post

১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

শাহ মোহাম্মদ মাহফুজুল হক

২৭ নভেম্বর ২০১৬
জাতিসংঘ সনদে বর্ণিত বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র অনুমোদন করে। তাই বিশ্বব্যাপী ১০ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালন করা হয়। জাতিসংঘ, সরকার ও বিভিন্ন এনজিওর উদ্যোগে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে সারা বিশ্বে এই দিবসটি পালিত হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস নিয়ে আলোচনার আগে মানবাধিকার সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিষ্কার করা আবশ্যক। মানবাধিকার বিষয়টি বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয়। মানবাধিকারের আক্ষরিক অর্থ হলো মানুষের অধিকার। সাধারণত মানবাধিকার বলতে মানুষের সে সকল অধিকার বোঝায় যা নিয়ে সে জন্মগ্রহণ করে, যা তাকে বিশিষ্টতা দান করে এবং যা হরণ করলে সে আর মানুষ থাকে না। অর্থাৎ মানুষকে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য যে সকল অধিকার দরকার তাই মানবাধিকার। মানবাধিকার সে সকল অধিকারকে নির্দেশ করে যা স্বাভাবিক ও সহজাত। মানবাধিকার মানুষের বেঁচে থাকার জন্য এবং সামাজিক জীব হিসেবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য। মূলত মানবাধিকার হলো ক্ষুধা ও ভয় থেকে মুক্তি এবং স্বাধীনতা। মানবাধিকার একটি সহজাত বিষয় যা মানুষ জন্ম নেয়ার সূত্রেই দাবি করতে পারে। মানবাধিকার প্রত্যেক ব্যক্তির মর্যাদাকে সম্মান প্রদর্শনেই নিহিত। মানবাধিকার ব্যক্তিকে স্বাধীনতা, সমতা এবং মর্যাদা দিয়ে থাকে। মানবাধিকারের মৌলিক বৈশিষ্ট্য বা মূলনীতি ১.    সার্বজনীনতা : মানবাধিকার সারা পৃথিবীতে সকল মানুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে সকল মানুষ এই অধিকারগুলো সমানভাবে ভোগ করতে পারবে। ২.    অবিচ্ছেদ্য নিরবচ্ছিন্নতা : যথাযথ বা ন্যায়সঙ্গত কোনো কারণ ব্যতিরেকে কোন দেশ বা রাষ্ট্র মানবাধিকারসমূহ বা কোন একটি মানবাধিকারও কখনও কেড়ে নিতে পারবে না। ৩.    পারস্পরিক নির্ভরশীলতা : মানবাধিকারসমূহ একটি অপরটির সাথে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত ও নির্ভরশীল। একটিকে অপরটি থেকে পৃথক করা যায় না। যেমনÑ সার্বজনীন চিকিৎসা বা শিক্ষার অধিকারটি কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ওপর নির্ভর করে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা মুক্তি এবং সচেতনতা ছাড়া চিকিৎসার অধিকার পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ৪.    সমতা ও বৈষম্যহীনতা : মানবাধিকারগুলো জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, রাজা, প্রজা ভেদে কোনো পার্থক্য করা যাবে না। সকল মানুষ সমানভাবে এই অধিকারগুলো ভোগ করবে। ৫.    আইনের শাসন ও কর্তব্যপরায়ণতা : ব্যক্তির ক্ষেত্রে মানবাধিকারগুলো ভোগ করতে হলে অবশ্যই কর্তব্য পালন করতে হবে। নিজের অধিকার পেতে হলে অবশ্যই অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আবার রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে অবশ্যই জনগণের এই অধিকারগুলো নিশ্চিত করার পজিটিভ Policy  গ্রহণ করতে হবে এবং কোন কারণে এই অধিকার লঙ্ঘন করলে জবাবদিহি করতে হবে। মানবাধিকারগুলোকে ৫ ভাগে ভাগ করা যায়: ১.    রাজনৈতিক অধিকার: ভোটাধিকার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার। ২.    নাগরিক অধিকার : জীবন ও স্বাধীনতার অধিকার। মতামত এবং অভিব্যক্তি প্রকাশের অধিকার। ৩.    অর্থনৈতিক অধিকার: ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ কাজের পরিবেশের অধিকার। ৪.    সামাজিক অধিকার: বাসস্থান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার অধিকার। ৫.    সাংস্কৃতিক অধিকার: প্রত্যেকের নিজ নিজ প্রথা এবং সাংস্কৃতিক চর্চার অধিকার। মৌলিক মানবাধিকারসমূহ: জাতিসংঘ ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী প্রধান প্রধান মানবাধিকারসমূহ নিম্নরূপ: #    সমতা এবং বৈষম্যহীনতার অধিকার। #    জীবন ধারণ এবং স্বাধীনতা লাভের অধিকার। #    খাদ্যের অধিকার। #    চিকিৎসার অধিকার। #    শিক্ষার অধিকার। #    রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের অধিকার। #    মতপ্রকাশ ও বাকস্বাধীনতার অধিকার। #    সমিতি বা সংগঠন করার অধিকার। #    শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অধিকার। #    ভোটাধিকার। #    ধর্ম পালন ও প্রচারের অধিকার। #    নিজ সংস্কৃতি চর্চার অধিকার। #    তথ্য পাওয়ার অধিকার। #    সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করার অধিকার। #    নির্যাতন ও বন্দিদশা থেকে মুক্তির অধিকার। #    আইনের দৃষ্টিতে সমতা ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার। #    স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকার। #    গোপনীয়তার অধিকার। #    জাতীয়তার অধিকার। #    বিয়ে ও পরিবার গঠনের অধিকার। #    কর্মসংস্থান লাভের অধিকার। #    সামাজিক নিরাপত্তা লাভের অধিকার। মানবাধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা: সমতা ও বৈষম্যহীনতার ভিত্তিতে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকারগুলোকে শ্রদ্ধা করা, রক্ষা করা এবং পরিপূর্ণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের। ১.    শ্রদ্ধা করার বাধ্যবাধকতা (Obligation to Respect):বলতে বুঝায় ব্যক্তির প্রাপ্য অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এমন কিছু করবে না যাতে কোন নাগরিকের অধিকার ক্ষুণœ হয়। ২.    রক্ষা করার বাধ্যবাধকতা (Obligation to protect): যদি তৃতীয় কোন পক্ষ কোন নাগরিকের অধিকার ভোগে বাধা প্রদান করে, রাষ্ট্র সেই বাধা থেকে নাগরিকের অধিকারকে সুরক্ষা করবে। ৩.    পরিপূর্ণ করার বাধ্যবাধকতা (Obligation to fulfill) রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিকের অধিকারগুলোকে তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে এগুলোকে সহজলভ্য ও উন্নতর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে। এক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি বা সামাজিক উদ্যোগকে সহযোগিতা প্রদান করতে রাষ্ট্র বাধ্য থাকবে। ৪.    পদক্ষেপ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা (Obligation to take step):  নাগরিকের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের প্রতি সম্মান রেখে যথাযথ পন্থায় ধারাবাহিকভাবে অর্জনের জন্য সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে রাষ্ট্রের। জাতিসংঘ সনদ: ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর ৫১টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ যার বর্তমান সদস্যসংখ্যা ১৯২। প্রতিষ্ঠার সময়ই গঠিত হয় জাতিসংঘের সংবিধান যা UN Charter  বা জাতিসংঘ সনদ হিসেবে পরিচিত। এই সনদের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এতে মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বাস্তবায়ন ও উন্নয়নের জন্য সংযোজিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশেষভাবে এই সনদের মুখবন্ধ, অনুচ্ছেদ ১(৩), ১০, ১৩ প্যারা ১(৯), ৫৫, ৬২, ৬৮ ও ৭৬ নং ধারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাছাড়া জাতিসংঘের অধীনস্থ মানবাধিকার কাউন্সিল সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। UN Declaration of Human Rights  (বিশ্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা): জাতিসংঘ সনদে বর্ণিত বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা অনুমোদন করে। এই মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে ৩০টি অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয় এবং এ সকল অধিকার বাস্তবায়নে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণের ঘোষণা দেয়া হয়। এজন্য UDHR-কে মানবাধিকারের পরশ পাথর বা মানদন্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় ৩০টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এর মধ্যে ১ ও ২নং ধারায় মানবাধিকারের মূলনীতি বর্ণনা করা হয়েছে। ৩-২১ নং ধারায় নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার এবং ২২-২৭ নং ধারায় অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। ২৮-৩০ নং ধারায় এই সনদের প্রায়োগিক দিক উল্লেখ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস ও সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার প্রেক্ষাপট: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৫ কোটি মানুয়ের নির্মম মৃত্যু সকলের মনে একটা দাগ কাটে। এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৪১ সালের ১৪ আগস্ট আটলান্টিক সনদে স্বাক্ষরদানের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ও যুক্তরাজ্যের উইনস্টন চার্চিল ঘোষণা দেন যে তার নাৎসি বাহিনী বা অক্ষ বাহিনীর নির্যাতনের অবসানের পর এমন এক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবেন যেখানে সকল দেশের সকল মানুষের ভয় ও অভাব থেকে মুক্ত হযে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারবে। অবশ্যই এর কিছু দিন আগে রুজভেল্ট তার চতুর্বিধ স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করেন। যার মধ্যে ছিল: ১.     বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা। ২.     স্বীয়পণে ঈশ্বরের উপাসনার স্বাধীনতা। ৩.     অভাব থেকে মুক্তি। ৪.     সকল প্রকার ভয় থেকে মুক্তি। ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের দিকে একে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন দেশে সভা সম্মেলন করে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার পক্ষে জনমত গঠন করতে থাকেন। এর মধ্যে ক্যাসাব্লাংকা, কুইবেক, মস্কো, কায়রো, তেহরান ও ইয়ালটার উল্লেখযোগ্য। আমেরিকার ডাম্বারটনওকস এর এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় সংগঠনটির নাম হবে সম্মিলিত জাতিসংঘ। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ২৬ জুন সানফ্রান্সিকোতে ২৫টি দেশের প্রতিনিধি মিলে রচনা করেন জাতিসংঘ সনদ, যা ২৪ অক্টোবর থেকে কার্যকর করা হয়। অবশ্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের এই কমিটমেন্ট এবং বিভিন্ন শান্তিকামী সঙ্ঘের প্রভাব লক্ষ করা যায় জাতিসংঘ সনদের চূড়ান্ত খসড়ায়। এই খসড়ার ৮৫টি অনুচ্ছেদের মধ্যে ৭টি অনুচ্ছেদে বিশ^ব্যাপী মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হয় এবং সুপ্রশস্ত হয় মানবাধিকার কাউন্সিল গঠনের পথ। জাতিসংঘ সনদের ৬৮ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বিভিন্ন কমিশন গঠন করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে ১৯৪৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ মানবাধিকার কমিশন গঠন করে। একই বছর কমিশনের প্রথম অধিবেশনে এই কমিশনকে একটি International Bill of Rightsতৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম অধিবেশনে কমিশনে এই বিল তৈরির জন্য মিসেস এলিনর রুজভেল্টের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। উক্ত কমিটি মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রস্তুত করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের মাধ্যমে সাধারণ পরিষদে পেশ করে। ১৯৪৮ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত সাধারণ পরিষদের তৃতীয় অধিবেশনে খসড়া ঘোষণাপত্রটি আলোচ্যসূচির শুরুতে রাখা হয়। এই সময় সনদের প্রতিটি শব্দ ও বাক্যাংশের ওপর ১৪০০ বার ভোট নেওয়া হয়। একই বছর (১৯৪৮) ১০ ডিসেম্বর প্যারিসের ফারি নগরীতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ঘোষণাটি গৃহীত হয়। এই অধিবেশনে জাতিসংঘের ৫৮টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ৪৮ জন পক্ষে ভোট দেন আর সোভিয়েত ব্লকের ৬টি রাষ্ট্রসহ ৮টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি ভোটদানে বিরত থাকেন। কেউ ঘোষণাটির বিপক্ষে ভোট দেননি। এই ঘোষণাপত্রে ৩০টি ধারা রয়েছে যা মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের আলোকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই ঘোষণাপত্র প্রণয়নের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন ফ্রান্সের রনে ক্যাসা যিনি একে জাতিসংঘ সনদের এক কর্তৃত্বব্যঞ্জক ব্যাখ্যা বলে ঘোষণা করেন। এই ঘোষণাটি কার্যকর করার জন্য জাতিসংঘ অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার ফলশ্রুতিতে জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্য রাষ্ট্র নিজ দেশের সংবিধানে এই ঘোষণাগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। গঠিত হয়েছে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকা আঞ্চলিক মানবাধিকার কনভেনশন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চুক্তি ঘোষণার মাধ্যমে মানবাধিকার সারা পৃথিবীতে আজ শুধু একটি ঘোষণাই নয় বরং আইনে পরিণত হয়েছে। মূল্যায়ন : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি ১০ ডিসেম্বর ১৯৪৮ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সর্বসম্মত অনুমোদনের মাধ্যমে গৃহীত সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ বিশ্ববাসীর মনে এক বিরাট আশার সঞ্চার করেছিল। যদিও মানবাধিকার সনদ মূলত একটি অঙ্গীকারনামা, এর ধারাসমূহ পালনে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রণীত মানবাধিকার ৯টি মৌলিক দলিল, সনদ ও বিভিন্ন চুক্তি প্রণয়ন ও সদস্য রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক অনুমোদনের মাধ্যমে তা আইনে পরিণত হয়েছে যা পালনে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পাশাপাশি এর ব্যাপক প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বঞ্চিত, নির্যাতিত এবং যুদ্ধবিগ্রহের জাঁতাকলে পিষ্ট মানুষ মুক্তির আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৬৮তম বছরে এসে আজকে এই কথাটি সবাইকে একবাক্যে স্বীকার করতে হবে, যে মানবাধিকার ঘোষণাপত্রটি যে উদ্দেশ্য নিয়ে গৃহীত হয়েছিল এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তা অর্জনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ না হলেও অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছে। এই কথা ঠিক জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা ও তার মানবাধিকার সার্বজনীন ঘোষণাপত্র অনুমোদনের পর প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের ন্যায় কোনো ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ হয়নি। কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধ, কোরিয়ান গৃহযুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধ, আবর-ইসরাইল যুদ্ধ, ইরাক-ইরান যুদ্ধ, বলকান যুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, যৌথবাহিনীর নামে আফগানিস্তান, ইরাকে হামলায় লক্ষ-কোটি মানুষের মৃত্যু মানবাধিকার ঘোষণাপত্র ও জাতিসংঘের কার্যকারিতাকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে চলমান ফিলিস্তিন ও কাশ্মির সমস্যা, সাম্প্রতিক সময়ের ভয়াবহ সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া সঙ্কট এবং মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সন্ত্রাসী কর্তৃক সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত গণহত্যা বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষকে আশাহত করেছে। এ ছাড়া বছরের পর বছর ধরে মানবাধিকার পালন, বিশ্বব্যাপী শত সহস্র মানবাধিকার সংগঠন ও মানবাধিকারকর্মীদের ব্যাপক তৎপরতার পরও ক্রমবর্ধমান ধনী-গরিবের বৈষম্য, নারী-শিশু নির্যাতন, উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর মানবেতর জীবন মানবাধিকার দিবসের উজ্জ্বলতাকে অনেকটাই ম্লান করে দেয়। বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্রসহ প্রায় সকল মানবাধিকার দলিলে (গুমবিরোধী চুক্তি ছাড়া) অনুস্বাক্ষরকারী দেশ। বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ে মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের প্রায় সকল বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে তৃতীয় অধ্যায়ের ২৭-৪৪ নং ধারায় নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলোকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে; যা লঙ্ঘন হলে যে কোন নাগরিক আদালতের আশ্রয় নিতে পারবে, রিট করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর নামে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দেশে-বিদেশে সর্বাধিক সমাদৃত তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতি বাতিল করে জনগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার; স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভোট প্রদানের মাধ্যমে দেশ পরিচালনায় অংশগ্রহণ করার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের পর বিরোধী দলের সহিংস আন্দোলন দমনের নামে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী কর্তৃক ব্যাপক দমন-নিপীড়ন, ধরে নিয়ে গিয়ে পায়ে গুলি করে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়া, সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ইলিয়াছ আলী, জাকির হোসেন, ওয়ালীউল্যাহ ও মোকাদ্দাসের মতো চিরতরে গুম করে ফেলা, ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়ে ঠান্ডা মাথায় খুন করা, মিথ্যা মামলা দিয়ে ঘরবাড়ি ছাড়া করা, রিমান্ডের নামে নিষ্ঠুর নির্যাতন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির অজুহাতে বিরোধী দলসমূহকে সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া এবং আইসিটি আইনের মাধ্যমে জনগণের ন্যূনতম মতপ্রকাশের অধিকারটুকু কেড়ে নেয়ার মাধ্যমে মূলত জনগণের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের ভয়াবহ মানবাধিকার পরিপন্থী কার্যকলাপের পরও যখন জাতিসংঘ ও তার মানবাধিকার কাউন্সিল এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠনগুলো নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে; কিংবা কোন কোন ইস্যুতে কিছু বিবৃতি দিয়ে, নিন্দা জানিয়ে দায়িত্ব শেষ করে দিচ্ছে কিংবা অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে ঠিক সেই রকম একটা পরিস্থিতিতে এবারের ১০ ডিসেম্বর ‘বিশ্ব মানবাধিকার দিবস’ পালন বিশ্বব্যাপী ভূলুণ্ঠিত মানবাধিকার সুরক্ষায় কতটুকু কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে তা বিবেচনার দাবি রাখে। তবে এ কথা ঠিক জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র ও অন্যান্য দলিল এবং বিশ্ব মানবাধিকার দিবস থাকার কারণে মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা হয়, চার বছর পরপর মানবাধিকার কাউন্সিলে রাষ্ট্রসমূহের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনা হয়, কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে তা বন্ধ ও বিচারের দাবি করা যায় কিন্তু এই কাঠামোই যদি না থাকতো তাহলে পরিস্থিতি আরো কত নাজুক হতো ভাবা নিশ্চয়ই কঠিন। পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে মানবাধিকার ঘোষণাপত্রসহ জাতিসংঘের আয়োজন অনেক সুন্দর কিন্তু যারা তার বাস্তবায়ন করবে তাদের মানসিকতা এবং জবাবদিহিতার অনুভূতি না থাকার কারণে এগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না বা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কিন্তু মানবাধিকারের সনদের নামে খুব বেশি প্রচার প্রচারণা না থাকলেও হযরত মুহাম্মদ (সা) ঘোষিত মদিনা সনদ যা পৃথিবীর প্রথম ঘোষিত মানবাধিকার সনদ ও লিখিত সংবিধান হিসেবে পরিচিত তার প্রতিটি ধারা-উপধারা তিনি বাস্তবায়ন করেছিলেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। তাইতো মাইকেল হার্ট একজন খ্রিষ্টান দার্শনিক হয়েও ‘দ্য হান্ড্রেস’ বইয়ে পৃথিবীর ১০০ জন শ্রেষ্ঠ মানুষের তালিকায় ১ নম্বরে মুহাম্মদ (সা)কে স্থান দিয়ে মন্তব্য করেছেন, যে আজকের এই ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ বিশ্বকে যদি একটি রাষ্ট্রে পরিণত করা হয় আর মুহাম্মদ (সা)কে এনে যদি ঐ রাষ্ট্রের প্রধান বানিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তিনি বিশ্ববাসীর শান্তি, মানবতা আর নিরাপত্তা উপহার দিতে সক্ষম হবেন। যেভাবে সক্ষম হয়েছিলেন আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে সঙ্ঘাতময় বিভক্ত মদিনাকে একটি শান্তি ও সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত করতে। তাই মাইকেল হার্টের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরা এ কথা বলতে পারি জাতিসংঘ সনদ, মানবাধিকার সনদ বা মানবাধিকার দিবস কোনোটাই পৃথিবীতে প্রকৃত শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম নয় বরং স্রষ্টাপ্রদত্ত বিধান ইসলামই রাসূল (সা)-এর আদর্শের যথার্থ অনুসরণই পারে প্রত্যেকটি মানুষের অধিকার তথা মানবাধিকার ও বিশ্বশান্তি সুনিশ্চিত করতে। লেখক : মানবাধিকার সংগঠক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির