post

২৮ শে অক্টোবর আহত নূর উদ্দিন

০৬ অক্টোবর ২০১৪

Chhatrasangbadবাতিলের ফুৎকারে আল্লাহর নূর কোনো দিন নিভে না। অতীত মানুষের প্রেরণা জোগায় যদি সেই অতীত হয় গৌরবের। ২৮ শে অক্টোবর বা পল্টন ট্র্যাজেডি এদেশের ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসের এমন একটি অতীত যা যুগ যুগ ধরে আন্দোলনের কর্মীদের জন্য হবে প্রেরণার ও গর্বের। সেই দিন প্রমাণ হয়েছিল ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা জীবন দেবে, রক্ত দেবে কিন্তু আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার এই সংগঠনের কোনো ক্ষতি হতে দেবে না। কোন বাতিল শক্তি মুখের ফুৎকার দিয়ে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে পারবে না। সেই দিনের স্মৃতি অমলিন। ২৫ শে অক্টোবর ঈদ হওয়ার পরই সকল জনশক্তিকে ২৭ শে অক্টোবরের মধ্যে ঢাকায় উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছিল। তাই ২৭ তারিখ রাতে ঢাকায় আসি। সকালে মতিঝিল থানার ঈদপুনর্মিলনী শেষে থানা সভাপতি রেজাউল ভাই আমাকে দশজন সাথীসহ বায়তুল মোকাররম পাঠালেন। সকাল ১০টার দিকে ২৮ শে অক্টোবর জোট সরকারের ৫ বছর পূূর্তি উপলক্ষে জামায়াতের সমাবেশ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে, আমার গ্রুপকে শৃঙ্খলার দায়িত্ব দেয়া হলো পুরানা পল্টনের কস্তুরীর গলিতে। একই দিনে আওয়ামী লীগ সমাবেশ ডেকেছে প্রেস ক্লাবের সামনে। সকাল ১০টায় আমরা দেখলাম বিজয় নগর কাকরাইলের দিক থেকে আওয়ামী লীগের মিছিল আসছে। আমি মূল রাস্তায় মিছিলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যারা মিছিল নিয়ে আসছে তাদের সবার হাতে তাদের নেত্রী খুনি হাসিনার কথা অনুযায়ী লগি-বৈঠা ও রড এমনকি আগ্নেয়াস্ত্রে ভয়ঙ্করভাবে সজ্জিত। তারা পল্টন থেকে বিজয়নগর মোড় পর্যন্ত আমাদের যে মাইকগুলো লাগানো ছিল তা লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে ফেলে দিচ্ছে, তারগুলো ছিঁড়ে ফেলছে। পাশে দাঁড়ানো পুলিশকে বিষয়টি বললে অবাক হয়ে দেখলাম পুলিশ শুধু নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। লগি-বৈঠার মিছিল যখন পল্টন মোড়ে পৌঁছায় তখন তারা প্রেস ক্লাবের দিকে না গিয়ে বায়তুল মোকাররমের দিকে মোড় নিলো। লক্ষ্য জামায়াতের মঞ্চ ভাঙচুর করে দখল করবে। জামায়াতের মহানগরী অফিস ও ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় অফিসে হামলা করবে। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। ইসলামী আন্দোলনের কর্মী ভাইয়েরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। লগি-বৈঠা, বাঁশ, আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হাজার হাজার আওয়ামী সন্ত্রাসীর সমানে গুটি কয়েক ইসলামী আন্দোলনের কর্মী। ততক্ষণে তারা আমাদের ওপর কস্তুরীর গলি দিয়ে মিছিল নিয়ে হামলা করে। আমরা গুটি কয়েকজন প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করি। শুরু হলো ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। আমি তাকিয়ে দেখলাম বৃষ্টির মতো ইট আসছে তাদের পক্ষ থেকে, শুধু ইট নয়, কোকের বোতলও তারা আমাদের ওপর নিক্ষেপ করছে। এভাবে চলে প্রায় আধঘণ্টা। এক সময় হঠাৎ একটি ইট এসে আমার পায়ে পড়ে। হঠাৎ করে আমার ডান পায়ের শক্তি শেষ হয়ে যায়। আমি এক পাশে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকি। এরপর একটু স্বাভাবিক হলে আবার লেগে যাই তাদের মোকাবেলায়। তখন আমাদের এই গ্রুপটির নেতৃত্ব দিচ্ছেলেন মহানগরী সেক্রেটারি রফিক ভাই। আমাদের সাথে ছিল মহানগরী পশ্চিমের কিছু ভাইÑ সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৫০ জনের একটি গ্রুপ। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার একপর্যায়ে আমি তাদের লগি-বৈঠার সামনে পড়ে যাই। তারা দশ থেকে বার জন আমার ওপর হামলে পড়ে। প্রথম আঘাতটি করে লগি দিয়ে মাথার পেছনে। আমি পড়ে যাই। এরপর সাত থেকে আটজন আমার মাথায় সামনের দিক থেকে আঘাত করতে থাকে, মাথার হাড়গুলো ভেঙে যায়। মাথা ও নাক দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। এই সময় আমাদের কয়েকজন ভাই তাদের ধাওয়া করলে তারা আমাকে ফেলে চলে যায়। হাফিজ ভাই ও তসলিম ভাই আমাকে ধরাধরি করে একটি রিকশায় ওঠায়। তখনও আমার জ্ঞান ছিল। এরপর প্রথমে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল পরে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল মতিঝিলে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজারবাগে শুধু মাথার রক্ত পড়া বন্ধ করে। তারা এর বেশি কিছু করতে অপারগতা প্রকাশ করে। পরে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নেয়ার পর মাথার চুল কামিয়ে কেটে যাওয়া অংশগুলো সেলাই করে ছয়তলায় একটা বেডে পাঠিয়ে দেয়া হয়। একটু পরে আমার সাথে পাশের বেডে যোগ হন কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদক ড. রেজাউল করিম ও মহানগরী সভাপতি কামাল হোসাইন। বিকেল ৪টার দিকে কয়েক টুকরো আপেল মুখে দিতেই প্রচণ্ড বমি হওয়ায় ডাক্তার সিটি স্কেন করার জন্য বললেন। সাথে সাথে অ্যাম্বুল্যান্সে করে নেয়া হয় কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে। সেখানে সিটি স্কেন করার পর ধরা পড়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে এবং ব্রেনের চারপাশে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। জরুরি অপারেশনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় ওটিতে। তখন সন্ধ্যা ৬টা। এরপর ২ দিন এই দুনিয়াতে ছিলাম না। জ্ঞান ফেরার পর দেখি কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ ভাই, আমীরে জামায়াত মাওলানা নিজামীসহ আরো ৫-৬ জন হাত তুলে দোয়া করছেন। ওঈট-তে রাখা হয়েছিল আমাকে। আমাদের জ্ঞান ফেরা নিয়ে সবাই খুব শঙ্কায় ছিলেন। সিপি ও আমীরে জামায়াত চলে যাওয়ার পর নার্স এক বোন এসে আমাকে বললেন, বাইরে অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে আপনাকে দেখার জন্য। কিন্তু ওঈট-তে প্রবেশ নিষেধ থাকায় কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। আপনি একটু হাত তুলে আশ্বস্ত করুন। একটু হাত তুলে আমি সবাইকে জানালাম যে মহান আল্লাহ আমাকে এখনো জীবিত রেখেছেন। জ্ঞান ছিল না ২ দিন। পরে শুনলাম যে শহীদ মাসুমের সাথে আমার জন্যও নাকি কফিনের বাক্স তৈরি করা হয়েছিল। আমার নাকে-মুখে, প্রস্রাবের রাস্তায়, মাথায় ৬টি পাইপ লাগানো ছিল। এরপর ১১ দিন কোন কিছু না খেয়ে শুধু ইনজেকশনের ওপর বেঁচে থাকা। এই সময় সারাক্ষণ আমার পাশে ছিলেন ঢাকায় এসে যার হাত ধরে সংগঠন করা সেই শ্রদ্ধেয় ইব্রাহিম ভাই। আমার জন্য সংগঠনের অনেক ভাইÑ বিশেষ করে থানা সভাপতি রেজাউল ভাই, হাফিজ ভাই, তসলিম ভাই, প্রিয় রাহেত ও তার বাবাসহ আপন বড় বোন ও ভাইয়েরা আমার জন্য সেই দিনগুলোতে অনেক অনেক কষ্ট করেছেন। সময় পেরিয়ে আজ ২০১৪ সাল। এর পর জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে জেল-জুলুম ও নির্যাতন। কিন্তু এসব কিছুই অনেক বেশি তুচ্ছ মনে হয় যখন দেখলাম চোখের সামনেই শাহাদাত বরণ করেছেন অনেক ভাই। হাত হারিয়েছেন, পা হারিয়েছেন, চোখ হারিয়েছেন- মনে হয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা আজ রক্ত ও জীবন দেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। লক্ষ্য সকল বাধা পেরিয়ে একটা নুতন সুন্দর সোনালি ভোরের। লেখক : সাবেক কেন্দ্রীয় অফিস বিভাগের সদস্য

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির