post

আমিরাত

ইসরাইল চুক্তির নেপথ্যে সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

০৫ অক্টোবর ২০২০

সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবেই ফিলিস্তিনি জনগণের দীর্ঘদিনের মুক্তি সংগ্রামের সাথে বিশ^াসঘাতকতা করে গত আগস্টে সংযুক্ত আরব আমিরাত ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের সাথে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছে। হোয়াইট হাউজে চুক্তি সম্পাদনের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উপস্থিত ছিলেন। সদ্য স্বাক্ষরিত এই চুক্তিকে কেউ কেউ ইতিবাচক মনে করলেও খুব একটা আশাবাদী হতে পারছেন না বিশে^র শান্তিপ্রিয় মানুষ। চুক্তির ফলে ইসরাইলের সাথে আমিরাতের বিমান চলাচল, নিরাপত্তা, টেলিযোগাযোগ, প্রযুক্তি, বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতা দূর হলেও ফিলিস্তিন পরিস্থিতিতে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশ^স্ত হওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট টমাস এল ফ্রিডম্যানের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, এই চুক্তি ‘মধ্যপ্রাচ্যে ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকম্পের সমতূল্য। ১৯৭৯ সালে ইসরাইল-মিসর চুক্তির ফলে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে প্রাণ দিতে হয়েছিল।’ চুক্তিটি স্বাক্ষরের পর আমিরাত ও ইসরাইলের দেয়া যৌথ বিবৃতি টুইটারে নিজ অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পোস্টে তিনি লেখেন, ‘বিশাল এক অর্জন এসেছে আজ। আমাদের ঘনিষ্ঠ দুই মিত্র ইসরাইল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ঐতিহাসিক এক শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।’ চুক্তিবদ্ধ দুই দেশের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘মধ্যপ্রাচ্যে এ চুক্তি শান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখবে। তিন নেতার দূরদর্শী কূটনীতিক বিবেচনা এবং লক্ষ্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই চুক্তি। যার মধ্যে দিয়ে অত্র অঞ্চলে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে আমিরাত ও ইসরাইল।’ কিন্তু এসব বক্তব্যের সাথে একমত হতে পারছে না বিশে^র আত্মসচেতন মানুষ। কারণ, বহুল আলোচিত এই চুক্তিতে ‘ইসরাইল জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ করবে না’ বলে অঙ্গীকার করলেও মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই দেশটি সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্টের অনুরোধ রক্ষার জন্য বসতি স্থাপন সাময়িক স্থগিত রাখা হবে’। ফলে এই চুক্তি বিশ্বজুড়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বাহরাইন, মিসর, ওমান, জর্দান, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জাতিসঙ্ঘ চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। ইসরাইলের পক্ষে চুক্তির ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। ফিলিস্তিন এই চুক্তিকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ আখ্যা দিয়েছে। তুরস্ক আমিরাতের এই ‘ভণ্ডামিপূর্ণ আচরণ’ ইতিহাস ও মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ কখনো ক্ষমা করবে না বলে সতর্ক করে দিয়েছে। ইরান এই চুক্তি ‘বিপজ্জনক ও অবৈধ’ বলে আখ্যা দিয়েছে। সৌদি আরব এই চুক্তি নিয়ে রহস্যজনকভাবে নীরব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রিয়াদ-তেলআবিবের মধুচন্দ্রিমা চলমান থাকলেও জনরোষের আশঙ্কায় সৌদি আরব কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। মূলত, ইহুদি আগ্রাসন ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে যখন বিশ্বের মানবতাবাদী ও শান্তিপ্রিয় মানুষ বিশেষত মুসলিম উম্মাহ সোচ্চার, ঠিক সে মুহূর্তে ইসরাইল-আমিরাত চুক্তি উম্মাহর চেতনায় বড় ধরনের আঘাত বলেই মনে করা হচ্ছে। মূলত ১৯১৭ সালে বেলফোর ডিক্লারেশনের মাধ্যমে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর ফিলিস্তিনকে ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষণা দেন। সে ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালে অবৈধ ইহুদিবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রের পথচলা শুরু। ১৮৮২ সাল থেকে ইহুদিদের অভিবাসন প্রক্রিয়া শুরু হলেও হিটলারের নিধনযজ্ঞ থেকে বাঁচার জন্য হাজার হাজার ইহুদি ফিলিস্তিনে এসে বসতি স্থাপন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে হিটলার ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করে। বাকিরা ফিলিস্তিনে আশ্রয় নেয়ার ফলে সাত লাখ ফিলিস্তিনি স্থায়ীভাবে নাগরিক বাস্তুচ্যুত হন। তারা আর নিজ ভূমে ফিরে যেতে পারেননি। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলের দখলদারিত্বের পর ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে তাদের সাথে আরবদের যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু কোন যুদ্ধেই আরবরা জয়লাভ করতে পারেনি। ইহুদিরা সব যুদ্ধেই পশ্চিমা সকল ধরনের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। ফলে যুদ্ধের ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। আরবদের সাথে সঙ্ঘাতের ইতিহাসে ২০০৬ সালে ইসরাইলি সেনারা লেবাননের হিজবুল্লাহ গেরিলাদের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়। ৩৪ দিনের এই লড়াই জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় শেষ হয়। ইসরাইলের সাথে এর আগে মিসর ও জর্দান কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের পথচলাকে সহজ করে দিয়েছে। আর আরব আমিরাতের সাথে তথাকথিত শান্তিচুক্তির ফলে ইহুদিরা এখন রীতিমত ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছে। তুর্কি আনাদুলু বার্তা সংস্থার সংবাদে বলা হয়েছে, নেতানিয়াহু গত দুই বছরে দু’বার গোপনে আমিরাত সফর করেছেন। নতুন চুক্তির পর সে সুযোগ আরও অবারিত হলো। মূলত ইসরাইলের সূচনালগ্ন থেকেই আরবরা পর্যুদস্ত হয়ে আসছে। আর সাম্প্রতিক আমিরাত-ইসরাইল শান্তিচুক্তি সার্বিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। কারণ, এই চুক্তি আরবদের মধ্যে বড় ধরনের বিভাজন সৃষ্টি করেছে। যা আমিরাতের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবেই বিবেচনা করছে সংশ্লিষ্টরা। সদ্য সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ ঘোষণা প্রকাশ্য দেয়া হলেও আমিরাত ও ইসরাইল উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্কের গোপন-বন্ধন চলছে ১৯৯০ সাল থেকে। এর নানাবিধ কারণও রয়েছে। মূলত আমিরাত ও ইরানের মাঝ বরাবর কৌশলগত গুরুত্ববহ হরমুজ প্রণালী। এ ক্ষেত্রে ইরান বেশ সুবিধাজনক পর্যায়ে রয়েছে। ইরানকে পর্যুদস্ত করার একটি উপায় হলো হরমুজের কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেয়া। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও এতে কেউ সফল হয়নি। বছরখানেক আগে ব্রিটিশ রয়েল নেভিও এখানে রীতিমতো নাকানি-চুবানি খেয়েছে। সাম্প্রতিক চুক্তির ফলে ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্র হরমুজকে নিজ তত্ত্বাবধানে আনতে আমিরাত সহায়ক হবে মনে করা হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই ইরান আমিরাতের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। ঘোষণার দুই দিনের মাথায় ইরান আমিরাতের জাহাজ ও ক্রুদের ধরে নিয়ে গেছে। ফলে পরিস্থিতির যে অবনতি হতে শুরু করেছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ইসরাইল ও আমিরাতের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই সাদৃশ্য রয়েছে। উভয় দেশই মিসরের অকৃত্রিম বন্ধু। দেশগুলো ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একাত্ম। আরব বিশ্বের ধনকুবের ও সৌদি পরিবারগুলো বিভিন্ন উৎসবে বিশেষ করে অবকাশ যাপনের নামে মৌজ-ফুর্তি করার জন্য মাঝে মধ্যেই দুবাই সফর করেন। বিরাট মলগুলোতে পণ্য বিক্রির জন্য ইসরাইল দশকের পর দশক ধরে বিভিন্ন পন্থায় বিভিন্ন উপায় ব্যবহার করেছে। সাম্প্রতিক চুক্তির ফলে অবারিতভাবে ইসরাইলি পণ্য দুবাই, শারজাহসহ আমিরাতের বড় নগরগুলোকে উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। উভয় দেশ নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও কয়েক বছর ধরে গোপনে কাজ করে যাচ্ছে বলে সম্প্রতি প্রাপ্ত তথ্যে জ্ঞাত হওয়া গেছে। ভৌগোলিক দিক আমিরাত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হলেও সাম্প্রতিক সময়ে বিশ^রাজনীতিতে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে বলে দৃশ্যত মনে হচ্ছে। মালি, লিবিয়া, ইয়েমেন, তুরস্ক, বলকান, মুসলিমবিরোধী সার্বিয়া, ভারত ও চীন- সব জায়গাতেই আমিরাতে রয়েছে সরব পদচারণা। অবশ্য সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আমিরাতের নিজেদের ওপর খুব একটা নিয়ন্ত্রণ নেই। নিজেদের অফুরন্ত সম্পদকে বিদেশীদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য উজাড় করে দিচ্ছে দেশটি। তুর্কি প্রধানমন্ত্রী কুলুসি আকার বলেছেন, ‘কয়েকটি দেশ রিমোটের সাহায্যে দেশটি চালাচ্ছে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য।’ বিষয়টি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির ক্ষেত্রে মোটেই ইতিবাচক নয়। মূলত সংযুক্ত আরব আমিরাত নিজেদের আত্মপরিচয় ভুলে গিয়ে শুধুই বৈশি^ক প্রভু তোষণের জন্য কথিত আধুনিক অবকাঠামো তৈরি করে চলেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে ভ্যালি, লেক, মন মাতানো হোটেল, সর্বাধুনিক দোকান ও মল। পশ্চিমাদের সাথে পাল্লা দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে এসব। ইহুদিরা নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে। কিন্তু এসব বিষয়ে আমিরাতের কোন মাথাব্যথা নেই। আমেরিকার সিআইএ ও ইসরাইলের মোসাদের প্রেসক্রিপশন অনুসারে চলছে দেশটি। আমেরিকার সাবেক সেক্রেটারি অব স্টেট কন্ডোলিজা রাইস যেকোনো আরব জাগরণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ২০০৬ সালে গোপন পরিকল্পনা করেছিলেন বলে জানা গেছে। আমেরিকার সরকারগুলো ইহুদিবাদী প্রাধান্য আরব বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করতে অতিমাত্রায় তৎপর। আরব দেশগুলো তেলের প্রাচুর্যে এখন বিশ্ব অর্থনীতির এক বড় শক্তি। তাই তাদের লাগাম লাগানোর জন্য পশ্চিমা দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে অনেক আগে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে চাপিয়ে দিয়েছে। মূলত, ইসরাইল যত শক্তিশালী হবে, মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ততই বাড়বে। সঙ্গত কারণেই তারা ইসলাম ও ইসলামী আদর্শ তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বানিয়েছে। তাই তারা নানা ছল-ছুতাই মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়িয়েই চলছে। আর এতে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে আবর বিশে^র কিছু রাষ্ট্র। সাম্প্রতি ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে সে দলে শরিক হয়েছে সংযুক্ত আরব অমিরাত। আর এদের আসল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেয়া। এক্ষেত্রে কতিপয় আবর রাষ্ট্র বিলিয়ন ডলার খরচ করছে ইসলামী জাগরণ ঠেকানোর জন্য। ক্ষমতা রক্ষার জন্য তারা জনজাগরণে সবসময়ই ভীত-সন্ত্রস্ত। তাদের সবচেয়ে বেশি ভয় মুসলিম ব্রাদারহুডকে। আবুধাবি ও রিয়াদ এই সংগঠনকে অনাকাক্সিক্ষতভাবে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। আমিরাত তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্র হত্যার মত আত্মঘাতী খেলায় মেতেছে। মিসরে মুরসিকে দমনের জন্য আবদেল ফাত্তাহ সিসিকে সব ধরনের সহায়তা দিয়েছে আরব আমিরাত। ইয়েমেনে ও আমিরাত সৌদি কোয়ালিশনে যোগ দিয়েছে ২০১৫ সালে। আফ্রিকার সোমালিয়া ও জিবুতিতেও আমিরাত স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে বাতিল করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। পূর্ব আফ্রিকায় আমিরাতের রাজনৈতিক কোনো এজেন্ডা না থাকলেও অনেক কাজ করে চলছে। ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায় তাদের টেলিভিশন নেটওয়ার্কের কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। আমিরাত জোর চেষ্টা চালাচ্ছে ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ার মধ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য। সোমালিয়ায়ও শান্তি স্থাপনের কাজ করছে ও অর্থ ঢালছে আমিরাত। অর্থের অভাবে যে কাজটি ব্রিটিশরা করতে পারেনি সেটি সম্পন্ন করছে আমিরাত। এখন সোমালিয়ায় ব্রিটিশদের শান্তি প্রচেষ্টার ভূমিকা আমিরাতের কারণে নেই বললেই চলে। আমিরাত সুদানকে বিশেষভাবে টার্গেট করে মাঠে নেমেছে। শোনা যাচ্ছে, মিসর ও সুদানের মধ্যে সমস্যা সমাধানে আমিরাত বেশ তৎপর। দক্ষিণ সুদান আলাদা দেশ হওয়ার পর তেল খাতের রাজস্ব হারিয়েছে মূল সুদান। ইসরাইল যেখানে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না, সেখানে আমিরাত মাঠ চষে বেড়াচ্ছে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমিরাত মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যার বোঝা ঢেলে দিচ্ছে আফ্রিকায়। এ মহাদেশে তুরস্কের মানবিক কর্মসূচি এবং চীনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড রুখে দেয়ার মতো কোনো পলিসিই আমিরাত-ইসরাইলের নেই। আফ্রিকায় তুরস্ক-চীনের এজেন্ডা আমিরাত-ইসরাইলের কাজে সঙ্ঘাত সৃষ্টি করে আমিরাতের জন্য একসময় বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট তুরস্ক ও কাতারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে রাজি নয়। তাই ওদেরকে আমিরাতের অনুকূলে আনার প্রচেষ্টা যেকোনো সময় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সোমালিয়া ইথিওপিয়ার অধীনে ছিল ৪০ বছর। এখন সেটি মিটমাট করে মোগাদিসু বিমানবন্দর খুলে দেয়া হয়েছে এবং বেসামরিক বিমান চলাচল করছে। সমালোচকরা বলছেন, আফ্রিকায় বাণিজ্য করা আমিরাতের প্রথম উদ্দেশ্য। দুবাইয়ের মাধ্যমে অনেক আফ্রিকান দেশ বিশ্ব বাণিজ্যে অংশ নিয়ে থাকে। ইথিওপিয়া কম ট্যাক্সে দুবাই থেকে আমদানি করে। আমিরাত এই দেশটিকে হাত ছাড়া করতে চায় না। কিন্তু তুরস্ক আমিরাতের এই বাণিজ্যে একটি বড় বাধা। তুরস্কের উন্নতমানের প্রডাক্ট আমিরাতের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আমিরাতের মিডিয়ার চেয়ে তুর্কি টেলিভিশন ও সিরিয়াল আফ্রিকায় দ্রুতগতিতে বাজার দখল করছে। আফ্রিকানরা এখন দুবাইয়ের পরিবর্তে ইস্তাম্বুল, বুশরা, কাপাদোসিয়া ও আনাতোলিয়ামুখী। চীনের কর্মসূচি বৃহৎ শক্তিগুলোর চেয়ে আলাদা হওয়ায় আমিরাত-ইসরাইল জোট তেমন সুবিধা করতে পারছে না। এদিকে ইরানও উপসাগরীয় ও পূর্ব আফ্রিকায় নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। আমিরাত জোট সেটি বন্ধ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইরান অনেক আগে থেকেই ‘শিয়া মতবাদ’ ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করছে। অনেক স্থানে সৌদি আরবের ‘ওয়াহাবিজম’ খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে ইরান কিছুটা হলেও এগিয়ে রয়েছে। আন্তর্জাতিক মহল মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল-আমিরাত ইরানের একহাত নেয়ার সাথে সাথে তুরস্ককে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো শিক্ষা দেয়ার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা শুরু করেছে। আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনোয়ার গারগাশ বলেছেন, এই চুক্তি শুধু ইরানের প্রতি মেসেজ নয়। গারগাশ তুরস্কের ‘সা¤্রাজ্যবাদী লোভ’ আর ‘আরবদের ব্যাপার’ নিয়ে মাথা ঘামানোর সমালোচনা করেছেন। ইসরাইল ও আমিরাত, মিসর, গ্রিস, সৌদি আরব ও ফ্রান্সকে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের জন্য বিপদ দাঁড়িয়েছে। তুরস্ক বলেছে, তাদের সামরিক শক্তি এই সম্মিলিত বাহিনীকে মোকাবেলা করতে সক্ষম। আর এ বিষয়ে আমিরাতের বক্তব্যে সাম্প্রতিক চুক্তির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কোন ভাবেই অপ্রকাশ্য থাকেনি। চুক্তির শর্তানুযায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনুরোধে এবং আরব আমিরাতের সমর্থনের কারণে-ইসরাইল নির্দিষ্ট এলাকার উপর নিজ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া আপাতত বন্ধ রাখবে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাস্তি পরিকল্পনার আওতায় আরব এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির উদ্যোগ হিসেবে ইসরাইল এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানানো হয়েছে। আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ পশ্চিম তীরে ইসরাইলি অধিগ্রহণ সম্পূর্ণ বন্ধ করেছে বলে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। দাবি করেছেন তিনি বিশাল কিছু জয় করে ফেলেছেন। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়েছে। যা ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড অধিগ্রহণ বন্ধ করবে। কিন্তু বাস্তবতার সাথে তার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে ইয়েমেনে আগ্রাসন, মিশরে সিসি সরকার প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক মতামত দমনের মতো-আরব এবং মুসলিম বিশ্বের চোখে যেসব অপরাধ করেছেন বিন জায়েদ, নিজের হাত থেকে সেই কলঙ্কের দাগ মুছে যাবে এমন আশা করছেন এ চুক্তির মাধ্যমে। কিন্তু ইসরাইলের সঙ্গে চুক্তি তার কৃত কলঙ্কের তালিকা আরও দীর্ঘায়িতই করেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এই চুক্তির মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হলেও এতে তিনি কোনভাবেই সফল ও সার্থক হননি। ইসরাইলের সাথে সাম্প্রতিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর আরব আমিরাত ও দেশটির মিত্রদের পক্ষে অনেক সাফল্য গাঁথা প্রচার করা হলেও তা কোন মহলের কাছেই গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক অবস্থায় আনা এবং শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্ত দুই আঞ্চলিক সহযোগী পরস্পরের আরো ঘনিষ্ঠ হবে। এখন মধ্যপ্রাচ্যে কূটনৈতিক, বাণিজ্য এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধি ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-কৌশলগত লক্ষ্য পূরণে সহযোগী হিসেবে একত্রে কাজ করতে পারবে দেশ দু’টি চুক্তির ঘোষণায় এমনটিই উল্লেখ করা হয়েছে। তাই একে ফিলিস্তিনিদের জন্য নিজের অর্জন দাবি করে বিন জায়েদ তাদের সীমাহীন আত্মত্যাগ, ভোগান্তি এবং সংগ্রামকে চূড়ান্ত অসম্মান করেছেন। বিশেষ করে, যখন খোদ আমিরাতেই তার নির্দেশে ফিলিস্তিনি অধিকার কর্মীদের ধরপাকড় চলছে-তখন এ দাবি নিঃসন্দেহে স্ববিরোধী। চুক্তি স্বাক্ষরের পর দেখা যাচ্ছে আমিরাতে ফিলিস্তিনি প্রবাসীরাও ভিসার মেয়াদ বাড়াতে পারছেন না সহজে। ইচ্ছে করে দেরি করিয়ে হোক বা হয়রানিমূলক জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে; প্রতিনিয়ত তাদের জীবনযাত্রাকে চাপের মুখে রাখা হচ্ছে। চলমান মহামারীর মাঝেও যা বন্ধ হয়নি। আমিরাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবাপ্রত্যাশী ফিলিস্তিনিদের কয়েক দফা জেরা এবং সরকারি তদন্তের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এসব ছাড়া সেখানে ফিলিস্তিনিদের জন্য চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবার সুযোগ পাওয়া বর্তমানে একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ভুক্তভোগীরা জানাচ্ছেন, ‘উপসাগরীয় দেশটিতে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে, তৈরি হচ্ছে শ্বাসরুদ্ধকর এক অবস্থা।’ সঙ্গত কারণেই বিন জায়েদ অন্তত ফিলিস্তিনিদের জন্য সাফল্য অর্জনের দাবি করতে পারেন না। ফিলিস্তিনিদের বন্ধু হলে তিনি তাদের শত্রুর সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপনের চেষ্টা করতেন না। বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়, ওয়াশিংটনে নিযুক্ত আমিরাতি রাষ্ট্রদূতের ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক লেখায়; সেখানে তিনি রাখঢাক ছাড়াই বলেন, ‘ইসরাইল শত্রু নয়, বরং একটি সম্ভাবনা।’ এতে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বস্তুত, ইসরাইল ও আমেরিকার স্বার্থরক্ষায় মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স। এজন্যই ২০০৬ সাল থেকেই ফিলিস্তিনিদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে দমন করার চেষ্টায় বিন জায়েদের যে ভূমিকা-ফিলিস্তিনি জাতি বা মুসলিম বিশ্ব তাকে কোনোদিনই ক্ষমা করবে না বরং তাকে একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিতর্কিত চুক্তির পর উত্তাল হয়ে উঠেছে গোটা মধ্যপ্রাচ্য। সম্প্রতি চুক্তির বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোলান্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিলেও এত দিন যাবৎ কার্যত চুপ ছিল সৌদি আরব। এবার চুক্তির বিষয়ে মন্তব্য করেছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী এই দেশ। সৌদি আরব বলেছে, তারা আরব আমিরাতের মতো ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে না যতক্ষণ ইসরাইল ফিলিস্তনিদের সঙ্গে কোন শান্তিচুক্তি না করছে। ফলে সদ্য স্বাক্ষরিত চুক্তি কিছুটা হলেও জটিলতার মধ্যেই পড়েছে। সদ্য স্বাক্ষরিত চুক্তি নিয়ে আবর আমিরাত-ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে অনেক গালগল্প শোনালে তার সবই অন্তঃসারশূন্য বলেই মনে করা হচ্ছে। চুক্তি মোতাবেক ইসরাইলি সম্প্রসারণবাদী আচরণ বন্ধ হওয়ার কথা ফলাও করে প্রচার করা হলেও বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না বরং বিষয়টিকে ইসরাইলিরা সাময়িক আখ্যা দিয়ে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ফলে তথাকথিত এই চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জনগণের দীর্ঘদিনের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের প্রতি অশ্রদ্ধাই প্রদর্শন করা হয়েছে। এতে আরবরা তো উপকৃত হয়-ই বরং সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্য তা আত্মঘাতী হয়েছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এই চুক্তির মাধ্যমে ইহুদিবাদী ইসরাইলিরাই একতরফাভাবে উপকৃত হবে। তারা মনে করছেন- ১. কথিত ইসরাইল রাষ্ট্রের কোন বৈধতা নেই। তারা দীর্ঘদিন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দখল করে আছে। আর সদ্য সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে আরব আমিরাত দখলদারদের বৈধতা দিয়েছে। তাই এই চুক্তিরও কোন বৈধতা নেই। সঙ্গত কারণেই স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই চুক্তি কোন ভাবেই সহায়ক হবে না। ২. এই চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড অধিগ্রহণ, পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ, মসজিদে আকসা দখল, জেরুসালেমকে ইসরাইলি রাজধানী ঘোষণা ও মসজিদে আকসার স্থলে ‘হায়কলে সোলায়মানি’ প্রতিষ্ঠাকে আমিরাত বৈধতা দিয়েছে। যা মুসলিম উম্মাহ কোনভাবেই মেনে নেবে না। ৩. ইসরাইলের সাথে আমিরাতের কূটনৈতিক, আর্থ-বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার হলে যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় অঞ্চলে অস্ত্র বিক্রির সুযোগ বেড়ে যাবে। চলতি বছর ৫৫৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যের চার হাজার ৫৬৯টি মাইন রেসিস্ট্যান্ট অ্যাম্বুশ প্রটেকটেড যান আমিরাতের কাছে বিক্রির জন্য মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। এই চুক্তির ফলে বিষয়টি এখন বাস্তবরূপ পেতে যাচ্ছে। ৪. যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে নিশ্চিত করেছে যে, লকহিড মার্টিনের তৈরি করা এফ-৩৫ জঙ্গিবিমানের মতো অত্যাধুনিক অস্ত্র দেশটি সরবরাহ করা অব্যাহত রাখবে। আরব দেশগুলোর হাতে এত উন্নত অস্ত্র নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার বাইরে যাওয়ার সক্ষমতা নেই ইসরাইলের। ইহুদিদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আর্থ-সামরিক সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন ও রাজনৈতিক মোড়লিপনা অব্যাহত রাখার জন্য ইসরাইলের সহায়তাও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অতীব জরুরি। তাই এখানে স্বার্থটা দ্বিপাক্ষিক; বহুপাক্ষিক নয়। তাই এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যের জন্য কোন সুফল বয়ে আনবে না। ৫. আমিরাত-ইসরাইল চুক্তির ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অতি আগ্রহ রয়েছে। মূলত করোনা সঙ্কটে দেশের অভ্যন্তরে তার জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। কোভিড-১৯ এ পৌনে দুই লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং আক্রান্তে সংখ্যা ৬০ লাখ ছাড়িয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে লাখ লাখ মানুষ হয়েছে কর্মহীন। এমতাবস্থায় ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার কৃতিত্ব হিসেবে এ চুক্তিকে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে চান মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ৬. মধ্যপ্রাচ্যে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার নেই। শাসকগোষ্ঠী তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য কারো কাছে জবাবদিহি করেন না। মানবাধিকার, সুষ্ঠু নির্বাচন, মত প্রকাশের অধিকার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এসবে মোটেই আস্থাশীল নয় শাসকগোষ্ঠীর। যেহেতু শাসকদের কোন গণভিত্তি নেই, তাই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য বিদেশী প্রভুদের সহায়তা প্রয়োজন। ৭. মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইরান একটি উল্লেখযোগ্য শক্তি। বিভিন্ন আরব দেশে শিয়া মতবাদের প্রসার ঘটছে দ্রুততার সাথে। সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চল, ইয়েমেন, বাহরাইন, ওমান, লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকে বিপুল জনগোষ্ঠী শিয়া মতাবলম্বী। বাহরাইন থেকে মার্কিন সেনা ঘাঁটি প্রত্যাহার করা হলে শিয়ারা যেকোনো মুহূর্তে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নিতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তো রাখঢাক ছাড়াই বলেছেন, ‘আমেরিকাকে সামরিক খাতে নির্ধারিত অর্থ না দিলে সৌদি আরবের প্রতি প্রদত্ত মার্কিন সমর্থন প্রত্যাহার করা হবে এবং সে ক্ষেত্রে এক সপ্তাহও সৌদি শাসকরা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেন না।’ ৮. এই চুক্তির ফলে আমিরাতের বিশাল বাজারে ইসরাইলের অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তৃত হবে। ইহুদিরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনকুবের। তাই হাজার হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগে কোনো বাধা থাকবে না। গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’ দুবাইতে দফতর স্থাপন করে পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলোর নাড়ি নক্ষত্রের খবর জোগাড় করে নিজেদের থিংক ট্যাংকে সরবরাহ করার সুযোগ অবারিত হবে। ৯. সদ্য স্বাক্ষরিত চুক্তিতে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ প্রাধান্য দেয়া হয়নি। আল জাজিরার বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারার ভাষায়, ‘আরব আমিরাত বলছে, তারা ফিলিস্তিনি জনগণের মর্যাদা, অধিকার এবং তাদের নিজস্ব সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য লড়াইকে সমর্থন দেয়া অব্যাহত রাখবে; কিন্তু এ নিয়ে সংশয় এখন দানা বেঁধে উঠেছে। ইসরাইলের সাথে গোপন সুরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টি আমিরাত দীর্ঘ দিন ফিলিস্তিনিদের কাছে গোপন রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে, তারা অনেক আগে থেকেই ফিলিস্তিনিদের দুর্দশাকে কোনই গুরুত্ব দিচ্ছে না। ফিলিস্তিনিদের আশঙ্কা, ইসরাইল তার এলাকা সম্প্রসারণ এবং ফিলিস্তিনি জনগণকে দমনের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সম্ভাব্য অন্যান্য আরব উদ্যোগকে কাজে লাগাবে’। যা ফিলিস্তিন সঙ্কটকে আরও জটিল করে তুলবে। ১৩. মার্কিন রাজনীতি ও প্রশাসনে ইহুদি লবি বেশ শক্তিশালী। ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান দলের যিনিই প্রেসিডেন্ট হোন না কেন, সে দেশের ইহুদি প্রেসার গ্রুপের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। এটা থেকে ইসরাইল শতভাগ সুবিধা পেয়ে আসছে এবং আগামীতেও নেবে। আমিরাতের সাথে চুক্তি ইসরাইলকে বড় ধরনের আনুকূল্য দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। আর এটিই হচ্ছে চুক্তির নেপথ্যকথা। মূলত ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকারীদের মধ্যে মিসর ও জর্দানের পর আমিরাত তৃতীয় আরব রাষ্ট্র। আরও কিছু আরব রাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার পথেই দৃশ্যত অগ্রসর হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু একথা তারা কোনভাবেই বিবেচনায় আনছে না যে, ইসরাইল রাষ্ট্র। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, ইসরাইল জাতিসঙ্ঘের অন্তত ৫০টির বেশি প্রস্তাব অমান্য করেছে এবং ফিলিস্তিনের দুই-তৃতীয়াংশ জায়গা জবরদখল করে রেখেছে দীর্ঘদিন। তারা পূর্ব জেরুসালেম দখল করে রেখেছে। ১৯৪৭ সালে জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাবে পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কিন্তু ইহুদিরা তা জবরদখল করে রেখেছে। ইসরাইল পশ্চিমতীরে দুইশ’-আড়াইশ’ বসতি গড়ে তুলেছে অবৈধভাবে। গাজাতেও বসতি গড়েছিল। ইসরাইল রাষ্ট্র তাদের ওপর এখনো অত্যাচার-নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। গাজায় এখনো আকাশ ও সমুদ্রসীমা ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু তারা এসব কিছু ভাবতে রাজি নন। অথচ মুসলিম বিশে^র ৫৭টি দেশের মধ্যে মাত্র পাঁচ-সাতটি দেশ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক রেখেছে। মুসলিম বিশে^র অধিকাংশ রাষ্ট্র এখনও ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়নি; কখনো দেবেও। যারা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার ইহুদিবাদী ইসরাইলের সাথে সখ্যতা গড়ছে, তাদের জন্য করুণ পরিণতিই অপেক্ষা করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা ইসরাইলের সাথে চুক্তিকে আমিরাতের জন্য আত্মঘাতী বলে মনে করছেন। কারণ, ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের আগ পর্যন্ত ইসরাইলের সাথে যেকোন ধরনের সখ্যতা গড়ার বিরুদ্ধে মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্য রয়েছে। তাই বিচ্ছিন্নভাবে কোন মুসলিম ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে সাময়িক পুলকবোধ করলেও আগামী দিনে তা হবে নিষ্ফলা। বিষয়টি মুসলিম দেশগুলো যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবে উম্মাহর ততই মঙ্গল। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির