post

অরাজনৈতিক সিটি নির্বাচন নিয়ে রাজনীতি

০৬ মে ২০১৫

সামছুল আরেফীন#

Raznityইস্যু দিয়ে ইস্যু চাপা দেয়া আওয়ামীলীগের পুরানো কৌশল। নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করে জনগনের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়াটাও নতুন কিছু নয়। ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধের মধ্যেই অনেকটা নাটকীয়ভাবেই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন সবার সামনে চলে আসে। বিশেষ করে দ্বি-খন্ডিত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয় খুবই স্বল্পতম সময়ে। ২০ দল যখন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ‘প্রহসনের নির্বাচন’ বলে একটি নতুন জাতীয় নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের ঘোষনা আসলো। আন্দোলনরত ২০ দলের পক্ষ থেকেও ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি’ স্বাপেক্ষে নির্বাচনের যাওয়া ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখানো হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে মনোনয়নপত্র জমাও দেয়া হয়। ১লা এপ্রিল দুপুরে যখন এ লেখা লিখছি, তখন নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রার্থী বাছাই চলছিল। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা, ঢাকা মহানগর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল আওয়াল মিন্টুর মনোয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। তবে তার পক্ষে আপিল করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিনেও অনেকে মনোনয়ন জমা দিতে পারেননি বলে অভিযোগ করেছেন। মনোনয়ন দাখিলের পর অনেক প্রার্থীকে হয়রানী করা হচ্ছে, তাদের বাড়ীতে হানা দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে ২০ দল। আতংক বিরাজ করছে ভোটারদের মধ্যেও। সব মিলিয়ে একটি নির্বাচনের জন্য যেমন উৎসবমুখর পরিবেশ দরকার হয়, তা এখনও নগরবাসীর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হবে কিনা, হলেও তা ৫ জানুয়ারি’র নির্বাচনের মতো হয় কিনা, তা নিয়ে এখনও সংশয় কাটছে না। যদিও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন মূলত স্থানীয় সরকারের নির্বাচন, তবুও এই নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক তৎপরতার কমতি নেই। দীর্ঘ ৮৫ দিনেরও বেশি সময় ধরে যে রাজনৈতিক আন্দোলন চলছিল, সেই আন্দোলন কিছুটা হলেও ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। আইনি বিধান অনুযায়ী এই নির্বাচনের সঙ্গে রাজনীতির সংশ্লেষ থাকার কথা নয়। তদসত্ত্বেও এরশাদ আমল থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব-সংঘাত কম হয়নি। আমাদের মূল আলোচনা আসন্ন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে। দুটি নগরীতে নির্বাচন হলেও নির্বাচন হবে ৩টি সিটি কর্পোরেশনের। যেহেতু ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ করা হয়েছে, সেহেতু ঢাকাবাসীরা দু’জন মেয়র এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলরদের পেতে যাচ্ছেন। এই নির্বাচনে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলই কম-বেশি উৎসাহ প্রদর্শন করেছে। অনেকেই ভেবেছিলেন দল হিসেবে বিএনপি এই নির্বাচন সম্পর্কে নির্বিকার থাকবে অথবা অংশগ্রহণ করবে না। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সাবেক মেয়র মনজুরুল আলমকে সমর্থন জ্ঞাপন করে বিএনপি নীতিগতভাবে এই নির্বাচনে জড়িয়ে গেছে। ঢাকার ক্ষেত্রে এই লেখা পর্যন্ত জানা যায়নি বিএনপি কোন কোন প্রার্থীকে সমর্থন করবে। আওয়ামী লীগ অনেক আগেই তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে কোন কোন মেয়র প্রার্থীকে তারা সমর্থন দিচ্ছে তা ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং এদিক থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা বেশ কিছুটা এগিয়ে আছে। সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা নিয়ে বিএনপির অনেকের মধ্যেই দ্বিধাদ্বন্ধ কাজ করছে। কারণ দুই নগরীতেই তাদের শত শত কর্মী কারারুদ্ধ। বহু কর্মী মামলার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে নিজ বাসগৃহে কিংবা মহল্লায় থাকতে পারছেন না। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদসহ অনেকে গুম বা নিখোঁজের শিকার হয়েছেন বলে সারা দেশেই আতংকবোধ রয়েছে। অনেকে পুলিশের দ্বারা পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে পা কেটে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের পাশাপাশি পঙ্গু হাসপাতালের চিত্রটিও কম ভয়াবহ নয়। এ কারণেই আশংকা, নিজ পছন্দের প্রার্থীদের প্রতি তারা দায়িত্ব পালন করতে পারবেন কিনা? এছাড়া ঢাকায় বিএনপি ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় অফিসসহ মহানগর ও থানা পর্যায়ের কার্যালয় তালাবদ্ধ রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক কর্মকান্ডও চালাতে পারছে না সরকার বিরোধী জোটের নেতাকর্মীরা। আগামী ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য ঢাকা (উত্তর-দক্ষিণ) ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দিলেও এখনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে আশাবাদী নয় ২০ দলীয় জোট। তারা বলছে, সর্বশেষ ফরিদপুর ও চাদপুরে অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে যেভাবে সরকারি দল প্রশাসনের সামনের ভোট ডাকাতির মহোৎসব চালিয়েছে তাতে এই তিনটি নির্বাচনেও তারা ভোট জালিয়াতি করবে। সব দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে সরকার ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) কে কিছু শর্ত দেবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। যা এর আগে শত নাগরিক কমিটির একটা প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছিল। ১ এপ্রিল বিকেলে বিএনপির প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে যাওয়ার কথা রয়েছে। ভোট জালিয়াতির বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে বিদেশিদের কাছে সরকার বলতো, দেখুন আমরা আগেই বলেছিলাম বিএনপি নির্বাচন চায় না, ওরা জঙ্গিবাদী। তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনকে ভয় পায় না। সিটি নির্বাচনেই তা দেখা যাবে। তিনি বলেন, সিটি নির্বাচনে ৫ জানুয়ারির পুনরাবৃত্তি করে সরকার যদি আবারও সেই খেলায় মেতে ওঠে তাহলে এই খেলাই হবে শেষ খেলা। অনেক খেলা হয়েছে, আশা করি, আর সেই খেলা খেলতে যাবেন না। সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হতে হবে। কোন প্রকার হয়রানি করলে বা সভা সমাবেশ, মিছিলে বাধা দিলে পরিণতি যা হবার তাই হবে বলেও সরকারকে হুঁশিয়ার করেন তিনি। তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের দিনেও আতঙ্ক তাড়া করেছে বিরোধী সমর্থক প্রার্থীদের। গ্রেপ্তার আতঙ্কের কারণে বেশির ভাগ ২০ দল সমর্থিত প্রার্থীই সরাসরি মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাননি। কেউ আইনজীবী কেউ-বা পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বিরোধী জোটের সম্ভাব্য প্রার্থীদের বেশির ভাগই একাধিক মামলার আসামি। দীর্ঘদিন আত্মগোপন ও নিরাপদ অবস্থানে থেকেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তারা। সরকার হঠাৎ করে সিটি নির্বাচনের উদ্যোগ নিলে ভোটের লড়াইয়ে থাকার ইতিবাচন সিদ্ধান্ত নেয় ২০ দল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে বিরোধী নেতারা মাঠে নামতে পারছেন না। প্রার্থীসহ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশি হয়রানি বন্ধ, প্রচার-প্রচারণায় সমান সুযোগ দেয়াসহ কয়েকটি দাবি জানিয়েছেন বিরোধী জোটের নেতারা। সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রাম জেলা কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে বলা হয়েছে, স্বাগত জানালেও এ নির্বাচন নিয়ে রয়েছে আমাদের কিছু উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। বর্তমানে সারা দেশে পেট্রোল বোমা হামলা ও বিচার বহির্ভূত হত্যাসহ নানা ধরনের সহিংসতা ঘটছে। মূলত ৫ জানুয়ারির পর থেকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে সরকার এ আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে ক্রমাগতভাবে কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে, বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের নামে বহু মামলা দায়ের করেছে, লাখ লাখ ব্যক্তিকে আসামী করেছে এবং অনেককেই গ্রেফতার করেছে। এর ফলে অনেক সম্ভাব্য প্রার্থীই মামলার কারণে কারারুদ্ধ বা পলাতক রয়েছেন। এ অবস্থায় সম্ভাব্য সকল প্রার্থীর অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টি তথা লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। জানা গেছে, সরকারের আচরণের উপরই নির্ভর করছে আসন্ন তিন সিটি নির্বাচনে ২০ দলীয় জোটের নির্বাচনে অংশ নেয়ার উদ্যোগ। যদি সরকার বিএনপি ও জোটের প্রার্থীদের হয়রানি করে এবং সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কোনো ভূমিকা না রাখে সেক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমের নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্তও আসতে পারে। সেটি হতে পারে প্রার্থীতা চূড়ান্ত হবার পর থেকেই। তবে এ নির্বাচনটি সরকারী জোট ও সরকার বিরোধী জোট উভয়ের জন্যই একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করছে। বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কিনা এটি আবারো সবার সামনে প্রমাণের সুযোগ আসছে। আর সেটাই প্রমাণিত হবে ২৮ এপ্রিল। এ নির্বাচনে কে জিতলো আর কে হারলো, তার চাইতে বড় বিষয় হবে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সরকারের ভুমিকা কী ছিল। লেখক : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির