বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগ থেকেই নাটক রচিত হচ্ছে। এমনকি বাংলা ভাষায় বিদেশি নাটকের অনুবাদের পরিমাণও কম নয়। নাটক রচয়িতাদের কতটুকু মহব্বত থাকলে ভিনদেশি ভাষার নাটক উপন্যাসকে আমরা আমাদের জনগণের জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুবাদ করে গুছিয়ে দিচ্ছি, সাজিয়ে তৈরি করে দিচ্ছি। এটা বিশ্বায়নের জন্য প্রয়োজন হতে পারে তা মানি, কিন্তু নিজেদের গোলা শূন্য করে অন্যের ধানের আশায় থাকাটা সমীচীন? আমাদের সংস্কৃতিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ রচনা থাকলে তখন উদ্বৃত্ত করা হিসেবে অন্য দেশীয় ভাষার সংস্কৃতি রচনার আবশ্যকতা থাকতে পারে। একবারও ভাবছি না যে বিদেশি লেখাগুলো আমাদের কি কাজে আসছে? আমাদের সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি মুসলিম ধর্মীয় সংস্কৃতি। সংস্কৃতি মানে নিয়ম কানুন, চাল চলন। যাকে আরবিতে তাহজিব তমদ্দুন বলে থাকি। আরো সহজে যদি বলি সংস্কৃতি মানেই চলমান জীবন ও নতুন সৃষ্টি। তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেমন খারাপ আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালো কিছুও হতে পারে। যেমন- রাসূলের যুগে মুখে আযান দেয়া হতো, এখন মাইকে দেয়া হয়। এটি হাসানা বা উত্তম। আর নতুনের মধ্যে খারাপ হলো ইসলামের নামে কবর পূজা, পীরের পায়ে মাথা রাখা। রাসূলের নবুওয়াতের আগে আর পরের সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবন সম্পূর্ণ নতুন। এই নতুন জীবনটাই সংস্কৃতি।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের সংস্কৃতি বলতে তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতিই বুঝায়। বাস্তবেও তাই হওয়া উচিত। যার ধর্ম সেই অনুযায়ী সংস্কৃতি করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের নাট্য সংস্কৃতিতে কখনোই আমাদের দেশ, সমাজ বা ধর্মকে উন্নত করতে দেখা যায় না। বিদেশি সংস্কৃতির লালনই তাতে ফোটে ওঠে। আরো কষ্টের কথা হিন্দু অভিনেতাকে দিয়ে মুসলিম নাটকের অভিনয় করানো হচ্ছে। মুসলিম লেবাসে প্রতারণা ঠকবাজি আর হঠকারিতা করানো হচ্ছে তা কিভাবে মুসলিম সংস্কৃতির কোনো কাজে আসবে? ভারতীয় নাটকগুলো টিভিতে দেখলেই দেখা যায় তাদের কোনো না কোনো পূজাকে কেন্দ্র করে নাটকটি প্রবাহিত হচ্ছে। কিংবা কারো বিয়ের অনুষ্ঠানের সকল কার্যক্রম, বা সাতপাকে বাঁধা ইত্যাদি তুলে ধরা হয়। মেয়েদের একটি সিঁদুরের গুরুত্ব কত তা বোঝানো হচ্ছে, অথচ এগুলোর বিপরীতে মুসলিমরা কি শিখছে? মুসলিমদের এসব অনুষ্ঠান কি আমাদের রচিত নাটকের মধ্যে জানতে পারে? ওসব অনুষ্ঠানে মেয়েদের চাল চলন, পোশাক আশাক কথাবার্তার নিয়ম আমাদের সংস্কৃতিকে তো ধ্বংস করছেই বরং বেহায়াপনা ও নির্লজ্জতার সবক দিচ্ছে।
অথচ আমাদের নাটকগুলোতে ফিতরার ঈদ বা, জবেহের ঈদ, রোজা কিংবা খাতনা অনুষ্ঠান বা ওয়াজ মাহফিল অথবা কোনো বিবাহের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে রচিত হয় না। দেখানো হয় না মোহর কাকে বলে? মোহরের গুরুত্ব কী? মোহরে ফাতেমি কি? ফলে আমাদের সংস্কৃতি আমাদের লোকেরা জানার কোনো উপায়ও নেই। বহু গল্প ইসলামি আদলে রচিত হলেও তা প্রকাশ প্রচার হয় না। আমাদের ছেলে-মেয়েরা শিখবে ইসলাম। তাদেরকে কিভাবে চলতে হবে, তাদের পোশাক কেমন হলে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে না। যুবক যুবতীরা কোন পোশাকে চললে যুবকরা লালায়িত কুকুরের মতো হবে না। ধর্ষণ খুন রাহাজানিতো এসব নিয়েই হচ্ছে বেশি। এমনকি আমাদের কুরআন যে শিক্ষা দিয়েছে ন¤্র স্বরে কথা বলতে তা কয়জন মুসলিম জানে? আমাদের ধর্মানুসারীরা এখন অন্যান্য ধর্মানুসারীদের মতো হয়ে গেছে না জেনে না বুঝে, শুধু শুনে শুনে মুসলিম দাবি করে। এটা মুসলিম সংস্কৃতির রূপ? মুসলমানের নামাজ রোজা হজ, পাঞ্জাবি পায়জামা, টুপি, রুমাল, এগুলোও সংস্কৃতির মধ্যেই পড়ে। আমাদের জিকির একটি সংস্কৃতি কিন্তু এই যিকিরের সাথে এখন কেউ কেউ ঢোল বাজিয়ে অপসংস্কৃতি বানিয়ে ফেলেছে। আর নাটকগুলোতে সেটাই দেখানো হয়।
বর্তমানে যেসব নাটক রচিত হচ্ছে সেসব নাটকে এখন শেখানো উচিত মা-বাবারা কেমন করে খবর রাখবে, তাদের ভার্সিটি পড়–য়া ছেলে-মেয়েরা কোথায় যায়, কী করে। খারাপ হওয়া থেকে বিরত থাকার উপায় কি তা শিক্ষা দেবে। না তা না। বরং শিক্ষা দেয়া হচ্ছে নিজে নিজে কিভাবে সমাজচ্যুত হবে। কিভাবে মা বাবার অবাধ্য হবে। মা-বাবার মুখে চুনকালি মেখে নিজের মতো করে চলবে। মোটকথা এসব সংস্কৃতি আমাদের সমাজব্যবস্থাকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে। ওদের বুঝানো হচ্ছে সংস্কৃতি বলতে কিছু নেই, মুসলিম অমুসলিমে বিবাহতেও কোনো বাধা নেই। নিজের মতো করে বিয়ে করে বউ ঘরে নিয়ে আসাতেও কোনো দোষ নেই। মা-বাবার পছন্দেরও কোনো মূল্য নেই।
আমাদের সংস্কৃতির কোনো অংশ ধার করতে হয় না, কোথাও অসম্মানের কোনো সম্ভাবনা নেই, আমাদের সংস্কৃতি সভ্যতার সংস্কৃতি। পৃথিবীতে ইতিহাস আমাদের সংস্কৃতি নয়, ধর্মীয় গ্রন্থ হওয়া উচিত আমাদের সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি দুনিয়া ও আখেরাতে মুক্তির সংস্কৃতি, এ সংস্কৃতি উন্নয়নের সংস্কৃতি। আলোর পথে এগিয়ে চলতে নির্বিঘেœ পথ চলার সংস্কৃতি। বিজয়ের জন্য প্রয়োজন আমাদের এ সংস্কৃতি। ইসলামের স্মৃতি ও সংস্কৃতি অন্যায় অপরাধ থেকে দূরে রাখে। এ সংস্কৃতি কেউ অনুসরণ করলে সে সাংস্কৃতিকভাবে বলিষ্ঠ ও মজবুত হয়ে উঠবে। আমাদের মহানবী সা.-এর সংস্কৃতি হলো ‘লান তামাসসাকতুম বিহিমা কিতাবুল্লাহি ও সুন্নাতি রাসূলিহি’ অর্থাৎ কুরআন ও হাদিস আঁকড়ে ধরে থাকলে পথচ্যুত হবে না। রাসূল সা. একজন মহামানব হওয়ার পরও তাঁর জীবন সংস্কৃতিতে রয়েছে কষ্ট, সমস্যা, আঘাত ও সমাধান। তিনি ছিলেন বকরি পালক, যা একজন সাধারণ মানুষের সাথে মিলে যায়। তথাপি তাঁর জীবনই পৃথিবীর সব মানুষের জীবনের চেয়ে মহান আদর্শের। এটাই সংস্কৃতি। আরবীয় অনারবীয় সবাই লম্বা জুব্বা পরে, সবাই দাড়ি গোঁফ রাখে, জীবনের সকল কর্ম সম্পাদন করে কিন্তু কারো জীবনই রাসূলের জীবনের মতো নয়। তিনি একক তিনি জন্ম নিয়েছেন শিক্ষক হিসেবে। তাঁর শিক্ষক ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। তিনি বলেছেন ইন্নি বুয়েসতু মুয়াল্লিমান’। আমার জন্মই শিক্ষক হিসেবে। হযরত আদম (আ)কে আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন- বলেছেন ‘ওআল্লামাল আদামাল আসমায়া কুল্লাহা, আল্লাহ আদমকে সব কিছুর নাম শিক্ষা দিয়েছেন। আর নবীয়ে আকরাম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-কে দিয়ে বলেছেন ‘আল-ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দিনাকুম ওয়া আতমামতু আলাইকুম নিঅ’মাতি’ আজ আমি তোমাদের জন্য দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, এবং তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম।’ এতেই রাসূলের জীবনের মাহাত্ম্য প্রকাশিত হয়েছে। শুরু এবং শেষ একটি সংস্কৃতিতে ঘেরাও করা।
এ ছাড়া আল্লাহ নিজে রাসূলের কতগুলো গুণ প্রকাশ করে দিয়েছেন যাতে তিনি সর্বোচ্চ সম্মানিত হয়েছেন। আল্লাহ পাক কুরআনে ঘোষণা করেন- ‘লাক্বাদ কানা লাকুম ফি রাসূলিল্লাহি উসওয়াতুন হাসানা,’ নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলগণের জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ। আরেক আয়াতে বলেছেন- ওয়া ইন্নাকা লা আলা খুলকিন আযিম’ এবং নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী। তারপর আল্লাহ রাব্বুল আলমিন আরেক জায়গায় বললেন- ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।’ রহমত বরকতের জীবন আর ছন্নছাড়া জীবনের মধ্যে রহমতের জীবনই গ্রহণযোগ্য।
‘উদখুলু ফিস সিলমি কাফ্ফা’ তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামী সংস্কৃতিতে প্রবেশ করো। মানে হলো পুরো ইসলামী নিয়ম কানুন মেনে চলো। একটি মানুষ মশা থেকে বাঁচার জন্য মশারির ভেতরে শয়ন করে নিরাপদ থাকার মতো। কিন্তু কেউ যদি মশারির বাইরে তার একখানা হাত রেখে ঘুমায় আর তাতে মশা কামড়ায় তাহলে কি তার সারা শরীর আক্রান্ত হবে না? অবশ্যই হবে। ঠিক তেমনি ইসলামের কালেমা যারা পড়েছে অথবা মেনে নিয়েছে তারা ইসলামের সব কিছু মেনে চলবে এটার নামই পরিপূর্ণ প্রবেশ করা। ‘উদখুলু ফিসসিলমি কাফফা।’ আমাদের অধিকাংশ মা-বাবাও শুনে শুনে মুসলিম সংস্কৃতি পালন করে। মাদরাসায় যা পড়ানো হয় তা শুনলে অনেকে বিরক্ত হয়। পড়ে জেনে ইসলাম মানাটা কঠিন মনে হয়। কারণ অন্য কোনো ধর্মে এত কড়াকড়ি নেই, পড়াশোনার ব্যাপার নেই। ইসলামতো একটি মানুষকে, পরিবারকে, সমাজকে আদর্শের দিকে আহ্বান করে। আর তাতো সমাজের পাপ পঙ্কিলতার গণ্ডির বাইরে এক মহান শান্তির সংস্কৃতি। সেখানে সবার জন্য সবাই। কবি বলেছেন- ‘আমার বাড়ির ফুল-বাগিচা, ফুল সকলের হবে, আমার ঘরে মাটির প্রদীপ আলোক দিবে সবে।’
আফসোসের বিষয় হলো আমাদের নাটকগুলোতে এই বিষয়টি ওঠে আসে না। প্রচলিত ধারায় যারা নাটক রচনা করেন তারা আর আমাদের চিন্তাধারার ব্যাপক ব্যবধান। যদি ইসলামের নিয়ম কানুন নিয়ে বাংলা নাটকগুলো রচিত হতো কতই না ভালো হতো। লেখক : অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক
আপনার মন্তব্য লিখুন