post

৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ একটি প্রহসনের রায় : অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম মহানগরী ঝরে গেল আরো দু’টি প্রস্ফুটিত গোলাপ

২৪ মার্চ ২০১৪
Shahidএম.এইচ. সোহেল

এই পৃথিবীতে সত্যের বাহকদের সাথে বাতিল শক্তির দ্ব›দ্ব শেষ হয়নি-হবে না- কেয়ামত পর্যন্ত চলবে। হজরত ইবরাহিম (আ) এর যুগে নমরুদের অস্তিত্ব, হজরত মূসা (আ) এর যুগে ফেরাউনের দম্ভ এবং হজরত মুহাম্মদ (সা) এর যুগে আবু জেহেলদের হুঙ্কার যেমন ছিল, বর্তমানেও কুরআনের সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত লোকদের সাথে দ্ব›দ্ব চলছে নব্য নমরুদ, ফেরাউন ও আবু জেহেল, আবু লাহাবসহ অসংখ্য বাতিল শক্তির। আন্দোলনের বৃক্ষকে সতেজ-সজীব রাখার জন্য বৃক্ষের গোড়ায় রক্ত সিঞ্চন করে চলেছে কুরআনের বিপ্লবী সৈনিকরা। এমনই একটি রক্তসিক্ত জনপদ চট্টগ্রাম মহানগরী। যে জনপদে সত্যের দাওয়া বহন করতে গিয়ে ইতঃপূর্বেই শহীদি মিছিলে যোগ দিয়েছে হাফেজ আবদুর রহীম, আমীর হোসেন ও জসিম উদ্দীন মাহমুদের মতো সাহসী তরুণেরা। শহীদের এই মিছিল আজো থামেনি। ৫ ফেব্রæয়ারি ২০১৩ সালে সর্বকালের সর্বনিকৃষ্ট অবৈধ বিচারালয় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল জনাব আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেয়ার প্রতিবাদে তৌহিদি জনতা এ রায়কে অবৈধ বলে প্রত্যাখ্যান করে। তৎক্ষণাৎ সারা দেশে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। চট্টগ্রামেও তারই ধারাবাহিকতায় ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগরী দক্ষিণ বেলা ১টায় নগরীর অলঙ্কার মোড়ে হাজারো কর্মীর একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করে। মিছিলের শুরুতেই পুলিশ ও র‌্যাবের মুহুর্মুহু গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন শিবিরের ২৭ নম্বর দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের সাথী চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেধাবী ছাত্র ইমরান ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ড পূর্ব পাঠাগার সম্পাদক আবিদ। শহীদ ইমরানের শাহাদাতের প্রতিবাদে পুনরায় বাদ মাগরিব বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগরী দক্ষিণ বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করে নগরীর দেওয়ানহাট মোড়ে। যথাসময়ে হাজার হাজার নেতাকর্মীর অংশ গ্রহণে মিছিলটি মিস্ত্রীপাড়ার মুখে মিষ্টিমেলার সামনে এলে এখানে আগে থেকে অবস্থানরত ডবলমুরিং থানার এসআই, সেকেন্ড অফিসার এর নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশের গুলিতে জামায়াতের দু’জন কর্মী আফজল ও শফীকুল ইসলাম গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে শাহাদাত বরণ করেন। গুলিবিদ্ধ অব¯হায় গুরুতর আহত হন অর্ধ শতাধিক নেতাকর্মী। ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করা হয় ১৫ জন নেতাকর্মীকে। গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের মাঝে ছিলেন এইচএসসি পরীক্ষার্থী আবিদ বিন ইসলাম। পুলিশ সম্পূর্ণ সুস্থ আবিদকে গ্রেফতার করে ভ্যানে তুলে বুকে গুলি করে পরে ভ্যানের মধ্যেই পুলিশ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আবিদের দুই চোখ উপড়ে ফেলে। এর পর শহীদ আবিদকে তারা চট্টগ্রাম মেডিক্যালের মর্গে পাঠিয়ে দেয়। ইসলামী আন্দোলনের কিশোরকর্মী আবিদ বিন ইসলামের লাশ নিয়ে আওয়ামী পুলিশ বাহিনী ও ছাত্রলীগ যে ঘৃণ্য তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। প্রত্যেক যুগে এভাবেই ওহুদ প্রান্তরের মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে ইসলাম বিরোধী নাস্তিক, মুরতাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী।

শহীদ ইমরান : সত্যের আকাশে এক ধ্রæবতারা শহীদ ইমরান একটি সবুজ জান্নাতি পাখি, যে পাখিটি স্বপ্নের সবুজ পাখা মেলে এখন আর এ শহরে আসে না। ভাবনার মুক্তবিহঙ্গ ডানা মেলে অলিতে গলিতে কাউকে আর নামাজের জন্য ডাকে না। হঠাৎ চমকে ওঠার মতো তার সেই চেনা মমতামাখা কন্ঠস্বর এখন আর কেহ শুনে না। মিছিলের নগরীতে সম্মুখে দাঁড়িয়ে নারায়ে তাকবির শ্লোগান তার সেই বলিষ্ঠ কন্ঠে উচ্চারিত হয় না। কিংবা কলেজ থেকে ফেরার পর মাকে খুব আদর করে বলে না ক্ষুধা লেগেছে তাড়াতাড়ি খেতে দাও। পড়ন্ত বিকেলে খেলার মাঠে যাবার জন্য বন্ধুরা এখন আর তার চিৎকার শোনে না। ইমরান ছিল পৃথিবীর বাগানে সেরা ফুলগুলোর একটি কিন্তু সুবাস ছড়ানোর আগেই নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। বাগানের সেই সেরা ফুলটিকেই কবুল করা হলো। বাগানের সবচেয়ে সুন্দর ফুলটি সবাইকে আকর্ষণ করে, যার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে মানুষ তাকে পেতে চায়। শহীদ ইমরান যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র তখন থেকেই সে তার জীবনের কারণে অকারণে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে প্রাঞ্জল ভাষায় ডায়েরির পাতায় তুলে রাখতো। শহীদ ইমরানের ডায়েরি হতেÑ ‘আমরা বন্ধুরা সবাই সবাইকে খুব বিশ্বাস করি। বিশেষ করে রিয়াদ ও আশিক আমাকে খুব বিশ্বাস করে, আমিও তাদেরকে খুব বিশ্বাস করি। রিয়াদ মাদ্রাসায় পড়ে তাই সে বেশির ভাগ সময় ইসলামিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। আমরা কোচিংয়ে একটা সংগঠন করেছি। সংগঠনটি একটা ইসলামিক সংগঠন। সংগঠনের প্রধান (সভাপতি) হচ্ছে রিয়াদ কারণ ও খুব ভালো ছাত্র যেহেতু আমিও ওদের সাথে লেখাপড়ায় তাল মিলিয়ে চলতে পারি তাই আমি হলাম সহসভাপতি। এসব নির্বাচন করেছে ছাত্ররাই। ওদের অমতে কিছুই করা যায় না। সংগঠনে সবাই সবাইকে সম্মান করে।’ (১৬.০৯.২০০৮) ‘চিন্তা করছি ঈদের পর আমি এক মাসের জন্য চাকরিতে ঢুকবো। মূলত কম্পিউটার কেনার জন্য। নিজের একটা কম্পিউটার কেনা আমার অনেক দিনের স্বপ্ন।’ (২২.১০.২০১১) ‘আজ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী। মুসলমানদের জন্য খুবই খুশির দিন। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সা) এ দিন জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু আমি কল্পনাও করতে পারিনাই যে আজ আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরবে। কিছুদিন আগে অর্থাৎ ফেব্রæয়ারির শেষের দিকে বিডিআর কার্যালয়ে সেনা অফিসারদের ওপর যে চরম হত্যাযজ্ঞ চালানো হলো এ জন্য। এ বিষয়ে আমি তেমন জানি না তবে আমার মনে হয় সরকারের সহযোগিতা না থাকলে এমন হত্যাকাণ্ড চালানো যেতো না।’ (০৩.০৩.২০০৯) ‘আজ ঘুমানোর আগে আমার একটাই প্রার্থনা যেন আগামী ফজরের নামাজটা আমি জামায়াতে আদায় করতে পারি, নতুন বছরের সকালটা যেন মসজিদে নামাজের মাধ্যমে শুরু হয়।’ (০১.০১.২০১১) জীবনের অন্যরকম পরিবর্তন শুরু : এরই মধ্যে শান্ত ইমরান ছাত্রশিবিরের বিপ্লবী দাওয়াত পায়। তার বাসার পাশেই থাকতো উপশাখা শিবিরের সভাপতি। স্থানীয় ভাইদের দাওয়াতে সে বিভিন্ন প্রোগ্রামে যাওয়া শুরু হলো। সংগঠনের ভাইদের সাথে মেলামেশায় আস্তে আস্তে পরিবর্তন আসতে শুরু করলো তার জীবনে। তিনি তার ডায়েরিতে লিখেন, ‘ইদানীং আমি ছাত্রশিবিরে যোগ দিয়েছি, এখন তো আমার ক্লাস আরম্ভ হয়নি তাই সেখানে মাঝে মাঝে সময় দিতে হয়। আমি বর্তমানে শিবিরের কর্মী, এরপর আমি শিবিরের সাথী হতে চাই, শুনেছি শিবিরের সাথীদের অনেক সম্মান থাকে।’ (২৬.০৮.২০১১)। ‘আজ থেকে চিন্তা করলাম জীবনে একটা রুটিন বানাতে হবে। জীবনে অনেকটা সময়ই নষ্ট করলাম। এবার একটা পরিকল্পিত রাস্তায় আসতে হবে। এ রাস্তায় আসতে হলে একটা পরিকল্পনা নেয়া খুবই জরুরি আর সেটা করার জন্যই আজ বসলাম।’ (জুলাই-২০১১) মেধাবীদের একজন ছিল ইমরান : ইসলামী ছাত্রশিবির ২৭ নম্বর দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের সাথী চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেধাবী ছাত্র ইমরান। তার প্রাথমিক স্কুল ছিল সুলতান আল নাহিয়ান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পরবর্তীতে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নাসিরাবাদ বয়েজ হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে সেখান থেকেই জিপিএ ৪.৫৬ নিয়ে ২০১০ সালে এসএসসি পাস করে। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে সংগঠনের সাথী হিসেবে শপথ নেয়ার পর সদাশান্ত এই ছেলেটির সময় কেটে যেত আন্দোলনের মাঠে। তার দায়িত্ব ছিল আগ্রাবাদের ছোট পুল এলাকার ইসলাম মিয়ার ব্রিক ফিল্ড উপশাখার সেক্রেটারি। তাকে দেখা যেত কখনো কর্মীদের বাসায়, কখনো শুভাকাক্সক্ষীদের সাথে নম্র আলাপচারিতায়। কখনো কথায় বা আচরণে ভুল করে ফেললে মিষ্টি করে হেসে সেই ভুল স্বীকার করতো। সদা হাস্যোজ্জ্বল ও শান্ত হওয়ায় কর্মীরাও ভিড় করতো তার চারপাশে। নিজের টেবিলের সাথে লাগানো সামনে দেয়ালে ক্যালেন্ডারের একটি পাতা নিয়ে উল্টোপিঠে বড়ো বড়ো করে লিখে রাখলোÑ ১. সবসময় চেষ্টা করবো, যেন প্রতিটি সাংগঠনিক বৈঠকে ঠিক সময়ে যোগদান করতে পারি এবং অসুখ-বিসুখ বা শরয়ি ওজর ব্যতীত কোনো বৈঠকে অনুপস্থিত না থাকি; ২. বিশেষ কারণে বৈঠকে উপস্থিত থাকতে না পারলে আগেই অনুমতি নেবো; ৩. সবসময় দাওয়াতি বই সঙ্গে রাখবো এবং প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে দু’টি বই বিতরণ করবো; ৪. কমপক্ষে দু’জন লোককে কর্মী বানানোর চেষ্টা করবো এবং তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবো; ৫. প্রতিদিন দাওয়াতি কাজ ও সাংগঠনিক কাজের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু সময় দেবো এবং সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন দাওয়াত সম্প্রসারণ ও কর্মীগঠনের কাজ করবো; ৬. আমার পরিচিত মহল থেকে মাসিক বা এককালীন সাহায্য আদায় করার চেষ্টা করবো। এবং প্রতি মাসে কমপক্ষে দু’জন শুভাকাক্সক্ষী বৃদ্ধি করবো। মাস শেষে বায়তুলমালের টাকা দায়িত্বশীল বৈঠকে জমা দিতে হবে। অথচ শুভাকাক্সক্ষীদের বাসায় পাওয়া যায়নি বলে সব টাকা তোলা হয়নি। আব্বুকে জানাল সমস্যাটা। বাবার কাছ থেকে ১৫০ টাকা ধার নিয়ে দায়িত্বশীল বৈঠকে জমা দিলো। দ্বীনের বিপদে অর্থনৈতিক বকেয়া করা যাবে না, হিসাব-নিকাশেও স্বচ্ছ হতে হবে...এই ছিল তার মনোভাব। শাহাদাতের পর শহীদ ইমরানের মাকে সান্ত্বনা দিতে গেলে তিনি কান্নাজড়িতকণ্ঠে বললেন, আমি দুইবারের অপারেশনের রোগী, বাসার কাজগুলো করতে খুব কষ্ট হতো। ইমরানই সব করে দিতো। আমিই বরং তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করতাম। আমরা মা-ছেলে হলেও আমাদের আচরণ ছিল বন্ধুর মতো। ঘটনার দিনও সে আমার নির্দেশমতো ঘরের সব বাজারই করে দিয়েছিল, দ্বীনের কাজে পাগল ছিল আমার ছেলে। বন্ধুর মতো আমার কাছে সব কিছু শেয়ার করতো। ছোট-ভাইবোনদের সে নিজেই পড়াতো। আমার ঘরের অন্যান্য সব কাজে সে সহযোগিতা করতো। শহীদ ইমরানের ৫টি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি জানাজায় সরকারের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী বাধা প্রদান করে। সব ধরনের বাধা উপেক্ষা করে হাজার হাজার জনতা অংশগ্রহণ করে শহীদ ইমরানের জানাজায়। জানাজায় আগত মানুষের অশ্র“সিক্ত নয়নে পারিবারিক গোরস্থানে শায়িত হন শহীদ ইমরান। শহীদ মোহাম্মদ আবিদ বিন ইসলাম : প্রস্ফুটিত হবার সময় যাকে দেয়া হয়নি আবিদ বিন ইসলাম তেমনি এক তরুণ, যার বয়স তখনো আঠারোতে পা দেয়নি। অথচ তার আগেই সে কাঁপন তুলেছিল সমাজে। জানিয়ে দিয়েছিল তার স্বকীয়তাবোধ। যে ভাবতো সারাক্ষণ আর কিছুক্ষণ পরপর এসে মাকে বলতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবাইকে নিয়ে লড়বার জন্য সে বড়ো-অনেক বড়ো নেতা হবে। সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে। আসলেই আবিদ আমাদের সবাইকে ছাড়িয়ে অনেক বড় হয়েছে। কৈশোরেই সে পেয়েছে মৃত্যুহীন সার্থক জীবন। শহীদ আবিদের মায়াময় চোখগুলোই ছিল আকৃষ্ট করার মতো। যে কেউ একবার তাকাবে সে কখনোই তার ওপর রাগ ধরে রাখতে পারতো না। আবিদের আব্বু বলছেন, Shahid-02আমি যতবারই তার ওপর বিভিন্ন কারণে রাগ করে তাকে বকা দিতে গিয়েছি যখনই তার দু’চোখে আমার চোখ পড়েছে তখনই আমার রাগ গলে পানি হয়ে গিয়েছে। তার চোখ ছিল মায়া আর ভালোবাসার প্রদীপ। ওই দু’চোখে যার চোখ একবার পড়বে সে কখনোই তার শত্রæ হতে পারবে না। মা বললেন এ জন্যই পুলিশ আর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে তার চোখ উপড়ে ফেলে। কারণ তারা তার চোখের জ্যোতিকে সহ্য করতে পারতো না। দু’চোখ দিয়ে সে একবার যাকে একটি মুহূর্তের জন্য দেখেছে তাকে কখনোই ভুলতো না। চোখতো নয় যেন হরিণের দৃষ্টি। ছোট থেকেই দুর্দান্ত প্রকৃতির হওয়ায় কোথাও স্থির হয়ে বসে থাকতে পারতো না। প্রচণ্ড ডানপিটে এই ছেলেকে নিয়ে মা-বাবা সবসময় চিন্তিত থাকতেন কখন কী করে বসে। তার একমাত্র সাইকেলটা নিয়ে পাড়া-মহল্লায় টই টই করে ঘুরে বেড়াতো। মা স্কুলের শিক্ষিকা ও বাবা কোর্টে ব্যস্ত থাকার সুবাদে ঘোরাঘুরির সুযোগটা দারুণভাবে কাজে লাগাতো সে। তার সাইকেলের ক্রিং ক্রিং ক্রিং আওয়াজ হালিশহরবাসী নিত্যদিন শুনতো এবং বুঝে যেত সাইকেলের আরোহী আবিদ না হয়েই যায় না। আব্বু অ্যাডভোকেট হওয়ার পরও উনাকে না পাড়ার যতো মানুষ জানতো তার চাইতেও কয়েকগুণ বেশি মানুষ জানতো আবিদকে। রাতজাগা এই পাখি মাঝে মাঝে একা তাহাজ্জুদ পড়তো। এ দিকে মা তো সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত থাকতো, একদিন অধিক রাত অবধি মা তার কাজ করে চলছেন তখন ছোটো ছেলে আবিদ গিয়ে গম্ভীর স্বরে মাকে বললো ‘মা কেন তাহাজ্জুদ পড়ছো না.. এটাতো তাহাজ্জুদের সময়। মুহূর্তেই মায়ের মনে হলো আবিদ যেন তাকে দ্বীন শেখাচ্ছে। ছোট শিশু যখন এভাবে মা-বাবার শিক্ষক হন তখন মা-বাবার মনে আনন্দের সমীরণ বয়ে যায়। এখন গভীর রাতে আবিদকে মা অনেক বেশি অনুভব করেন আর দু’হাত তুলে জান্নাতের পাখি আবিদের জন্য দোয়া করেন। ঘুরে বেড়ানো তার আরেকটি শখ। যেন পুরো পৃথিবীকে দেখতে চায়। উপলব্ধি করতে চায় স্রষ্টার সৃষ্টির মাহাত্ম্য আর সৌন্দর্যকে। ছোট বয়সেও সে ঢাকা-চট্টগ্রামের প্রায় সকল পর্যটন স্থান ভ্রমণ করে। তার ফেসবুকে ভ্রমণের সেই ছবিগুলো দেখে মনে হয় সে যদি জীবনে আরো ১৫-২০ বছর সময় পেতো তাহলে পুরো পৃথিবী ঘুরো বেড়াতো। শহীদ আবিদ সব সময় স্মার্ট চলাফেরা করতে খুব পছন্দ করতো। এ ছাড়াও গান শোনা, গানের কোকিল ও চিত্রশিল্পী হওয়ার শখ ছিল আবিদের। লেখালেখিতেও সে ছিল সেরা; শাহাদাতের কয়েকদিন আগে তার লেখা কবিতা ‘মানবতা’ আমাদের মুগ্ধ করেছে। একদিন হঠাৎ আব্বুর চেম্বারে এসে আবিদ বললো, আব্বু চেয়ার থেকে ওঠো, কী আর করা, জো হুকুম জাঁহাপনা, আব্বু চেয়ার থেকে উঠামাত্র সে আব্বুর চেয়ারে বসে বললো, এটা ভবিষ্যতের ব্যারিস্টার আবিদ বিন ইসলামের চেয়ার। আব্বুর স্বপ্ন ছিল আবিদ ব্যারিস্টার হবে। একদিন নিজের উপশাখার ইফতার চক্রে ইফতার গ্রহণের সামান্য আগে অতিথি ফোন করে জানালেন রাস্তায় জ্যামের কারণে তিনি আসতে পারছেন না। মহা মুশকিলে পড়ে গেল আবিদ। এখন উপায়? অতিথি ছাড়াই বিপুলসংখ্যক সমর্থক-কর্মীদের ইফতার করিয়ে বিদায় দিতে হবে!! এটা কেমন কথা! এ সময় তার বাবা কোর্ট থেকে বাসায় ফিরছিলেন। আবিদের মাথায় একটা বুদ্ধি চাপলো। বাবাকে প্রোপ্রামে টেনে এনে সবার উদ্দেশ্যে বললো-এখন আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছেন আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জনাব অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম। বাবাতো অবাক ছেলের কাণ্ড দেখে! আবিদের আব্বু বলেন এমন অবাক করা কাণ্ড সে জীবনে অনেক করেছে। চলমান আন্দোলন সংগ্রামে আবিদ ছিল অগ্রসেনানীদের অন্যতম একজন। আন্দোলন সংগ্রামে আবিদকে দেখা যেতো সবসময় সম্মুখভাগে। মিছিল মিটিং পিকেটিং সবকিছুতেই তার অংশগ্রহণ ছিল অগ্রগণ্য। নিজের রিপোর্ট বইয়ের কভার পেইজে তার হস্তাক্ষরে লেখা উক্তিগুলো (সংগ্রামী ২০১৩, আন্দোলনের ২০১৩, আন্দোলনের চূড়ান্ত সময়), আন্দোলনবিমুখ জনশক্তিদের জন্য হেদায়েতের আলো এবং যারা আন্দোলনে চলমান তাদের ঈমানি শক্তিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। নিজের নামের স্থানে লিখতো ‘সংগ্রামী পথিক’। কেন্দ্রীয় জামায়াত নেতৃবৃন্দের মুক্তির জন্য সবসময় আব্বু আম্মুকে দোয়া করতে বলতো। আর এ সময়ে যারা আন্দোলনে যাবে না তাদেরকে সে মোনাফেক ভাবতো। আব্বু আম্মু কখনো মিছিলে যেতে বারণ করলে তাদেরকে এ কথা সরাসরি স্মরণ করিয়ে দিতো। এভাবে আবিদ অনেক কিছু ভাবতো। অনেক স্বপ্ন দেখতো। কিন্তু এতো কিছুর পরও আবিদ জানতো খুব শিগগিরই সে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যাবে। আর তাইতো ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর আবিদ তার ডায়েরিতে লিখলোÑ ‘আমার মনের সকল আশা পূরণ হবে না এমন করে চলে যাবো কেউতো বুঝবে না’ অবশেষে ৬ ফেব্রæয়রী বিকাল ৩টায় শহীদের পূর্বনির্ধারিত জনাজা নগরীর প্যারেড মাঠে অনুষ্ঠানের অনুমতি প্রশাসন দিলেও বিকাল ৪টা পর্যন্ত তারা লাশ দেয়নি। মাইকিং করতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অবশেষে শোকার্ত লাখো তৌহিদি জনতার উপস্থিতিতে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। অবশেষে সন্ধ্যার সামান্য পূর্বে প্রশাসন লাশ হস্তান্তর করলে হালিশহর বিডিআর মাঠে প্রায় ১০ হাজার শোকার্ত জনতা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের কমিশনার মোরশেদসহ অন্যান্যদের উপস্থিতিতে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। মাগরিবের নামাজের পর শহীদ আবিদের লাশ হালিশহর বি বøক গোরস্থানে দাফন করা হয়। আজ শহীদ আবদুল মালেকের মতো মেধাবী উত্তরসূরিরা বাতিলের কালো থাবায় অকালেই ঝরে পড়ছে। রাষ্ট্রযন্ত্র এখানে খুনের নেশায় মত্ত। রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীর হাত কঁচিকাচা তরুণদের পবিত্র রক্তে রঞ্জিত। স্বদেশ যেন তাই পলাশীর প্রান্তর। বাতিলেরা হয়তো ভাবছে শহীদ করে তারা ইমরান ও আবিদকে পরাজিত করেছে। কিন্তু না, আজ ইমরান ও আবিদ বুকের খুন ঝরিয়ে সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে বদর আর ওহুদের শহীদদের কাতারে নিজেকে শামিল করেছে। দুনিয়ার বাগানে সুবাস ছড়িয়ে গিয়ে জান্নাতের বাগানের পাখি হয়েছে। আলী-খালিদ-কাসিমদের অনুসারীরা নির্ভীক সাহসী হবে এটাই স্বাভাবিক। শহীদ ইমরান ও আবিদ ইসলামী আন্দোলন থেকে পিছু হটাকে কাপুরুষতা মনে করতো। আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন তাকেই শাহাদাতের মর্যাদা দান করেন। এই দিক দিয়ে জয়ী হলেন ইমরান ও আবিদ। আর নৈতিকভাবে পরাজিত হলো তাগুতি শক্তি। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, চট্টগ্রাম মহানগরী দক্ষিণ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির