডিমোক্রেটিক ফ্রন্টের চেয়ারম্যান জনাব নূরুল আমীনের বাসভবনে একটি মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। এতে আরো উপস্থিত ছিলেন সর্বজনাব এ.কিউ.এম. শফিকুল ইসলাম (মুসলিম লীগ), মাহমুদ আলী (পাকিস্তান ডিমোক্রেটিক পার্টি), আবদুল জাব্বার খদ্দর (কৃষক শ্রমিক পার্টি), পীর মুহসিনুদ্দীন (জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম), এ.এস.এম. সুলাইমান (কৃষক শ্রমিক পার্টি), মাওলানা নূরুয্যামান (পিপলস পার্টি) প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন জনাব নূরুল আমীন। মৌলবী ফরিদ আহমদ প্রথমে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে আন্দোলনে এগিয়ে দিয়ে নিজেরা ভারতে পালিয়ে গেলেন। এদিকে সরকার সেনাবাহিনীকে দিয়ে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে যে সশস্ত্র অভিযান চালাচ্ছে তাতে নিরীহ জনগণই বেশি নির্যাতিত হচ্ছে। যারা আন্দোলনে সক্রিয় তারা সবাই আত্মগোপন করছে বা ভারতে চলে গেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে প্রশাসন, পুলিশ, ব্যাংক, আদালত সবই চলছিলো। টিককা খান ঐ সরকার পুনর্দখলের উদ্দেশ্যে যা কিছু করছেন তাতে নিরপরাধ লোকেরা যাতে বিপদগ্রস্ত না হয় এবং সেনাবাহিনী যেন বাড়াবাড়ি না করে এমন ব্যবস্থা হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। যারা বিপদগ্রস্ত হচ্ছে তারা কার কাছে আশ্রয় পাবে? আমরা যারা রাজনীতি করি জনগণ তাদের কাছেই সাহায্যের জন্য আসছে এবং আসবে। আমরা তাদেরকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি সেই বিষয়ে মত বিনিময়ের উদ্দেশ্যেই আজকের এই মিটিং।’ এ.কে. রফিকুল হোসেন বলেন, ‘আমরা যাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ভারত বিভক্ত করে পাকিস্তান কায়েম করেছিলাম, সেই পাকিস্তানকে ভারত দখল করে নিক তা আমরা চাইতে পারি না। ভারত আমাদের বন্ধু হতে পারে না। আওয়ামী লীগ নেতারা এই দেশটাকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার জন্য ভারত সরকারের নিকট আশ্রয় নিয়েছে। আমি নিশ্চিত যে ভারত পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার এই মহা সুযোগ গ্রহণ করবে। আমার আশংকা যে আমরা দিল্লীর গোলামে পরিণত হতে যাচ্ছি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য যেই চেষ্টা করছে তাতে তাদের সাথে আমাদের সহযোগিতা করা কর্তব্য। ভারতীয় কংগ্রেসের অধীনতা থেকে মুক্তির জন্যই আমরা পাকিস্তান আন্দোলন করেছিলাম। আমরা আবার সেই কংগ্রেসের অধীন হতে পারি না।’ আবদুল জাব্বার খদ্দর বলেন, ‘সেনাবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে এই দেশকে ভারতের খপ্পর থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। ভারত জয়ী হলে এরা কেউ পালাতেও পারবে না। এই অবস্থায় তাদের এই প্রচেষ্টায় আমাদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করা কর্তব্য।’ অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, ‘এই দেশের রাজনীতিতে আজকের সভাপতি ছাড়া আমরা কেউ গণ্য নই। গত নির্বাচনে আমাদের কারো কোন পাত্তা ছিলো না। একমাত্র নূরুল আমীন সাহেব নির্বাচিত হতে সক্ষম হন। আর সকল আসনই শেখ মুজিব পেয়েছেন। জনগণের নিকট আমাদের কতটুকু মূল্য আছে? নির্বাচনে জনগণ যাদেরকে ক্ষমতায় বসাতে চেয়েছে তাদেরকে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহইয়া খান কেমন জঘন্য চক্রান্ত করেছেন তা জনগণ ও বিশ্ববাসী লক্ষ্য করেছে। নির্বাচনের ফলাফলকে চরম অবজ্ঞার সাথে উপেক্ষা করে, এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক সরকারকে শেখ মুজিবের আনুগত্য করতে দেখেও ইয়াহইয়া খান শেখ মুজিবের সাথে সংলাপে কোন সমঝোতায় পৌঁছাতে সক্ষম হলেন না। রাজনৈতিক মতবিরোধকে রাজনৈতিকভাবেই মিমাংসা করতে হয়। সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে তা করা যায় না। ইয়াহইয়া খান জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে ভারতের হাতে তুলে দিলেন। আমরা জনগণের প্রতিনিধি নই। আমরা এই সমস্যার কী সমাধান দেবো? সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, কোন সামরিক শক্তি ১৯৪৭ সনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ করেনি। শুধু সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এই ঐক্য বহাল রাখা যাবে না। আমরা কিভাবে টিককা খানের  সাথে সহযোগিতা করবো? তারা যা করছেন তাতে কি আমাদের কোন পরামর্শ চেয়েছেন? তারা কি আমাদের কথা মতো চলবেন? এসব কথা বিবেচনা করেই আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। পাকিস্তান টিকে থাকুক, আমাদের দেশ ভারতের খপ্পর থেকে বেঁচে থাকুক, এটা অবশ্যই আমাদের সবার আন্ত—রিক কামনা। কিন্তু এই বিষয়ে আমাদের হাতে কোন উপায় আছে বলে মনে হয় না। তাই আমি মৌলবী ফরিদ আহমদের প্রস্তাব সমর্থন করি এবং অসহায় জনগণের যতটুকু খিদমত করা সম্ভব, সেই প্রচেষ্টাই আমাদের সীমাবদ্ধ থাকা উচিত।” আরো অনেকেই বক্তব্য রাখেন। অবশেষে সর্বসম্মতিক্রমে ‘শান্তি কমিটি’ নামে একটি সংস্থা গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।৬ খাজা খায়েরউদ্দিন এই কমিটির আহ্বায়ক নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে ২১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কার্যকরী কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সদস্য ছিলেন-  এডভোকেট এ.কিউ.এম. শফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক গোলাম আযম, মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মাদ মাসুম, জনাব আবদুল জাব্বার খদ্দর, মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ, জনাব আবুল কাসেম, জনাব মোহন মিয়া, জনাব আবদুল মতিন, অধ্যাপক গোলাম সারওয়ার, ব্যারিস্টার আখতারউদ্দীন, পীর মুহসিনুদ্দীন, জনাব এ.এস.এম. সুলাইমান, জনাব এ.কে. রফিকুল হোসেন, জনাব নুরুজ্জামান, জনাব আতাউল হক খান, জনাব তোয়াহা বিন হাবীব, মেজর আফসারউদ্দীন, দেওয়ান ওয়ারাসাত আলী এবং হাকিম ইরতিয়াজুর রহমান। জনগণের জীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং নিরপরাধ জনগণকে সেনাবাহিনীর যুল্ম থেকে বাঁচানোর জন্য শান্তি কমিটি প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। দেশের সকল স্তরেই মুসলিম লীগের লোক ছিলো। থানা পর্যায়েও মুসলিম লীগের লোকেরাই নেতৃত্ব লাভ করেন। মুসলিম লীগের পর আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোন দলেরই জিলা ও মহকুমা পর্যায়ের নিচে সংগঠন ছিলো না। জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন তখনো মহকুমা স্তরের নিচে বিস্তার লাভ করেনি।

‘রেযাকার বাহিনী’ গঠন ১৯৭১ সনের ২রা অগাস্ট পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর লে. জেনারেল টিককা খান The East Pakistan Razakars Ordinance 1971  ১৯৭১ জারি করেন। এই অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে The Ansars Act 1948  বাতিল করা হয় এবং আনসার বাহিনীর টাকা-পয়সা, রেকর্ডপত্র এবং সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি Razakar বাহিনীর নিকট হস্তান্তর করা হয়।৭ অর্থাৎ আনসার বাহিনীর স্থলাভিষিক্ত হয় রেযাকার বাহিনী। এখন যাদেরকে ইউ.এন.ও. বলা হয় তখন তাদেরকে বলা হতো সার্কল অফিসার। সামরিক সরকারের নির্দেশে সার্কল অফিসারগণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে হাটে বাজারে ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দিয়ে রেযাকার রিক্রুট করা শুরু করেন। “স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয়” গ্রন্থে কামরুদ্দিন আহমদ রেযাকার বাহিনীর কমপোজিশন সম্পর্কে একটি চমৎকার চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, “(ক) দেশে তখন দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছিলো। সরকার সে দুর্ভিক্ষের সুযোগ নিয়ে ঘোষণা করলো, যারা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেবে, তাদের দৈনিক নগদ তিন টাকা ও তিন সের চাউল দেওয়া হবে। এর ফলে বেশ কিছু সংখ্যক লোক, যারা এতোদিন পশ্চিমা সেনার ভয়ে ভীত হয়ে সন্ত্রস্ত দিন কাটাচ্ছিলো, তাদের এক অংশ ঐ বাহিনীতে যোগদান করলো। (খ) এতোদিন পাকসেনার ভয়ে গ্রামগ্রামান্ত—রে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলো, আত্মরক্ষার একটি মোক্ষম উপায় হিসেবে তারা রাজাকারদের দলে যোগ দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। (গ) এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী জোর করে মানুষের সম্পত্তি দখল করা এবং পৈতৃক আমলের শত্র“তার প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ গ্রহণের জন্যেও এ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো।” পাকিস্তানী সেনাদের গাড়ি চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা পুল ও কালভার্ট ভেংগে দিতো। রেযাকারদেরকে পুল ও কালভার্ট পাহারা দেওয়ার কাজে লাগানো হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম যাতে নির্বিঘেœ চলতে পারে সেই জন্য পাহারাদার হিসেবে রেযাকারদেরকে নিয়োজিত করা হয়। ইলেকট্রিসিটি সাল্পাই যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সেই জন্য ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কেন্দ্রগুলোতে রেযাকারদেরকে পাহারাদার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ইত্যাদি। একজন মুক্তিযোদ্ধার লিখিত চিঠিতে আমরা রেযাকার বাহিনী গঠন ও তাদের ভূমিকা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ পাই- “অবশ্য আজকাল পাকিস্তানিরা একটা নতুন বাহিন গঠন করেছে। নাম দিয়েছে রাজাকার। এরা প্রায়ই মুসলিম লিগের লোক। অনেক জায়গায় আবার জোর করে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ঢুকাচ্ছে। এক এক মহল্লায় গিয়ে সেখানকার চেয়ারম্যান অথবা সরদার গোছের লোকদেরকে ভয় দেখিয়ে বলছে যে তোমাদের মহল্লা থেকে এতজন লোক রাজাকার বাহিনীতে না দিলে তোমাদের মহল্লা বা গ্রাম ধ্বংস করে দেব। এই রাজাকারদের হাতে ৩০৩ রাইফেল দেওয়া হয় আর তারা ব্রিজ, রাস্তা ইত্যাদি পাহারা দেয়, যাতে মুক্তিবাহিনী এগুলো ধ্বংস না করতে পারে। যদি কোন এলাকার Bridge  ইত্যাদি ধ্বংস হয় তাহলে আশপাশের তিন-চার মাইলের মধ্যে বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দেয়। তাই লোকেরা ব্রিজ ধ্বংস করতে গেলে তারা... Fight করে, না হয়তো হাতে পায়ে ধরে তাদের ব্রিজ উড়াতে মানা করে। অবশ্য রাজাকাররা অনেক জায়গায় আমাদের সাহায্য করেছে, আবার অনেক জায়গায় গ্রামবাসীর ওপর খুব অত্যাচার করেছে। অবশ্য রাজাকাররা আমাদের খুবই ভয় করে (They are no match for us)  এবং প্রায় অনেক রাজাকার Defect করে MB তে যোগ দিচ্ছে।”৮ রেযাকার বাহিনীর দুইটি উইং ছিলো : আল বদর বাহিনী ও আশ্ শামস বাহিনী। এই সম্পর্কে লে. জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজী বলেন, “Two separate wings called Al-Badr and Al-Shams were organized.Well-educated and properly motivated students from schools and madrasas were put in Al-Badr wing, where they were trained to undertake Ôspecialized operationsÕ, while the remainder were grouped together under Al-Shams, which was responsible for the protection of bridges, vital points and other areas.”৯ ‘আল বদর ও আশ্ শামস নামে দুইটি আলাদা ‘উইং’ গঠন করা হয়। স্কুল-মাদ্রাসার সুশিক্ষিত ও যথাযথভাবে উদ্বুদ্ধ ছাত্রদের সমন্বয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে কার্য চালাবার জন্য আল বদর উইং গঠন করা হয় এবং পুল, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও অন্যান্য স্থান পাহারা দেওয়ার জন্য অন্যদেরকে নিয়ে গঠন করা হয় আশ্ শামস উইং’। এত্থেকে এটি স্পষ্ট হয় যে, ‘আল বদর বাহিনী’ ও ‘আশ্ শামস বাহিনী’ নামে স্বতন্ত্র কোন বাহিনী ছিলো না। ‘আল বদর বাহিনী’ ও ‘আশ্ শামস বাহিনী’ রেযাকার বাহিনীরই দুইটি ভাগ ছিলো মাত্র। রেযাকার বাহিনী জামায়াতে ইসলামীর সৃষ্টি বলে যেই প্রচারণা, তা একেবারেই ভিত্তিহীন। তদুপরি রেযাকার বাহিনীতে জামায়াতে ইসলামীর বিপুল উপস্থিতির কথাও একটি কল্পকাহিনী। উল্লেখ্য, সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীর সদস্য (রুকন) ছিলেন সাড়ে চারশত জন। কর্মী সংখ্যা ছিলো ছয় হাজার থেকে সাত হাজারের মধ্যে। এই জনশক্তির উল্লেখযোগ্য অংশ ছিলেন বৃদ্ধলোক ও নারী। তথ্যসূত্র : ১.    আবুল আসাদ, কালো পঁচিশের আগে ও পরে, পরিশিষ্ট-৯, পৃষ্ঠা-৩৪৯। ২.    আরমান আমিন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা, পৃষ্ঠা-৬১। ৩.    লে. জেনারেল এ.এ.কে নিয়াজী, দ্যা বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান, বাংলা অনুবাদ: ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল, পৃষ্ঠা-৮৪। ৪.    এম.এ ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা : ১০০-১০১। ৫.    মঈদুল হাসান, মূলধারা ’৭১, পৃষ্ঠা-৭২। ৬.    অধ্যাপক গোলাম আযম, জীবনে যা দেখলাম, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৫৭। ৭.    এড. মো. খায়রুল আহসান (মিন্টু), আর্মি, বিডিআর ও যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কিত আইন ও অধ্যাদেশরূপৃষ্ঠা-১২৩। ৮.    মুক্তিযোদ্ধা টিটো, একাত্তরের চিঠি, পৃষ্ঠা-১২২, ১২৩। ৯.    Lieutenant General (R) A.A.K. Niazi, The Betrayal of East-Pakistan, Page-78

  (চলবে)

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির