মহানবী (সা) কুরআনের আলোকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা কায়েম করেছেন। কুরআন প্রবর্তিত বিধানই ছিল রাসূল (সা)-এর আদর্শের মূল ভিত্তি। তিনি এমন কোনো কথা বলেননি বা এমন কোনো কাজ করেননি, যার পক্ষে কুরআনের সমর্থন নেই। আর কুরআন হলো আল্লাহর বাণী। তাই নবীজি (সা)-এর আদর্শ মানেই কুরআনের আদর্শ। মানবজীবনের প্রতিটি বিষয়ে আল্লাহর রাসূল (সা) দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক জীবন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। প্রাত্যহিক জীবন নির্বাহ করার জন্য মানুষের জীবনের বিরাট অংশ দখল করে আছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। চাষাবাদ, গৃহস্থালি, কৃষি, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কর, রাজস্ব ইত্যাদি কর্মকাণ্ড ছাড়া জীবন পরিচালনা যে সম্ভব নয়, আমরা তা অনুধাবন করি। তাই তো প্রত্যেক নবী-রাসূলের জীবনে হয় মেষ পালন, কৃষিকাজ বা ব্যবসায় ব্যাপৃত থাকতে হয়েছে। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সা) ছেলেবেলায় মেষ চরানো থেকে পরিণত জীবনে এসে ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। সাহাবিদের অধিকাংশ ছিলেন ব্যবসায়ী। ফলে মানুষের অর্থনৈতিক জীবন পরিচালনায় আদর্শ বিধান কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে প্রবর্তিত হয়েছে। মহানবী (সা) প্রবর্তিত এবং কুরআন নির্দেশিত সেই মহান আদর্শই এ প্রবন্ধের আলোচনার বিষয়।
সম্পদের মালিকানার বিধান
মহানবী (সা) মদিনায় যখন রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন, তখন তিনি একটি টেকসই এবং সুবিন্যস্ত অর্থ প্রশাসনও কায়েম করেছিলেন। আর এই অর্থব্যবস্থার মৌলিক দর্শন হলো, পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদের মালিকানা আল্লাহর। তাই অর্থ-সম্পদ যেই অর্জন করুক না কেন, তাতে তার অধিকার থাকলেও সেই অধিকার প্রযোজ্য হবে আল্লাহর নির্দেশনার আলোকে। মানুষ কেবল সম্পদের আমানতদার হিসেবে আল্লাহর সম্পদ উপার্জন, সংরক্ষণ এবং ভোগ করবে। কারণ আল্লাহ মানুষের কল্যাণেই পৃথিবীর সম্পদ সৃষ্টি করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন।’-(সূরা বাকারা : ২৯)। সম্পদ উপার্জনের নীতিমালাও আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।’-(সূরা বাকারা : ১৮৮)। সম্পদ অর্জন এবং ব্যয় সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সা) আমাদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি এক হাদিসে বলেন, ‘কিয়ামতের দিন পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসিত না হওয়া পর্যন্ত মানুষের পা একবিন্দু নড়তে পারবে না। এর একটি হলো তার সম্পদ সম্পর্কে, সে তা কোথা থেকে উপার্জন করেছে এবং কোন পথে ব্যয় করেছে।’ (সুনানে তিরমিজি)
অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা
রাসূল (সা) প্রবর্তিত অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সুবিচার কায়েম করা। এ বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ হলো, মানুষ বৈধভাবে অর্থ উপার্জনের অধিকার লাভ করবে, তেমনি তা অর্জনে শোষণ ও জুলুমের পথ পরিহার করবে। অর্থাৎ অর্থ উপার্জন ও ব্যয় হবে ন্যায়নিষ্ঠ, শোষণ ও জুলুমমুক্ত। ইসলামের অর্থ ব্যবস্থাপনা হবে সুবিচারপূর্ণ। মানুষ অন্যের অকল্যাণ হবে এ কারণে সম্পদ জমিয়ে রাখতে পারবে না। আর তা হবে অবিচারের শামিল। তাই আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।’-(সূরা তাওবা : ৩৪)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘আল্লাহর পথে ব্যয় করো, আর নিজেদের হাতেই নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না। মানুষের প্রতি অনুগ্রহ-ইহসান করো। আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন।’-(সূরা বাকারা : ১৯৫)। ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অপচয়, অপব্যয়ের মতো অনৈতিক কাজ নিষিদ্ধ, যা সুবিচারের পরিপন্থী। আল্লাহ বলেন, ‘অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আন’আম : ১৪১)
বঞ্চিত ও অভাবীদের অধিকার সংরক্ষণ
রাসূল (সা) মদিনা রাষ্ট্রে যে অর্থ ব্যবস্থাপনা চালু করেছিলেন, তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল বঞ্চিত, অভাবী ও এতিমের অধিকার প্রতিষ্ঠা। সম্পদশালীদের সম্পদে আল্লাহ সম্পদহীন ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘এবং তাদের (ধনীদের) ধন-সম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতের অধিকার রয়েছে’ (সূরা যারিয়াত : ১৯)। অভাবী ও ভিক্ষুকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামি অর্থনৈতিক নির্দেশনা অনন্য। আল্লাহ বলেন, ‘ভিক্ষাপ্রার্থীকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিয়ো না’ (সূরা দোহা : ৯)। ক্ষুধার্ত মানুষের প্রতি নজর দিতে নির্দেশনা দিয়েছেন মহানবী (সা)। তিনি বলেছেন, ‘সর্বোত্তম সাদাকা এই যে, তুমি কোনো ক্ষুধার্তকে তৃপ্তিসহকারে খাওয়াবে’ (মিশকাত)। এভাবে মহানবী (সা) মদিনায় কায়েম করেছিলেন এমন একটি সমাজ যেখানে একসময় জাকাত গ্রহণ করার লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। নবীজি (সা)-এর সাহাবিরাও আল্লাহর নির্দেশনার আলোকে এমন অর্থব্যবস্থার নজির স্থাপন করেছিলেন, যার ফলে মদিনা একটি সুখী ও কল্যাণময় রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল।
সম্পদ সুষম বণ্টনের নিশ্চয়তা
দুনিয়ার তাবৎ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সুষম বণ্টনের স্লোগান তুললেও প্রতিটি ব্যবস্থা শোষণ, পীড়ন এবং লুণ্ঠনের পথকেই সুগম করেছে। এসব (পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র) ব্যবস্থায় ধনী ক্রমান্বয়ে ধনী হয়েছে। গরিবরা দিন দিন আরও খারাপ অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। এর ফলে দুনিয়ায় প্রতিনিয়ত চলছে মানুষের সংগ্রাম ও অধিকার আদায়ের রক্তাক্ত লড়াই। অথচ ইসলাম সুষম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। রাসূল (সা) প্রবর্তিত ব্যবস্থায় অর্থ-সম্পদ শুধু ধনীদের হাতে পুঞ্জীভূত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং তা সম্পদহীন মানুষের কাছে প্রবাহিত হওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘ধন-সম্পদ যেন শুধু তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তশালী তাদের মধ্যেই কেবল পুঞ্জীভূত না হয়’ (সূরা হাশর : ৭)। মহান আল্লাহ মানুষকে অনুগ্রহ করে যে ধন-সম্পদ দান করেন, তা যেন সবার কাছে যেতে পারে, অভাবী ও প্রার্থীর চাহিদা পূরণ করতে পারে, তার নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তাদের সম্পদে হক নির্ধারিত রয়েছে প্রার্থী-অপ্রার্থী (যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিত) নির্বিশেষে সকলের’ (সূরা মাআরিজ : ২৪-২৫)। সম্পদ প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, ‘আমিই বণ্টন করে রেখেছি তাদের জীবিকা পার্থিব জীবনে তাদের মধ্যে এবং তাদের একজনকে অন্যজনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি, যাতে একে অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারে’ (সূরা যুখরুফ : ৩২)। সম্পদকে ত্বরিত তার হকদারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য মহানবী (সা) ছিলেন সবচেয়ে অগ্রসর। এক হাদিসে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে যদি ওহুদ পরিমাণ স্বর্ণ থাকত, তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার (বণ্টনের) পর তার কিছু অংশ আমার কাছে থেকে যাক, তা আমি ভালো মনে করতাম না।’ (সহিহ বুখারি)
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা, ন্যায়নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা এবং যাবতীয় অনৈতিকতা ও অপরাধ বন্ধ করা ছিল রাসূল (সা) প্রতিষ্ঠিত অর্থব্যবস্থার অন্যতম লক্ষ্য। এজন্য ইসলামে মজুদদারি, প্রতারণা, ওজনে কম দেয়া, মিথ্যা শপথ করে খারাপ জিনিস বিক্রি, কাউকে ঠকানো এবং অর্থ পাচার বা সম্পদ আত্মসাৎ সবকিছু নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এসব কাজ থেকে বিরত থাকা অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা সুবিচারের জন্য অপরিহার্য। অন্যের অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করাকে আল্লাহ তা’আলা কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না (আত্মসাৎ করো না)’ (সূরা আন-নিসা : ২৯)। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা) বলেন, ‘আর যে তোমার আমানত (সম্পদ) আত্মসাৎ করেছে, তুমি তার আমানত আত্মসাৎ করো না’ (আবু দাউদ)। অর্থ ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতা সৃষ্টি এবং সম্পদকে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার জন্য মজুদদারির আশ্রয় নেয়া হয়। এটা ইসলামে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। রাসূল (সা) বলেন, ‘যে ব্যক্তি খাদ্যশস্য মজুদ (গুদামজাত) করে রাখে, সে অপরাধী’ (মুজামুল কাবির)। অন্যত্র রাসূল (সা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যশস্য মজুদ করে রাখে, আল্লাহ তা’আলা তার ওপর দরিদ্রতা চাপিয়ে দেন।’-(আবু দাউদ)। ছলচাতুরী বা প্রতারণা করা অথবা কাউকে ঠকিয়ে অর্থ উপার্জন করাকে ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক সুব্যবস্থাপনার জন্য এসব কাজ খুবই ক্ষতিকর। রাসূল (সা) বলেন, ‘এমন কিছু মানুষ আছে, যারা আল্লাহর বান্দাদের সম্পদে অন্যায়ভাবে ছলচাতুরীর (প্রতারণা) মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করে। কিয়ামতের দিন তাদের জন্য জাহান্নাম অবধারি’ (সহিহ বুখারি)। ব্যবসা-বাণিজ্যের বেলায় ওজনে কম দিয়ে কাউকে ঠকানো অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘হে আমার কওম! মাপ ও ওজন পূর্ণ করো ইনসাফের সাথে এবং মানুষকে তার পণ্য কম দিয়ো না’ (সূরা হুদ : ৮৫)। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা) বলেন, ‘মন্দ পরিণাম তাদের জন্য, যারা মাপে বা ওজনে কম দেয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)
কেন্দ্রীয় অর্থভান্ডার হিসেবে বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠা
মদিনা রাষ্ট্র কায়েমের পর মহানবী (সা) যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন, তার অন্যতম হলো বায়তুলমাল। মদিনা রাষ্ট্র পরিচালনার খরচ নির্বাহ, রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যয় পূরণ এবং জনগণের কল্যাণ সাধনের জন্য বায়তুলমাল ছিল রাষ্ট্রীয় কোষাগার। ‘মসজিদে নববীকে কেন্দ্র করেই মূলত বায়তুলমালসহ রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হতো’ (ইসলামি বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ, ১৯৯৪, খণ্ড- ১৫, পৃ. ৫৯৫)। উল্লেখ্য, বায়তুলমালের সকল কার্যক্রম রাসূল (সা.)-এর সরাসরি তদারকিতে পরিচালিত হতো।’-(প্রাগুক্ত, পৃ. ১১২)। বায়তুলমালের আয়ের উৎসসমূহ ছিল- (ক) জাকাত, (খ) উশর, (গ) সদাকাতুল ফিতর, (ঘ) ওয়াকফ, (ঙ) গণিমত, (চ) আল-ফাই, (ছ) মুক্তিপণ, (জ) উপহারসামগ্রী, (ঝ) জিযিয়া, (ঞ) খারাজ, (ট) নাওয়াইব, (ঠ) আমওয়াল আল-ফাদিলা, (ড) দান-খয়রাত, (ঠ) কর্জ। (ইকোনমিক অ্যান্ড ফিসক্যাল সিস্টেম ডিউরিং দ্য লাইফ অব মুহাম্মদ সা.)। নিচে বায়তুলমালের উৎসগুলোর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো :
ক. জাকাত : ইসলামি রাষ্ট্রের রাজস্বের প্রধান উৎস জাকাত। নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের ওপর জাকাত আদায় করা ফরজ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও সৎকর্ম করে এবং সালাত কায়েম করে ও জাকাত প্রদান করে, তাদের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে পুরস্কার’ (সূরা বাকারা : ২৭৭)। জাকাতের খাত সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘জাকাত পাবে ফকির, মিসকিন, জাকাত আদায় ও হেফাজতে নিয়োজিত কর্মচারী, অমুসলিমদের মন জয় করার জন্য, দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তরা, আল্লাহর পথে এবং মুসাফির’ (সূরা তাওবা : ৬০)। মদিনা রাষ্ট্রে জাকাত বাবদ যে অর্থ-সম্পদ আদায় হতো নবীজি (সা)-এর নির্দেশে তা সংরক্ষণ এবং ব্যয়ের কেন্দ্রীয়ভাবে দায়িত্ব পালন করতেন যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা)’ (আল-কুরআনে অর্থনীতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯০, পৃ. ৫৬২)। এখানে উল্লেখ্য, জাকাতের আটটি খাতের মধ্যে ছয়টি খাতই দারিদ্র্য দূরীকরণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। নবীযুগে, খলিফাদের আমলে এবং মুসলিম শাসনের সময় দেশ ও সমাজের দরিদ্র মানুষের কল্যাণে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাতের অর্থ ব্যয় করা হতো। কেন্দ্রীয় কোষাগার বা বায়তুলমালে জাকাতের অর্থ জমা হতো এবং তা প্রয়োজনমতো নির্দিষ্ট খাতে বিলি-বণ্টন করা হতো। মানুষের (বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের) অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাতে জাকাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
খ. উশর : জমির ফসলের জাকাত হলো উশর। মুসলমানদের অধিকারভুক্ত জমিতে উৎপন্ন ফসলের জাকাতই মূলত উশর। বৃষ্টিতে সিক্ত ভূমি হতে ফসলের এক-দশমাংশ ও যেসব জমিতে অন্যভাবে সেচ দিয়ে জমি সিক্ত করতে হয়, তা থেকে উৎপন্ন ফসলের বিশ ভাগের একভাগ ফসল উশর হিসেবে আদায় করা হতো। উশর সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যা উপার্জন করো এবং আমি যা ভূমি হতে তোমাদের উৎপাদন করে দিই, তার মধ্যে যা উৎকৃষ্ট, তা ব্যয় কর এবং এর নিকৃষ্ট বস্তু ব্যয়ের সংকল্প কর না, অথচ তোমরা তা গ্রহণ করার যোগ্য নও, যদি না তোমরা চোখ বন্ধ করে থাক। তবে জেনে রাখ যে, আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত’ (সূরা বাকারা : ২৬৭)। উল্লেখ্য যে, মদিনা রাষ্ট্রের প্রধান উৎপন্ন দ্রব্য ছিল খেজুর। মৌসুমে খেজুর বৃক্ষের উৎপন্ন খেজুরের উশর আদায় করে কেন্দ্রীয়ভাবে জমা করা হতো।
গ. সাদাকাতুল ফিতর : রমজান মাসের সিয়াম সাধনার পর ঈদের দিন বিত্তশালীদের ওপর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নির্দিষ্ট হারে যে বিশেষ দানের নির্দেশ রয়েছে, তাকে ‘সাদাকাতুল ফিতর’ বলে। জাকাতের ক্ষেত্র সীমিত হলেও সাদাকাতুল ফিতরের ক্ষেত্র অনেকটা বিস্তৃত। প্রত্যেক বিত্তবান ব্যক্তিকে তার নিজের, পরিবারবর্গ ও পোষ্যদের পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হয়। সাদাকাতুল ফিতর ব্যক্তিগত দান হলেও মদিনা রাষ্ট্রে তা আদায় করে দরিদ্র মানুষের মাঝে বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করে মহানবী (সা) মুসলিম দাস ও স্বাধীন ব্যক্তি, নর ও নারী এবং বালক ও বৃদ্ধের ওপর সাদাকাতুল ফিতর এক সা (প্রায় সাড়ে তিন কেজি) খেজুর কিংবা এক সা যব নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তিনি এটাও নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, লোকেরা (ঈদের) নামাজে যাওয়ার পূর্বেই যেন তা আদায় করে দেয়।
ঘ, ওয়াকফ : মানবকল্যাণের লক্ষ্যে প্রবর্তিত ইসলামের এক অনন্য বিধানের নাম ওয়াকফ। ইসলামি পরিভাষায় কোনো বস্তু বা সম্পদ আল্লাহর মালিকানায় রেখে তার উৎপাদন বা উপযোগকে দরিদ্রদের মাঝে কিংবা যেকোনো জনহিতকর খাতে দান করাকে ওয়াকফ বলা হয়। এটি হচ্ছে সমাজসেবা ও জনকল্যাণমূলক একটি স্থায়ী ব্যবস্থা। ইমাম আবু হানিফা (রহ)-এর মতে, ‘কোনো বস্তুকে ওয়াকফকারীর মালিকানায় রেখে এর উৎপাদন ও উপযোগকে গরিবদের মধ্যে কিংবা যেকোনো কল্যাণজনক খাতে দান করাকে ওয়াকফ বলে।’ দাতার ইন্তেকালের পরও তার ওয়াকফ মানবকল্যাণে বহাল থাকে। এ ব্যাপারে মহানবী (সা) বলেন, ‘মানুষের ইন্তেকালের পর তিনটি আমল ছাড়া তার সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়। তিনটি আমল হলো, (১) অব্যাহত দান বা সদকায়ে জারিয়া, (২) কল্যাণধর্মী ইলম (জ্ঞান) বা এমন ইলম যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় এবং (৩) এমন নেক সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে।’- (সহিহ মুসলিম)। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে অদ্যাবধি মুসলিম জাতি আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের লক্ষ্যে এই সুন্দরতম ব্যবস্থা অনুসরণ করে আসছে। স্বয়ং মহানবী (সা) ওয়াকফ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। খোলাফায়ে রাশেদাসহ অধিকাংশ সাহাবা থেকে ওয়াকফ করার বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রখ্যাত সাহাবি ইবনে উমর (রা) বলেন, উমর (রা) খয়বর যুদ্ধে একখণ্ড জমি লাভ করেছিলেন। তিনি উক্ত জমি সম্পর্কে মহানবী (সা)-এর নিকট জানতে চান যে, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি খয়বরে একখণ্ড জমি লাভ করেছি, যা অপেক্ষা উত্তম জমি আর পাইনি। আপনি আমাকে এ ব্যাপারে কী পরামর্শ দেন?’ জবাবে মহানবী (সা) বলেন, ‘তুমি চাইলে এর মালিকানা নিজের কাছে রেখে দেবে এবং এর উৎপাদিত পণ্য সাদাকা করে দেবে।’ তখন উমর (রা) তা সাদাকা করে দিয়ে বললেন, ‘এই জমি বিক্রি করা যাবে না, দান করা যাবে না, কেউ এর উত্তরাধিকারী হবে না, বরং এর মাধ্যমে গরিব, নিকটাত্মীয়, দাসমুক্তিকরণ, আল্লাহর পথে, মুসাফিরদের জন্য এবং অতিথি সেবায় ব্যয় করা যাবে। এই সম্পদ যিনি তত্ত্বাবধান করবেন, তিনি ন্যায়সঙ্গতভাবে তা থেকে পারিশ্রমিক নিতে পারবেন। কিন্তু মূলধন সরবরাহকারী (মালিক) হিসেবে খেতে পারবেন না।’ (সহিহ বুখারি)। পরবর্তীকালে এসব সম্পদের আয় বায়তুলমালে জমা হতো। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ওয়াকফ হলো ‘মসজিদুল কোবা’। আর দ্বিতীয় উদাহরণ হলো ‘মসজিদে নববী’।
ঙ. আল-গণিমত : গণিমত বলতে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বোঝায়। পারিভাষিক অর্থে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত পরাজিত অমুসলিমদের নিকট থেকে যে সকল অস্ত্রশস্ত্র, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ হস্তগত করা হতো, তা সবই গণিমতের সম্পদ হিসেবে গণ্য হতো। মদিনা রাষ্ট্রের সম্প্রসারণকালে এটি ছিল রাষ্ট্রীয় রাজস্বের উল্লেখযোগ্য উৎস। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু পরিত্যক্ত যে সমস্ত সম্পদ হস্তগত হতো, সেগুলো একত্র করে পাঁচ ভাগের এক ভাগ মহানবী (সা) রাষ্ট্রের জন্য রেখে অবশিষ্ট চার ভাগ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের মাঝে দায়িত্ব ও পদমর্যাদা অনুযায়ী বণ্টন করে দিতেন। গণিমতের মাল তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেন সাহাবি মুআইকিব ইবনে আবু ফাতিমা (রা)। মহানবী (সা)-এর জীবদ্দশায় সেনা সদস্যদের সুনির্দিষ্ট বেতন-ভাতা না থাকায় গণিমত সামগ্রী প্রদানের মাধ্যমে কার্যত বেতন-ভাতা দেওয়া হতো। এর মাধ্যমে মুসলিম সৈনিকগণ প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি নিতে পারতেন এবং জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহনের সুযোগ লাভ করতেন। এ প্রসঙ্গে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আরও জেনে রাখ, যুদ্ধে যা তোমরা লাভ কর তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর রাসূলের, রাসূলের স্বজনদের, এতিমদের, মিসকিনদের এবং পথচারীদের যদি তোমরা ঈমান রাখ এবং তাতে যা মীমাংসার দিন আমি আমার বান্দার প্রতি নাজিল করেছিলাম, যেদিন দু‘দল পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিল এবং আল্লাহ সর্ববিষয়ে শক্তিমান।’-(সূরা আনফাল : ৪১)। মহানবী (সা) তাঁর জীবদ্দশায় গণিমতের মালের যে অংশ গ্রহণ করতেন, তা তিনি ব্যক্তিগতভাবে না নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে গ্রহণ করতেন এবং তা জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করতেন।
চ. আল-ফাই : মহানবী (সা) প্রবর্তিত রাষ্ট্রের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল আল-ফাই। মুসলিম সেনাবাহিনীর প্রতি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অমুসলিমরা তাদের জমি জমা, বাড়িঘর, ধন-সম্পদ ইত্যাদি ফেলে পালিয়ে যেত এবং যা কার্যত যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়াই মুসলমানদের দখলে এসে যেত। এরূপ সম্পদকে আল-ফাই বলা হয়। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তাদের (ইহুদিদের) নিকট হতে তাঁর রাসূলকে যে ফাই দিয়েছেন, তার জন্য তোমরা ঘোড়া কিংবা উটে চড়ে যুদ্ধ করনি। আল্লাহ তো যার ওপর ইচ্ছা তার রাসূলকে কর্তৃত্ব দান করেন; আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’-(সূরা হাশর : ৬)। ফাই গণিমতের সম্পদের মতো নয়। গণিমতের মতো তা সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করা যায় না।
ছ. মুক্তিপণ : কোনো যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয় অর্জনের পর প্রায়ই অনেকে যুদ্ধবন্দী হয়ে আসত। এদের মধ্যকার খুব কমসংখ্যক লোককে দাস বানানো হতো। মহানবী (সা) কখনো কোনো কিছুর বিনিময় ব্যতিরেকে আবার কখনো মুক্তিপণ গ্রহণপূর্বক যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দিতেন। যুদ্ধবন্দীদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকতেন। ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদরে অনেক শত্রুকে বন্দী করা হয়। অবশেষে মুক্তিপণ আদায় করে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। মুক্তিপণের এই অর্থ বা সম্পদ বায়তুলমালে জমা দেয়া হয়। মুক্তিপণ মদিনা রাষ্ট্রের বায়তুলমালের আয়ের অন্যতম একটি উৎস ছিল।
জ. উপহারসামগ্রী : মহানবী (সা) মদিনা রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন। তাঁর সম্মানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা মদিনায় নানারকম উপহারসামগ্রী পাঠাতেন। উক্ত উপহারসামগ্রী মহানবী (সা) নিজে ব্যবহার করতেন না। তিনি তা বায়তুলমালে জমা করে দিতেন। ফলে উপহারসামগ্রী রাজস্বের একটি উৎস ছিল। মুসলিম খলিফাগণও তাঁদের কাছে আসা উপহারসামগ্রী বায়তুলমালে জমা করে দিতেন।
ঝ. জিযিয়া : ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিমরা জীবন ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তার জন্য যে নির্দিষ্ট কর প্রদান করে থাকে তাকে জিযিয়া বলা হয়। মদিনা রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমদের ওপর জিযিয়া আরোপ করা হয়েছিল। জিযিয়া মূলত নিরাপত্তামূলক সামরিক কর হিসেবে বিবেচিত হতো। তখন সামরিক বাহিনীতে মুসলিম নাগরিকদের যোগদান করা ছিল বাধ্যতামূলক। পক্ষান্তরে অমুসলিম নাগরিকদের সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক ছিল না। তাই তাদের ওপর জিযিয়া কর ধার্য করা হতো। কুরআনে জিযিয়া করের ব্যাপারে উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যাদের প্রতি কিতাব নাজিল হয়েছে, তাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে না ও শেষ দিনেও নয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন, তা হারাম গণ্য করে না এবং সত্য দ্বীন অনুসরণ করে না, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে স্বহস্তে জিযিয়া না দেয়।’-(সূরা তাওবা : ২৯)
জিযিয়া ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাস করার কারণে অমুসলিমদের ওপর ধার্যকৃত খাজনা বিবেচিত হতো না। কেননা দরিদ্র অমুসলিমদের নিকট থেকে জিযিয়া নেয়া হতো না। এছাড়া শিশু, মহিলা, পঙ্গু, অসহায়, ধর্মপ্রচারক প্রমুখের নিকট হতেও জিযিয়া নেয়া হতো না। সামর্থ্যবান পুরুষদের নিকট হতে প্রতি বছর ১ দিনার জিযিয়া আদায় করা হতো। উল্লেখ্য, যেসব অমুসলিম সামরিক বাহিনীতে যোগদান করত, তাদের জিযিয়া প্রদানের প্রয়োজন ছিল না। জিযিয়া হতে যে অর্থ আয় হতো, তা বায়তুলমালে জমা হতো এবং সামরিক বাহিনীর কল্যাণে ব্যয় করা হতো।
ঞ. খারাজ : খারাজ অমুসলিমদের নিকট থেকে আদায় করা ভূমি কর। মদিনা রাষ্ট্রের রাজস্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল খারাজ বা ভূমি কর। অমুসলিম কৃষিজীবী নাগরিকদের ওপর রাসূল (সা) এই কর ধার্য করেন। শরঈ দৃষ্টিতে কোনো জমি খারাজি হওয়ার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তার ওপর খারাজ বা ভূমিকর ধার্য করা জরুরি শর্ত। খয়বর বিজয়ের পর মহানবী (সা) সর্বপ্রথম সেখানকার ইহুদিদের ওপর খারাজ ধার্য করেন। উল্লেখ্য, ইহুদিরা ইসলামি রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার করে ও খারাজ প্রদানের প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি ভূমি চাষাবাদের অধিকার লাভ করে। ইসলামি রাষ্ট্র ও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মাঝে আলোচনাসাপেক্ষে খারাজের অংশের পরিমাণ নির্ধারণ করা হতো। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র মালিকপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হতো। খারাজের যাবতীয় অর্থ মহানবী (সা) সৈনিকদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন।
ট. নাওয়াইব : রাষ্ট্রের জরুরি প্রয়োজনে ব্যয় নির্বাহের জন্য বিত্তবান মুসলিমদের নিকট থেকে যে লেভি গ্রহণ করা হয়, তাকে নাওয়াইব বলা হয়। যেমন, তাবুক যুদ্ধের পূর্বে মহানবী (সা) ধনী সাহাবাগণের নিকট থেকে এ ধরনের দান গ্রহণ করেছিলেন। মহানবী (সা)-এর ঘোষণার পর মুসলমানরা তাতে তাৎক্ষণিক সাড়া দেন। ফলে অল্প সময়ের ব্যবধানে সম্পদের স্তূপ গড়ে ওঠে। আবু বকর (রা) সর্বস্ব নিয়ে আসেন এবং তা পরিমাণে ছিল ৪০০০ (চার হাজার) দিরহাম। উমর (রা) তার অর্ধেক সম্পদ নিয়ে আসেন। উসমান (রা) সেনাবাহিনীর এক-তৃতীয়াংশের ব্যয়ভার বহন করেন। বালাযুরি বলেন, উসমান (রা)-এর সম্পদের পরিমাণ ছিল সত্তর হাজার দিরহাম।
ঠ. আমওয়াল আল-ফাদিলা : উত্তরাধিকারী বিহীন কোনো মুসলিমের সম্পত্তি বা ওয়ারিসবিহীন সম্পত্তি, ধর্মত্যাগী ও পলাতক ব্যক্তির সম্পত্তি থেকে প্রচুর অর্থ আহরণ হতো। আর তা বায়তুলমালে জমা হতো। এগুলো আমওয়াল আল-ফাদিলা নামে পরিচিত।
ড. দান-খয়রাত : প্রয়োজনের দাবি মেটাতে সময়মতো দান-খয়রাতকে উৎসাহিত করেছে ইসলাম। এটি মদিনা রাষ্ট্রের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল। উল্লেখ্য, মহানবী (সা) একবার নও-মুসলিমদের সাহায্যের জন্য আহ্বান জানালে সবাই তাদের সাহায্যে ছুটে আসেন। কেউ খাদ্য, কেউ কাপড় এবং কেউ কেউ বিপুল অর্থ নিয়ে আসেন। দান-খয়রাত জাকাতের মতো অপরিহার্য নয়। তারপরও ইসলাম তা অব্যাহত রাখার জন্য বিশেষভাবে অনুপ্রেরণা দেয়। দান-খয়রাত উত্তোলন ও বণ্টন উভয়বিধ কাজ মহানবী (সা.) নিজ হাতেই করতেন। বায়তুলমালে দান-খয়রাত খাতে যে বিপুল অর্থ আদায় হতো, তা যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা) তত্ত্বাবধান করতেন।
ঢ. কর্জ বা ধার : মহানবী (সা) মক্কা বিজয়ের পর প্রয়োজনে কর্জ বা ঋণ গ্রহণ করেন। হাওয়াজিন যুদ্ধের পূর্বে মহানবী (সা) আবদুল্লাহ ইবনে রবীয়ার নিকট থেকে ৩০,০০০ (ত্রিশ হাজার) দিরহাম ঋণ গ্রহণ করেন। অপর একটি সূত্রে ২০,০০০ (বিশ হাজার) দিরহামের কথা উল্লেখ আছে। হুনাইনের যুদ্ধের সময় মহানবী (সা) সাফওয়ান নামক এক অমুসলিমের নিকট থেকে ৫০টি বর্ম ধার করেন। এই কর্জ, ধার বা ঋণ বায়তুলমালের সাময়িক উৎস হিসেবে বিবেচিত হতো।
এভাবে অর্থব্যবস্থার অনেক আদর্শ উৎস মহানবী (সা) প্রচলন করেন। এগুলো রাষ্ট্রীয় ব্যয়ভার বহন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। মুসলিম সমাজ ও দেশের কল্যাণে নবীজি (সা)-এর আদর্শ অর্থব্যবস্থা অনন্য উচ্চতা লাভ করেছিল। মুসলিম জীবনের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে রাসূল (সা) প্রবর্তিত আদর্শ ব্যবস্থাই হোক চলার পাথেয়।
লেখক : ব্যাংকার, প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক
আপনার মন্তব্য লিখুন