post

আত্মশুদ্ধি ও আত্মগঠনের মাস মাহে রমজান

মোবারক হোসাইন

০১ মার্চ ২০১৮
মাহে রমজান সিয়াম সাধনা ও তাকওয়ার মাস, আত্মশুদ্ধি ও আত্মগঠনের মাস, কল্যাণ ও বরকতের মাস, রহমত ও মাগফিরাত এবং জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি লাভের মাস। মহান আল্লাহ এ মাসটিকে বহু ফজিলত ও মর্যাদা দিয়ে অভিষিক্ত করেছেন, ফলে এ মাস সারা বিশ্বের মুসলমানদের সুদীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যায়। মুমিন বান্দার জীবনে বছরের মধ্যে রমজান মাসটিই এক দুর্লভ সুযোগ এনে দেয়। এ কারণেই বলা হয়, পবিত্র রমজান মাস হচ্ছে ইবাদত, পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত, জিকির, শোকর ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক বিশেষ মৌসুম। একদা নবী করিম (সা) মাহে রমজানের প্রাক্কালে বলেন, “রমজান মাস আগতপ্রায়, এ মাস বড়ই বরকতের মাস, আল্লাহ তাআলা বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করেন এবং খাস রহমত বর্ষণ করেন, গুনাহ মাফ করেন ও দোয়া কবুল করেন।” রোজাদারের মর্যাদা রোজাদারের মর্যাদা সম্পর্কে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, “মানুষ যত প্রকার নেক কাজ করে আমি তার সওয়াব ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দিই। কিন্তু রোজা এই নিয়মের বাইরে। রোজার সওয়াব একই নিয়মে সীমাবদ্ধ বা সীমিত নয়। রোজার সওয়াবের পুরস্কার স্বয়ং আমি প্রদান করব। অথবা আমি নিজেই রোজার সওয়াবের পুরস্কার।” এ প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে উল্লেখ হয়েছে, যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো নফল কাজ করল সে যেন অন্য মাসে একটি ফরজই আদায় করল। আর যে এ মাসে কোনো ফরজ আদায় করল সে যেন অন্য মাসে ৭০টি ফরজ আদায় করল। নবী করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন, “যারা রমজান মাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রোজা পালন করেছে, তারা ওই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে, যেদিন তাদের মাতা তাদের নিষ্পাপরূপে প্রসব করেছিলেন।” আগুন যেমন স্বর্ণকে নিখাদ করে দেয় তেমনি রমজান মাস মুমিনদের অন্তর থেকে ষড়রিপু ধ্বংস করে পরিশুদ্ধ করে তোলে। আত্মগঠন করার মৌসুম হিসেবে পরিগণিত হয়। এটি শোরগোলের নয়, নত-নম্র হওয়ার; পিছু হটার নয়, অগ্রসর হওয়ার এবং কদর্য হওয়ার নয়, স্বচ্ছ হওয়ার মৌসুম। এই মহিমান্বিত মাসের রয়েছে অনেক মর্যাদা। কুরআন অধ্যয়নের মাধ্যমে সহজ-সরল পথকে বেছে নিতে হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “আমাদের সরল পথ দেখাও, সেই সব লোকের পথ, যাদের তুমি নেয়ামত দান করেছ। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাজিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।” (সূরা ফাতিহা : ৬-৭) রমজান যেখানে ঐকান্তিক প্রয়াস, প্রচেষ্টা ও ইবাদতের মাস, তারা একে মনে করেছে আলসেমি ও নির্লিপ্ততার মাস। রমজান যেখানে সিয়াম ও কৃচ্ছ্র সাধনার মাস, কিছু লোক একে মনে করছে খাবার টেবিল ও খাদ্যদ্রব্যে নান্দনিক ও বৈচিত্র্যের মাস। রমজান যেখানে তুচ্ছ বিষয় থেকে ঊর্ধ্বে ওঠা, জিকির, নামাজ ও কুরআন তেলাওয়াত ও কাতর প্রার্থনায় সংখ্যা ও গুণগত দিক থেকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শের অনুসরণ করার মাস। আল্লাহ ওই ব্যক্তির ওপর রহম করেন যে নিজের কথাকে সুন্দর করে, রোজাকে সংরক্ষণ করে, অন্যকে নিষ্ঠার সঙ্গে আহার করায় এবং উত্তমরূপে সালাত আদায় করে। এটা করে একমাত্র নবী (সা.)-এর ওয়াদার প্রতি বিশ্বাস রেখে। তিনি বলেন, “জান্নাতের মধ্যে কিছু কক্ষ রয়েছে, যার বাইরের অংশ ভেতর থেকে এবং ভেতরের অংশ বাইরে থেকে দেখা যায়। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, কক্ষগুলো কাদের জন্য হবে হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি নরম কথা বলে, অন্ন দান করে ও লোকেরা যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন সালাতে রত হয়- তার জন্য।” (আহমাদ, তিরমিজি) রমজানের গুরুত্ব রমজান হলো কুরআন নাজিলের মাস : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন : “রমজান মাস, এতে নাজিল হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের দিশারি এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী।” (সূরা বাকারা : ১৮৫) প্রতি বছর রমজান মাসে জিবরাইল রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন এবং রাসূল (সা.)ও তাকে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন। আর জীবনের শেষ রমজানে আল্লাহর রাসূল দু’বার পূর্ণ কুরআন তেলাওয়াত করেছেন। সহিহ মুসলিমের হাদিস দ্বারা এটা প্রমাণিত। এ মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয়, জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : “রামাদান মাসে এলে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয় জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৮০০) এ মাসে রয়েছে লাইলাতুল কদরের ন্যায় বরকতময় রজনী : মহান আল্লাহ বলেন, “লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাত্রে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে, তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিময় এ রজনী, ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত।” (সূরা আল-কদর : ৩-৫) এ মাস দোয়া কবুলের মাস : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “(রামাদানের) প্রতিদিন ও রাতে (জাহান্নাম থেকে) আল্লাহর কাছে বহু বান্দা মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাদের প্রত্যেক বান্দার দোয়া কবুল হয়ে থাকে (যা সে রামাদান মাসে করে থাকে)।’’ (সহিহ সনদে ইমাম আহমদ কতৃক বর্ণিত, হাদিস নং ৭৪৫০) রোজার পুরস্কার আল্লাহ স্বয়ং নিজে প্রদান করবেন : হাদিসে কুদসিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ বলেন, “বনি আদমের সকল আমল তার জন্য, অবশ্য রোজার কথা আলাদা, কেননা রোজা আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার দিব।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৮০৫) রোজা রাখা গোনাহের কাফফারাস্বরূপ এবং ক্ষমা লাভের কারণ : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রামাদান মাসে রোজা রাখবে, তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৯১০) রোজা জান্নাত লাভের পথ : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে যাকে বলা হয় ‘রাইয়ান’। কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে রোজাদারগণ প্রবেশ করবে। অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না... রোজাদারগণ প্রবেশ করলে এ দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আর কেউ সেখান দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৭৯৭) সিয়াম রোজাদারের জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : “কিয়ামতের দিন রোজা এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, ‘হে রব! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির কামনা হতে বাধা দিয়েছি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন।’ কুরআন বলবে, ‘আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুমাতে দেইনি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। ফলে এ দু’য়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।” (মুসনাদ, হাদিস নং ৬৬২৬) রোজা জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তিলাভের ঢাল : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- “যে বান্দাহ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোজা রাখে আল্লাহ তার মাঝে এবং জাহান্নামের মাঝে ৭০ বছরের দূরত্ব তৈরি করেন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৮৯৪) এ মাসের রোজা রাখা একাধারে বছরের দশ মাস রোজা রাখার সমান : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “রামাদানের রোজা দশ মাসের রোজার সমতুল্য, ছয় রোজা দু’মাসের রোজার সমান, এ যেন সারা বছরের রোজা।” রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের সুগন্ধির চেয়েও উত্তম : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ তার শপথ! রোজাদারের মুখের গন্ধ কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে মিসকের চেয়েও সুগন্ধিময় হবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৮৯৪) রোজা ইহকাল-পরকালে সুখ-শান্তিলাভের উপায় : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “রোজাদারের জন্য দুটো খুশির সময় রয়েছে। একটি হলো ইফতারের সময় এবং অন্যটি স্বীয় প্রভু আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার সময়।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৮০৫) রমজানের ফজিলত এক. রোজাদারকে ইফতার করানো : সহীহ সনদে তিরমিজি ও আহমাদ বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করায়, সে উক্ত রোজাদারের সাওয়াবের কোনরূপ ঘাটতি না করেই তার সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে।” (সুনান তিরমিজি, হাদিস নং ৮০৭) দুই. এ মাস সবর বা সহিষ্ণুতার মাস : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত এ হাদিসে রামাদান মাসকে সবরের মাস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “সবরের মাসে রোজা রাখা ও প্রত্যেক মাসে তিন দিন রোজা রাখা অন্তরের অস্থিরতা দূর করে থাকে।” (আলবানি বলেন, হাসান-সহিহ হাদিস নং ১৭০৩৩) তিন. আল্লাহর রাস্তায় বেশি বেশি দান ও সদকা করা : আল্লাহর রাস্তায় দান-সদকা ও ব্যয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। ইমাম বুখারি ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেন, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল মানুষের চেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন। আর রামাদান মাসে যখন জিবরিল তার সাথে সাক্ষাতে মিলিত হতেন তখন তিনি আরো দানশীল হয়ে উঠতেন...। জিবরিলের সাক্ষাতে তিনি বেগবান বায়ুর চেয়েও বেশি দানশীল হয়ে উঠতেন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৩০৪৮) চার. বেশি বেশি দোয়া, জিকির এবং ইস্তেগফার করা : রামাদানের দিনগুলোতে পুরো সময়টাই ফজিলতময়। তাই সকলের উচিত এ বরকতময় সময়ের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা- দোয়া, জিকির ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে। কেননা রামাদান মাস দোয়া কবুল হওয়ার খুবই উপযোগী সময়। পাঁচ. কিয়ামু রামাদান বা রামাদানের তারাবিহের ফজিলত : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে রামাদানের তারাবিহ আদায় করল তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।” ছয়. লাইলাতুল কদরের বিশেষ ফজিলত : আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “আমরা লাইলাতুল কদরে তা (কুরআন) নাজিল করেছি, আপনি কি জানেন লাইলাতুল কাদর কী? লাইলাতুল কাদর হাজার মাসের চেয়ে উত্তম, এতে ফিরেশতাকুল ও জিবরিল তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে সকল বিষয় নিয়ে অবতীর্ণ হয়, ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত; ইহা শান্তিময়।” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে লাইলাতুল কদর জেগে ইবাদত করল তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।” আত্মশুদ্ধি আত্মশুদ্ধি শব্দের অর্থ হলো, নিজের আত্মাকে গুনাহ থেকে পরিশুদ্ধ করা। আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে দেহ ও আত্মা এ দুয়ের সমন্বয়ে সৃষ্টি করেছেন। দেহের রয়েছে দুটি অবস্থা : সুস্থতা ও অসুস্থতা। ঠিক তেমনি আত্মারও রয়েছে সুস্থতা ও অসুস্থতা। দেহ অসুস্থ হলে যেমনি চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে সুস্থ করার চেষ্টা চালাতে হয়, তেমনিভাবে আত্মা রোগাক্রান্ত হলে আত্মিক চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে সুস্থ বা শুদ্ধ করে তুলতে হয়। আর একেই বলে আত্মশুদ্ধি বা তাযকিয়াতুন্নাফস। আত্মশুদ্ধি দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আত্মশুদ্ধি ছাড়া মানুষের ঈমান, ইসলাম কখনো বিশুদ্ধ বা পরিপূর্ণ হয় না। আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেন, “আল্লাহ তাআলা তোমাদের বাহ্যিক রূপের দিকে তাকাবেন না; বরং তোমাদের অন্তরের দিকে তাকাবেন।” (সহীহ আল মুসলিম- ৪৬৫০) আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন, “সে দিন সম্পদ এবং সন্তান কোন উপকারে আসবে না, কেবল যে ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে পরিচ্ছন্ন অন্তর নিয়ে আসবে উহাই কাজে লাগবে।” (সূরা আশ শু’আরা : ৮৮-৮৯) হাদিস শরিফে আছে “প্রত্যেক মানবদেহে একটি গোশতের টুকরা রয়েছে, যখন উহা ঠিক হয়ে যায়; তখন সমস্ত দেহ সুস্থ-সঠিক হয়ে যায়। আর যখন উহা বিগড়িয়ে যায়, তখন সমস্ত দেহ বরবাদ হয়ে যায়। জেনে রাখ উহা হলো কলব।” উল্লিখিত কুরআন ও হাদিসের আলোকে বোঝা যায় যে, আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা একান্ত কর্তব্য ও জরুরি।” মানুষের দু’টি দিক রয়েছে- বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ। ইসলাম যেমন মানুষের বাহ্যিক দিকটি সুন্দর করতে চায় তেমনি অভ্যন্তরীণ দিকটিও কলুষমুক্ত সুন্দর করতে চায়। বাহ্যিক দিকের দু’টি অংশ-দেহ ও পোশাক। দেহের পরিশুদ্ধি : অজু, গোসল ও তাইমুম দ্বারা বাহ্যিক পবিত্রতা অর্জিত হয়। হালাল রিজিক দ্বারা রক্ত-মাংস পবিত্র হয়। নিষিদ্ধ ও বেহুদা চিন্তা- কথা-কাজ পরিহার, চোখ-জিহ্বা-লজ্জাস্থানের হিফাজত, বেশি কাঁদা, কম হাসা, কম কথা বলা এর মাধ্যমে দেহ পরিশুদ্ধ হবে। পোশাকের পরিশুদ্ধি : পোশাক হতে হবে পবিত্র, পরিচ্ছন্ন, হালাল পথে অর্জিত, শালীন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সুন্নত অনুযায়ী পোশাক। অপরদিকে অভ্যন্তরীণ দিকে রয়েছে তিনটি অংশ রূহ, কলব, নাফ্স। রূহের পরিশুদ্ধি : কুপ্রবৃত্তি বর্জন করে রূহকে (নিজেকে) সর্বদা আল্লাহর দিকে রুজু রাখলে রূহ আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হয়, আল্লাহর নূরে আলোকিত হয়, ফলে রূহ পরিশুদ্ধ হয়ে আল্লাহর মহব্বত লাভের যোগ্য হয়। কলবের পরিশুদ্ধি : আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমেই কলব পরিশুদ্ধ হয়। আল্লাহকে সর্বদা হাজির-নাজির জানা, সার্বক্ষণিক জিকির, কুরআন তেলাওয়াত, মৃত্যুর স্মরণ, তওবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে কলব পরিশুদ্ধ করতে হয়। নাফসের পরিশুদ্ধি : আত্মার জন্য ভালো গুণাবলি। যেমন- ইখলাস, তাওয়াক্কুল, সবর, শোকর ইত্যাদি অর্জন এবং খারাপ দিকসমূহ। যেমন- গর্ব-অহঙ্কার, মিথ্যাচার, প্রদর্শনেচ্ছা ইত্যাদি বর্জনের মাধ্যমে অন্তকরণ পরিশুদ্ধির জন্য সাধনা করতে হবে। পরিশুদ্ধির জন্য সব অংশই পরিশুদ্ধ করতে হবে। আবার ব্যক্তি জীবনের ৫টি ক্ষেত্রে তাযকিয়া বা পরিশুদ্ধি অর্জন করতে হবে, যথা- ঈমান ও আকিদার পরিশুদ্ধি : ঈমান হতে হবে- শিরকমুক্ত, কুফরমুক্ত, নিফাকমুক্ত, জাহিলিয়াতমুক্ত এবং তাগুতমুক্ত। সাহাবা (রা)-গণের নমুনায় ঈমান ও আকিদা পোষণ করতে হবে। সর্বদা এর ওপর অবিচল থাকতে হবে। ইলমের পরিশুদ্ধি : ইলম হতে হবে-সব ধরনের কুসংস্কার ও বিভ্রান্তিমুক্ত। কুরআন, হাদিস এবং নিয়মিত ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়নের মাধ্যমে জাহিরি ও বাতিনি ইলমের পরিশুদ্ধি করতে হবে। আমলের পরিশুদ্ধি : আমল হতে হবে- কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আল্লাহর হুকুম ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তরিকা অনুযায়ী। রিয়া, জাহিলিয়াত ও বিদআতমুক্ত। সাহাবা (রা)-গণের নমুনায় আমলকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। আখলাকের পরিশুদ্ধি : মুয়ামিলাত ও আখলাক হতে হবে এমন, যা আল্লাহর দরবারে পছন্দনীয়, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শে, সাহাবা (রা)-গণের নমুনায়, মানবজাতির জন্য উত্তম শিক্ষণীয় আদর্শ হবে। অর্থনৈতিক পরিশুদ্ধি : আয়-রোজগার এবং ব্যয় হতে হবে আল্লাহর দরবারে পছন্দনীয় হালাল পথে। হারাম ও সন্দেহযুক্ত পন্থা সর্বদা বর্জন করতে হবে। আত্মশুদ্ধি কেন : মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনের সূরা শামসের ৯-১০ নং আয়াতে ঘোষণা করেন- “যে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে সে সফলকাম। যে নিজের আত্মাকে কলুষিত করে সে ব্যর্থ।” সূরা নাজিআতে আল্লাহ বলেন- যে ব্যক্তি প্রভুর সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করে এবং নফসকে কুপ্রবণতা থেকে নিবৃত্ত রেখেছে , তার ঠিকানা হচ্ছে জান্নাত। (সূরা নাযিআত : ৪০-৪১) আত্মশুদ্ধির পথ: -সহীহ দ্বীনি ইলম চর্চা -হালাল উপার্জন -যথার্থভাবে ফরজসমূহ আদায় -আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি ও সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ -মৃত্যু ও আখিরাতে চিন্তা -সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ -কুরআন বুঝে পড়া -সর্বাবস্থায় ও সকল কাজে সুন্নাতের অনুসরণ -সুন্দর চরিত্র ও আচরণ -সাহাবিদের জীবনী অধ্যয়ন -বেশি বেশি দোয়া, তওবা ও ইস্তেগফার -সৎ গুণাবলি অর্জন (ইখলাস, সততা, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা, বিনয় নম্রতা, অন্যের উপকার, দয়ার অনুভূতি, অন্যের দোষত্রুটি মার্জনা, সৎ কথা বলা, ওয়াদা পালন, আমানত আদায়, অল্পে তুষ্ট, অপরের কল্যাণ কামনা করা, অন্যের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়া) -অসৎ গুণাবলি বর্জন (লোভ-লালসা, আত্মপ্রীতি, গর্ব-অহঙ্কার, মিথ্যাচার, প্রদর্শনেচ্ছা, জাগতিক স্বার্থ চিন্তা, গিবত, পরনিন্দা, চোগলখুরি, রাগ, অনর্থক কথা, আত্মশুদ্ধি কিভাবে হওয়া উচিত? নিম্নে তার কিছু পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো : -সর্বপ্রথম কাজ হলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পাবন্দির সহিত আদায় করা। -বেশি পরিমাণে আল্লাহর জিকির করার দ্বারাও আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা যায়। -বেশি বেশি কুরআন শরিফ তেলাওয়াত করা। -মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করা। রাসূল (সা.) বলেছেন, যে দৈনিক বিশবার মউতের কথা স্মরণ করবে তাকে শহীদি দরজা দেয়া হবে। -গিবত করা থেকে বিরত থাকা -হিংসা-অহঙ্কার না করা -নজরকে হেফাজত করা (বেগানা নারী দেখা, খারাপ জিনিস দেখা ইত্যাদি) -কম কথা বলা ইত্যাদি। মাহে রমজানের তাকওয়াই হতে পারে আত্মশুদ্ধি ও আত্মগঠনের পাথেয় আত্মশুদ্ধি ও আত্মগঠনের সবচেয়ে বড় সুযোগ তৈরি হয় পবিত্র রমজানের এই মৌসুমেই। রমজানের গুরুত্ব ও ফজিলত উপলব্ধি ও পালনের মাধ্যমেই নিজেদের আত্মার পবিত্রতা অর্জন ও ব্যক্তি গঠন করা সম্ভব। সিয়াম ছাড়া অন্য ইবাদত তাকওয়া সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলোর মধ্যে যেমন নামাজের মাধ্যমে মানুষকে দেখানোর সুযোগ রয়েছে, জাকাতের মাধ্যমে মানুষ দেখতে পায়, অন্তত যাকে জাকাত দেয়া হলো সে তো জানতে পারে। হজ পালনে মানুষ বুঝতে পারে। কিন্তু রোজা যদি কেউ একান্তে গোপনে ঘরে নিভৃত কোণে বসে পানাহার করে তা কোনো মানুষ দেখতে পায় না, সেই ক্ষেত্রে কেবলমাত্র আল্লাহভীতি বা তাকওয়ার গুণাবলিই লোকচক্ষুর অন্তরালে ব্যক্তিকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে। আর তাকওয়ার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি শুধুমাত্র রমজান মাসের জন্য নয় বরং তার জীবনগঠনে যাবতীয় অন্যায়, দুর্নীতি, পাপ, খারাপ কাজ থেকে লোক ভয় নয়, আল্লাহর ভয়ে বিরত থাকার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির পথ সুগম করে দেয়। তাকওয়ার মাধ্যমে সর্বোচ্চ পরহেজগারি এবং গুণাহ মাফ সম্ভব। এ সম্পর্কে সা’দ বিন আবি আক্কাস থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বীন হলো পরহেজগারি।” (সহিহুল জামে-৩৩০৮) আবু যার জুন্দুন বিন জুনাদাহ (রা) ও মুআয ইবনে জাবাল (রা) থেকে বর্ণিত অন্য একটিতে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যেখানেই থাক না কেন আল্লাহকে ভয় কর এবং পাপের পরে পুণ্য কর, যা পাপকে মুছে ফেলবে।” (তিরমিযি- ১৯৮৭) রোজার মূল কাজ তাকওয়া বৃদ্ধি। তাই তাকওয়া নিছক ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও যৌনতাকে দমিয়ে রাখার সামর্থ্য নয়, বরং সর্বপ্রকার জৈবিক, আত্মিক ও আর্থিক কুপ্রবৃত্তি দমনের ঈমানী শক্তি। এমন তাকওয়া থেকেই প্রেরণা আসে আল্লাহপাকের হুকুমগুলি জানার এবং সে সাথে সেগুলি অনুসরণের। সিয়াম পালনকারী ব্যক্তি এক দিকে নফসের যাবতীয় দাবি প্রত্যাখ্যান করে বিদ্রোহী ও অবাধ্য নফসকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। সমস্ত জুলুম-অনাচার, অত্যাচার ও পাশবিকতার বিরুদ্ধে হয়ে ওঠে সংগ্রামী। রোজার প্রশিক্ষণ এত অপরিহার্য কেন? ভালো মানের কৃষক, শ্রমিক, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার গড়ার জন্যও লাগাতর প্রশিক্ষণ চাই। তেমনি প্রশিক্ষণ চাই নিষ্ঠাবান মুসলমান গড়ার জন্যও। সে প্রশিক্ষণের মূল কথা হলো জিহ্বা, পেট ও যৌনতার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। ব্রেক ছাড়া কোন গাড়ি নির্মাণ ও সে গাড়িকে রাস্তায় নামানোর বিপদ ভয়াবহ। তাতে অনিবার্য হয় দুর্ঘটনা। তেমনি জিহ্বা, পেট ও যৌনতার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সভ্য সমাজ নির্মিত করা যায় না। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে অশান্তির মূল কারণ হলো লাগামহীন জিহ্ববা। তেমনি পেটের লালসার ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে মানুষ তখন উপার্জনে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। তেমনি যৌন লালসার ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে মানুষ ব্যভিচারের দিকে ধাবিত হয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে জিহ্বা ও যৌনাঙ্গের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে। রমজানের মাসব্যাপী রোজা মূলত সে নিয়ন্ত্রণকেই প্রতিষ্ঠা করে। রমজানের রোজা যদি সে নিয়ন্ত্রণ স্থাপনেই ব্যর্থ হয় তবে বুঝতে হবে রোজাদারের মাসব্যাপী ট্রেনিং সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেছে। রোজা তাকে দিনভর উপবাসের কষ্ট ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের রোজা যে তাদের জীবনে কোনোরূপ নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি তা শুধু রমজানের মাসে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ধরা পড়ে না, প্রকট ভাবে ধরা পড়ে দুর্নীতির মধ্য দিয়েও। ব্যর্থ হচ্ছে কেন এ প্রশিক্ষণ? সৈনিকের খাতায় নাম লেখালে বা প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি হলেই কেউ ভালো সৈনিক রূপে গড়ে ওঠে না। ভালো সৈনিক হতে হলে সৈনিক জীবনের মূল দর্শন ও মিশনের সাথেও সম্পূর্ণ একাত্ম হতে হয়। দেশের স্বাধীনতা ও সংহতিতে তাকে পূর্ণ বিশ্বাসী হতে হয়। এখানে আপস চলে না। তেমনি জীবনভর নামাজ-রোজা, হজ-জাকাতের প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েও বহু মানুষের জীবনে পরিশুদ্ধি আসে না। পরিশুদ্ধি আসে নামাজ-রোজা, হজ-জাকাতের পাশাপাশি জীবন ও জগৎ নিয়ে ইসলামের যে মূল দর্শন, তার সাথে একাত্ম হওয়ায়। কথা হল, সে দর্শনটি কী? সেটি হল, আল্লাহকে একমাত্র প্রভু, প্রতিপালক, আইনদাতা ও রিজিকদাতারূপে মেনে নেয়া এবং তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে নিজেকে একজন আত্মসমর্পিত সৈনিক রূপে পেশ করা। মুসলমানের মিশন মূলত আল্লাহর কাছে এক আত্মসমর্পিত গোলামের মিশন। সে দায়িত্ব নিছক নামাজ- রোজা, হজ-জাকাতে পালিত হয় না। সে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রটি বরং বিশাল; এবং সেটি সমগ্র দেশ, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি জুড়ে। দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে কখনও তাকে দ্বীনের প্রচারক হতে হয়, কখনও রাজনৈতিক কর্মী বা নেতা হতে হয়, আবার কখনও সৈনিক বা জেনারেলের বেশে যুদ্ধেও লড়তে হয়। মুসলিম শব্দটির উদ্ভব তো হয়েছে আত্মসমর্পণ থেকে, যার নমুনা পেশ করেছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আ.)। যিনি আল্লাহর প্রতিটি হুকুমে- সেটি শিশুপুত্রের কোরবানি হোক বা নিজ দেশ ছেড়ে হিজরত হোক- সব সময়ই লাববাইক (আমি হাজির এবং মেনে নিলাম) বলেছেন। নামাজ- রোজা, হজ-জাকাতের মত কুরআনি প্রশিক্ষণ তো এমন আত্মসমর্পিত মুসলমানদের জন্যই। বেঈমান ও মুনাফিকদের জন্য নয়। যারা জান্নাত চায়, আল্লাহতায়ালার এ প্রশিক্ষণ তো তাদেরকে সে মহাপুরস্কার লাভের জন্য যোগ্য করে গড়ে তোলে। প্রতিটি ঈমানদার যেমন এ প্রশিক্ষণ থেকে ফায়দা পায়, তেমনি এর সাথে একাত্মও হয়। মানবাত্মা একান্ত অনুগত হওয়া অবধি মানুষ তার পরিচর্যা ও শাসন করে যাবে, তার বিরুদ্ধে লাগাতার সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। বিষয়টি নিতান্ত সহজ ব্যাপার নয় যে, সকলের পক্ষে তাতে সফল হওয়া সম্ভব বরং খুবই কঠিন। অবাঞ্ছিত সব যাতনা ও কষ্টে ভরা দীর্ঘ রাস্তা, যার সত্যতা মিলে আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণীতে।” (অপরদিকে) যারা আমার পথে জেহাদ করে আমি অবশ্যই তাদের আমার পথে প্রচালিত করি, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা নেককার বান্দাদের সাথে রয়েছেন। (সূরা আনকাবুত : ৬৯) আল্লাহ তাআলা হিদায়াত দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আর শর্তারোপ করেছেন দু’টি: এক. আল্লাহর আনুগত্যের ওপর সর্বাত্মক পরিশ্রম করা, আত্মাকে কঠোর সাধনা-সংগ্রামে নিয়োজিত রাখা এবং শাসনের মাধ্যমে তাকে সুগঠিত ও নিয়ন্ত্রিত করা। দুই. এসব কিছু হতে হবে কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যে, সুখ-ঐশ্বর্য অর্জন কিংবা পার্থিব কোন উদ্দেশ্যে নয়। আত্মগঠন নিজের প্রচেষ্টায় নিজের জীবনকে উপযোগী করে কাক্সিক্ষত মানে দক্ষ ও ত্যাগী হিসেবে গড়ে তোলার নামই হচ্ছে আত্মগঠন। আত্মা শব্দটি বাংলা, আরবিতে যাকে নফস বা রূহ বলা হয়। নিজের নফসের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা। নফসের গোলাম না হওয়া এবং নফসকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসা। “মানুষের আত্মার শপথ! আর শপথ সেই সত্তার যিনি মানুষের আত্মাকে পরিপূর্ণ রূপ দিয়েছেন, অতঃপর তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান বা তাকওয়া দান করেছেন। মানুষের মধ্যে যারা এই নফস ও আত্মাকে তাজকিয়া করে তারাই সফলকাম হয়। আর যারা অবদমিত করে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যর্থ হয়।” (সূরা আস্ শামস : ৭-১০) মানুষের কাছে আমি দু’টি পথ তুলে ধরেছি। একটি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ও আনুগত্যের পথ আরেকটি কুফরি এবং নাফরমানির পথ। (সূরা আদ্ দাহর : ৩) সেই স্বভাবধর্মের অনুসরণ করো, যে স্বভাবধর্মের ওপর মানবজাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে। (সূরা আর রূম : ৩০) অতঃপর আমার পক্ষ থেকে হেদায়াত আসবে, যারা এর অনুসরণ করবে তাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ারও কারণ নেই। (সূরা আল বাকারা : ৩৮) হে পরিতৃপ্ত আত্মা! ফিরে এসো তোমার রবের সমীপে-খুশি মনে, সন্তুষ্টচিত্তে। অতঃপর আমার বান্দা, আমার অনুগত বান্দাদের মধ্যে শামিল হও এবং জান্নাতে প্রবেশ করো। (সূরা আল ফাজর : ২৭-৩০) হে রাসূল! তোমার প্রতি তোমার রবের পক্ষ থেকে যা নাজিল করা হয়েছে তা যথাযথভাবে পৌঁছিয়ে দাও। যদি এমনটি না করো তাহলে তোমার প্রতি অর্পিত রিসালাতের দায়িত্ব তুমি পালন করনি বলেই বিবেচনা করা হবে। আল্লাহ তোমাকে মানুষের অনিষ্টকারিতা থেকে হেফাজত করবেন। বিশ্বাস কর আল্লাহ কাফেরদেরকে সাফল্যের পথ কখনই দেখাবেন না। (সূরা আল মায়েদা : ৬৭) আমি কাফেরদের জন্য তৈরি করে রেখেছি লোহার শিকল ও দোজখের আগুন। নেক লোকেরা বেহেশতে সুপেয় পানি দ্বারা আপ্যায়িত হবে, যাতে মিশানো থাকবে সুগন্ধিযুক্ত কর্পূর। এটা হবে একটা প্রবাহিত ঝর্ণাধারা, যার পানি থেকে আল্লাহর বান্দাগণ শরাব পান করবে, যেখানে যেভাবে চায় এর শাখা প্রশাখা খুলতে পারবে। (সূরা আদ্ দাহর : ৪-৬) আত্মা কত প্রকার ও কী কী? আত্মা ৩ প্রকার : যথা- -নফসে আম্মারা-যা মানুষকে সর্বদা মন্দ পথে ধাবিত করা। -নফসে লাওয়ামা-যা ভালো ও মন্দ উভয় দিকে ধাবিত করে। -নফসে মুতমায়িন্নাহ-যা মানুষকে সর্বদা ভালো পথের সন্ধান দিবে। রমজান মাসে আমাদের করণীয় -সর্বোত্তম পন্থায় সিয়াম পালন করা। -কুরআনুল কারিম তেলাওয়াত, চর্চা ও গবেষণা -কিয়ামুল লাইল -আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় -লাইলাতুল কদর অন্বেষা ও ইবাদাতের মাধ্যমে তা উদযাপন -সঠিক সময়ে সেহরি ও ইফতার করা ও অন্যকে করানো -রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগানোর জন্য চেষ্টা করতে হবে -সমাজে ও রাষ্ট্রে দ্বীনি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে -কুরআন তেলাওয়াত করা এবং এর মর্ম উপলব্ধি করা -আল্লাহর রাস্তায় বেশি বেশি দান ও সদকা করা -বেশি বেশি দোয়া, জিকির এবং ইস্তেগফার করা -সকল প্রকার ইবাদতে নিজেকে ব্যাপৃত রাখা -লাইলাতুল কদরের বিশেষ ফজিলত শেষ কথা আত্মশুদ্ধি, আত্মগঠন ও তাকওয়া অর্জনের এ মুবারক মাসে মুমিনদের ওপর অর্পিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, সৃষ্টি হয়েছে পুণ্য অর্জনের বিশাল মৌসুম এবং প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে মহান চরিত্র অর্জনের সুন্দর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এ অর্পিত দায়িত্ব পালন এবং সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আজ সারা বিশ্বের মুসলিমদের উচিত চারিত্রিক অধঃপতন থেকে নিজেদের রক্ষা করা, নেতিয়ে পড়া চেতনাকে জাগ্রত করা এবং সকল প্রকার অনাহূত শক্তির বলয় থেকে মুক্ত হয়ে হক প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞাকে সুদৃঢ় করা, যাতে তারা রিসালাতের পবিত্র দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে এবং কুরআন নাজিলের এ মাসে কুরআনের মর্ম অনুধাবন করতে পারে, তা থেকে হিদায়াত লাভ করতে পারে এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে একেই অনুসরণের একমাত্র মত ও পথ রূপে গ্রহণ করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে রমজান মাসের রোজা, পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত, সেহরি, ইফতার, তারাবি নামাজ, সাদাকাতুল ফিতর, জাকাত, দান-খয়রাত প্রভৃতি আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতরাজি, যা রোজাদারদের কুপ্রবৃত্তি দমন ও তাকওয়া বা খোদাভীতিপূর্ণ ইবাদতের মানসিকতা সৃষ্টিতে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জোগায়। পবিত্র মাহে রমজানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আত্মশুদ্ধির নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে সর্বজনীন-কল্যাণের শাশ্বত চেতনায় সকল অকল্যাণ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মানবতাকে বিজয়ী করার পথে আমাদের এগিয়ে দিক। আল্লাহ আমাদের সকল আমল কবুল করুন এবং আমাদের সবাইকে আরো উত্তম আমল করার তাওফিক দান করুন। লেখক : সম্পাদক, মাসিক প্রেরণা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির