post

অবহেলিত বাংলা যেভাবে ‘শাহী বাংলা’ হলো

আহমেদ আফগানী

২১ জানুয়ারি ২০২১

শাহী বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৩৫২ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের হাত ধরে। এর মাধ্যমে বাংলা দিল্লি সালতানাত থেকে আলাদা হয়। সমগ্র বাংলা অঞ্চল, বিহার, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, নেপাল, আরাকানের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয় বাংলা সালতানাত। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ পুনরায় সেই হারিয়ে যাওয়া শব্দ বঙ্গকে তুলে এনেছেন। বঙ্গ থেকেই তিনি সালতানাতের নাম দেন বাঙ্গালাহ। বাংলা ভাষা ও বাংলার জাতিসত্তা বিকাশে তাই শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের অবদান অনস্বীকার্য। স্বাধীন সুলতানী আমলে বাংলা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত ছিলো। সেসময় বিশ্বের মোট উৎপাদনের (জিডিপির) ১২ শতাংশ উৎপন্ন হতো সুবাহ বাংলায়, যা সে সময় সমগ্র ইউরোপের চেয়ে জিডিপির চেয়ে বেশি ছিল। [১] সারা পৃথিবী থেকে এখানে ব্যবসায়ীরা আসতেন বাণিজ্য করার জন্য। ইলিয়াস শাহ ইরানের সিজিস্তানের এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের শুরুর দিকে তিনি দিল্লির মালিক ফিরোজের অধীনে সেনানায়ক ছিলেন। পরে সাতগাঁও-এর তুঘলক শাসনকর্তা ইজ্জউদ্দীন ইয়াহিয়ার অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। নিজ যোগ্যতাবলে তিনি মালিক পদে উন্নীত হন। ইজ্জউদ্দীন ইয়াহিয়ার মৃত্যুর পর তিনি ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে সাতগাঁওয়ের শাসক হন। সেখানে তার কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করে তিনি লখনৌতির আলাউদ্দীন আলী শাহ-এর বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং যুদ্ধে জয়লাভ করে তিনি সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ উপাধি নিয়ে ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে লখনৌতির সিংহাসনে আরোহণ করেন। লখনৌতিতে তাঁর ক্ষমতা সুদৃঢ় করে ইলিয়াস শাহ রাজ্যবিস্তারে মনোনিবেশ করেন। তিনি ১৩৪৪ খ্রিস্টাব্দে সহজেই ত্রিহুত দখল করেন এবং ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে নেপালের তরাই অঞ্চলে এক দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেন। ইতঃপূর্বে কোনো মুসলিম বাহিনী এ অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারেনি। তিনি রাজধানী কাঠমাণ্ডু পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে স্বয়ম্ভুনাথ মন্দির অধিকার করেন। অতঃপর ইলিয়াস শাহ পূর্ব বাংলায় অভিযান পরিচালনা করেন এবং ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহকে পরাজিত করে ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁও অধিকার করেন। এরূপে তিনি সমগ্র বাংলার অধিপতি হন। শামস-ই-সিরাজ আফিফ তাকে ‘শাহ-ই-বাঙ্গালাহ’, ‘শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান’ ও ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ’ বিশেষণে ভূষিত করেন। ইলিয়াস শাহ উড়িষ্যা আক্রমণ করেন এবং জয়পুর ও কটকের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত পৌঁছেন। অতঃপর ইলিয়াস শাহ ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে বিহার আক্রমণ করেন। বিহারের পরেও তিনি তাঁর কর্তৃত্ব চম্পারণ, গোরখপুর এবং বেনারস পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। ইলিয়াস শাহের সাথে দিল্লির সুসম্পর্ক তখনো হয়নি। সুলতান ফিরোজ শাহ তুগলক ইলিয়াস শাহকে দমন করার জন্য বাংলা অভিমুখে অভিযান করেন। ইলিয়াস শাহ তাকে রুখে দেন। পরবর্তীতে ইলিয়াস শাহের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে ফিরোজ শাহ তুগলক দিল্লি ফিরে যান। ইলিয়াস শাহ্ সফল সেনানায়ক ছিলেন। ফিরোজ শাহকে তিনি যেভাবে প্রতিহত করেন, তা থেকেই ইলিয়াস শাহর কুশলতার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৫৫৩ সালে ৯০ হাজার অশ্বারোহী এবং এক লাখ পদাতিক সেনা ও তীরন্দাজ নিয়ে ফিরোজ বাংলা অভিযানে আসেন। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ্ একডালা দুর্গে অবস্থান নেন। দিল্লির দরবারের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারুণীর মতে, “পাণ্ডুয়ার পার্শ্বেই ‘একডালা’ নামে একটি দুর্গ আছে, যার একদিকে নদী, অন্যদিকে জঙ্গল।” ফিরোজ শাহ্ এই দুর্গ অবরোধ করলে প্রথম দিনই প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এতে ইলিয়াস শাহের পুত্র সিকান্দার শাহ্ দিল্লির বাহিনীর হাতে বন্দি হন। ২২ দিন অবরোধের পরও দুর্গ দিল্লির দখলে নিতে পারলো না দিল্লির বাহিনী। তখন ফিরোজ শাহ্ একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি অবরোধ প্রত্যাহারের কথা বলে পিছু হটেন। এই দেখে ইলিয়াস শাহ দশ হাজার অশ্বারোহী, ২ লাখ পদাতিক সৈন্য এবং ৫০টি হাতী নিয়ে দিল্লির বাহিনীকে আক্রমণ করেন। ফিরোজ শাহ এটিই চেয়েছিলেন। তিনিও ঘুরে আক্রমণ প্রতিহত করেন। কিন্তু তার কৌশল কাজ করলেও শেষমেশ ফিরোজ জিততে পারেননি। পিছু হটে গিয়ে ইলিয়াস আবার দুর্গে প্রবেশ করেন। ফিরোজ শাহ্ আবার দুর্গ অবরোধ করেন। অনেকদিন অবরোধের পর যুদ্ধে কাক্সিক্ষত সফলতা আসবে না চিন্তা করে ফিরোজ শাহ তুঘলক সন্ধি প্রস্তাব করেন। তাছাড়া বর্ষা ঋতু চলে আসায় তার সৈন্যরাও পড়েছিলো বিপদে। ১. ইলিয়াস শাহ্ বাংলার স্বাধীন শাসনকর্তা থাকবেন। ২. দিল্লির দরবারে বার্ষিক কর ও উপঢৌকন পাঠাবেন। ৩. পাণ্ডুয়ায় বন্দি সকল সৈন্যকে ফিরোজ শাহ্ মুক্তি দেবেন। এর ফলে ইলিয়াস শাহ স্বাধীন সুলতান হিসেবে বাংলা শাসন করতে আর কোনো বাধা থাকলো না। পরবর্তীতে বাংলা ও দিল্লির সুলতানদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উপহার ও দূত বিনিময়ের মাধ্যমে আরও দৃঢ় হয়। তাদের মধ্যে প্রায়ই দূত ও উপহার বিনিময় হয়েছিল। দিল্লির সুলতানের সঙ্গে আপোষ ইলিয়াস শাহকে পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্যের ওপর তাঁর প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ করে দেয়। শাসন কাজেও ইলিয়াস শাহ্ দক্ষ ছিলেন। লক্ষণাবতী, সাতগাঁও ও সোনারগাঁ তিনি একীভূত করেন। অভিজ্ঞ কূটনীতিকের মতো তিনি সময় ও সুযোগকে ব্যবহার করে সমগ্র বাংলাকে একীভূত করেছিলেন। এবং তিনি রাজধানী লক্ষণাবতী থেকে সরিয়ে পাণ্ডুয়ায় আনেন। তিনি সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় জনগণের সাহায্য নেন। স্থানীয় জনগণকে উদারভাবে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তিনি তাঁর শাসনকে গণশাসনের রূপ দেন। ইলিয়াস শাহ্ বর্ণ, গোত্র ও ধর্ম নির্বিশেষে যোগ্য লোকদের চাকরিতে নিয়োগ লাভের সুযোগ দেন। তিনিই প্রথম রাজকার্যে হিন্দুদের নিয়োগ দেন। ‘ইনশাহ-ই-মাহরু’ থেকে জানা যায় যে, খান, মালিক, উমারা, সদর, আকাবির ও মারিফগণ সামরিক ও বেসামরিক শাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এদের মধ্যে সম্ভবত খান, মালিক ও আমিরগণ ছিলেন জায়গির ভূমির অধিকারী ও রাজ্যের পদস্থ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। তাদের কেউ কেউ হয়তো মন্ত্রী হিসেবে সুলতানের উপদেষ্টাও ছিলেন। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ্ একজন ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সাধু, দরবেশ ও সুফি ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তার রাজত্বকালে সাদত, উলামা ও মাশায়েখদের মতো হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীরাও সরকার থেকে বৃত্তি পেতেন। তাঁর দরবেশ প্রীতির একটি গল্প প্রচলিত আছে। ফিরোজ শাহ্ যখন একডালা দুর্গ অবরোধ করে রেখেছিলেন, তখন ‘রাজা বিয়াবানি’ নামে এক মস্ত দরবেশ মৃত্যুবরণ করেন। ইলিয়াস শাহ্ এ খবর শুনে ছদ্মবেশে দুর্গের বাইরে যান এবং দরবেশের দাফনে অংশ নেন। ফেরার সময় ইলিয়াস তাঁর শত্রু, ফিরোজ শাহের শিবিরে প্রবেশ করেন। ফিরোজ তাঁকে চিনতে পারেননি। বরং দরবেশ ভেবে আপ্যায়ন করান। ইলিয়াস দুর্গে ফেরার পর ফিরোজ শাহ্ আসল ঘটনা জানতে পারেন। ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন সালিম তাঁর ‘রিয়াজ-উস-সালাতীন’ গ্রন্থে এ ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। ইলিয়াস শাহ স্থাপত্য শিল্পের উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি হাজিপুর শহরের প্রতিষ্ঠা করেন। সুফি সাধক আলা-উল-হকের সম্মানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এ ছাড়া দিল্লির শামসী হাম্মামখানার অনুকরণে ফিরোজাবাদে একটি হাম্মামখানা নির্মাণ করেন। অভিজ্ঞ কূটনীতিকের মতো ইলিয়াস শাহ সমগ্র বাংলাকে একত্রীকরণের সময় ও সুযোগ তাঁর অনুকূলে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন। তিনি সুশাসন প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং তা প্রবর্তন করে বাংলার স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার জন্য জনসমর্থন লাভে প্রয়াসী হন। স্থানীয় জনগণকে উদারভাবে সুযোগ সুবিধা দিয়ে তিনি তাঁর শাসনকে গণশাসনের রূপ দেন। তিনি বর্ণ, গোত্র ও ধর্ম নির্বিশেষে যোগ্য লোকদের চাকরিতে নিয়োগ লাভের সুযোগ দেন। [২] তিনিই সর্বপ্রথম স্থানীয় লোকদেরকে অধিক সংখ্যায় সৈন্যবাহিনীতে নিয়োগ করেন। ইনশাহ-ই-মাহরু থেকে জানা যায় যে, খান, মালিক, উমারা, সদর, আকাবির ও মারিফগণ সামরিক ও বেসামরিক শাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এদের মধ্যে খান, মালিক ও আমীরগণ ছিলেন জায়গির ভূমির অধিকারী ও রাজ্যের পদস্থ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। তাদের কেউ কেউ হয়ত মন্ত্রী হিসেবে সুলতানের উপদেষ্টাও ছিলেন। এভাবে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ বাংলার স্বাধীন সালতানাতকে সুদৃঢ় করেন। এ সালতানাত প্রায় দুই’শ বছর টিকে ছিল। ষোল বছর গৌরবোজ্জ্বল রাজত্বের পর ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। ১৩৫৮ সালে সুলতান শামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহ মৃত্যুবরণ করলে তার সুযোগ্য পুত্র সিকান্দার শাহ বাংলার শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তিনি বাংলার মুসলিম শাসনের ইতিহাসে দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন। প্রায় ৩৫ বছরের শাসনে তিনি বাংলার মুসলিম শাসনকে মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনামলে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক বাংলা জয়ের জন্য অভিযান পরিচালনা করেন। সোনারগাঁওয়ের প্রাক্তন শাসক ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের জামাতা পারস্য বংশোদ্ভূত ব্যক্তি জাফর খান ফারস বাংলা থেকে পালিয়ে দিল্লি পৌঁছান। ফিরোজ শাহ তাকে বাংলার ন্যায়সঙ্গত শাসক বলে ঘোষণা করেন। জাফর খানের আহ্বানে ১৩৫৯ সালে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ৮০,০০০ অশ্বারোহী, ৪৭০ হস্তী ও বড় আকারের পদাতিক বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত সেনাবাহিনীকে ব্যক্তিগতভাবে নেতৃত্ব দেন। পিতার মত সিকান্দার শাহও একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। ফিরোজ শাহ প্রাসাদ অবরোধ করেন। শেষ পর্যন্ত ফিরোজ শাহ বাংলা থেকে তার বাহিনী ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হন এবং সিকান্দার শাহের সাথে সন্ধি করেন। এভাবে ফিরোজ শাহের দ্বিতীয় অভিযানও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর ফলে সিকান্দার শাহ স্বাধীনভাবে দীর্ঘদিন ধরে নির্বিঘেœ বাংলাদেশ শাসন করেন। [৩] [৪] সুলতান সিকান্দার শাহ করিতকর্মা ও প্রজাবৎসল শাসক ছিলেন। তিনি দায়ী, সুফি ও দরবেশদের শ্রদ্ধা করতেন। তার শাসনামলের উজ্জ্বল কীর্তি হযরত পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত আদিনা মসজিদ। প্রায় দশ বছর ধরে [১৩৭৪-৮৪] এই মসজিদ নির্মিত হয়। এটি বাঙালিদের কাছে পৃথিবীর আশ্চর্যতম ইমারত ছিল। পাথর ও পোড়ামাটির নকশা করা এই বৃহৎ মসজিদটি বাংলায় মুসলিম স্থাপত্যের অনবদ্য দৃষ্টান্ত। এছাড়া ১৩৬৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে সিকান্দার শাহ দিনাজপুরের দেবকোটে মোল্লা আতার দরগাহে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। তার রাজদরবারে বহু সুফি, দরবেশের সমাগম ঘটে। এদের মধ্যে শেখ আলাউল হক ও শেখ সরফউদ্দীন ইয়াহিয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। [৫] প্রজাহিতৈষী ও সুশাসক সুলতান সিকান্দার শাহের শেষ জীবন সুন্দর ছিলো না। সিকান্দার শাহের দুই স্ত্রী ছিল। প্রথম স্ত্রীর ছিলো ১৭ জন পুত্র আর দ্বিতীয় স্ত্রীর একজন পুত্র ছিলো। সেই পুত্র গিয়াসউদ্দীন বিমাতার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। গিয়াস উদ্দিন শাসনকার্যে ও যুদ্ধে পারদর্শী ছিলেন। সেই কারণে সিকান্দার শাহ তাকেই পরবর্তী শাসক নিযুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার বিমাতা তার জীবন অতিষ্ঠ করে তুললেন ও সিকান্দার শাহকে তার প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। অবশেষে গিয়াস উদ্দিন রাজধানী পাণ্ডুয়া ত্যাগ করে সোনারগাঁয়ে চলে যান। সেখানে তিনি শক্তিশালী বাহিনী গঠন করে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সিকান্দার শাহও একটি সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে পুত্রের মোকাবিলা করলেন। ১৩৯৩ খ্রিস্টাব্দে গোয়ালপাড়ায় পিতা-পুত্রের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ আরম্ভ হয় এবং যুদ্ধে সুলতান সিকান্দার শাহ পুত্র গিয়াসউদ্দীনের কাছে পরাজিত হন। [৬] গিয়াস উদ্দিন ‘আজম শাহ’ নামধারণ করে বাংলার শাসনক্ষমতায় আসে। তিনি ১৩৮৯ থেকে ১৪১০ সাল পর্যন্ত শাসন করেছেন। রাজ্যের বিস্তৃতির চেয়ে তিনি রাজ্যকে সুদৃঢ় করার দিকে বেশি মনোযোগ দেন। তিনি তাঁর রাজত্বের প্রথম দিকে শুধু কামরূপে অভিযান করে তা দখল করেন এবং কামরূপের উপর কয়েক বছর তাঁর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন। গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ তাঁর আদর্শ চরিত্র, শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা এবং সুশাসনের জন্য যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। আইনের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল। তার বিরুদ্ধে সাধারণ নাগরিকরা কাজীর কাছে মামলা করার অধিকার রাখতো। তার বিরুদ্ধে বলার মতো অভিযোগ হলো তিনি তার পিতা ও সৎ ভাইদের শাস্তি দিয়েছেন।[৭] সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ নিজে বিদ্বান ও কবি ছিলেন। তিনি বিদ্বান লোকদের খুব সমাদর করতেন। মাঝে মাঝে তিনি আরবী ও ফারসি ভাষায় কবিতা লিখতেন। পারস্যের বিখ্যাত কবি হাফিজের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ ছিল। একবার তিনি হাফিজের নিকট কবিতার একটি চরণ লিখে পাঠান এবং কবিতাটিকে পূর্ণ করার জন্য কবিকে অনুরোধ জানান। তিনি তাঁকে বাংলায় আসার আমন্ত্রণও জানান। হাফিজ দ্বিতীয় চরণটি রচনা করে কবিতাটি পূর্ণ করে পাঠান। তিনি সুলতানের নিকট একটি গজলও লিখে পাঠান। গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ বাংলা সাহিত্যের উন্নতির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অবদান রাখেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁর বিখ্যাত কাব্য ‘ইউসুফ জোলেখা’ রচনা করেন। গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ তাঁর পিতা (সুলতান সিকান্দার শাহ) ও পিতামহের (সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ) মতোই আলেম ও সুফিদের অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতেন। তিনি বিদ্বান ও ধার্মিকদের উদার পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন। তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে শেখ আলাউল হক ও নূর কুতুব আলম খুবই বিখ্যাত ছিলেন। তিনি বিহারের শেখ মুজাফফর শামস বলখীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। মুজাফফর শামস বলখীর সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ ছিল। তিনি পবিত্র মক্কা ও মদীনার তীর্থযাত্রীদের সব ধরনের সাহায্য দিতেন। তিনি একাধিকবার মক্কা ও মদীনা শহরের অধিবাসীদের জন্য প্রচুর উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। তিনি ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের জন্য বাংলায় প্রচুর মাদরাসা ও খানকাহ স্থাপন করেছেন। এছাড়া মক্কার উম্মে হানির ফটকে একটি এবং মদীনার ‘বাব আল-সালামে’র (শান্তির দ্বার) নিকটে অপর একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করান। এ প্রতিষ্ঠান দুটির জন্য তিনি প্রয়োজনীয় অর্থও প্রদান করেন। এ দুটি মাদ্রাসা ‘গিয়াসিয়া মাদ্রাসা’ নামে পরিচিত। তিনি আরাফায় পানির বন্দোবস্তের জন্য ত্রিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা প্রেরণ করেন। বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য গিয়াসউদ্দীন বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি বেশ কয়েকবার মক্কা ও মদীনায় দূত পাঠিয়েছিলেন। গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ জৌনপুরের সুলতান খাজা জাহানের নিকট দূত প্রেরণ করেন এবং উপঢৌকন স্বরূপ তাঁকে কয়েকটি হাতিও পাঠান। তিনি সমসাময়িক চীন স¤্রাট ইয়ংলোর সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি ১৪০৫, ১৪০৮ ও ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দে চীনে দূত পাঠিয়েছিলেন। চীন স¤্রাট দূতদেরকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানান এবং প্রতিদানে তিনিও বাংলার সুলতানের নিকট দূত ও উপঢৌকন প্রেরণ করেন। [৮] গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের রাজত্বকালের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো যে, তাঁর সময় হিন্দুরা তাঁর দরবারে বেশ প্রাধান্য লাভ করেছিল। এর ফলে ভাতুরিয়ার বর্তমান দিনাজপুরের জমিদার রাজা গণেশের উত্থান ঘটে। ১৪১০ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের মৃত্যু হয়। ধারণা করা হয় রাজা গণেশ সুলতানকে হত্যা করে। রাজা গণেশ পনের শতকের প্রারম্ভে ইলিয়াস শাহী বংশের দুর্বল সুলতানের নিকট থেকে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে বাংলার রাজা হন। গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের রাজত্বকালের শেষের দিকে ফিরোজাবাদের (পাণ্ডুয়া) ইলিয়াস শাহী রাজদরবারে যেসকল অমাত্য প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন, গণেশ তাদের অন্যতম। তিনি সাইফুদ্দীন হামজাহ শাহ, শিহাবউদ্দীন বায়েজীদ শাহ ও আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহের রাজত্বকালে বাংলার রাজনীতিতে ষড়যন্ত্রমূলক ভূমিকা পালন করেন এবং কম করে হলেও চার বছর (১৪১০-১৪১৪) রাজ্যের প্রকৃত ক্ষমতা তার হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। তিনি রাজ্যের শাসন কর্তৃত্ব কুক্ষিগত করেন এবং বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক গোলযোগের সুযোগে আলাউদ্দীন ফিরোজ শাহকে হত্যা করে ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সিংহাসন দখল করে। [৯]

গণেশের উত্থান গণেশের বাংলার সিংহাসনে আরোহণ দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও গভীর ষড়যন্ত্রের ফল। গণেশ ও তার সমমনা হিন্দু সামন্তবর্গ বাংলায় মুসলমানদের শাসন মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেননি। যদিও বিগত দুই শতকের ইতিহাসে মুসলিম শাসকগণ কর্তৃক অমুসলমানদের প্রতি কোনো প্রকার উৎপীড়নের নজির পাওয়া যায় না, তারপরও মুসলিম শাসনকে তারা হিন্দুজাতির জন্য চরম অবমাননাকর মনে করতো। তাই গণেশ সিংহাসনে আরোহণ করার পর মুসলিম নির্মূলে আত্মনিয়োগ করেন। এভাবে মুসলমানদের প্রতি তার বহুদিনের পুঞ্জীভূত আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ইসলাম প্রচারক শায়খ বদরে ইসলাম এবং তাঁর পুত্র ফয়জে ইসলাম গণেশকে অবনত মস্তকে সালাম না করার কারণে তিনি উভয়কে হত্যা করেন। শুধু তাই নয়, বহু মুসলমান ওলি দরবেশ, মনীষী, পণ্ডিত ও শাস্ত্রবিদকে গণেশ নির্মমভাবে হত্যা করেন। মুসলিম নিধনের এ লোমহর্ষক কাহিনী শ্রবণ করে শায়খ নূর কুতুবে আলম মর্মাহত হন এবং জৌনপুরের গভর্নর সুলতান ইব্রাহীম শর্কিকে বাংলায় আগমনের আহ্বান জানান। সুলতান ইব্রাহীম বিরাট বাহিনীসহ বাংলা অভিমুখে যাত্রা করে ফিরোজপুরে শিবির স্থাপন করেন। রাজা গণেশ জানতে পেরে ভীত হয়ে কুতুবে আলমের শরণাপন্ন হন এবং নিজেকে মুসলিম দাবি করেন। শুধু তাই নয় সে ক্ষমতা ছেড়ে দেয় তার পুত্র যদুর কাছে। যদু ইতোমধ্যে মুসলিম হয়ে জালাল উদ্দিন নাম ধারণ করেছিল। শায়খ নূর কুতুবে আলম গণেশের এই চালাকি ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি সুলতান ইবরাহীম শর্কিকে ফেরত যাওয়ার অনুরোধ করেছেন। ইবরাহীম শর্কি মনঃক্ষুণœ হয়ে ফেরত চলে যান। তাঁর প্রত্যাবর্তনের পরপরই গণেশ জালালউদ্দীনের নিকট থেকে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন। গণেশ সিংহাসন পুনরুদ্ধার করার পর সুবর্ণধেনু অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ধর্মচ্যুত যদুর শুদ্ধীকরণ ক্রিয়া সম্পাদন করে। অর্থাৎ একটি নির্মিত সুবর্ণধেনুর মুখের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে তার মল ত্যাগের দ্বার দিয়ে হিন্দুশাস্ত্রের বিশেষ ধর্মীয় পদ্ধতিতে বহির্গত হওয়াই হলো শুদ্ধীকরণ পদ্ধতি। এই শুদ্ধীকরণ অনুষ্ঠানের পর গণেশ দেশ থেকে মুসলমানদের মূলোৎপাটনের কাজ পুনরায় শুরু করে। সে পূর্বের চেয়ে অধিকরত হিং¯্রতার সাথে মুসলিম হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। সে কুতুবে আলমের পুত্র শায়খ আনওয়ারকে হত্যা করে ও পৌত্র শায়খ জাহিদকে নির্বাসনে পাঠায়। যদু প্রকৃত অর্থেই মুসলিম হয়েছিলেন। তিনি তার পিতার অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। অবশেষে গণহত্যার অভিযোগে যদু ওরফে জালালুদ্দিন তার পিতা গণেশের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। [১০]

তথ্যসূত্র ১. Developing cultures: case studies / Peter L. Berger / P. 158 ২. ইলিয়াস শাহ / বাংলাপিডিয়া / https://bit.ly/2jVfEke / অ্যাকসেস ইন ২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ 3. The Delhi Sultanate / R.C. Majumdar / P. 202, 203 4. Far East Kingdoms / The History File/ https://bit.ly/3rYL0EQ / অ্যাকসেস ইন ৬ জানুয়ারি ২০২১ ৫. সিকান্দর শাহ / বাংলাপিডিয়া / https://bit.ly/3hOzBmn / অ্যাকসেস ইন ৬ জানুয়ারি ২০২১ ৬. Far East Kingdoms, South Asia / https://bit.ly/38Vvzpz / অ্যাকসেস ইন ১৮ জানুয়ারি ২০২১ ৭. পর্যটকদের আকর্ষণ গিয়াস উদ্দিন আযম শাহর সমাধি / মনিরুজ্জামান / দৈনিক প্রথম আলো / ১৬ জানুয়ারি, ২০১৭ ৮. গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ / বাংলাপিডিয়া / https://bit.ly/3bREJ8e অ্যাকসেস ইন ১৮ জানুয়ারি ২০২১ ৯. আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা / মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান / কামিয়াব প্রকাশন / পৃ. ৩৪-৩৫ ১০. বাংলার ইতিহাস / ড. আবদুল করিম / বড়াল প্রকাশনী / পৃ. ৮০-৮২

লেখক : গবেষক ও ইতিহাসবিদ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির