post

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও বাংলাদেশে প্রভাব নেই

মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ

২৮ জুলাই ২০১৫
ভোগ্যপণ্যের বিশ্ববাজারদর গত পাঁচ বছরের মধ্যে এখন সবচেয়ে কম। কিন্তু এর প্রভাব বাংলাদেশে নেই। সরকারের মন্ত্রী ও আমলার দুর্নীতির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার কোনো সুফল পাচ্ছে না। একই সাথে সরকারি নেতাদের চাঁদাবাজির কারণেও বাংলাদেশের ভোক্তারা অনেক ক্ষতির মুখে পড়ছেন। খোদ সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিত্যপণ্য যৌক্তিক মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত আমদানি করা সব নিত্যপণ্যের দামই কমেছে। তবে সে অনুযায়ী এর প্রভাব পড়েনি বাংলাদেশের বাজারে। এ জন্য দায়ী করা হচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম না কমাকে। আর বিশ্লেষকরা বলছেন সরকারসহ আমদানিকারকদের অদূরদর্শিতার কারণেই কমছে না পণ্যের দাম। নিত্যপণ্যের বাজার সহনীয় রাখার জন্য সরকার সব সময়ই নানা রকম তৎপরতা চালিয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে কিংবা স্থানীয় বাজারে শুল্ককর ও সুদহার কমিয়েও সরকার তা করার চেষ্টা করে। তারপরও বেশির ভাগ সময়ই এর সুফল পায় না ভোক্তারা। এরকম পরিস্থিতি চলছে বর্তমানে। আইএমএফ বলছে, নিত্যপণ্যের দাম গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। এক জরিপে দেখা গেছে, ২০১১ সালের তুলনায় ২০১৪ সাল পর্যন্ত আমদানিকৃত সব নিত্যপণ্যের দামই কমেছে। চালের দাম টনপ্রতি ৫৫১ ডলার থেকে বর্তমানে নেমে এসছে ৪১৯ ডলারে। গমের দাম ৩১৬ থেকে ২৫৮ ডলারে। সয়াবিনের দাম ১২১৫ থেকে ৭২১ ডলারে, চিনির দাম ৫৭৭ ডলার থেকে কমে ৩৫০ ডলারে নেমে এসেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, নিত্যপণ্যের দাম কমার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাধা জ্বালানি তেলের দাম। এ ক্ষেত্রে অদক্ষ বিপিসির সংস্কার মনোপলি ভেঙে দেয়ার পরামর্শ তাদের। আমদানিকারকদের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণেই নিত্যপণ্যের দাম কমছে না বলে মনে করেন তারা। সয়াবিন তেলের দাম গত দুই-তিন বছরের মধ্যে এখন সর্বনিম্ন। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমায় খোলা সয়াবিন তেলের দাম কমে পাইকারি বাজারে ৮৩-৮৪ টাকা লিটার দরে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম মাসখানেক আগে লিটারে এক টাকা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন খুচরা বিক্রেতারা। অন্য দিকে গত মার্চ থেকে বিশ্ববাজার পড়তির ধারায় থাকলেও দেশে গুঁড়োদুধের দাম বেড়েছে বলে দেখা গেছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি)  করা বাজার দরের তালিকায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো সংক্রান্ত আইন প্রয়োগে সরকারের ঔদাসীন্য দুঃখজনক। রান্নায় তেল ব্যবহার খাবারের স্বাদ আনে। এ ছাড়া খাবার স্বাস্থ্যপ্রদ করার জন্যও তেল অপরিহার্য। নইলে সীমিত আয়ের মানুষ হয়তো অনেক আগেই তেল খাওয়া বন্ধ করে দিতেন। কারণ প্রতিবছর লাফিয়ে লাফিয়ে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে। বাড়ছে আর সাধারণ ভোক্তার জন্য দুঃসহ যন্ত্রণা তৈরি করছে। ভোজ্যতেলের দাম শুধুই আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে ঘটছে বলে ব্যবসায়ীরা যে দাবি করছেন, তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। তারা সাধারণত খন্ডিত চিত্র হাজির করতেই উদ্গ্রীব, অসাধু ব্যবসায়ীদের হুজুগে দাম বাড়ানোর বিষয়ে তারা নীরব থাকেন। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রচারণা আছে, পদক্ষেপ নেই। বিশেষত, সয়াবিনের দাম বাড়ানো সংক্রান্ত আইন প্রয়োগে সরকার ও ব্যবসায়ীদের ঔদাসীন্য খুবই দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক। একদা শর্ষে, তিল ও বাদাম তেল ছিল বাঙালির ভোজ্য। এখন প্রধান ভোজ্য সয়াবিন তেল; এরপরই পাম অয়েল। বিদেশ থেকে এনে এ দেশে শোধন করে এ দুটো তেল বিপণন করা হয়। কাঁচা সয়াবিন তেল ও কাঁচা পাম অয়েল যারা আমদানি করেন এবং শোধন করেন ভোজ্যতেলের বাজারের কলকাঠি তাদেরই কব্জায়। দর বাড়ালেন কেন? তাদের উত্তর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে, তাই এ দেশেও বাড়াতে হয়েছে। লোকসান দিয়ে তো বাণিজ্য চলে না। খুবই খাঁটি কথা। কিন্তু দর যখন আন্তর্জাতিক বাজারে কমে তখন সঙ্গতি রেখে এ দেশে দাম কমানোর উদাহরণ বিরল। চতুরতার সঙ্গে তখন বলা হয়, আগে আনা ক্রুড দিয়ে তৈরি তেল রয়েছে বাজারে। দর তো আগের মতোই থাকবে। ভোগ্যপণ্য নিয়ে এ ধরনের নষ্টামি ও স্বেচ্ছাচার রোধ করার জন্য সক্রিয় রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্যারিফ কমিশন। সম্প্রতি একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশন বাজার পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে সরকারকে জানিয়েছে, ভোজ্যতেলের বাজারমূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে নেই। পণ্যটি নিয়ে এক ধরনের ভোজবাজির খেলা চলছে। কমিশনের হিসাব অনুযায়ী প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ৮৪ টাকা ও পাম অয়েল ৬৩ টাকা হওয়া উচিত। বোতলজাত সয়াবিন লিটার ৯৯ টাকা ও পাঁচ লিটার কন্টেইনার ৪৬৬ টাকা হওয়া উচিত। অথচ বাজারে খোলা সয়াবিন লিটার ৯০ টাকায়, পাম ৮০ টাকায়, বোতলজাত সয়াবিন কোম্পানিভেদে ১১৬-১১৭ টাকা এবং পাঁচ লিটার সয়াবিন ৫৭০-৫৮০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। ক্রেতারাও জেনে গেছেন, এটা অন্যায় দর। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে ইদানীং ভোজ্যতেলের দাম কমেছে। তবু দেশে দর বেশি কেন? ক্রেতারা কারো কাছে জবাব পাচ্ছেন না। তবে জানা গেছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ভোজ্যতেলের বাজারে মিল মালিক ও ক্রুড আমদানিকারকদের স্বেচ্ছাচার বন্ধ করে ভোক্তাসাধারণের জীবনে স্বস্তিদানে একটি স্থায়ী ব্যবস্থা বলবত করা হবে বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে এই-ই আমাদের প্রত্যাশা। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ, ফলে জনসাধারণের জীবনযাপনকে আমলে নিয়ে নিত্যপণ্য তথা ভোজ্যতেল ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। আর যদি এমন হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমছে কিন্তু দেশের বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়ছে না, তবে তা নিঃসন্দেহেই উদ্বেগজনক। একটি জনসংখ্যাবহুল দেশের জন্য এ পরিস্থিতি সার্বিকভাবেই নেতিবাচক। যে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও আনুপাতিক হারে দেশের বাজারে দাম কমেনি। আর এ পরিস্থিতি শুধু ভোজ্যতেলেই নয়, বরং গুঁড়োদুধের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। বিশ্বব্যাপী গুঁড়োদুধের দামের তথ্য জানা যায় গ্লোবাল ডেইরি ট্রেড নামের একটি সংস্থার ওয়েবসাইট থেকে। ওই সংস্থার তথ্যানুযায়ী, গুঁড়োদুধের দাম গত এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর। ওই দিন ৫২০৮ ডলার দরে প্রতি টন গুঁড়োদুধ বিক্রি হয়েছে। চলতি সেপ্টেম্বর মাসে তা ২৬০০-২৭০০ ডলারের মধ্যে ওঠানামা করছে। বিশ্ববাজারে দাম প্রায় ৪৯ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশে কিন্তু তেমন কমছে না। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের ব্যাপক দরপতন হলেও দেশে দাম কমছে না। দাম কমানো কিংবা মূল্যসংস্কারের মাধ্যমে তেলের দাম বাজারনির্ভর করার বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে সরকার। সরকারি-বেসরকারি সূত্রগুলো জানায়, গত জুলাই থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার প্রবণতা শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমানে বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল তেলের যে দাম ছিল, সে হিসাবে দেশে প্রতি লিটার ডিজেল ও ফার্নেস তেলের দাম পড়ছে যথাক্রমে ৪৪ ও ২৮ টাকা। আর দেশে ডিজেল ও ফার্নেস তেল বিক্রি হচ্ছে আগের দরেই, প্রতি লিটার যথাক্রমে ৬৮ ও ৬০ টাকা। পেট্রল ও অকটেনের দামও লিটারপ্রতি যথাক্রমে ৯৬ ও ৯৯ টাকাই আছে। সরকারি- বেসরকারি উভয় পর্যায়েই একাংশের মত, সরকার জ্বালানি খাতে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার যে নীতি নিয়েছে তা বাস্তবায়নের এখনই উপযুক্ত সময়। তারা মনে করে, যে রাজনৈতিক সমীকরণে তেলের দাম কমছে আগামী দু-এক বছরে তার নিরসন হবে না। কাজেই মূল্যসংস্কারে ঝুঁকি নেই। তবে ভিন্নমতও আছে। কেউ কেউ মনে করেন, দেশের অর্থনীতি ঘন ঘন জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামার অভিঘাত সহ্য করার পর্যায়ে এখনো যায়নি। বিষয়টি সম্পর্কে সরকারের সর্বশেষ অবস্থান জানতে চাইলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এ এম বদরুদ্দোজা বলেন, দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমানো কিংবা মূল্যসংস্কারের বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে তাঁর কাছে কোনো নির্দেশনা নেই। জ্বালানি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিষয়টি সরকারের নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছে। আরও অন্তত ছয় মাস পর্যবেক্ষণের পর মূল্য সমন্বয় কিংবা মূল্যসংস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, প্রথমে তেলের দাম কমতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েনের কারণে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টির যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল ছিল এটি। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে যখন বিপুল পরিমাণ ‘শেল অয়েল’ উৎপাদন শুরু করে তখন বিশ্ববাজারে তেলের চাহিদা কমে গিয়ে দাম পড়তে থাকে। ‘শেল অয়েল’ হচ্ছে খনিতে তেলের ছোট ছোট আধারগুলো ভেঙে বের করে আনা তেল। কয়েক বছর আগেও এই প্রযুক্তি ছিল না। তেলের ওই আধারগুলো অব্যবহৃতই পড়ে থাকত। এখন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব তেল উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। এতে প্রতি ব্যারেল তেল উত্তোলনে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৪০ ডলার। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তেল রফতানিকারক (ওপেকভুক্ত) দেশসমূহ তেলের দাম কমিয়ে দেয়। ওপেকভুক্ত দেশগুলোতে তেলের উত্তোলন ব্যয় গড়ে ১৫ ডলারেরও কম। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র উল্টো চাপে পড়ে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করাও তেলের দাম কমানোর অন্যতম কারণ। এই বহুমুখী জ্বালানি রাজনীতি ভিন্ন মাত্রা না পাওয়া পর্যন্ত তেলের দাম বাড়ার সম্ভাবনা কম বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এ প্রসঙ্গে সাবেক বিদ্যুৎসচিব, বর্তমানে ফ্রিল্যান্স পরামর্শক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ের গবেষক ফাওজুল কবির খান বলেন, বাংলাদেশে এখন জ্বালানি তেলের মূল্যসংস্কার করতে কোনো সমস্যা নেই। বরং এটাই উপযুক্ত সময়। বিশ্ববাজারে তেলের দাম আদৌ আর কখনো আগের পর্যায়ে যাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অন্তত ২০২০ সালের মধ্যে যে যাবে না তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। জনাব কবির বলেন, এখন মূল্যসংস্কার করা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন, কৃষি উৎপাদনসহ সব ধরনের উৎপাদন ব্যয় কমবে। সমগ্র অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় স্বস্তির সুবাতাস বইবে। তবে ভারত ও মিয়ানমারের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মূল্যসংস্কার করতে হবে। তার চেয়ে দাম কম হলে চোরাচালানের আশঙ্কা আছে। এই মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, দাম বাড়লে তা সমন্বয় করা সব সময়ই কঠিন হয়। আর এখন দাম কমালে সাধারণ মানুষ তার কতটা সুবিধা পাবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। লেখক : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির