ভাষা বহতা নদীর মতো চঞ্চল। স্থিরতা এর স্বভাববিরুদ্ধ। পরিবর্তন পরিবর্ধন ভাষার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্যের কারণে যুগে যুগে নতুন কত ভাষার জন্ম হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই, আবার কালের গর্ভে কত ভাষা হারিয়ে গেছে তারও কোনো হদিস নেই। এ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান বিশ্বে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ভাষার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তবে সব ভাষাই সমান নয়। কোনো ভাষায় বেশি লোকে কথা বলে, আবার কোনো ভাষায় কথা বলে কম লোক। কোনো ভাষা আন্তর্জাতিকতা লাভ করেছে, আবার কোনো ভাষা আঞ্চলিকতা পর্যায়েই রয়েছে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা বিশ্বের অন্যতম প্রধান ভাষা। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যের প্রশাসনিক ভাষা বাংলা। ভারতের বিহার, আসাম ও মনিপুর রাজ্যের অনেক লোক বাংলা ভাষাতেই কথা বলে। বর্তমানে একাধিক দেশের প্রায় ৩০ কোটি মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। এ ছাড়া মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়, পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয়ে থাকে। বাংলাভাষা কবে থেকে শুরু হয়েছে তার নির্ধারিত সন-তারিখ নেই। ভাষা উৎপত্তির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো দিন তারিখ থাকেও না। দিন-ক্ষণ ঠিক করে কোনো ভাষার জন্মও হয় না। কোনো লোকগোষ্ঠীর দীর্ঘকালব্যাপী বোধগম্য শব্দ গ্রহণ, বর্জন ও সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে ভাষার জন্ম হয়। হঠাৎ করেই যেমন কোনো ভাষার উদ্ভব হয়নি। বাংলাভাষার ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। ভাষা গবেষকদের মতে এ অঞ্চলের স্থানীয় ভাষার সাথে বহিরাগত আর্যদের ভাষার সংমিশ্রণে প্রাকৃত-অপভ্রংশ রূপ ধারণ করে দীর্ঘদিন যাবৎ অনেক পরিবর্তন-পরিবর্ধনের মাধ্যমে বাংলাভাষার উৎপত্তি হয়েছে। বাংলাভাষা উৎপত্তির সঠিক কোনো ইতিহাস না থাকলেও ‘চর্যাপদ’কে বাংলাভাষার প্রাচীন নিদর্শন বলা হয়ে থাকে। তবে চর্যাপদের ভাষার সাথে বাংলাভাষার হুবহু মিল পাওয়া যায় না। চর্যাপদের ভাষা অস্পষ্ট। এ জন্য সাহিত্যিকরা এর নাম দিয়েছেন ‘আলো-আঁধারি’ বা ‘সান্ধ্যভাষা’। চর্যাপদকে ‘মৈথিলী’, ‘হিন্দি’, ‘উরিয়া’ ও ‘অহমি’ ভাষার আদি ভাষা হিসেবেও দাবি করা হয়। ‘হিন্দি’ ও ‘মৈথিলী’দের দাবি ধোপে না টিকলেও ‘উরিয়া’ ও ‘অহমি’দের দাবি একেবারে অযৌক্তিক নয়। কারণ চর্যাপদের সাথে উরিয়া ও অহমি ভাষার অনেক মিল আছে। যেমন মিল আছে বাংলাভাষার সাথে। এজন্য ভাষা গবেষকদের মতে বর্তমানে ভিন্নতার আগে বাংলা, উরিয়া ও অহমি ভাষার অভিন্ন রূপ থাকতে পারে। হতে পারে সে অভিন্ন রূপেই চর্যাপদ রচিত হয়েছে। তবে চর্যাপদের সময়কাল নিয়ে ভাষা গবেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, সুখময় মুখোপধ্যায় প্রমুখের মতে চর্যাপদ রচিত হয়েছে খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতকে। অন্যদিকে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে অষ্টম শতকে চর্যাপদ রচিত হয়েছে। তবে সবাই ঐকমত্য হয়েছেন পাল শাসনামলের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ সকল ভাষা গবেষকের মতে পাল আমলেই চর্যাপদগুলো রচিত হয়েছে। এসব চর্যাপদে তৎকালীন বৌদ্ধ ধর্মের বিধি-বিধান, সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, জীবন-জীবিকা, সামাজিক অবস্থা ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে। চর্যাপদের ব্যাকরণ, ছন্দ-অলঙ্কারের কিছু কিছু ব্যতিক্রম দৃষ্টিগোচর হলেও সেগুলোতে বাংলার আদিরূপই বিধৃত হয়েছে। অধিকাংশ চর্যাপদ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশে রচিত এবং এগুলো বাংলাভাষার নিজস্ব সম্পদ। তাই বলা যায় চর্যাপদই বাংলাভাষার শৈশবকাল। কিন্তু চর্যাপদের ভাষা স্থায়িত্ব লাভের আগেই ভারতের দক্ষিণ কর্নাটক থেকে আগত সংস্কৃতভাষী সেন শাসকেরা বাংলাভাষার চর্চা নিষিদ্ধ করেন। আর সংস্কৃত ভাষাকে করেন রাজভাষা। অধিকন্তু ‘রৈরব’ নামক নরকের ভয় দেখিয়ে বাংলাভাষাকে সাধারণ মানুষ থেকে দূরে রাখার কৌশল করেন তারা। এ ভয়ে সরকারি কর্মচারী ও উঁচু বর্ণের মানুষেরা বাংলাভাষা চর্চা বাদ দিলেও সাধারণ মানুষেরা তাতে কর্ণপাত করেননি। তারা ‘পক্ষীর বুলি’ তথা বাংলাভাষাকে ছাড়েননি এবং বিদেশী ভাষা সংস্কৃতকে মন থেকে গ্রহণ করেননি। ১২০৩ সনে তুর্কিবীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির নেতৃত্বে সেন শাসনের অবসান হলে এ দেশীয়রা আবার নতুন করে বাংলাভাষা চর্চা করার সুযোগ পান। তুর্কিরা বিদেশী হলেও তারা স্থানীয় বাংলাভাষাকে অবজ্ঞা করেননি। ফার্সিকে তারা রাজভাষা করলেও বাংলাভাষা নিষিদ্ধ করেননি। অধিকন্তু বাংলাভাষায় সাহিত্য চর্চায় উৎসাহ দিয়েছেন। তবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সংঘর্ষ-অস্থিরতা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা এবং সাংস্কৃতিক বিবর্তনের কারণে এ সময়ের উল্লেখযোগ্য কোনো সাহিত্য পাওয়া যায় না। তখন বাংলাদেশ কিংবা বাংলাভাষাভিত্তিক কোনো অঞ্চলও ছিল না। সুলতানি শাসনামলের প্রথম দিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে বিভক্ত ছিল বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী। হাজি শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ্ ১৩৫২ সনে বঙ্গ, রাঢ়, গৌড়, পুন্ড্রবর্ধন, লক্ষ্মণাবতী, হরিকেল, সমতট ইত্যাদি বাংলাভাষী অঞ্চলকে একত্রিত করে ‘সুবহি বাঙ্গালা’ নাম দেন। আর এর অধিবাসীদের নাম দেন ‘বাঙালি’। এতে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায় এবং বাংলাভাষার পুনর্জন্ম হয়। এ সময় বড়– চন্ডীদাস ‘শ্রী কৃষ্ণকীর্তন’ (১৩৫০) কাব্য রচনা করে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের বন্ধ্যত্ব ঘুচান। আর শাহ্ মুহাম্মদ সগীর ‘ইউসুফ জুলেখা’ (১৩৮৯-১৪১০) রচনা করে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে রোমান্টিকতার আবির্ভাব ঘটান। এ ছাড়া গিয়াসউদ্দীন আযম শাহ্, জালালুদ্দীন মুহাম্মদ শাহ্, রুকনুদ্দীন বারবাক শাহ্, আলাউদ্দীন হুসেন শাহ্ প্রমুখ শাসকের উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় মালাধর বসু, জৈনুদ্দীন, বিজয় গুপ্ত, কৃত্তিবাস, মুজাম্মিল, বিপ্রদাস পিপিলাই প্রমুখ কবি বাংলাভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। এরপর মোগল শাসনামলে সৈয়দ সুলতান, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, আব্দুল হাকিম, দৌলত উজির বহারাম খান, কোরেশী মাগন ঠাকুর, সৈয়দ আলাওল, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর প্রমুখের সাহিত্য সাধনায় বাংলাভাষা ও সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ১৭৫৭ সনে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলার শাসকের পরিবর্তনের সাথে ভাষা-সংস্কৃতিরও পরিবর্তন হয়। এতে বাংলাভাষার পুনর্জাগরণ স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং নিম্ন মানের মিশ্রভাষার ‘পুঁথি সাহিত্য’ ও ‘কবিয়াল গান’-এর আবির্ভাব ঘটে। এ সময় ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজিকে রাজভাষা করা হয়। উল্লেখ্য, মুসলিম শাসনামলে বাংলাভাষায় আরবি, ফার্সি, উর্দু, পর্তুগিজ, হিন্দিসহ অনেক বিদেশী শব্দের সমাবেশ ঘটে। আর ইংরেজ শাসনামলে বাংলাভাষায় ইংরেজি, ফরাসি, স্পেনিশসহ বিভিন্ন ভাষার অনেক শব্দ যোগ হয়। এতে বাংলাভাষার শব্দ ভাণ্ডার, সৌন্দর্র্য ও বৈচিত্র্য বেড়ে যায়। ইংরেজ শাসনামলের প্রথম দিকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ব্যাঘাত ঘটলেও পরে উন্নতি সাধিত হয়। ইংরেজ শাসনামলেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব হয়। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে শুধু কাব্য সাহিত্য পাওয়া যায়, এ সময় বাংলাভাষায় কোনো গদ্য সাহিত্য রচিত হয়নি। অন্যদিকে ইংরেজ শাসনামলে বাংলাভাষায় গল্প, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি গদ্য সাহিত্যের সূচনা হয়। এ সময় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মীর মশাররফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা, জীবনানন্দ দাশ, জসীম উদ্দীন, ফররুখ আহমদ প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক বাংলাভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। ১৯১৩ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যে নোবেল বিজয় বিশ্ব দরবারে বাংলা সাহিত্যের মর্যাদা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। তবে মুসলিম ও ইংরেজ শাসনামলে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি ও ব্যাপ্তি বাড়লেও কখনও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়নি। অথচ ভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না পেলে জাতীয় ভাষার উন্নতি ও মর্যাদা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না। তাই ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসন অবসানের পর বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) অধিবাসীরা বাংলাভাষা নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখেন। তারা বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন। কিন্তু উর্দুভাষী শাসকরা বাঙালিদের দাবি উপেক্ষা করে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। এতে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হন এ দেশের ছাত্র, রাজনীতিবিদসহ সর্বস্তরের জনতা। জেল-জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়ন উপেক্ষা করে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন করেন তারা। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সনের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮ বাংলা) তারিখে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, সালাউদ্দীন, শফিউদ্দীনসহ অনেকে। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৫৬ সালে তৎকালীন সরকার পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে। এই প্রথম বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। আর ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগ স্মরণীয় করে রাখতে আমাদের ‘শহীদ মিনার’ নির্মিত হয়েছে। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর ২১ শে ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ দিবস’ পালন করা হয়। আর ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর মাধ্যমে জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করেছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় দুই শতাধিক রাষ্ট্র এ দিবসটি পালন করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে বিশ্বদরবারে আমাদের মাতৃভাষার অবস্থান সুসংহত হয়েছে। আর এ ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা অর্জনের জন্য আত্মত্যাগ করে বাঙালির শ্রেষ্ঠসন্তান ভাষাশহীদগণ বিশ্ববরণীয় হয়েছেন। লেখক : শিক্ষক ও আহবায়ক, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব নন-গভর্নমেন্ট টিচার্স (ড্যাঙ্গট)
আপনার মন্তব্য লিখুন