post

শহীদ ড. মুরসি প্রেরণা জোগাবে আর খুনিরা অভিশপ্ত হতে থাকবে । ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম

০৫ আগস্ট ২০১৯

শহীদ ড. মুরসি প্রেরণা জোগাবে আর খুনিরা অভিশপ্ত হতে থাকবে । ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিমপৃথিবীতে নীল নদের দেশ হিসেবে খ্যাত মিসর। পিরামিডসহ অনেক ইতিহাস ঐতিহ্যের নিদর্শন রয়েছে এখানে। অনেক নবী-রাসূলের আগমন হয়েছে এই পবিত্র মাটিতে। আবার দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জালিম শাসক ফেরাউনও এই জনপদকে শাসন করেছে, ফেরাউন ঔদ্ধত্যের সীমা ছাড়িয়ে নিজেকে খোদা বলে দাবি করে আল্লাহর গজবে পতিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আজ আমি তোমার (ফেরাউন) দেহ রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাকো। অবশ্যই মানুষের মধ্যে অনেকে আমার নিদর্শন সম্পর্কে উদাসীন।’ (সূরা ইউনুুস : ৯২) ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহর এই ঘোষণা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ড. মরিস বুকাইলি লিখেছেন- ‘লোরেট ১৮৯৮ সালে রাজাদের উপত্যকায় (কিংস ভ্যালি) থিবিসে দ্বিতীয় রামাসিসের পুত্র ও মহাযাত্রাকালীন ফেরাউন মারনেপতাহর (মিনফাতাহ) মমি করা লাশ আবিষ্কার করেন। সেখান থেকে তা কায়রোয় নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯০৭ সালের ৮ জুলাই এলিয়ট স্মিথ এ মমির আবরণ অপসারণ করেন। তিনি তাঁর ‘দ্য রয়্যাল মমিজ’ নামক গ্রন্থে (১৯১২) এর প্রক্রিয়া ও লাশ পরীক্ষার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। কয়েকটি জায়গায় কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও মমিটি তখন সন্তোষজনকভাবেই সংরক্ষিত ছিল।’ আল্লাহ বলেন, “কাফেরদের আমি যে ঢিল দিয়ে চলছি এটাকে যেন তারা নিজেদের জন্য ভালো মনে না করে; আমি তাদেরকে এ জন্য ঢিল দিচ্ছি, যাতে তারা গোনাহের বোঝা ভারী করে নেয়, তারপর তাদের জন্য রয়েছে কঠিন অপমানকর শাস্তি। (সূরা আলে ইমরান : ১৭৮) সুতরাং আল্লাহর ওয়াদা সত্য। আজকে মিসরের ক্ষমতার মসনদে যারা অধিষ্ঠিত এরাও ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে আল্লাহর লানতে পতিত হবে। একটি প্রবাদ আছে, “হুকমু মিসরা লা’নাতুন” অর্থাৎ - মিসরের শাসন একটি অভিশাপ। মিসরের কোন শাসক তার শাসনের পুরোটা সময় কাটিয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেছে এমন শাসক নেহায়েত কম। কায়রোর সিংহাসন কারো জন্য ফুল ছিটানো ছিল না। এটি ছিল যেন একটি বারুদের ডিপো, যা সবাইকে ভস্ম করে ছেড়েছিল। এই অভিশাপ থেকে ন্যায়পরায়ণ শাসকরাও রেহায় পায়নি। ১৮০৫ সালে উসমানী সালার মুহাম্মাদ আলী পাশা থেকে নিয়ে প্রেসিডেন্ট মুরসি পর্যন্ত মোট ১৮ জন শাসক মিসর শাসন করেন। ড. মুরসি ছিলেন ১৮তম প্রেসিডেন্ট। এখানে যেমনি হযরত মূসা (আ)-এর ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে, তেমনি সেই পথ ধরে রয়েছে সত্যপন্থীদের শাহাদাত, ত্যাগ-কোরবানির বিস্তৃত এক ইতিহাস। ১৯২৮ সালে এক সংকটময় মুহূর্তে ইসলামের ঝাণ্ডা হাতে ছুটে আসেন শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সন্তান ইমাম হাসানুল বান্না। মাত্র ৬ জনকে নিয়ে এ সংগঠনের যাত্রা করেন। ৮৫ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের ও রাজপথ থেকে ক্ষমতায় এসে ইতিহাস গড়েছে মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী ইসলামী সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমিন, যা সারা বিশ্বে মুসলিম ব্রাদারহুড নামে পরিচিত। কিন্তু গণতান্ত্রিকভাবে ইসলামী আন্দোলনের এতবড় বিজয়কে পশ্চিমারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। তাই এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার বলেছিলেন- গণতন্ত্র মানে শুধু বেশি ভোটই নয়, সেখানের ক্ষুদ্রদের বাসনার দিকটিও নজরে রাখতে হবে। গণতান্ত্রিকভাবে মুসলমানরা বিজয়ী হলে সেই গণতন্ত্রকেও পশ্চিমা মানতে নারাজ। কিন্তু পশ্চিমাদের ক্রীড়নক হয়ে মিসরের সেনাবাহিনী জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতায় আসার এক বছরের মাথায় ২০১৩ সালে অন্যায়ভাবে ক্ষমতাচ্যুত করে। এই ন্যক্কারজনক কাজের নেতৃত্ব দিয়েছেন তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সেনাপ্রধান এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সিসি সত্যপন্থীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে ফেরাউনী সভ্যতা পুনরুজ্জীবনের জঘন্য অপপ্রয়াসে লিপ্ত। ইসলামের চিহ্ন মুছে ফেলার সকল আয়োজন চলছে সর্বত্র। প্রেসিডেন্ট পদ থেকে চ্যুত করার পর আটক ও প্রহসনমূলক বিচারের মুখোমুখি করা হয় ড. মোহাম্মদ মুরসিসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীকে। প্রহসনের বিচারে মুরসিকে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়। প্রতিবাদ ও সারা বিশ্ববাসীর সমালোচনার মুখে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। কিন্তু জেলখানায় অমানবিকভাবে নির্যাতন চালিয়ে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়। যিনি নিজের জীবন নিয়ে ভাবেননি কোন সময়েই। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি জালিমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার। আল-জাজিরার খবরে বলা হয়, আদালতে শুনানির সময় ফিলিস্তিনের পক্ষে দীর্ঘ বক্তব্য দিচ্ছিলেন মুরসি। প্রায় ২০ মিনিট বক্তব্য দেওয়ার পর এজলাস কক্ষেই হঠাৎ তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এ সময় মুরসিকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মুরসিকে মৃত ঘোষণা করে। যুগ পরম্পরায় চিরচেনা সেই পথ মাড়িয়ে হাফেজ শহীদ ডক্টর মোহাম্মদ মুরসি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে গোটা মুসলিম বিশ্বকে কাঁদিয়ে মা’বুদের দরবারে পাড়ি জমিয়েছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মানুষের জন্মের পর দুনিয়াতে অনিবার্য সত্য হলো মৃত্যু। মুমিনের মৃত্যু হলো মহান মাবুদের সান্নিধ্যে পৌঁছানোর সূচনাপর্ব। আল্লাহর মেহমান হওয়ার উদ্বোধনী আয়োজন। আমাদের বিশ্বাস তিনিও শহীদি মিছিলে শামিল হয়েছেন। আল্লাহর দ্বীনের এই মুজাহিদের বিদায়ে গোটা বিশ্বে মুসলিম মিল্লাতের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, নিন্দায় উত্তাল সারা দুনিয়া। বিশেষভাবে মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার সংগঠন ও সংস্থা এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে এর একটি নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছেন। প্রায় সকলেই এটিকে একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করেছে। এর আগে তার পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর জীবন সংকটাপন্ন বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু জালিম সরকার কোনো কর্ণপাত করেনি। ড. মোহাম্মদ মুরসির পুরো নাম মোহাম্মদ মুরসি ইসা আল-আইয়াত। তিনি ১৯৫১ সালের ২০ আগস্ট মিসরের শারকিয়া প্রদেশের আল-আদওয়াহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন কৃষক ও মা ছিলেন গৃহিণী। স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণ করার পর নিজের প্রখর মেধার জোরে ১৯৭৫ সালে মোহাম্মদ মুরসি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং (প্রকৌশল) বিষয়ে স্নাতক পড়া শুরু করেন। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি এবং ১৯৭৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি। তিনি ছিলেন হাফেজে কুরআন। ছাত্রজীবন থেকে তিনি এতই মেধাবী ও সম্ভাবনাময় ছিলেন যে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ স্কলারশিপ নিয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৮২ সালে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮২-৮৫ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে নাসায় স্পেস শাটল ইঞ্জিন উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। কিন্তু দেশের মানুষের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে ১৯৮৫ সালে নিজ জন্মভূমিতে ফিরে আসেন। মিসর ফিরে শারকিয়া প্রদেশের জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৫-২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মুরসি। ২০১১ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডের আদলে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (এফজেপি) গঠন করে পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মুরসি। ২০১২ সালে মিসরে দুই পর্বে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উভয়পর্বে সর্বমোট ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে মিসরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (এফজেপি) থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাকে জয়ী ঘোষণার পর মুসলিম ব্রাদারহুড ও এফজেপি থেকে ড. মোহাম্মদ মুরসিকে অব্যাহতি দিয়ে মিসরের সর্বস্তরের মানুষের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। শুরু হয় জীবনের অন্য অধ্যায়।

অসাধারণ একজন নেতা মুরসি প্রথমবারের মত প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে পা রাখলেন, সেদিনই তিনি মনস্থির করেন, প্রেসিডেন্টের জন্য নির্ধারিত কোনো প্রাসাদেই তিনি থাকবেন না। এটা একটা অনবদ্য দৃষ্টান্ত। কেননা তার নিজের ও পরিবারের ওপর হুমকি থাকার পরও তা অগ্রাহ্য করেই তিনি অটল থাকার সিদ্ধান্ত নেন। প্রেসিডেন্ট ড. মুরসির বোন একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকেরা তাকে বিমান বা হেলিকপ্টারে বাহিরে নেয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু মুরসি এই সুবিধাটুকু নিতে রাজি হননি। তিনি বলেন, তার বর্তমান পদের সুযোগ নিয়ে তাঁর পরিবারকে সাধারণ কোনো মিসরীয় নাগরিকের চেয়ে তিনি বেশি সুবিধা দিতে পারেন না। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট মুরসির বোন একটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। প্রেসিডেন্ট মুরসি একদিন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলেন একজন বয়স্ক বিধবা কায়রোর সড়কে শুয়ে আছেন। তিনি গাড়ি থেকে নেমে এসে বিধবার পাশে বসলেন এবং প্রশ্ন করলেন, তিনি কেন রাস্তায় থাকেন? মহিলা বললো বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করতে না পারায় বাধ্য হয়ে বাসা ছেড়ে দিয়ে এখন রাস্তায় এসে আবাসন গড়েছেন। মুরসি জানান, তার নেতৃত্বাধীন মিসরে এভাবে কোনো মহিলা থাকতে পারেন না। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সেই মহিলার জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। সেই সাথে সরকারের তরফ থেকে মহিলার জন্য একটি ভাতা সরবরাহ করার নির্দেশ দেন যাতে তিনি বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে পারেন। এভাবে সেই মহিলা তখন বাসা বাড়ি পেয়ে গেলেও সিসির অন্যায্য সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে তিনি আবারও গৃহহীন হয়ে পড়েন। ড. মুরসি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর যখন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে পত্র দিয়েছিলেন, মুরসি তার উত্তরে লিখেছিলেন, “আমি আপনাকে সিরিয়ার জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধি বলে মনে করি না।” তিনি হাজার হাজার মানুষের খুনি বাশারের প্রতি বিনয়ী হতে রাজি ছিলেন না। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তো বটেই, প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও মুরসি কখনোই জামায়াতে নামাজে অনুপস্থিত থাকতেন না। এ ছাড়া তিনি প্রায় শুক্রবারে জুমার নামাজে খুতবা প্রদান করতেন। ড. মুরসি পূর্বসূরি শাসকদের পরিবর্তে সরকারি অফিসগুলোতে আল্লাহ তায়ালার নামের সুন্দর সুন্দর ক্যালিওগ্রাফি লাগানোর ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন।

আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ড. মুরসি কূটনীতি ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষ ভূমিকা রাখেন। এই অল্প সময়ে তিনি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেন। নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ান। দখলদার ইসরাইল অবররুদ্ধ গাজাবাসীর জন্য মিসরের সীমান্ত খুলে দিয়ে জেরুজালেম ও আল আকসা মসজিদের ওপর ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণের পক্ষে অবস্থান নেন তিনি। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ভালো চোখে দেখেনি। বৈশ্বিক রাজনীতির এক সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আটকে পড়েন মুরসি। এরদিকে মিসরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে ইসরাইলের জোরালো ভূমিকার কথা জানিয়ে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আরয়িহ ইলদাদ স্থানীয় এক পত্রিকা ‘ম্যারিভ’-এ প্রকাশিত নিবন্ধে এই তথ্য প্রকাশ করেন। ‘দ্য আউটব্রেক অব দ্য জানুয়ারি রেভ্যুলেশন’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধে তিনি বলেন, মিসরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ইসরাইল মুসলিম ব্রাদারহুডের মানুষ হিসেবেই মূল্যায়ন করত। কারণ, তিনি ইসরাইলের সাথে সম্পাদিত শান্তিচুক্তি বাতিল এবং সিনাই উপত্যকায় সেনা উপস্থিতি বাড়িয়েছিলেন, যা ইসরাইলকে ভীত করে তোলে। ফলে ইসরাইল দ্রুত ও সক্রিয়ভাবে কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং আবদুল ফাত্তাহ সিসিকে ক্ষমতায় আনার ব্যবস্থা নেয়। এই ক্ষেত্রে ওবামার মার্কিন সরকার কোনো আপত্তি করেনি। পাকিস্তানি বিখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী ড. আবদুল কাদির খান বলেন, তার মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ছাড়াও অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দারা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ক্ষমতায় আসার পর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি রাশিয়া, ভারত ও পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলেন। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ মিসরীয় পরমাণু চুল্লি ফের চালু করতে রাশিয়ার সঙ্গে একমত হয়েছিলেন তিনি, যেটা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। ‘মিসরীয়রা কি জানেন, তাদের সাবেক প্রেসিডেন্টের এই সফর পশ্চিমাদের জন্য বড় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল?’ প্রেসিডেন্ট মুরসির শাসনকালে জার্মানির কাছ থেকে দুটি ডুবোজাহাজ পেয়েছিল মিসর। কিন্তু এ ধরনের ডুবোজাহাজ প্রতিবেশী দেশে হস্তান্তরে জার্মানিকে নিবৃত্ত করতে চেয়েছিল ইসরাইল। কারণ মিসরের কাছে সঠিক ক্ষেপণাস্ত্র থাকলে এই ডুবোজাহাজ দিয়ে রণতরীতে আঘাত হানা সম্ভব।’ ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্বীকার করেছেন, তিনি জার্মানি ও মিসরের মধ্যে এই ক্রয়চুক্তিকে অনুমোদন দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন তিনি সেটা করেছেন, তা গোপন রাখলেন। তার দাবি, এটা রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা। তিনি মনে করেন যদি ২০১৩ সালের অভ্যুত্থান না ঘটতো তাহলে ইতোমধ্যে এমন একটি উপগ্রহের মালিক হয়ে যেতেন মিসরীয়রা।

প্রহসনের বিচার ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ড. মুরসির মৃত্যুতে চরম অবহেলার অভিযোগ করেছে ব্রিটিশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিটেনশন রিভিউ প্যানেল। তারা বলছেন, সাবেক এ প্রেসিডেন্টকে কারাবন্দী রাখার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। ইসলাম, ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং মুসলমানদের জন্য ড. মুরসি বিশ্বব্যাপী যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। জেলখানায় তাকে প্রতিদিন ২২-২৩ ঘণ্টাই নির্জন কক্ষে বন্দী করে রাখা হতো। তাকে যে খাবার দেয়া হতো, তার বেশির ভাগ থাকত পচা আর বাসি খাবার। খালি মেঝেতে মাদুর বা বিছানা ছাড়াই ঘুমাতে দেয়া হতো। গত কয়েক বছরে ড. মুরসিকে অল্প কয়েকবার তার পরিজনের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, রাষ্ট্রপ্রধান ও নেতারা শোক প্রকাশ করেছেন। সাবেক এ প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শোক প্রকাশ করতে দেখা গেছে অসংখ্য সাধারণ মানুষ। মুরসির মৃত্যুর বিষয়ে নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক তদন্ত করতে জাতিসংঘের কাছে দাবি জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান। কাতারের আমির, তিউনিসিয়ার এনাহাদা আন্দোলন, জর্ডান ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস মুরসির মৃত্যুতে ফিলিস্তিনি জনগণের নিকটতম বন্ধু হারানোর সঙ্গে তুলনা করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশ, সংগঠন, সংস্থা, বিশিষ্ট ব্যক্তি এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের নিন্দা প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

শেষ বিদায় মিসরের ইতিহাসের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে মঙ্গলবার ভোরে কঠোর গোপনীয়তায় রাজধানী কায়রোতে দাফন করা হয়েছে। এর আগে পরিবারের পক্ষ থেকে শারকিয়া প্রদেশের নিজ শহরে তার দাফনের আবেদন জানালে তা দেয়নি সরকার। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান ও মুসলিম ব্রাদারহুড তাকে শহীদ আখ্যা দিয়ে তার রুহের মাগফিরাত কামনা করেছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট, কাতারের আমির এবং হামাস প্রধানের পাশাপাশি শোক জানিয়েছেন জর্ডানের সাবেক রাজা নূর আল হুসাইন। মুসলিম বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতার শাহাদাতের পর তাঁর সম্মানিতা স্ত্রীর বক্তব্য এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুহাম্মদ মুরসি (রহ) আল্লাহর নির্দেশে তাঁর জিম্মায় চলে গেছেন! তিনি এমন অবস্থায় আল্লাহর নিকট চলে গেলেন, যখন তিনি ছিলেন আল্লাহর দ্বীনের একজন সাহায্যকারী, শাহাদাতপ্রত্যাশী এবং জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার এক প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব। তিনি এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেন, যখন তিনি ছিলেন তাঁর জাতির জন্য একজন সাহায্যকারী। অথচ তাঁর জাতির অনেকেই তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তিনি এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেন, যখন তিনি ছিলেন একজন সত্যের পতাকাবাহী, সত্যের ব্যাপারে অগ্রগামী কিন্তু কখনোই পশ্চাদগামী ছিলেন না। তিনি এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেন, যখন তিনি কোন ধরনের অসত্যের পদলেহন না করে ক্লান্তিহীন নিরলসভাবে ছয়টি বছর সত্যের ঝান্ডা উড্ডীন করে রেখেছিলেন। তিনি এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেন, যখন তিনি ছিলেন একজন মহান মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তিত্ব। আল্লাহ তাঁকে ভালোবেসে যুগের এই নিফাকি খিয়ানত এবং হীনতা থেকে মুক্ত করে তাঁর কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন। আল্লাহ তাঁকে এমনভাবে উঠিয়ে নিয়েছেন, যেন তিনি আমাদের নবী সাইয়্যেদিনা ইয়াহইয়া ও ঈসা (আ) এর দৃষ্টান্তের ন্যায় এ যুগের দৃষ্টান্ত হতে পারেন। যেমন দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন আসহাবুল উখদুদ ও হাবিবে নাজ্জার। দাওয়াতি কর্ম ও আমানতের দায়িত্ব পালনের পর আল্লাহ তায়ালা তাঁকে তাঁর সর্বোত্তম সাথীর (আল্লাহর) নিকট সুমহান জান্নাতুল ফিরদাউসে উঠিয়ে নিয়েছেন। হে বিশ্বাসঘাতকের সহচররা, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো! অচিরেই তোমাদেরকে এমন এক বিভীষিকা গ্রাস করবে যা থেকে তোমরা মুক্ত হতে পারবে না। অচিরেই আপতিত হবে তোমাদের উপর ভয়ঙ্কর এক আজাব। তোমরা আরও সুসংবাদ গ্রহণ করো যে, কিয়ামত পর্যন্ত যত প্রজন্ম পৃথিবীতে আসবে তাদের মধ্যে যারা শিক্ষা গ্রহণ করতে চায় এমন প্রত্যেকের জন্য তোমরা এক শিক্ষা (নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত) হয়ে থাকবে। হে শহীদ! আপনি আজ জান্নাত পানে.. (আপনার রবের সাথে) কত উত্তম ব্যবসা-ই না আপনি করেছেন, হে শহীদ...! রাসূল (সা) বলেন, আল্লাহ তা’আলা জালিমকে দীর্ঘ সময় দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেন না। অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করেন, “তোমার প্রভুর পাকড়াও এ রকমই হয়ে থাকে, যখন তিনি জুলুমরত জনপদগুলোকে পাকড়াও করেন। তাঁর পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, অপ্রতিরোধ্য।” (বুখারি ও মুসলিম) জালিমদের শেষ পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহর নিদর্শন পর্যায়ক্রমে এসেছে এবং অত্যাচারীদের ওপর তাঁর শাস্তি বিরতিহীনরূপে এসে পড়েছে। প্রত্যেক শুরুরই শেষ আছে এবং প্রত্যেক শাসনকালের একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে। মহান আল্লাহ জালিমদের শেষ পরিণতির জন্য কারণ তৈরি করেছেন এবং তাদের জুলুমের বিনিময়ে মর্মন্তুদ শাস্তির বিধানও রেখেছেন। আর তাঁর ফয়সালা আসতে খুব বেশি দিন বাকি নেই ইনশাআল্লাহ। তা ছাড়া শাহাদাতের রক্ত জমিনকে করে উর্বর। আন্দোলনকে এগিয়ে দেয় অনেক দূর। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে সে ঐসব লোকদের সঙ্গী হবে যাদের নিয়ামত দান করা হয়েছে, তারা হলো- নবী, সিদ্দিক, শহীদ এবং সালেহ, আর তাদের সান্নিধ্যই হলো উত্তম।” আল্লাহর পথে লড়াই করা কর্তব্য সেই সব লোকেরই যারা পরকালের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন বিক্রয় করে দেয়, আল্লাহর পথে যে লড়াই করে ও নিহত হয়, কিংবা বিজয়ী হয়, তাকে আল্লাহ অবশ্যই বিরাট সফলতা দান করেন। ইহলৌকিক জীবন থেকে শহীদরা বিদায় নিয়েও পৃথিবীতে তারা অমরত্ব লাভ করে। আর পরজগতে যাওয়ার সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা তাদের জীবিত করে নিজের মেহমান হিসেবে জান্নাতে থাকতে দেন। আল্লাহ বলেন, “আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের মৃত বলো না, প্রকৃতপক্ষে তারা জীবন্ত, কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমরা অনুভব করতে পারো না।” (সূরা আল-বাকারা : ১৫৪) সা’আদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা) বলেন, আমি রাসূল (সা)-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! মানুষের মধ্যে সর্বাধিক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে কারা? জবাবে তিনি বলেন- ‘নবীগণ অতঃপর তাদের অনুরূপগণ। অতঃপর তাদের অনুরূপগণ (অর্থাৎ সম্মানিতগণ, অতঃপর সম্মানিতগণ এবং পর্যায়ক্রমে উচ্চপদ মর্যাদায় অধিষ্ঠিতগণ), বান্দা তার দ্বীনের পরিধি অনুযায়ী পরীক্ষিত হবেন। অতএব যদি তার দ্বীনের ব্যাপারে কঠিন মজবুত হয় তাহলে তার পরীক্ষাও কঠিন হবে, আর যদি সে দ্বীনের ব্যাপারে নরম হয় তাহলে তার দ্বীনের পরিধি অনুযায়ী তাকে পরীক্ষা করা হবে, এভাবে বান্দার নিকট বালা-মুসিবত আসতেই থাকবে (এবং ক্ষমাও হতে থাকবে) যেন সে পাপমুক্ত হয়ে পৃথিবীতে চলতে থাকে। শায়েখ সা’আদী (রহ) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই স্বীয় বান্দাদের বিপদাপদ দিয়ে পরীক্ষা করবেন এ জন্য যে, যেন সত্যবাদী, মিথ্যাবাদী এবং ধৈর্যশীল ও ধৈর্যহারা ব্যক্তির মধ্যে সুস্পষ্ট প্রমাণ পরিলক্ষিত হয়।’ (ইমাম তিরমিযী ও ইমাম ইবনু মাজাহ) সুতরাং মুমিনের জন্য পরকালীন জীবনে মাবুদের পক্ষ থেকে রয়েছে মহাপুরস্কার। সাইয়্যেদ হাসান আল বান্না, শহীদ সাইয়্যেদ কুতুব, শহীদ মাওলানা নিজামী, অধ্যাপক গোলাম আযম, আলী আহসান মোজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী, আব্দুল কাদের মোল্লারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে জন্মালেও তাঁদের পরিণতি যেন একই। তাঁরা মহান পরওয়ারদেগারের দেয়া জীবনব্যবস্থা আল ইসলামকে জীবনাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে মাবুদের সন্তুষ্টিকে একমাত্র লক্ষ্য বানিয়েছেন। তাই তারা প্রত্যেকেই ছুটেছেন সেই চিরচেনা মঞ্জিলের দিকে দুর্বার গতিতে...। আল্লাহর দ্বীনের মুজাহিদদের এই ত্যাগ-কোরবানি বিজয়ের সূচনা করবে, ইনশাআল্লাহ লেখক : সহকারী সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির