ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক#
শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ কখন সঠিক মনে পড়ছে না। সম্ভবত ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে, লন্ডনে। আমার বার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ব্রিটেনে যুব আন্দোলন সংগঠিত করার দায়িত্ব আমার ওপর পড়েছে। পড়াশুনার ঝামেলা শেষ হয়ে যাওয়ায় নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছি। তখনকার ব্রিটেনের অবস্থা অনেক ভিন্ন ছিল। বাংলা ভাষাভাষী বেশির ভাগ মানুষই তখন শ্রমজীবী। তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার জন্য খুব একটা উৎসাহিত করা হতো না। ১৭-১৮ বছর পার হলেই কাজে লাগিয়ে দেয়া হতো। ছাত্র ও যুবকদের সংগঠিত করতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হচ্ছিল।
এমতাবস্থায় আমরা কিছু যুবককে হাতে নিয়ে কাজ শুরু করেছি হাঁটি-হাঁটি-পা-পা করে। অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম একটি যুব সম্মেলন করব। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বড়দিনের ছুটিতে সেই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো বার্মিংহামে, যা পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনের যুব আন্দোলনের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। ওই সম্মেলনের মাধ্যমেই যুবকদের কাজের ভিত্তি স্থাপিত হয়। সম্মেলনের জন্য বক্তা পাচ্ছিলাম না। ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়লাম। হঠাৎ খবর পেলাম ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ইংল্যান্ড সফর করছেন। যুব সম্মেলনে তিনি যে একজন উপযুক্ত মেহমান হবেন তাতে আমাদের কোনো সন্দেহ ছিল না। তাকে পেয়ে আমরা যারপরনাই আনন্দিত হলাম। অপর মেহমান ছিলেন তৎকালীন সময়ে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত একজন ছাত্র। যুবকদের সামনে উৎসাহব্যঞ্জক বক্তব্য রাখলেন কামারুজ্জামান ভাই। ব্যক্তিগতভাবে তাদের অনেকের সাথে মিশে গেলেন তিনি। যুবকেরাও তাকে পেয়ে খুবই আনন্দিত। ওই সম্মেলনের ৩৬ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর পেছনের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা ব্রিটেনে ইসলামী আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপনে শহীদ কামারুজ্জামান থেকে এক ঐতিহাসিক খেদমত নিয়েছিলেন।
১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইরানে শাহের পতন হয় এবং ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হয়। ইরান বিপ্লব বিশ্বরাজনীতিকে প্রভাবিত করে। বিপ্লবের মাত্র কয়েক মাস আগে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার তার ইরান সফরকালে বলেছিলেন, ‘সঙ্ঘাতময় বিশ্বে ইরান একটি শান্তির দ্বীপ।’ ইরান বিপ্লব, গোটা মুসলিম বিশ্বের ওপর এর প্রভাব, মধ্যপ্রাচ্যসহ বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন এবং পাশ্চাত্যে ইসলামের ভবিষ্যৎ এসব খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাথে অনেক দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ হয়। সেই সময়ে তার বিচক্ষণতা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা এবং সর্বোপরি তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার সাথে আমি পরিচিত হই।
তারপর ১৯৮২ সালে গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটাতে বাংলাদেশে যাই। তখন তিনি দৈনিক সংগ্রামের একজন সাংবাদিক। সংগ্রাম অফিসেই তার সাথে সাক্ষাৎ করি। সাক্ষাতের সময় আমার হাতে বার কাউন্সিলের আইনজীবী হিসেবে এনরোলমেন্টের জন্য কিছু কাগজপত্র ছিল। এসব কাগজ দেখে আমি কিছু বলার আগেই মেধাবী এই সাংবাদিক বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমি দেশে ফিরে আসার পরিকল্পনা করছি। তিনি খুশি হন এবং আমাকে দেশে ফিরতে উৎসাহিত করেন। ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি ইংল্যান্ডের প্রবাসজীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বাংলাদেশে ফিরে আসি। তখন থেকে তার সাথে আমার সম্পর্ক গভীর হয়। ১৯৮৬ সালের শুরুতে আন্দোলন নিয়ে বিস্তারিত কথা বলার জন্য তাকে আমার বাসায় দাওয়াত করি। তিনি তখন জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় নেতা। বিনা সঙ্কোচে তিনি আমার বাসায় আসেন। অনেক রাত পর্যন্ত তার সাথে আলোচনা হয়। সেদিন থেকেই আমি লক্ষ্য করলাম তার সাথে আমার চিন্তার অদ্ভুত মিল রয়েছে। অবশ্য তার সাথে যে আমার দ্বিমত হতো না তা-ও নয়। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী যখন যুগপৎভাবে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল, তখন আন্দোলনের ধরন নিয়ে তার সাথে আমার মতপার্থক্য হয়। ১৯৯৬-এর জুন মাসের সংসদীয় নির্বাচনের ফলাফল জামায়াতে ইসলামীর জন্য মোটেই সুখকর ছিল না। নানা কারণে আমার মনটা খুব খারাপ ছিল। অনেক দিন কারো সাথেই কোনো যোগাযোগ রাখিনি। হঠাৎ একদিন দেখি উনি আমার মতিঝিলের ল-চেম্বারসে এসে হাজির। আলাপ-আলোচনার একপর্যায়ে বললেন, ‘আমাদের ওপর বোধ হয় রাগ করেছেন, কোনো যোগাযোগ রাখছেন না এবং আইন পেশায় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত রেখেছেন।’ তার কথার কী জবাব দিয়েছিলাম তা আজ আমার মনে নেই, তবে তিনি যে একজন অসাধারণ বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছিলেন এবং আপনজনকে যে কখনো উপেক্ষা করতেন না, সে বিষয়টি আমি খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করেছিলাম। তিনি ছিলেন সাহসী ও দূরদর্শী। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর জামায়াতে ইসলামী সরকারে অংশগ্রহণ করে। ২০০৩-০৪ সালে জোট সরকার দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিল। জামায়াতে ইসলামীর কর্মপরিষদে তিনি প্রস্তাব দিলেন, আমরা সরকারে থাকলেও যারা মন্ত্রিসভায় নেই তাদের পক্ষ থেকে এসবের প্রতিবাদ জানানো উচিত। আমার মতও তাই ছিল। আমি আরো এক ধাপ অগ্রসর হয়ে ব্রিটেনের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলাম : সেখানকার রাজনৈতিক দলের প্রবীণ নেতৃবৃন্দ, যারা মন্ত্রিসভার সদস্য নন, নিজ দলের মন্ত্রিসভারও সমালোচনা করেন। একদিন পত্রিকায় দেখলাম কামারুজ্জামান ভাই জোট সরকারের আইনশৃঙ্খলা ও দ্রব্যমূল্য সংক্রান্ত ব্যর্থতার সমালোচনা করেছেন। এ সমালোচনা তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার পরিচয় বহন করে। ছাত্রশিবিরকে নিয়ে তিনি সব সময় ভাবতেন। ২০০৯ সালে একটি সম্মেলনে যোগদানের জন্য তিনি সিঙ্গাপুর যেতে চেয়েছিলেন। সরকার তাকে বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেয়। তখন তার মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না। আমি বিষয়টি নিয়ে তার সাথে আলাপ করলাম। তিনি জবাব দিলেন, ‘আমাদের ভাগ্যে যা হওয়ার তাই হবে, ছাত্রশিবিরের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছি।’ ছাত্রদের পড়াশুনা, তাদের ক্যারিয়ার এবং তারা সঠিকভাবে গড়ে উঠছে কি নাÑ এসব বিষয় নিয়ে তিনি গভীরভাবে চিন্তিত ছিলেন।
২০১০ সালের মার্চ মাসে ‘যুদ্ধাপরাধ’ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। ওই সময় আন্দোলনকে নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত ছিলেন এবং বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে অনেক মন্তব্য করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতি বছরই গ্রীষ্মকালে সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন সময়ে আমি ইউরোপ ও আমেরিকা সফর করি। ২০১০ সালের জুন মাসের শুরুতে আমি আমেরিকা ছিলাম। ওই মাসের শেষে লন্ডন আসি। লন্ডন আসার কয়েক দিন পর আমীরে জামায়াত, সেক্রেটারি জেনারেল ও মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী একই সাথে গ্রেফতার হন। আমার তখন জার্মানি সফরের কথা ছিল। জার্মানির পররাষ্ট্র দফতরে সাক্ষাৎকারের একটা দিন-তারিখ ঠিক হয়েছিল। নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের কারণে জার্মানি সফর বাতিল করে দ্রুত বাংলাদেশে ফিরে আসি। দ্রুত ফিরে আসার পেছনে আরো একটা কারণও ছিল- আবদুল কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামান ভাইয়ের জন্য হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নেয়া। ১৩ জুলাই তারা হাইকোর্টে জামিনের জন্য হাজির হন। আমি তাদের আইনজীবী। অ্যাটর্নি জেনারেল কোনো কারণ ছাড়াই সময়ের প্রার্থনা করলেন। আমরা সময়ের প্রার্থনার বিরোধিতা না করে পরবর্তী শুনানি না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন জামিন প্রদানের আবেদন করলাম। দ্বৈত বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এতে রাজি হলেন। কিন্তু কনিষ্ঠ বিচারপতির বিরোধিতার কারণে জামিন পাওয়া গেল না। খবর পেলাম, পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের সব দরজা বন্ধ করে শুধু প্রধান ফটক খোলা রেখেছে। কী ঘটতে যাচ্ছে তা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হলো না। অ্যাটর্নি জেনারেলের সময় প্রার্থনার মাহাত্ম্যও বোঝা গেল। আমরা নিশ্চিত হলাম মোল্লা ভাই ও কামারুজ্জামান ভাই বের হলেই গ্রেফতার হবেন। এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠলোÑ কে প্রথমে সুপ্রিম কোর্ট ভবন থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করবেন। কারো কোনো কথা বলার আগেই শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা দ্বিধাহীন চিত্তে বললেন, ‘আমি আগে যাবো। কামারুজ্জামান ভাই আমার পরে যাবেন। এ বিষয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই।’ শহীদ আবদুল কাদের মোল্লার এই দ্বিধাহীন বলিষ্ঠ বক্তব্যে আমি অনেকটাই বিস্মিত হয়েছিলাম। সুপ্রিম কোর্টের গেটে যাওয়ার সাথে সাথে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তারপর কামারুজ্জামান ভাইকে বিদায় দেয়ার পালা। আমরা সবাই যৌথভাবে তার জন্য দোয়া করে অশ্রুভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাকে বিদায় জানালাম। অনেকের মধ্যে সেখানে ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো: তাহেরও উপস্থিত ছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের গেটে আসতেই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। যদিও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তাদের এই গ্রেফতার থেকে বিরত থাকা উচিত ছিল। ১৩ জুলাই ২০১০ সাল ছিল দুই শহীদÑ আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের স্বাভাবিক মুক্তজীবনের শেষ দিন।
ট্রাইব্যুনালের মামলা নিয়ে তিনি প্রায়ই বলতেন, আপনারা এত কষ্ট করে কেন বিচারকার্য পরিচালনা করছেন? বিচারের ফলাফল তো সবারই জানা। ২ নম্বর ট্রাইব্যুনালে তার মামলা চলছিল। সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণের পর যুক্তিতর্কের পালা। যুক্তিতর্কের দু’টি দিক ছিল। ১. মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধের আইনের ব্যাখ্যা; ২. সাক্ষ্যপ্রমাণের যথাযথ বিশ্লেষণ। বাংলাদেশের ফৌজদারি মামলা পরিচালনায় আমার বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু কামারুজ্জামান ভাইয়ের মামলায় আইনগত দিক এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ সংক্রান্ত দলিলদস্তাবেজ খুব ভালোভাবে রপ্ত করার চেষ্টা করলাম। টানা চার-পাঁচ দিন তার মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করলাম। একপর্যায়ে ট্রাইব্যুনালের মাননীয় চেয়ারম্যান আমাকে বললেন : ‘আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা আপনার কাছ থেকে শুনতে আমরা খুব আগ্রহী। কিন্তু সাক্ষ্যপ্রমাণের বিশ্লেষণ নিয়ে আপনার এত কষ্ট করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। অন্য কাউকে আপনি এই দায়িত্ব দিলেও পারতেন।’ মাননীয় বিচারপতির বক্তব্যে হয়তো সারবত্তা ছিল; কিন্তু কামারুজ্জামান ভাইয়ের পক্ষে সব ধরনের যুক্তিপ্রমাণ উপস্থাপনের ঐতিহাসিক সুযোগ থেকে আমি নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইনি। তা ছাড়া কামারুজ্জামান ভাইয়ের সাথে আমার ব্যক্তিগত যে সম্পর্ক ছিল মাননীয় বিচারপতির তা জানা থাকার কথা নয়। আমরা তার মামলার সাথে প্রাসঙ্গিক দেশ-বিদেশের উচ্চ আদালতের নজিরসহ যুক্তি ও প্রমাণ উপস্থাপন করছিলাম, আর তিনি ‘আসামির’ কাঠগড়ায় বসে তা শুনছিলেন। যুক্তিপ্রমাণ উপস্থাপন শেষ হলে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। এর কয়েক দিন পর কারাগার থেকে লেখা তার একটি চিঠি পেলাম। লিখেছেন, আমি এবং আমার জুনিয়র এহসানকে উদ্দেশ করে। তাতে আমাদের পেশাগত দক্ষতার প্রশংসা করেছেন এবং তার পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তার এই সৌজন্যে আমি সত্যিই অভিভূত হয়েছিলাম। আমার দুর্ভাগ্য, সুপ্রিম কোর্টে তার আপিল ও রিভিউ পিটিশন শুনানির সময় আমি অনুপস্থিত ছিলাম। এটা আমার জন্য খুই বেদনাদায়ক। দীর্ঘ ১৬ মাস ধরে আমাকে বিদেশে নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হচ্ছে। ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্টে শহীদ কামারুজ্জামানের আপিল আবেদন খারিজ হয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই তড়িঘড়ি করে তার রায় কার্যকরের চেষ্টা করা হয়। এ অবস্থায় একদিন তার বড় ছেলে ওয়ামির ফোন পেলাম। সে বলছিল, ‘চাচা, আব্বুর ভাগ্যে যা আছে তা তো হবেই, কিন্তু মোল্লা চাচার মতো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করত তাহলে আমরা পরিবারের লোকজন কিছুটা হলেও সান্ত¡Íনা পেতাম।’ এরপর আটলান্টিক মহাসাগরের উভয় তীরে জাতিসঙ্ঘসহ বিপুলসংখ্যক মানবাধিকার সংগঠন এই মর্মে জোরালো প্রতিবাদ জানায় যে, আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ এবং রিভিউ পিটিশন শুনানি না হওয়া পর্যন্ত যেন চূড়ান্ত শাস্তি বাস্তবায়ন করা না হয়। যার ফলে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়া এবং রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা থেকে বিরত থাকতে। শেষ পর্যন্ত এপ্রিল মাসের ১১ তারিখে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পূর্ব পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মৃত্যুদন্ড যাতে কার্যকর না হয় এর পক্ষে জোরালো দাবি জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার’ যে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার দুনিয়াতে নতুন কিছু নয়। আজ থেকে ৭০ বছর আগে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে সর্বপ্রথম নুরেমবার্গ ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হয়। তার পরে টোকিও, সাবেক যুগোস্লøাভিয়া, রুয়ান্ডা, সিয়েরালিয়ন, কম্বোডিয়া, পূর্ব তিমুর, লেবাননসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হয়েছে। এসব বিষয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ছিলেন সামরিক বিভাগের লোক। এর বাইরে যারা ছিলেন তারা ছিলেন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধিকারী। স্মরণ করা যেতে পারে, যে সময়ে কামারুজ্জামান ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল তখন তার বয়স ছিল ১৮-১৯। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ ছিল তা হচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো সুশৃঙ্খল বাহিনীর ওপর তার কর্তৃত্ব ছিল। এটা যুগপৎভাবে অবিশ্বাস্য ও নজিরবিহীন। শহীদ কামারুজ্জামান ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করিয়ে প্রতিহিংসাবাদীরা হয়তো বিজয়ের হাসি হেসেছেন, কিন্তু তারা জানেন না দ্বীন-দুনিয়ার মালিক কী অভিভাষণে তাকে পরকালে স্বাগত জানাবেন। আল কুরআনের ভাষায়- ‘তাকে বলা হলো, জান্নাতে প্রবেশ করো। সে বলল, হায় ! আমার জাতি যদি কোনোক্রমে জানতে পারতো কিভাবে আমার পরোয়ারদিগার আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিতদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।’ (৩৬ : ২৬-২৭)
রাজনীতি একটি কঠিন ও জটিল বিষয়। রাজনীতিবিদদের দূরদর্শী হতে হয়। কামারুজ্জামান ভাইয়ের রাজনীতি বিশ্লেষণী ক্ষমতা যে কতটা পরিপক্ব ছিল এবং তিনি যে কতটা দূরদর্শী ছিলেন তার প্রমাণ মেলে কারাগার থেকে ২০১০ সালে প্রকাশ করা এক ভাবনায়। ফাঁসির মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজের জীবন রক্ষার উদ্বেগের পরিবর্তে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নিয়েই ছিলেন উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের জটিল রাজনৈতিক সমস্যার অত্যন্ত গভীরে তিনি পৌঁছতে পেরেছিলেন এবং এর সমাধানের জন্য জাতীয় রাজনীতিতে হানাহানি বন্ধ করে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টির প্রস্তাবনা রেখেছিলেন। তিনি দৃঢ়ভাবে এই মত ব্যক্ত করেছিলেন যে, শুধু এভাবেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব। তিনি ১১টি পয়েন্টের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের বর্তমান সঙ্কটপূর্ণ অবস্থা বিশ্লেষণ করে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন মাত্র চার বছর অতিবাহিত হওয়ার পর তা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি যে এতটা দূরদর্শী ছিলেন তার জীবদ্দশায় এ সত্যটা অনুধাবন করতে পারিনি বলে আজ খুবই আক্ষেপ করছি।
শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল শনিবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১০টায় দুনিয়াবাসী তাকে চিরবিদায় জানিয়েছে অশ্রুভারাক্রান্ত হৃদয়ে। এখন তিনি আছেন আসমানবাসীর তত্ত্বাবধানে। আল কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা : ‘আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাদেরকে কখনো মৃত মনে কোরো না; বরং তারা তাদের পালনকর্তার কাছে জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত।’(৩ : ১৬৯)
আজ এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, কামারুজ্জামান ভাই আর আমাদের মাঝে নেই। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, আমার ধানমন্ডির বাসভবনে তাকে আর কোনো দিন অভ্যর্থনা জানাতে পারব না। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, আমার নয়া পল্টন ল-চেম্বারসে তিনি আর কোনো দিন সাক্ষাৎ করতে আসবেন না। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, টেলিফোনে তার কণ্ঠস্বর আর কোনো দিন শুনতে পারব না। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, তার হাসিমাখা মুখ এই দুনিয়ায় আর কোনো দিন দেখতে পাবো না। কামারুজ্জামান ভাই ছিলেন বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের এক বিরল ব্যক্তিত্ব। ইসলামী আন্দোলনের আকাশে আরেকজন কামারুজ্জামানের আবির্ভাব কবে ঘটবে দূর প্রবাসে বসে জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় (অঁঃঁসহ ড়ভ ষরভব) তাই ভাবছি আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে আরজি জানাচ্ছি তিনি যেন ভাই কামারুজ্জামানের শাহাদত কবুল করে তাকে জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান দেন এবং ইসলামী আন্দোলনে তার অভাব পূরণ করে দেন।
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট