post

হৃদয়পটে মুদ্রিত স্মৃতি

মুহাম্মদ এনামুল হক

৩০ মার্চ ২০১৮
প্রিয় জন্মভূমির ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয়। তুমি কাঁদলে আমি কিন্তু আর বাড়িতে আসব না, মা তুমি কেঁদো না। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু সে ভালোবাসা আল্লাহ্, তাঁর রাসূল ও ইসলামের প্রতি ভালোবাসার চেয়ে বেশি নয়। এই কথাগুলো মহান আল্লাহ্র একান্ত প্রিয় বান্দাহ্ আমাদের সকলের প্রিয় হাফেজ জাকির হোসেন ভাইয়ের। প্রিয় দ্বীনিভাইটির সাথে অনেক স্মৃতি আমার হৃদয়পটে মুদ্রিত হয়ে আছে। ২০০৬ সালের মার্চ মাসের দিকে প্রিয় জাকির ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। জাকির ভাই এবং আমি একই মাদ্রাসায় পড়তাম। যার সূত্র ধরে মাঝে মধ্যেই আমাদের কথা হতো। সে সময় তার কাছ থেকে সংগঠন ও ইসলাম সম্পর্কে উৎসাহ-উদ্দীপনামূলক অনেক কথা শুনতাম। সে কথাগুলো মনে পড়লে আজো আমার অশ্রু সংবরণ করতে অনেক বেশি কষ্ট হয়। ২০১০ সালে যখন জাকির ভাই ঢাকায় আসেন, তখন আমরা এক সাথেই থাকতাম। তাঁর সাংগঠনিক জীবন শুরু হয় নিজ এলাকাতে। ঢাকায় আসার পরই দায়িত্বশীল ভাইদের সাথে যোগাযোগ করে ইসলামী আন্দোলনের কাজ শুরু করেন। জাকির ভাইয়ের মিষ্টভাষী, পরিশ্রমপ্রিয়তা, জ্ঞানার্জনের তীব্র বাসনা, সাহসিকতা, মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমে খুব সহজে কাছে টেনে নেয়ার গুণাবলি দেখে আমি ও আমার সহপাঠীরা খুবই মুগ্ধ হতাম। ২০১২ সালে আমি যখন কারাগারে ছিলাম সর্বশেষ কোর্টে তার সাথে আমার দেখা হয়। সেদিন হাসিমাখা মুখে একটি লাল কম্বল আমার কাঁধে দিয়ে বলেছিলেন, এনাম ভাই চিন্তা করবেন না, ময়দানের কাজ আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালোভাবে চলছে আর আপনার মায়ের সাথে আমার কথা হয়, আপনার বাড়ির সকলে ভালো আছেন। সেই দিনের কথাগুলো মনে হলে আমি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারি না। ২০১৩ সালে আমাদের তৎকালীন থানা সভাপতি, কয়েকজন ওয়ার্ড সভাপতি, আমি এবং আমরা অনেকেই যখন জেলখানাতে, জাকির ভাই তখন ভারপ্রাপ্ত থানা সভাপতি হিসেবে সকলকে নিয়ে যেমনভাবে ময়দানের কাজ হিকমতের সাথে আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছিলেন, তেমনিভাবে জেলে থাকা প্রত্যেকটি ভাই ও তাদের পরিবারের সাথে আন্তরিকভাবে যোগাযোগ করতেন। পরবর্তীতে এই সকল পরিবারগুলোর সাথে যতবারই কথা হয়েছে ততোবারই আমি অবাক হতাম, জাকির ভাইয়ের জন্য তাদের কান্না দেখে। ২০১৩ সালের ৩রা এপ্রিল শ্যামলীর লিং রোডের ১৯/৬, টিক্কাপাড়া, মোহাম্মদপুরের একটি বাসা থেকে রাত আনুমানিক ৪ ঘটিকার সময় সাদা পোশাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও র‌্যাব-২ এর কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে তাকে তুলে নিয়ে যায়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বন্দীকে আদালতে হাজির করার নিয়ম রয়েছে বাংলাদেশ সংবিধানে। অথচ ২৪ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও তাকে আদালতে হাজির করা হয়নি। পরিবারের পক্ষ থেকে একাধিকবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করা হয় এবং তার সন্ধানের দাবিতে ঘটনার ৯ দিন পর একটি সাংবাদিক সম্মেলন করা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত সরকার তার কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। দিন পেরিয়ে মাস, মাস পেরিয়ে বছর এভাবে দীর্ঘ পাঁচটি বছর কেটে গেল কিন্তু আমাদের এই প্রিয় ভাইটি কোথায় আছে, কোন অবস্থায় আছে কিংবা আদৌ বেঁচে আছে কিনা আমরা কেউ তা জানি না। আজও থামেনি প্রিয় ভাইটির জনম দুঃখিনী মায়ের সীমাহীন কান্না। যখন আমরা মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াই, তখন আমরা আমাদের ভাষা হারিয়ে ফেলি। মাকে আর কত দিন কাঁদতে হবে আমরা কেউ তা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। তার কোনো প্রশ্নের উত্তরও আমাদের কাছে জানা নেই। জাকির ভাই এতই পরিশ্রমী ছিলেন যে, যা দেখে আমি বারবার মুগ্ধ হতাম। থানা অফিসে থাকার কারণে দায়িত্বশীল ভাইয়েরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজে পাঠাতেন। এমনকি তিনি পড়ছেন এমন সময়েও কোনো প্রয়োজনীয় কাজে পাঠালে কোনো প্রশ্ন না করে চলে যেতেন এবং দ্রুত কাজ শেষ করে ফিরে এসে আবার পড়তে বসতেন। ইসলামী আন্দোলনের কাজে জাকির ভাই সব সময় প্রতিযোগিতা করতেন। তিনি যখন ওয়ার্ড সভাপতি আমিও তখন ওয়ার্ড সভাপতি ছিলাম। অন্য ওয়ার্ড সভাপতি ভাইদের সাথে যখন কথা বলতেন, তখন তিনি অন্য ওয়ার্ডের কাজের খোঁজ-খবর নিতেন। উদ্দেশ্য হলো মানোন্নয়নসহ সকল কাজের ক্ষেত্রে অন্যান্য ওয়ার্ডের সাথে নিজের ওয়ার্ডের কাজ মিলিয়ে নেয়া। প্রিয় জাকির ভাইয়ের বাবার কথাগুলো আমাকে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করে। তিনি আমাকে বলতেন : বাবা এনাম “জাকিরের জন্য আমার কোনো দুঃখ নেই বরং আমি গর্বিত। কারণ আমি তো আমার জাকিরকে আরো অনেক আগেই আল্লাহর পথে দিয়ে দিয়েছি। আল্লাহ তাকে দুনিয়ায় রাখবেন নাকি দুনিয়া থেকে নিয়ে যাবেন এটা তাঁর ইচ্ছা। আর যদি শাহাদাতের মৃত্যুর মাধ্যমে নিয়ে যান, সেটা তো অনেক সৌভাগ্যের কথা। শহীদ ভাইদের ত্যাগ-কোরবানি কোন দিনও বৃথা যাবে না ইনশাআল্লাহ্। তাদের রক্ত কথা বলবেই এই জমিনে। শত নির্যাতন, গ্রেফতার, গুম, খুন, হামলা-মামলা, গুলি আর লগি-বৈঠার জবাবে গর্জে উঠে প্রতিবাদ করবেই তাদের রক্ত। বাতিলরা জানে না সমস্ত বিজয় ও সফলতা রয়েছে শাহাদাতের মধ্যে। সভ্যতার প্রতিটি ইটের সাথে রয়েছে শহীদের রক্তের দাগ। কুরআনে বর্ণিত আছে: “মৃত্যুর সিদ্ধান্ত যখন আসবে, মৃত্যু কেবল তখনি আসবে, যা এক মুহূর্ত আগেও আসবে না, পরেও আসবে না।” তাই আমাদের হৃদয় থেকে মরণের মিথ্যা ভয় মূলশুদ্ধ টেনে তুলে ফেলে দিতে হবে। হে আরশের মালিক! তোমার কাছে দোয়া কামনা করি, তুমি আমাদের প্রিয় জাকির ভাইকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দাও; আর যদি শহীদ হয়ে থাকেন তাহলে তাকে জান্নাত নসিব কর। আর প্রিয় ভাইটির বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজনসহ সবাইকে ধৈর্য ধরার তৌফিক দান কর। আমিন।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির